শ্রী শ্রী মা পাগলা চণ্ডী
শ্রী শ্রী মা পাগলা চণ্ডী
শ্রী শ্রী মা পাগলা চণ্ডী
চন্দন চ্যাটার্জি
আরতি প্রায় আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে শিয়ালদা স্টেশনে, বারবার হাত ঘড়ি দেখছে এবং আগত যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখছে, উদ্দেশ্য তার স্বামী অপূর্বকে দেখতে পাওয়া । তারা যাবে নদীয়া জেলার পলাশীতে, তাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে । আরতির বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দুমাস হল । অবশ্য তাদের পরিচয় কলেজ জীবন থেকে । তাদের কলেজ, দমদম মতিঝিল কলেজ । সেইখান থেকে দুজনে বি এস সি পাশ করে । তারপর আরতী এম এস সি পড়তে ভর্তি হয় রাজাবাজার সাইন্স কলেজে, অপূর্ব চলে যায় এম টেক পড়তে ব্যাঙ্গালোরে ।
তিন বছর পর ফিরে আসে সল্টলেকে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে । তারপর তাদের বিয়ে হয়, আজ তারা যাচ্ছে পলাশীতে তাদের এক দূর সম্পর্কের কাকিমার বাড়ি । কাকু কাকিমা তাদের বিয়েতে এসেছিলেন । বিয়ের পর দুজনে যেন প্রথমে তার বাড়ি যায় এইরকম করে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিলেন কাকিমা ।
আজ শনিবার দৈনিক ও সাপ্তাহিক যত যাত্রী আছে তাদের ভিড়ে শিয়ালদা স্টেশন চত্বর গমগম করছে, হঠাৎই আরতি দেখতে পেল অপূর্ব প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে কাঁধে ব্যাগ, এসেই প্রথমে বলল,”সরি অফিস থেকে বের হতে একটু দেরি হয়ে গেল, চলো প্লাটফর্ম নাম্বার ৯ সি, লালগোলা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার থার্ড এসি । আরতির এই বাহানার সঙ্গে কলেজ জীবনে থেকে পরিচিত, তাই স্টেশন চত্বরে কোনরকম নাটক না করে চুপচাপ ট্রলিব্যাগটা টেনে নিয়ে চলল প্ল্যাটফর্মের দিক । এখন বাজে বিকেল তিনটে তিরিশ, প্লাটফর্মে গাড়ি দিয়ে দিয়েছে , আর ২৫ মিনিত পরে ছাড়বে । তারা দুজনেই ট্রেনে উঠে বসলো, তাদের নির্দিষ্ট আসনে । গাড়ি ছাড়ার পর একজন চা-ওলা কে ডেকে দুজনে চা খেল । গাড়িটা ঠিক দমদম পার হয়েছে এমন সময় একটা জটাজুট ধারী সন্ন্যাসী গোছের সাধু এসে তাদের ঠিক সামনের আসনে এসে বসলো । অপূর্ব ধীরে ধীরে আরাতিকে বলল,” আজকাল সাধুসন্তদের বেশ কামাই হচ্ছে, তারাও এখন থার্ড এ সি চড়ে বসছে” ।
এই কথাটা বোধহয় সাধুবাবা শুনতে পেয়েছিলেন তাই তিনি আরতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মা আমার এইদিকে একটা কাজ ছিল সেইটা সেরে আজই আমাকে ফিরে যেতে হবে, তাই আমার শিষ্য আমাকে তাৎক্ষণিক এই কামড়াতে টিকিট কেটে দিয়েছে” ।
অপূর্ব বলল,” তৎকালে” ।
সাধু বাবা বলল, “হ্যাঁ তাই” ।
আরতী দেখল এই সাধু আর পাঁচটা মেকি সাধুর মত নয়, এর মুখমন্ডল থেকে একটা জ্যোতি যেন ঠিকরে বের হচ্ছে । পরনে একটা লাল ধুতি কাপড় দক্ষিণ ভারতীয় স্টাইলে পরা, বাঙ্গালীদের মত কাছা দিয়ে নয়, উপরে একটা লাল পাঞ্জাবি তাতে সাদা বোতাম । বোধহয় ছিঁড়ে গিয়েছিল, শিষ্যর বাড়িতে কেউ লাল বোতাম পায়নি, তাই সাদা বোতামই লাগিয়ে দিয়েছে । মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়িগোঁফ ভর্তি, কিন্তু সেগুলো মার্জিত, বোধ হয় থার্ড এ সি কম্পার্টমেন্টে গুরুজি যাবেন বলে শিষ্যর বাড়ি থেকে সবকিছু যত্ন পূর্বক ব্যবস্থা করে দিয়েছে । সাধারণত সাধুসন্ত মানুষ এইরকম সুন্দর ভাবে নিজেকে সাজিয়ে রাখে না । কাঁধে একটা ঝোলা, পায়ে খড়ম ।
আরতি জিজ্ঞেস করল, “ বাবা কোথায় যাবেন” ।
সাধু বাবা বলল, “ পাগলাচণ্ডী নদে জেলায়, অনেকদিন হলো মাকে ছেড়ে এসেছি, তাই ফিরে যাচ্ছি”
অপূর্ব কম্পিউটারে দেখেছিল পলাশি স্টেশন আগেই পড়ে পাগলা চণ্ডী স্টেশন, তার আগে দেবগ্রাম । গাড়ি কিন্তু সেই স্টেশনে এক মিনিট দাঁড়ায় ।
অপূর্ব জিজ্ঞেস করল, “ওখানে কি আপনার আশ্রম আছে” ।
সাধু বাবা বলল,”হাঁ অনেক আগে আশ্রমের মতোই ছিল বটে কিন্তু এখন অনেক লোক আসা-যাওয়া করে সেই শান্তি আর খুঁজে পাই না । তোমরা কোথায় নামবে বাবা” ।
অপূর্ব,” পলাশি” ।
সাধু বাবা,” আমি যেখানে যাব তার পরের স্টেশনে পলাশী, তোমরা পারলে একবার আসো না আমার মায়ের বাড়িতে “ । অপূর্ব,” হ্যাঁ জানি, যদি সময় পাই যাব” ।
আরতি বলল,” বাবা, আমাদের মায়ের সম্বন্ধে কিছু বলুন না” । এখানে উল্লেখযোগ্য, আরতি এম এস সি পাশ করলেও সে কিন্তু আধুনিক মহিলার মত নয় । ধর্মে কর্মে তার পুরো মতিগতি আছে, প্রতি বৃহস্পতিবার এক বেলা খায় তাও নিরামিষ, সন্ধ্যে বেলায় লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠ করে । প্রতি শনিবার স্থানীয় শনি মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়, এছাড়া পাড়ার দুর্গাপুজোয় ও নিজের বাড়িতে কালীপূজায় সে বিশেষ ভূমিকা নেয় । অপূর্ব ভাবল চলুক বাবার উপদেশ, প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টার পথ, ১৪৪ কিলোমিটার রাস্তা, গল্পের চেয়ে ভালো টাইম পাস করার কি উপায় আছে । ইতিমধ্যে তার অবশ্য আধঘন্টা পথ অতিক্রম করেছে ।
সাধুবাবা শুরু করলেন শ্রী শ্রী মা পাগলা চণ্ডী মায়ের কাহিনী বৃত্তান্ত । অনেকদিন আগেকার কথা তখন কৃষ্ণনগর , শান্তিপুরের নামই কম শোনা যেত, তো দেবগ্রাম, পলাশী নাম শোনা যায় না বলেই হয় । দেবগ্রাম থেকে পলাশী যেতে হলে, রাস্তায় পরে এক গভীর অরণ্য, সেখানে হিংস্র জীব জন্তুর বাস, রাস্তার পাশ দিয়ে বহে গেছে একটা খাল, বর্তমানে তার নাম অবশ্য মা পাগলাচণ্ডী দহ । হিমালয় থেকে এক সাধু মায়ের নাম করতে করতে কিভাবে এইদিকে এসে পরে । পরে তিনি স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিলেন এই বনের মধ্যে কোথাও মা চন্ডী পাথরেরে মধ্যে বিরাজ করছেন । তপস্যা করে মায়ের সেই মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য । এই আদেশ পাওয়া মাত্র সেই সাধু পাগলের মত পুরো জঙ্গল এক দিক থেকে আরেক দিকে ঘুরতে লাগলো । শেষে একটা বড় আশুথ গাছের তলায় নিজের একটা ডেরা জমালেন । সারা দিন শুধু জপ তপ ও ধ্যান করে কাটাতেন । এই আশুথ গাছের অদুরেই ছিল একটা শ্মশান এবং তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক খাল । গ্রামের লোক মাঝেমধ্যেই সেই পাগলাবাবাকে ফলমূল দিয়ে আসতে কিন্তু তিনি কিছুই খেতেন না, অধিকাংশ ফলমূল মাটিতে পরে থেকে গাছ বেরিয়ে যেত । তার মাথার ওপর ছাদ বলতে শুধু আশুথ গাছের ছায়া, এবং চারিদিক খোলা । তাই রোদ, ঝড়, বৃষ্টি সবই তার মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যেত ।
তিনি কি খেতেন তা কেউ বুঝতে পারত না লোকেরা শুধু দেখতো তাকে ধ্যানস্থ অবস্থায় । আস্তে আস্তে তার শরীর শীর্ণ থেকে শীর্ণ তর হতে লাগলো । একসময় এমন হয়ে গিয়েছিল লোকেরা ভেবেছিল তিনি বুঝি মারা গেছেন । অনেক ডাকাডাকির পর তিনি আওয়াজ দিলেন এবং লোকেদের তার ডেরা থেকে চলে যেতে বললেন, কারণ এতে নাকি তার সাধনায় ব্যাঘাত হচ্ছে । স্বভাবতই লোকেরা চলে গেল, ক্রমে ক্রমে দিন মাস বছর পার হল । তার প্রায় যখন সাধনার সিদ্ধির পথে এমন সময় তিনি এক গভীর রাতে তিনি এক মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেলেন বাঁচাও বাঁচাও করে চেঁচাচ্ছে । এই আওয়াজে সাধুবাবার গভীর সাধনায় ব্যাঘাত হচ্ছে বারবার, শেষ পর্যন্ত তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না, তার কাছে ছিল এক ত্রিশূল, মাটিতে পোঁতা, সেইটাকে তুলে নিয়ে তিনি সজোরে ছুড়ে দিলেন যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেই দিকে । ত্রিশূলটা খানিকটা দূরে গিয়ে মাটিতে বিদ্ধ হল তারপর সেই স্থান থেকে নির্গত হতে লাগলো এক অলৌকিক জ্যোতি । তারপর মা চন্ডী তাকে দেখা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন এবং আদেশ দিলেন যে স্থানে ত্রিশূল বিদ্ধ হয়েছে সেই জায়গা মাটিটা খুঁড়লে তুই আমার পাথরের মূর্তি দেখতে পাবি এবং এর সাথে ভৈরবনাথ গোলাকার শিবলিঙ্গ আছে, এইগুলো তুই পূজা করবি । এখানে আমি দেবী চণ্ডিকা তোর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাগলা চণ্ডী হিসেবে বিরাজিত হব । এছাড়াও নবগ্রহের মূর্তি এখনে স্থাপিত করবি এই গ্রামে তাহলে কোন গ্রহ এই গ্রামের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা । এরপর সেই পাগলা সাধু বাবা ত্রিশূল দিয়ে সেই স্থানের মাটি খুঁড়ে মায়ের পাথরের মূর্তি বার করেন । এই কাজ করতে গিয়ে তার ত্রিশূল বোধহয় পাথরে আঘাত লাগে তাই মায়ের মূর্তিতে অনেক জায়গায় তার দাগ আছে এখনো । পাগলা বাবা সেই মা চন্ডী মূর্তি ও গোলাকৃতির শিবলিঙ্গ মাটি থেকে বার করেন এবং আশুথ গাছের নিচে একটা ছোটো মাটির ঘর তৈরি করে পুজো শুরু করেন । এরপর ক্রমে ক্রমে গ্রামের লোকেরা সেই কথা জানতে পারে এবং তারাও মাঝে মধ্যে আসতে থাকে । পাগলা বাবা মায়ের নাম ও উপাখ্যান সকলের কাছে বর্ণিত করেন । তিনি যে এই গ্রামের সকলকে রক্ষা করছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরও কয়েক বছর পর । এর কিছুদিন পর পাগলা বাবা মারা যান, এবার গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবার সেই মূর্তি পূজার দায়িত্ব নেন । যেদিন মা চন্ডী, পাগলা বাবাকে দেখা দিয়েছিলেন সেটা ছিল বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার মধ্যরাত্রি । সেই থেকেই প্রতি বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার মায়ের খুব ধুমধাম করে পূজা-অর্চনা হয় । এছাড়া বর্তমানে প্রতি অমাবস্যায় মায়ের পুজো হয় । এসবের মধ্যে ও মা কিন্তু তখনও প্রায় খোলা জায়গাতেই বিরাজ করতেন ।
এর কয়েক বছর পর কৃষ্ণনগর থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয় । রেল কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল মা চণ্ডিকার দহের উপর দিয়ে রেল লাইন পাতবে । দহের ওপর একটা ব্রিজ তৈরি হবে । রেল কোম্পানির সেই কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছিল যেদিন রেল লাইন উদ্বোধন হবে তার আগের দিন স্থানীয় রেল কর্তৃপক্ষের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মায়ের কাছ থেকে স্বপ্নাদেশ পেলেন - তোরা এখানে রেললাইন পাচ্ছিস আর আমি খালি বসে আছি গাছ তলায়, আগে আমার মন্দির করবি তারপর অন্য সব হবে । তোর স্বপ্নটা সত্যি কিনা সেটা যাচাই করার জন্য দহের ওপর যে তোরা পুল বানিয়েছেস সেই পুলের মাঝের স্তম্ভটা বাঁকিয়ে দিচ্ছি । এই আদেশ শোনার পর সেই ব্যক্তির খুব ভয় হয় । পরের দিন সকালে উঠে তিনি কয়েকজন লোক সাথে করে নিয়ে আগে পুলের নিচের স্তম্ভ দেখতে যাযন । সেখানে গিয়ে দেখেন সত্যি সত্যিই বাঁ দিকের একটা স্তম্ভ বেঁকে গেছে অন্য সবকিছু ঠিকই আছে । তিনি তড়িঘড়ি করে রেললাইন উদ্বোধন বন্ধ করে দেন এবং বনের মধ্যে গিয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চান এবং এটা বলেন আগে তোমার মন্দির হবে তারপর রেললাইন , এছাড়া স্থানীয় স্টেশনের নাম হবে “মা পাগলা চণ্ডী স্টেশন” । তখন থেকে দেবগ্রাম এর পরের স্টেশন পাগলা চণ্ডী তারপর পলাশী । এখনও পুলের একটা স্তম্ব বাঁকা আছে অথচ তার ওপর দিয়ে দিনে কত রেলগাড়ি যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । এতক্ষণ কথা বলে সাধুবাবা একটু থামলেন । ততক্ষণে ট্রেনটি নদীয়া জেলায় ঢুকে পড়েছে প্রথম স্টপেজ হল কল্যাণী তারপর আঠারোটি স্টপেজ পার হয়ে পলাশী । কৃষ্ণনগর সিটি জংশন ঢুকতে প্রায় সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা, ট্রেনটি ১০ মিনিত লেট যাচ্ছে। অপূর্ব একজন মুড়িওয়ালাকে ডেকে তিনটে মসলা মুড়ি বানানোর জন্য বলল । আরতী দেখলো সাধুবাবা বেশ যত্ন পূর্বক মুড়ি খেলো তারপর মাটির এক পেয়ালা চা খেলো ।
এতক্ষণ মায়ের উপাখ্যান দু'জনকেই বেশ মুগ্ধ করেছে । এরপর সাধুবাবা আবার শুরু করলেন রেল কোম্পানী যে মন্দির করেছিল সেটা ছোট মত ছিল । বর্তমানে তোমরা যে মন্দির দেখছ এটা সংস্কার করেছে স্থানীয় গ্রামের মানুষ, তারা তাদের যথাসাধ্য দান দিয়ে, কারণ এই পাগলা চণ্ডী মা গ্রামের মানুষকে সমস্ত রকম ভয়ংকর মহামারী রোগ থেকে রক্ষা করেন ।
সেটার প্রমান গ্রামের লোক পায় তার বেশ কিছুদিন পরে । এই গ্রামের এক ঘর ব্রাম্ভন ছিল। তাদের কোন সন্তানাদি হয়নি তাই ব্রাহ্মণী দিনের বেশিরভাগ সময় এই মায়ের মন্দিরে পড়ে থাকত । ব্রাহ্মন বাড়ি বাড়ি পুজো করে যা নিয়ে আসতো তাতেই তাদের সংসার চলে যেত । ব্রাহ্মণী এই পাগলা চণ্ডী মাকে নিজের মায়ের মত দেখত । একদিন কোন কারনে নবগ্রহের একগ্রহ এই গ্রামের মানুষের প্রতি কুপিত হয়ে যায়, তাই সেই গ্রহাধিপতি স্থির করেন সমস্ত গ্রামবাসীকে বসন্ত রোগে মারবেন । এই কথা মা পাগলা চণ্ডী জানতে পারেন, তিনি এক বয়স্ক মহিলার বেশ ধরে মন্দিরে উপস্থিত হন । দেখেন যে মন্দিরে সেই ব্রাহ্মণী ছাড়া অন্য কেহ নেই ।
তিনি ব্রাহ্মণীকে বলেন, “ মা আমাকে কিছু খেতে দিতে পারিস’
ব্রাহ্মণী বলল, “ ঠিক আছে মা আপনি আমার এই মায়ের মন্দিরে বসুন আমি বাড়ি থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসছি “।
যাবার সময় ব্রাহ্মণী আগন্তুক স্ত্রী লোককে বলেছিল, “ মা আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি যাবে না এই মন্দির ছেড়ে”
স্ত্রীলোক বেশী মা চণ্ডী একটু মুচকি হেসে উত্তর দিয়ে ছিলেন “ ঠিক আছে মা তুমি যাও, যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি আসবে আমি এই মন্দির ছেড়ে কোথাও যাব না”
তারপর ব্রাহ্মণী নিশ্চিন্ত মনে চলে গেল । খানিকটা দূর যাবার পর হঠাৎ তার মনে হল আচ্ছা যদি মায়ের জল তেষ্টা পায় তা হলে কি হবে, কারণ বাড়ি থেকে আসতে তার একটু দেরি হবে। মন্দিরের ভেতরে একটা কুঁজো আছে আর একটা মাটির গ্লাস ও আছে সেটা মাকে দিয়ে আসি, ততক্ষণ জিরুক, তারপর আমি মুড়ি বাতাসা বাড়ি থেকে নিয়ে এসে দেব । কিন্তু সে যেই মন্দিরের সামনে এল অমনি তার ভয় হল, সেই স্ত্রীলোকটি তো মন্দিরের দাওয়াতে বসে নেই । তাছাড়া মন্দিরের ভেতর থেকে মন্ত্র উচ্চারণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এবং হোম হলে যেরকম ধোঁয়ায় ভরে যায় সেই রকম চারিদিক ধোঁয়ায় ভরে গেছে । সে ভয়ে ভয়ে, আস্তে আস্তে মন্দিরের ভেতরে উঁকি মারলো, ভেতরের দৃশ্য দেখে সে অবাক হয়ে গেল । সেই স্ত্রীলোকটি দেবী মায়ের মত সেজে একমনে পুজো করছে সামনে আগুন জ্বলছে তাতে নিমপাতা জাতীয় কিছু পাতা ঘিয়েতে ডুবিয়ে আগুনে আহুতি দিচ্ছে । কাঁচা পাতায় ঘি মাখানো থাকার জন্য খানিকটা জ্বলছে তারপর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে এই মন্দির থেকে ধোঁয়া পুরো গ্রামে ভরে যাবে । ব্রাহ্মণী বুঝতে পারল স্বয়ং মা পাগলা চণ্ডী এসেছেন গ্রামের মঙ্গল করতে । এখানে তাঁর পুজো করার অর্থ গ্রামের কোন অমঙ্গল দূর করা । এখন না হয় মা এসেছেন , তিনি কি আর সব সময় আসতে পারবেন ।
আমাদের গ্রামকে তাহলে কে রক্ষা করবে । মাকে যদি এখানে রেখে দেওয়া যায় তবে তিনি পুরো গ্রামবাসীকে রক্ষা করবেন । ব্রাহ্মণী নিজ বাড়ি অভিমুখে চলছে আর এই সব কথা ভাবছে । হঠাৎ তার মনে হল মা আমাকে কথা দিয়েছেন যে আমি মন্দিরে ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি এই মন্দিরে থাকবেন । তাহলে আজ থেকে সে আর মন্দিরে আসবে না । কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়, কারণ মায়ের পুজো না করে সে কোনদিন জল গ্রহণ করে না । তাহলে কি উপায় ।
একটা উপায় আছে সে যদি নাই থাকে এই পৃথিবীতে তাহলে তো আর তাকে মন্দিরে আসতে হবে না এবং সে যতক্ষণ না আসবে মাও ততক্ষণ মন্দিরে থাকবে । যেমনি ভাবা তেমনি কাজ সে কর জোরে বাইরে থেকে নমস্কার করল । মনে মনে মাকে এই প্রার্থনা জানাল - মা তুমি নিশ্চয়ই তোমার কথা রাখবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি আসি তুমি মন্দির ছেড়ে যাবে না । তুমি থাকলে সব গ্রামবাসী রোগমুক্ত থাকবে ।
এই কথা বলে সেই ব্রাহ্মণী পাগলা চণ্ডী দহে ঝাঁপ দিল আর উঠল না । এদিকে মা সেই ব্রাহ্মণীর আত্মত্যাগ স্বীকার করে নিজ জ্যোতিকে মূর্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং ব্রাহ্মণীর আত্নাকে আশীর্বাদ করলেন ও জীবন চক্র থেকে মুক্তি দিলে । তাই পাগলা চণ্ডী গ্রামে বড় কোনো মহামারী রোগ হয় না । এই কথা শুনে আরতির চোখে জল এলো ।
এতক্ষন ট্রেন দেবগ্রাম ছাড়িয়ে গেছে । অপূর্ব বলল,”সাধুবাবা আপনি গেটে যান, এর পরেরটাই আপনার স্টপেজে” ।
সাধু বাবা আস্তে আস্তে উঠে কাঁধে ঝোলা নিয়ে চলতে লাগলেন । পাগলা চণ্ডী স্টেশন ছোট, এখানে কম লোকই নাবে । আরতী জানলা দিয়ে বারবার দেখতে লাগল সাধুবাবা নামলেন কিনা । কারণ তাকে এই জানলার পাস দিয়েই যেতে হবে । প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বের হবার এই একটাই রাস্তা । এই স্টেশনে যত লোক নাবল তারা সবাই আরতি কাছে জানলার পাস দিয়ে চলে গেল, অথচ সাধু বাবাকে আর দেখা গেল না । ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । আরতী অপূর্বকে জিজ্ঞেস করল, “ সাধুবাবাকে তো দেখলাম না, তিনি কি নামতে পারলে কিনা ।“
অপূর্ব “ হ্যাঁ নাবেছেন, বোধ হয় পিছন দিক দিয়ে গেছেন, তাছাড়া সাধু বাবার কথা ছাড়ও পরের স্টেশনে আমাদের নামতে হবে ব্যাগ গোছাও” ।
আরতির মন মানল না, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে সে সাময়িকভাবে সাধু বাবার কথা মন থেকে মুছে দিল । পলাশী স্টেশনে নেবে একটা রিস্কা করে তারা কাকিমার বাড়ি চলল । কাকিমা তো মেয়ে জামাইকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি । তাদের আদর যত্ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন । রাত্রির ভোজটা একটু বেশি হয়েছিল, খাসির মাংস, চিংড়ি মাছ, কৃষ্ণনগরে সরভাজা ইত্যাদি । পরদিন সকালে স্নান করে আরাতি, কাকিমার ঠাকুর ঘরে গেল সেখানে অন্য সব ঠাকুরের মূর্তির পাশে এক সাধু বাবার ছবি দেখল । ধুলো পরেছে তাই আবছা, আরতি একটা কাপড় দিয়ে ছবিটা পরিষ্কার করল, তারপর চমকে উঠে কাকিমাকে জিজ্ঞেস করল, ” এটা কার ছবি” ।
কাকিমা,” পাগলা বাবা । এই পলাশী স্টেশনের আগেই আছে পাগলা চণ্ডী স্টেশন , সেই গ্রামে মা চণ্ডী কে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন এই পাগলা বাবা, একদিন তোদের নিয়ে যাব”।
মৃদু হেসে আরতি বলল,” এনাকে আমি জানি, ইনি গতকাল আমাদের সঙ্গে শিয়ালদা স্টেশন থেকে এসেছেন, আমাদের মায়ের উপ্যাখান বর্ণনা করেছেন । এছাড়া এক ব্রাহ্মণী জলে ডুবে আত্নহত্যা করে সারা গ্রামকে মহামারীর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, সে কথাও বলেছেন” ।
কাকিমা তো তার কথা শুনে হতবাক । দুপুরে খেতে বসে অপূর্ব সকলের কাছে পাগলাবাবার সঙ্গে তাদের যাত্রার পুরো বৃত্তান্ত
করে ছিল ।
স মা প্ত
