বিজ্ঞানের অপমৃত্যু
বিজ্ঞানের অপমৃত্যু
সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের কারণ হিসাবে যখন বলা হয় রাহু, সূর্য ও চন্দ্রকে গ্রাস করে তখন বিজ্ঞানের অপমৃত্যু । সাপে কাটা রোগীকে যখন ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তখন বিজ্ঞানের অপমৃত্যু । ডাইনি সন্দেহে যখন কোন অশীতপর নিঃসহায় বৃদ্ধার মৃত্যু হয় তখনই বিজ্ঞানের অপমৃত্যু ।
কিন্তু আজ আপনাদের এমন কাহিনী শোনাব যেটা শুধু বিজ্ঞানের অপমৃত্যু নয় মানবতার পক্ষে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় ।
সত্য বাবুকে চেনে না এমন কেহ ডানকুনি এলাকায় প্রায় নেই বললেই চলে ।সত্য প্রকাশ চক্রবর্তী, জাতে ব্রাহ্মণ হলেও নাস্তিক, ডানকুনি হাইস্কুলের জীব বিজ্ঞানের শিক্ষক । বিজ্ঞানের যুক্তি ছাড়া অন্যকিছু তিনি বিশ্বাস করেন না । আমি অবশ্য যখনকার ডানকুনির কথা বলছি আজকের ডানকুনির সঙ্গে তার অনেক তফাৎ । দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে তখন এত চওড়া হয়নি। লরি, বাসের লম্বা লাইন থাকতো, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতে লাইনেই । ডানকুনি ষ্টেশন চত্বর ও ছিল তথৈবচ । এক স্টিল কোম্পানির মালগাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো দিনের পর দিন । একটা লাইন খালি থাকতো এক্সপ্রেস গাড়ি যাবার জন্য । স্টেশনের পাশেই বন জঞ্জলে ভর্তি, রাতে সেখানে শিয়াল ডাকত । স্টেশনের পাশেই সার দিয়ে রেল বস্তি ছিল, আর একটু দূরে সুভাষপল্লী ছিল । আজকের মত বড় বড় বিল্ডিং তখন ছিল না, ডানকুনিকে তখন উপনগরী হিসাবে ঘোষিত হয়নি । নিবেদিতা সেতু তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি ।
এই সুভাষপল্লী থেকে খানিকটা দূরে সত্যবাবুর বাড়ি । বর্তমানে তার বয়স ৬২ বছর । ৬০ বছর বয়সে তিনি স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন তারপর বিজ্ঞান সাধনার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন । গতবছর তার স্ত্রী মারা গেছে, বাড়িতে তিনি একাই থাকেন এক পুত্র মিচিগান ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় । বছরে একবার এসে বাবাকে দেখে যায় । স্ত্রী গত হবার পর থেকে তার পুরো বাড়িটাই এখন ছোটখাটো একটা ল্যাবে পরিণত হয়েছে । বর্তমানে তিনি একটা বিশেষ বিষয়ে গবেষণা করছেন মানুষের কর্মক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায় । যেমন ধরা যাক একজন কুড়ি বছরের যুবক একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধকে যদি ১০০ মিটার দৌড় লাগাতে বলা হয়, তাহলে কে প্রথম হবে । খুব সাধারণভাবে এর উত্তর হলো সত্তর বছরের ব্যক্তির কর্মক্ষমতা অনেক কম, কুড়ি বছরের যুবকের তুলনায় । কাজেই কুড়ি বছরের যুবক প্রথম হবে, কিন্তু কেন । বাহিরের আকার দুজনের সমান, দুজনেরই দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, একটা শরীর আছে, সবকিছু একই । কিন্তু যুবকের শরীরে রক্তের যে জোর আছে তা বৃদ্ধের শরীরে তা নেই । তাই যদি বৃদ্ধের শরীরে যুবকের রক্ত দেওয়া যায় এবং কিছু কোষ প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে বৃদ্ধও, যুবকের ন্যায় কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে । এই বিষয়টি নিয়ে তিনি গভীরভাবে গবেষণা করছেন । এইজন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে কিছু টাকা তুলে তিনি নতুন কিছু যন্ত্রপাতি ও কিছু বিদেশি বই কিনেছেন । তিনি দিনরাত পড়াশোনা করেন এবং গবেষণার কাজে মগ্ন থাকেন । সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি ল্যাবে থাকেন, বিকালে খাবার পর পান চিবুতে চিবুতে স্টেশনের ধারে বেড়াতে যান । তার পানের নেশা অনেকদিনের, আগে দিনে দুটো বা তিনটে পান খেতেন, স্ত্রী বিয়োগের পর এখন দিনে পাঁচ- ছয়টি পান খান ।
যখন ল্যাবে থাকেন তখন পুরো সময়ই মুখে পান থাকে । যেহেতু তার কোনো সহকারি নেই, নিজেই সব কাজ করেন, কাজেই কথা বলতে হয় না । মুখে পান নিয়ে তিনি দিব্যি মনোযোগ সহকারে কাজ করেন ।
বিজ্ঞানী যখন কোন সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তখন সেটা প্রমান করার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পিছপা হয়না । সত্যবাবুর জীবনে ঠিক এইরকমই ঘটনা হয়েছিল । তার কাজের জন্য যুবকের রক্ত ও কোষ লাগবে, এই জন্য তিনি রেলবস্তিতে এক গরীব ছেলেকে কিছু টাকা দিয়ে এক বোতল রক্ত ও তার শরীর থেকে কিছু কোষ নিয়েছিলেন তারপর সে গুলোকে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নত করার চেষ্টা করেছেন । এই কাজ করার জন্য তিনি বেশ কয়েকমাস প্রায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়েছিলেন, চুল ও দাড়ি লম্বা হয়েছিল, এমনকি হাতের নখও বড় হয়েছিল । নিজের শরীরের যত্ন চাইতে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অনেক বেশী কার্যকর মনে হয়েছিল তার কাছে । তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে অবশেষে এক জায়গায় পৌছালেন । এরপর বাকি আছে শুধু এর প্রয়োগের । এর জন্য একটা বৃদ্ধ মানুষের শরীর দরকার, তারপর তার এই পরীক্ষা তিনি প্রয়োগ করতে পারবেন । আর তাই জন্যই তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন ।
সম্প্রতি ডানকুনি এলাকায় রক্তাল্পতা বা অপুষ্টি রোগীর সংখ্যা বেশ বেড়েছে । একে গরমকাল জলের অভাব, দুপুরে যেন আকাশ থেকে আগুন বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়, নদী-নালা সব শুকিয়ে ফুটিফাটা হয়ে গেছে । গরিব মানুষ অপুষ্টি কেন অনাহারেও মারা যাচ্ছে । বস্তিবাসীরা সকলে মিলে জায়গায় জায়গায় জলছত্র খুলেছে, সরকার থেকেও কিছু সাহায্য এসেছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল । এই সেই দিন বিশু বাগদীর ছোট ছেলেটা সন্ধ্যে থেকে ধুম জ্বর । রাত্তির হাসপাতালে নিয়ে যায় ডাক্তার বলেছে রক্তাল্পতা । ইদানিং রক্তাল্পতা রোগ যেন একেবারে এই এলাকার মানুষের কাছে এক অভিশাপ । হাসপাতালে অন্য রোগীর চাইতে রক্তাল্পতা রোগী বেশি আসে । সব মানুষের শরীর থেকে রক্ত যাচ্ছে কোথায় ?
মনে হয় কোন রক্তচোষা বাদুর বা ভ্যাম্পায়ার সবার রক্ত চুষে নিচ্ছে । সত্যবাবু বলেন আসলে আমরা যে খাবার খাই তার মধ্যে যে পুষ্টিগুণ থাকে সেটা রক্তের মধ্যে মিশে রক্তের লোহিত কণিকা বৃদ্ধি করে এবং শরীরের কোষগুলোকে আরও বিকশিত হতে সাহায্য করে, আর তাতেই মানুষের কর্ম ক্ষমতা বাড়ে । যখন মানুষ ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হয় তখন খাবারের হজমের ক্ষমতা কমে, তাই নানান রকম পেটের রোগ হয়, সেইজন্য তারা খাবার কম খায়, তাতে শরীরের পুষ্টি কম পায়, সেই জন্যেই কর্মক্ষমতাও আস্তে আস্তে কমে আসে । বর্তমানে ডানকুনি এলাকায় এটাই চলছে । মোল্লাপাড়া শরিফ উদ্দিন চাচা বলছিল, না না ওসব কোন অপুষ্টি নয়, আমরা তো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখেছি, তখন তো এত রক্তাল্পতা দেখা যায়নি । এটা কোন জীনের কাজ । দেখছো না জাতীয় সড়কের ধারে ধারে যেসব বড় বড় গাছ আছে তাতে নানান বাদুর, শকুনি এসে বাসা বেঁধেছে । আগে তো কখনো এগুলো আসেনি । এদেরকে আগে কোনদিন দেখেছো । এরাই রাত্রিবেলায় ভ্যাম্পায়ারের রূপ নেয়, তারপর ঘুমন্ত মানুষের বা জন্তু জানোয়ারের রক্ত চুষে খায় । তোমরা সবাই সাবধানে থাকবে । এরা অনেক সময় আবার মানুষের রূপ নিয়ে আমাদের মধ্যে থাকতে পারে । তুমি দেখলে বুঝতে পারবে না যে, কে ভ্যাম্পায়ার আর কে সাধারন মানুষ । কিন্তু রক্ত খাবার জন্য এদের মুখের ভেতরের রঙ সবসময় লাল হয়ে থাকে , এবং চোখ দুটো ও লাল বা ঘোলাটে হয় । এই সমস্ত জীন রাত্রি অশরীরী শক্তি পায় ।
মোল্লাপাড়া থেকে সুভাষপল্লী সর্বত্র এখন এই চর্চা যে ডানকুনিতে ভ্যাম্পায়ারের উপস্থিতি । গতকাল সকালে মোল্লাপাড়া থেকে কয়েকজন ছেলে মিলে জাতীয় সড়কের ধারে যে গাছ আছে তার ওপর থেকে শকুন, বাদুর এদের তাড়ার ছিল ।
এসবের মধ্যে, সত্যবাবু কিন্তু বেখবর, কারণ তিনি পাড়ার লোকের সঙ্গে খুব একটা মেশেন না, প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হন না, ও কারুর সঙ্গে বিশেষ একটা কথা বলেন না । নিজের গবেষণা নিয়ে সবসময় মশগুল থাকেন ।
গত রবিবারে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। সুভাষপল্লী একদম শেষ প্রান্তে সমীর মজুমদারের বাড়ি । তার এক বাল্য বিধবা পিসি, তার কাছে থাকে । বয়স ৭৫ বছরের কাছাকাছি । কয়েকদিন থেকেই তাঁর শরীর খুব খারাপ । সমীর নিজে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করে, তাই সে নিজেই পিসিকে ওষুধ দিয়েছিল । কিন্তু পিসির প্রকৃত কি রোগ হয়েছে তা সে ধরতে পারেনি । কিন্তু সে কথা সে বাড়ির অন্য কাউকে বলেনি । তার আরও একটা কারণ আছে, যদি পিসি মারা যায় তবে তার সম্পত্তির মালিকানা সমীরের । সেটা মনে থাকলেও, একজন ডাক্তার হিসেবে তার যা করণীয় তা সে করেছিল নিশ্চয়ই, সেখানে কোন ভুল নেই । তবুও পিসিকে বাঁচানো যায়নি । রবিবার অনেক বেলা পর্যন্ত পিসি যখন দরজা খুলছে না দেখে, বাড়ির সবাই বেশ চিন্তিত হল, অতঃপর সমীর, পাড়ার কিছু লোক জুটিয়ে দরজা ভাঙলো । ভেতরে ঢুকে সবাই অবাক পিসি মারা গেছে, বিছানার সঙ্গে তার শরীর যেন পাতার মতো লেপ্টে আছে । পুরো শরীরটা নীলাভ হয়ে গেছে । বিছানা নিচের দিকটা রক্তে ভেজা, উত্তর দিকের জানলা খোলা । এরা যখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো তখন দেখল দুটো কালো বাদুরের মত পাখি যেন জানলার পাস দিয়ে উড়ে গেল । ঘরের অবস্থাটা সত্যিই অমানবিক । মৃত ব্যক্তির চেহারা এবং পারিবারিক অবস্থা বিচার করে অমলবাবু বললেন, এটা কোন রক্তচোষা বাদুর বা ভ্যাম্পায়ারের কাজ। সেটা ওই জানলা দিয়ে ঢুকেছে এবং ঘুমন্ত মানুষের রক্ত চুষেছে । যেটা না গিলতে পেরেছে সেটা বিছানায় ফেলে দিয়েছে । আর তার বিষেই পিসির শরীর নীলাভ হয়ে গেছে । সমীরের স্ত্রী সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল যে পিসির অর্শ রোগ আছে, এবং গত কয়েকদিন থেকে তার নাকি সময় অসময় খুব ব্লিডিং হচ্ছিল, কিন্তু তার কথা কেউ কানে তুললো না । অমলবাবুর কথাটি যেন আগুনের ফুলকি পুরো ডানকুনি গ্রামে ছড়িয়ে গেল । একজনের মুখ থেকে আরেকজনের, তার মুখ থেকে আবার অন্য আর একজন, এইভাবে কথা ছড়াবে ছড়াতে, ক্রমে ক্রমে কথার বিকৃতি হতে লাগলো । সন্ধ্যেবেলা বেচুদার চায়ের দোকানে শোনা গেল কোন এক ব্যক্তি, রাত্তিরে ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা বাদুরের রূপ নিয়ে গ্রামের মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে । সেই ব্যক্তি যে কে সেটাই এখনো জানা যায়নি, কিন্তু সে যে আমাদের মধ্যেই কেউ সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই ।
রেলবস্তিতে থাকে পরেশ, আগে সে রিস্কা চালাতো । একটা অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পর এখন সে বাড়িতেই থাকে । এখন তার ছেলে রিকশা চালায় । এক সময় পরেশের নিয়মিত খদ্দের ছিল সত্যবাবু । এনাকে রোজ বাড়ি থেকে স্কুলে এবং ছুটির পর আবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ছিল তার কাজ । কারণ পরেশের রিস্কা কেনবার প্রায় অর্ধেক টাকা সত্যবাবু দিয়েছিলেন । স্কুল থেকে রিটায়ার করার পর অবশ্য সত্যবাবু রিস্কায় কম চড়েন । তবে পরেশ মাঝেমধ্যেই সত্যবাবুর বাড়িতে এসে সময় কাটাত । সত্য বাবুর জন্য পান কিনে নিয়ে যেত ।
দুজন অসম পেশার হলেও সমবয়সী বলে বন্ধুত্ব একটু বেশি । দুজনে মাঝেমধ্যে বিকালের দিকে রেললাইনের ধারে বেড়াতে যেতেন । পরেশের একটা পা নেই তাই সে ক্ল্যাচ ধরে চলা ফেরা করে । সত্যবাবু পরেশের কাছ থেকে গ্রামের অনেক কথা শোনেন এবং গ্রামের লোক বর্তমানে যে একটা ভুল চিন্তা ধারায় আচ্ছন্ন সেটা তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন । এইসব নিয়ে দু'জনের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু তাদের করার কিছু নেই, কারণ একজন অশিক্ষিত পঙ্গু, অন্যজন শিক্ষিত বিজ্ঞানী হলেও তার কাছে সময়ের অভাব । অতএব তাদের মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায় ।
আজ সোমবার সত্যবাবুর রিসার্চ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা । যদি তার ঔষধ সাফল্য হয় তবে বৃদ্ধাশ্রম গুলো ফাঁকা হয়ে যাবে, কারণ লোকেদের কর্মক্ষম থাকবে আমৃত্যু, অন্য কারোর উপর তাদেরকে নির্ভর করতে হবে না। কিন্তু কার উপর প্রয়োগ করা যায় তার এই আবিস্কার সেইটা নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না ।
আজ দুপুর বেলায় তিনি খেয়েদেয়ে বাইরের রোয়াকে বসেছিলেন । আজ আকাশে খানিকটা মেঘ-রৌদ্র খেলা করছে, তাই তাপপ্রবাহ একটু কম, তবে বারিধারার দেখা নেই । হঠাৎ বাইরের দরজায় আওয়াজ, সত্য বাবু গিয়ে দরজা খুলে দেখেন পরেশের ছেলে রিস্কায় করে তার বাবাকে নিয়ে এসেছে । পরেশকে সকালবেলায় সাপে কেটেছিল, প্রথমে বস্তির লোকের কথায় তার ছেলে তাকে ওঝার কাছে নিয়ে যায় । ওঝা প্রথমে কিছুটা ঝাড়ফুঁক করেছিল, কিন্তু যত বেলা বাড়ছে অবস্থা তত বেগতিক হচ্ছে । পরেশ যেন ক্রমশ ঘুমের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে । তাই দেখে সে বলেছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে । ছেলেটা রিস্কা করে পরেশকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পরেশ বলেছে একবার সত্যবাবুর কাছে নিয়ে যেতে, তাই ছেলেটা এখানে নিয়ে এসেছে । পরেশকে দেখে সত্যবাবুর মায়া হলো, তাড়াতাড়ি দু জনে ধরা-ধরি করে নিজের ঘরে আনলেন, মেঝেতে একটা মাদুর পেতে তাকে শোয়ালেন । তারপর সাপের কাটা জায়গাটা ভালো করে দেখলেন । দুটো দাঁতের দাগ, তার মানে বিষধর সাপ, পায়ের পেশিতে কেটেছে, হাঁটুর উপরে একটা কাপড় বেঁধে দিয়েছে যাতে বিষটা না পুরো শরীরে ছড়িয়ে যায় । কিন্তু রক্ত তো পুরো শরীরে বইছে, অতএব কাটা জায়গা থেকে যতক্ষণ না দূষিত রক্ত বার করে দেয়া যাচ্ছে ততক্ষন কিন্তু বিপদ কাটবে না । সত্যবাবু একটা কাগজে কিছু ওষুধ লিখে ছেলেকে দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি এইগুলো যেন বাজার থেকে নিয়ে আসে । ছেলে চলে গেলে সত্যবাবু একটা ছুরি দিয়ে সাপে কাটা জায়গাটা থেকে দূষিত রক্ত বার করার চেষ্টা করতে লাগলেন । ছুরিতে করে কেটে, দু দিক থেকে একটু টিপে ধরতে খানিকটা রক্ত বের হলো বটে, কিন্তু এখনো অনেকটা বাকি । একটা কোন পাম্পের মত জিনিস হলে দূষিত রক্তটাকে পাম্প করে বের করে দেয়া যেত । কিন্তু সেই সব জিনিসপত্র তার কাছে নেই । কারণ তিনি বিজ্ঞানী, ডাক্তার নন । হঠাৎ তার মনে হলো জলে ডোবা রোগীকে মুখে ফুঁ দিয়ে যেমন তার শ্বাস প্রশ্বাস চালানোর চেষ্টা করা হয়, সেইরকম এই কাটা জায়গা থেকে যদি মুখে করে রক্ত টেনে নিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে ঠিক হতে পারে । যেমনিভাবে তেমনি কাজ, তিনি পান খাচ্ছিলেন পিকটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে, তাড়াতাড়ি পরেশের পা থেকে দূষিত রক্ত চুষতে লাগলেন । এরমধ্যে এই খবরটি ছড়িয়ে গেছে যে পরেশকে সাপে কেটেছে । বস্তির কয়েকজন লোক মিলে সত্যবাবুর বাড়িতে এসেছে । ইতি মধ্যে পরেশের ছেলে ওষুধগুলো কিনে নিয়ে এসেছে ।
ঘরে ঢুকে সকলে তো অবাক । তারা দেখছে পরেশ মেঝেতে শুয়ে আছে অচৈতন্য হয়ে, সত্যবাবুর তার পা থেকে রক্ত চুষে খাচ্ছে, তার লম্বা লম্বা চুল ও দাড়ি গোঁফ অগোছালো , মুখের ভেতরটা রক্তিম বর্ণ এবং ঠোটে লেগে আছে রক্ত । না এটা কোন মানুষের মুখ নয়, এটা যেন কোন রক্তচোষা, রক্তপিপাসু ভ্যাম্পায়ার । ব্যাপারটা আর কারো বুঝতে বাকি রইল না । সত্যবাবু হল এক রক্তচোষা বাদুর বা ভ্যাম্পায়ার, যে দিনের বেলায় মানুষের রূপে থাকে, রাত্রিতে ভ্যাম্পায়ারের রূপে বের হয়, এবং ঘুমন্ত বস্তি বাসীর শরীর থেকে রক্ত চুষে খায় । সমীরের পিসির মৃত্যুর কারন এই ভাম্পায়ার রূপী সত্য বাবু ।
পরেশের ছেলেকে দেখে তিনি বললেন, “ খোকা তুমি ওষুধ গুলো নিয়ে এসো, কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়েছে, মলম লাগিয়ে দেবো তাহলে ঠিক হয়ে যাবে । ছেলেটা ওষুধগুলো তার হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল । পাড়ার যে কয়েক জন লোক এসেছিল তারাও চলে গেল । সত্য বাবু তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু কেউই তাতে কর্ণপাত করল না ।
আগুনের ফুলকির মত এই খবর ছড়িয়ে গেল যে সত্য বাবু ভ্যাম্পায়ার। এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পাড়ার কয়েকজন লোক লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে সত্য বাবুর বাড়ি চড়াও হলো । সত্য বাবু স্বভাবে খুবই শান্ত ও মৃদুভাষী । তিনি কিছু বলার আগেই তার ওপর লাঠির বৃষ্টি শুরু হল । বৃদ্ধ বয়সে তিনি আর তা সহ্য করতে পারলেন না মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন । তার বাড়ির উঠানে যখন এইরকম রণক্ষেত্র চলছে, তখন ঘরে পরেশের সামান্য চৈতন্য ফিরে এসেছে, অতিকষ্টে সে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখে সত্যবাবু মাটিতে পড়ে আছেন, মাথা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে । পরেশ তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে বসল এবং মাথাটা কোলের ওপর তুলে নিয়ে বললো, “ সত্যদা তোমাকে কেউ বুঝলো না তুমি আমাকে বাঁচিয়ে নিজে চলে গেলে” । সত্য বাবু চোখে তখন জল, জোর করে মুখে একটু হাসি এনে ওপরের দিকে আঙ্গুলের একটা ইশারা করেছিলেন । তিনি কি বলতে চেয়েছিলে তা পরেশ বুঝতে পারলেও অন্যকেও বোঝে নাই ।

