গাছিলা
গাছিলা
কলকাতার ছেলে আমি । জন্ম থেকে বড়ো হয়েছি উত্তর কলকাতার মধ্যবর্তী শহরে । তাই আসল গ্রাম্য পরিবেশ ও সেখানকার জীবন যাপন সম্পর্কে কোনো ধারনা ছিল না আমার । শুনেছি বা দেখে এসেছি যে গ্রাম্য মানুষের প্রতি শহরের মানুষদের অবহেলার মানসিকতার ছবিই বেশি ফুটে ওঠে । কিন্তু আমার সেই ধারনা একদিন বদলে যায় ।
আমি তখন সবে প্রাইমারি স্কুলের চাকরি টা পেয়েছি । আর আমার প্রথম পোস্টিং পাই বর্ধমান জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে । সেখানে আমি দুই বছর ছিলাম । আমি নিজেকে ধন্য মনে করি যে আমি সেই গ্রামে সেই মানুষ গুলির সাথে থাকতে পেরেছি । সেই গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হওয়ার জন্য আমি সকলে কাছেই ছিলাম খুব কাছের ও সন্মানীয় । সব বিষয়ে তারা আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসতো । এমন কি তাদের সব অনুষ্ঠান পরব সব কিছুতেই আমাকে নিমন্ত্রণ করতো । এই ভাবেই একদিন গ্রামের মোড়ল এর কাছ থেকে এক নিমন্ত্রণ পেলাম । তখন আমার সবে চার মাস হয়েছে আমি মাস্টার হয়ে গেছি সেখানে । মোড়ল মশাই এসে আমাকে বলল । আমাদের করিমের ছেলে হয়েছে । তার গাছিলা আছে কাল , চলে এসো মাস্টার সকালে , আমি বললাম গাছিলা কি । মোড়ল বললো কাল আসো মাস্টার সব দেখতে পাবা । যথারীতি আমি সকাল বেলা গেলাম । গিয়ে দেখলাম যে করিম মিঞার বাড়ির উঠানে আয়োজন হয়েছে তার ছেলের গাছিলা অনুষ্ঠান । আমিও খুবই আগ্রহী ছিলাম এই বিষয়ে জানার জন্য ।
দেখলাম যে বাড়ির উঠানের ঠিক পাশে সবাই ভীড় করছে । আমিও গেলাম , দেখি যে করিম সেখানে অতি যত্নে একটা চারা গাছ পুঁতলো । সেই গাছের নীচে তার সেই ছোট্ট তিন মাসের ছেলেকে রাখলো । তারপর নানা উপাচার করা হল শাস্ত্র অনুযায়ী। সেই বৃক্ষ চারাটির উপর সবাই ফুল দিতে থাকে , আর করিমের ছেলেকে উদ্দেশ্যে আশিবার্দ করতে থাকলো । করিম আমার হাতে ফুল দিয়ে বলে মাস্টার আমার ছেলেকে আশিবার্দ কর । যেন সে তোর মতো বড় আর ভালো মানুষ হতে পারে । আমিও সেই সদ্য রোপণ করা বৃক্ষ চারাটির উপর ফুল দিলাম । এই অনুষ্ঠানের কি মানে। কি যে এর তাৎপর্য কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না । এমন তো আমি কোনো দিনি দেখেনি বা শুনিনি । তাই এই গ্রামের এই প্রথার কথা জানার এক প্রবল ইচ্ছা জাগে আমার মনে । তারপর সেদিন রাতেই আমি গিয়ে হাজির হই মোড়ল মশাইয়ের বাড়িতে । আর তার থেকে জানতে চাই, আজকের এই গাছিলা অনুষ্ঠানের কথা ।
মোড়ল মশাই বলে জানি মাস্টার তুমি কখনও এই প্রথার কথা শোনোনি । আমি বললাম প্রথা , মোড়ল মশাই বলে হ্যাঁ প্রথা । আমাদের গ্রামের এই প্রথা চলে আসছে আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থাকে । যখনি কোনো শিশু জন্ম নেয় আমাদের এই গ্রামে , সেই শিশুর মঙ্গল কামনায় নব্য বৃক্ষ রোপণ করা হয় । মনে করা হয় যে , ওই বৃক্ষে সেই শিশুর একটি অংশ থাকে । তাই সেই বৃক্ষ কে শিশুটির মাতা পিতা সহ পরিবারের সকল সদস্যরা মিলে পরম যন্তে পরিচর্যা করে । কারণ তারা মনে করে সেই বৃক্ষ টি যত সতেজ ও বড় হবে । তাদের শিশুও ততই সুস্থ নিরোগ সবল ও দীর্ঘ আয়ু পাবে । এছাড়া আরও একটা বিশেষত্ব হচ্ছে যে তার মৃত্যুর পরও স্মৃতি হিসাবে রয়ে যায় তার পরিবারের কাছে । এই হল আমাদের গাছিলা প্রথা । এই প্রথা অন্যথায় বেমানান হলেও । আমাদের গ্রামের প্রত্যেকে তা মেনে চলে । আমাদের এই গ্রামে সহজে কেউ কখনও অসুস্থ হয়ে পরে না । সবাই মনে করে গাছিলা দেবতা আমাদের এই গ্রামে রক্ষা কর্তা হয়ে বিরাজ করে । এর জন্য এই প্রথা গ্রামের সবাই মেনে চলে । তোমরা শহরের মানুষ , তোমরা এই সব মানবে না জানি । এই কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই । কোনো কথা আসে না আমার মুখে ।
আমি বাড়ি ফিরে রাত পর্যন্ত ভাবলাম মোড়ল মশাইয়ের কথা গুলো । আমি এই টুকু বুঝতে পারলাম যে । এই গ্রামের গাছিলা প্রথা এই গ্রাম বাসির বিশ্বাস হোক বা নিষ্ঠা । এই টুকু বুঝলাম যে একটি গাছ একটি প্রান , এই চিরন্তন সত্য কথাটি শহরের শিক্ষিত মানুষেরা না বুঝলেও । এই গ্রামের সহজ সরল মানুষেরা নিজের অজান্তেই তা করে চলেছে । আর এই সরলতার মানুষের সংখ্যা যদি শহরাঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তার করে । তাহলে পৃথিবীটা ই বদলে যাবে । যা হওয়াটা ভবিষ্যতে খুবই দরকার । যেন পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পরে এই গাছিলা দেবতার রক্ষা কবচ ।
তবে এই গ্রামের এই প্রথার সুফল আমিও পেয়েছিলাম । ছয় মাস পর যখন আমি প্রথম বারের জন্য বাড়ি ফিরি , তখন সুটকেস খালি করতে গিয়ে আমার ইনহেলার টা দেখতে পেলাম । আর সাথে সাথে অবাক হলাম । যেখানে সপ্তাহে আমায় তিন থেকে চার বার আমাকে এই ইনহেলার ব্যবহার করতে হতো । সেখানে , ওই গ্রামে থাকাকালীন এই ছয় মাসে একবারও আমার এই বস্তুটির কথা মনেই আসেনি ।
