গাবলু চরণ
গাবলু চরণ
আজ কোচিন এ এক কাণ্ড হয়ে গেলো, এতদিন যে একটা দিনও ক্লাস মিস করে নি সেই গাবলু অনুপস্থিত। স্যার ও ঠিক মন দিতে পারছেন না ক্লাসে। বারবার বলে উঠছেন
"গাবলু টার কি হলো কে জানে, ক্লাসের পর একবার ফোন করে দেখবো, হয় তো শরীর টরীর খারাপ করেছে"
তনু গাবলু র পাশের বাড়িতেই থাকে তাই ওর দিকে তাকিয়ে স্যার আবার বলে উঠলেন
"তুই তো পাশেই থাকিস, একবার ওর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিস তো"
তনু মাথা নেড়ে বলে
"হ্যা স্যার, আমি বাড়ি ফেরার সময় ওদের বাড়ি হয়েই ফিরবো"
আসলে গাবলু ঠিক অন্য ছেলেদের মত নয়, পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী আর সিরিয়াস ছেলেটির জন্য স্কুল আর কোচিন এ ওর খুব কদর। সব স্যারেরা গাবলু র প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গাবলু র কিন্তু তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, পড়াশুনা ই ওর জগৎ, কত তাড়াতাড়ি ক্লাসের বই শেষ করে অন্য রেফারেন্স বই পড়বে সারাদিন সেই চেষ্টা। স্যারেরা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় ওর চেষ্টা দেখে।
সামনের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা তাই এখন গাবলু র দিন রাত এক, কোনো অনুষ্ঠানে যায় না কোচিন কামাই হবে বলে, বাবা মায়ের শত অনুরোধেও নয়। এই ছেলের কামাই হলে স্যারদের চিন্তা তো হবেই।
গাবলুর নাম কিন্তু গোবিন্দ, স্কুলে আর কোচিনে সবাই ওকে ভালোবেসে গাবলু বলেই ডাকে। তাতে অবশ্য গাবলুর তেমন আপত্তি নেই এমনিতে খুবই কম কথার মানুষ আর দিনের বেশিরভাগ সময়টা বই মুখো হয়ে থাকে তাই কে কি বলল তাতে ওর কিছু এসে যায় না।
সেদিন কোচিং এর পর তনু সোজা গাবলু দের বাড়ি আসে। বাড়ির বাইরে গাবলুর ভাই কৃষ্ণকে দেখেই বলে ওঠে
"কিরে কৃষ্ণ তোর দাদা আজ কোচিংয়ে গেল না কেন? স্যার খুব চিন্তা করছিল তাই আমাকে খোঁজ নিতে পাঠালো"
কৃষ্ণ তনুকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠে বলল
"আরে আজ একটা খুব মজার কান্ড হয়েছে তাই গাবলু মন খারাপ করে ঘরে শুয়ে আছে"
"বাবা কি এমন কান্ড হলো তাতে গাবলুর মত ছেলেকে কোচিং কামাই করে শুয়ে থাকতে হল?
"জানিস আজ গাবলুর ব্যাগ থেকে একটা বেশ বড়সড ক্যাডবেরি চকলেট বের করেছে তুলসী"
তুলসী হলো গাবলুর ছোট বোন।
"বুঝতে পারছি না তাতে গাবলু কোচিং যাবে না কেন?
"আরে গাবলু কিছুতেই স্বীকার করছে না যে ওটা ওকে কেউ গিফট দিয়েছে কারণ আজ ছিল চকলেট ডে বুঝলি?"
তনু এবার বোঝে গাবলুর এই চকলেট ব্যাগে পাওয়া নিয়ে কৃষ্ণ আর তুলসী ওকে খুব খেপিয়েছ , এমনিতে ও যে খুব অভিমানী তা তনু খুব ভালো করেই জানে।
এবার ঘরে ঢুকে সোজা গাবলুর খাটে গিয়ে বসে। দেখে গাবলু চোখ বুজে চুপ্টি করে শুয়ে আছে। তনু যেই খাটে গাবলুর পাশে গিয়ে বসে অমনি গাবলু তনুকে বলে ওঠে
"তনু আমার ব্যাগে কে একটা চকলেট দিয়েছিল তুই কি জানিস?"
"কে আবার তোকে চকলেট দেবে নিশ্চয়ই তুই কিনে ভুলে গেছিস?"
এবার সটান উঠে বসে গাবলু বলে
"না রে আমার কাছে এত পয়সা থাকে না তুলসী বলছিল ওই ক্যাটবরি টার দাম বোধহয় 60 টাকা হবে, অত টাকা আমি কোথায় পাব আর পেলেও চকলেট কিনে টাকা নষ্ট আমি করতাম না"
এই যুক্তিটা তনুর বেশ মনে ধরল। সত্যিই গাবলুর মত ছেলে চকলেট কিনে টাকা নষ্ট করবে না বরং সেই টাকায় ও পড়াশোনার জন্য জিনিস কিনবে। তনুর মনে তোলপাড় করতে আরম্ভ করলো। সত্যি এত বড় চকলেট টা কে কোচিংয়ে ওর ব্যাগে ভরে দিল? একে একে সবার মুখ ওর মনে আসতে লাগলো। এখানে যারা পড়ে তারা গাবলুকে এত বড় চকলেট যদিও গিফট করে থাকে তাহলে সেটা বলেই দেবে , তাই এখানে কেউ দিয়েছে বলে ওর মনে হলো না। ছেলেদের মধ্যে তো কেউই নয় । আর বাকি থাকলো ওদের গ্রুপের দুটি মেয়ে । একজন ঐশী আর একজন শম্পা। শম্পা খুবই গরিব পরিবার থেকে এসেছে। স্যার ওকে বই খাতা কিনে দিয়ে অনেক সাহায্য করেন তাই শম্পা এত বড় চকলেট কিনে গিফট দেওয়া অসম্ভব। আর বাকি থাকলো ঐশী, এখানে বলে রাখা ভালো যে গাবলুকে ঐশী ব্যঙ্গ করে গাবলু চরণ নামে ডাকে। গাবলু অনেক বার তনুকে ঐশীর এই নাম দেওয়া নিয়ে অভিযোগ করেছে কিন্তু ঐশী সবার সামনেই গাবলুকে গাবলু চরণ, ক্যাবলাকান্ত, হাঁদারাম এ
ছাড়াও অনেক নামে ডেকে ব্যঙ্গ করে। গাবলু ঐশীকে দু'চোখে সহ্য করতে পারেনা এমনকি ওর সাথে বেশ কয়েক মাস কথাও বলেনা। ঐশী গাবলুর সামনেই স্যার না থাকলে ওকে নিয়ে নানা রকম কথা বলে হাসাহাসি করে। ঐশির মতে গাবলু জীবনে কিছুই করতে পারবে না কারণ গাবলুর মতো হাদা ছেলে পৃথিবীতে ওই একটাই। এর চেয়ে পড়াশুনা না জেনে চালাক-চতুর হলে জীবনে কিছু করতে পারত। গাবলু বার দুই ঐশীর নামে স্যারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল তাতে ঐশী এখন এতটাই চটেছে যে বলা যেতে পারে দুজনে মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ। তাই ঐশীও চকলেট দেওয়ার তালিকা থেকে বাদ। কিন্তু এত বড় চকলেট টা এই চকলেট ডে তে দিল কে সত্যি এটা ভাববার বিষয়।
পরেরদন স্যার গাবলুকে দেখেই বলে উঠলেন
"কি রে গাবলু কাল কি শরীর খারাপ করেছিল?"
গাবলু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলতে পারে না তাই একটু ইতস্তত করে ও বলে ফেলল সত্যি কথাটা।
স্যার সবাইকে জিজ্ঞেস করেও কোন কিনারা করতে পারলেন না তখন বললেন
"ঠিক আছে যে চকলেট দিয়েছে সে আরও দুই তিনটে দিলে ভালই করত কারণ এখানে একটা চকলেট কিছুই হবে না"
একটু থেমে আবার বললেন
"গাবলু চকলেট টা বের কর আর সবাইকে ভেঙ্গে দে । গাবলু আর তনু মিলে চকলেট টা ভাঙতে আরম্ভ করলো। স্যার বললেন
"গাবলু তুই সেদিন ব্যাগটা কোথায় রেখে অঙ্কের খাতা আনতে গিয়েছিলি, কার কাছে তোর ব্যাগ ছিলো?"
"আমার ব্যাগ তো শম্পার পাশেই ছিলো, ওকে দেখতে বলে আমি খাতা আনতে বাড়ি গেলাম"
স্যার শম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন
"কি রে তোর কাছে যখন ব্যাগ ছিলো তুই তো জানবি কে ওর মধ্যে চকলেট রাখলো?"
শম্পা মুখ কাঁচু মাচু করে বলে ওঠে
"স্যার ওটা ঐশী আমাকে গাবলু র ব্যাগে ভরে দিতে বলেছিল, তাই,,,,,,,,,"
শম্পা বলতে বলতে থেমে যায়।
স্যার ঐশীর দিকে নজর ঘোরাতেই বলে ওঠে
"স্যার ওটা আমিই দিয়েছিলাম, কারণ গাবলু কে আমি ওটা হাতে দিলে ও নিত না, আর আমি এত ওকে নিয়ে ইয়ার্কি করি তাই আমাদের মধ্যে কথাও হয় না"
ঐশীর এইরকম স্বীকারোক্তি শুনে স্যার অবাক হলেও বুঝতে না দিয়ে আবার প্রশ্ন করেন
"তুই এত জনের মাঝে শুধু গাবলু র ব্যাগেই কেনো ওটা দিলি"
স্যারের প্রশ্নটা যেনো ঐশীর জানা ছিলো তাই কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো
"স্যার ওকে আমি অনেক জ্বালাতন করি কিন্তু আমার যখন কোনো নোট বা অন্য বইয়ের দরকার হয় গাবলু সম্পাক দিয়ে সেটা আমাকে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু আমার সাথে কথা বলতে ওর আপত্তি, আর এতেই আমার রাগ বেড়ে যায়, ওকে সবার সামনে এইসব বলে ফেলি"
এতক্ষণ পর সবার বোধগম্য হয় আসল ব্যাপারটা কি। স্যার তো কিছুক্ষন কোনো কথাই বলতে পারলেন না। সত্যি পরের প্রজন্ম কত এগিয়ে। গাবলু সব শুনে বলে উঠলো
"চকলেট টা তো ভাঙ্গা হয়ে গেছে, ঐশীকে আমি পরে কিনে ফেরত দিয়ে দেবো"
গাবলু র এই সরল কথায় সবাই হেসে উঠলেও স্যার ওর মাথায় হাত রেখে বলে উঠলো
"আমার এই ছেলেটা খুব সরল, পড়াশুনা ছাড়া ও আর কিছু বোঝে না, একে নিয়ে তোরা মস্করা করিস না"
ঐশী জানে গাবলু র মত ছেলে সত্যি খুবই কম, এখনও পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না ও করো সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, বরং ঐশীর ওকে নিয়ে নানা রকম মস্করা যতক্ষণ না সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ও মুখ বুজে সব সহ্য করেছে। ঐশীর মনে এই কারণে একটা অনুতাপ আছে কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও গাবলু কে ওর সাথে কথা বলতে পারেনি ওর বন্ধুরা, শেষে প্রলয় এই বুদ্ধিটা দেয় ঐশীকে। কিন্তু এটা যে এত বড়ো কান্ড হয়ে যাবে সেটা আর কে জানত।
সেদিন কোচিন থেকে বেরিয়ে ঐশী সোজা বাড়ি এলো। আজ মায়ের অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে তাই জলখাবার টা ওকেই করে নিতে হবে। ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রাখতে যাবে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোনটা মায়ের ছিলো। মা জিজ্ঞেস করলো ও বাড়ি ফিরেছে কিনা। এছারও কিছু অন্য কথা বলে মা ফোন রেখে দেয়। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করার সময় একটা টুকরো কাগজ পড়ে গিয়েছিল। ওটা তুলে দেখে গাবলু র হাতের লেখা
"হ্যাপি চকলেট ডে"।