Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Inspirational Others

4.0  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Inspirational Others

একটি খারাপ মেয়ের গল্প

একটি খারাপ মেয়ের গল্প

4 mins
177


পৃথিবীর অন্যতম আদিম ব্যবসা হল দেহ ব্যবসা। পৃথিবীর হেন দেশ নেই যে দেশে এই ব্যবসার অস্তিত্ব নেই। মানবজীবনে যৌন চাহিদা অত্যন্ত স্বাভাবিক ধর্মের প্রকাশ। এটা একটা এমন অনুভূতি যা স্বাভাবিক অপ্রাপ্তিতে সমাজে এক সামাজিক দূষণ তৈরী করে। কামান্ধ মানুষ তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূরণের জন্য যে কোন খারাপ কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করে না। মনেহয় আদিম প্রবৃত্তির কাছে মানুষের শুভ বুদ্ধি ও তার সংস্কৃতির কোন মূল্য থাকে না। নিজের প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করতে সে যে কোন অন্যায় করতে পিছপা হয় না। এরমধ্যে বহু নারী আছেন যারা আর্থিক ভাবে একদমই স্বচ্ছল নয়, তখন তাদের বিভিন্ন রকম লোভ দেখিয়ে বা প্রয়োজনে কখনও ভীতি প্রদর্শন করে নিজেদের ভোগের সামগ্রী হিসাবে তৈরী করে নেওয়া হয়। আরো মজার ব্যাপার হল - যে মেয়েটি তার সর্বস্ব হারালো সমাজ তাকেই নষ্ট বা খারাপ মেয়ের শিরোপা পরিয়ে দিল। ফল মেয়েটির আর এই সমাজে আর স্থান হবে না - তাদের জন্য পড়ে রইলো একটি নূতন সমাজ। পতিতা সমাজ। কিন্তু লালসা চরিতার্থ করা সেই পুরুষটি এই পুরুষশাসিত সমাজে নিস্কলঙ্ক হয়ে রইলেন। এটাই আমাদের সমাজের ন্যায় বিচার।


অনলাইন ভিডিও চ্যাটিং করছে তপু । এটা নিয়ে সকাল থেকে তার পাঁচ নম্বর ভিডিও কল। তপু মানে তাপসী মাল , সোনাগাছির নীলকমলের একজন পতিতা, যার এ তল্লাটের পনেরো হাজার মেয়েদের মতই জীবিকা বিপন্ন লকডাউনের জেরে। কি একটা সংক্রামক একটা রোগ এসেছে বিদেশ থেকে, যার জন্য সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে এক মৃত্যু মিছিল। সারাদেশ জুড়ে জমছে লাশের পাহাড়। এই রোগের সংক্রমন রোখার জন্য গোটা দেশ জুড়ে সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, রাস্তাঘাট একদম নির্জন শুনশান। একটাও খদ্দের নেই এই চৌত্রিশ দিন । কিভাবে যে দিন চলছে! বাড়ি ভাড়া, খাওয়া খরচা, বাড়িতে বাবা মাকে টাকা পাঠানো - সব দায়িত্ব তার। সরকারি কিছু সাহায্য পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু দরকারের তুলনায় তা অপ্রতুল।


শেষে বুদ্ধি খাটিয়ে দালালরাই একটা উপায় বের করেছে যে শারীরিক মিলন না হলেও দর্শনে তৃপ্তি লাভের একটা বন্দোবস্ত - মেয়েরা অনলাইন সেক্স চ্যাটিং করবে খদ্দেরদের সঙ্গে, পরিবর্তে তাদের মেয়েদের একাউন্টে অনলাইন টাকা ট্রান্সফার করতে হবে। মেয়েদের ভিডিও চ্যাটিং করতে হবে বিবস্ত্র হয়ে, খদ্দেরদের চাহিদা অনুযায়ী শরীরের অংশ বিশেষ দেখাতে হবে ক্যামেরায়। দালালরা থার্টি পার্সেন্ট পাচ্ছে এই নতুন বন্দোবস্তে। 


ফোনের ও প্রান্তে যিনি, তিনি মাঝবয়স্ক, ব্যবসায়ী ট্যাবসায়ী হবেন বোধহয়, প্রেমের পাক্কা নাগর। তার একেকটা আবদারে তপুরই কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু খদ্দের লক্ষ্মী, তাই মনের বিরক্তি মনে চেপে রেখেই খরিদ্দারের সঙ্গে অনস্ক্রীন ঢলাঢলি করতে লাগলো তপু ।


পনেরো মিনিটের চ্যাটিং স্লট শেষ হতে চললো। বয়স্ক খরিদ্দার বললেন যে তিনি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন, আবার কয়েকদিনের মধ্যে তার কাছে আসবেন । সম্মতি জানিয়ে তপু লাইন কেটে দিল।


পাঁচটা স্লট, পাঁচ হাজার টাকা রোজগার হয়েছে। বাপি দালালকে দেড় হাজার একাউন্ট ট্রান্সফার করতে হবে আজই, বাবার একাউন্টে দু'হাজার দিতে হবে । মার প্রেশার, সুগারের ওষুধ অনেক দিন ধরে বন্ধ।


বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিংয়ের সোফায় বসলো তপু । নিজেকে খুব হাল্কা লাগছিল শোভার। যাক, হাতে কিছু টাকা পাওয়া গেল। কাল, পরশু আবার কল আছে। অদ্ভুত লাগে তপুর - দেশে যখন মড়ক লেগেছে, সবাই ঘরবন্দী, গরীবদের কাজ নেই, অন্নের হাহাকার, চারিদিকে মৃত্যুর ভয়, তখন মুষ্টিমেয় এইসব লোকেদের মাথায় এত সেক্সের চিন্তা ঘোরে কি করে? এইসব লোকজনদের জন্যই তো দেশে মেয়েদের ওপর এত অত্যাচার, এত ধর্ষণ। তপুর হঠাৎ মনে পড়ে যায়, যেদিন নির্ভয়ার ধর্ষণকারীদের ফাঁসি হলো - রাস্তায় বেরিয়ে এসে আনন্দে নেচেছিল সে। কেন রে বাবা, নিরপরাধ, ভালোমানুষ মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করা, খুন করা ! কে তোদের লাইসেন্স টু রেপ এন্ড কিল দিয়েছে ? এত চুলকানি যখন, যা না বেশ্যাখানায়, কিছু কড়ি ফেলে ফূর্তি কর গে যা না। কেন ভালো মানুষ মেয়েগুলোকে বরবাদ করা ?


বেশ্যা শব্দটা মাথার ভিতর উচ্চারিত হতেই তপুর মনে পড়লো সে নিজেও তো তাই। সেই কবে তার প্রেমিক তাকে ফুসলে, বিয়ের লোভ দেখিয়ে এখানে বিক্রী করে দিয়েছিল। তারপর থেকে সে এই নরকে পড়ে আছে, যৌনকর্মী হয়ে। বাড়ীতে তাকে নেয় না কেউ, কিন্তু বৃদ্ধ অসহায় বাবা মা'র খোরাকি খরচ, ওষুধের খরচ সে নিয়মিত পাঠিয়ে দেয়। কারণ সে জানে বাবা মা তাকে বর্জন করলেও, তার সাপোর্ট ছাড়া তাঁরা বেশীদিন বাঁচতে পারবেন না, আর এটা করতে গিয়ে তার প্রায়ই মনে হয় তার কৃতকর্মের কিছুটা পাপ স্খলন হচ্ছে ।


হঠাৎই তপুর মনে হলো সে তার পেশাকে পাপই বা ভাববে কেন ? আর পাঁচটা পেশার মত এটাও তো একটা পেশা । হতে পারে এই পেশায় সে অনিচ্ছায় জড়িয়েছে । কোন জোরাজুরি নেই, খদ্দেররা স্বেচ্ছায় আসছে, সার্ভিস নিচ্ছে, বিনিময়ে পয়সা দিচ্ছে। আর সেই পয়সা দিয়ে তিনটে লোকের পেট তো চলছে।


আজ তার নিজেকে একজন অসংগঠিত সেক্টরের মজদুর বলে মনে হচ্ছে - কোটি কোটি 'দিন আনি, দিন খাই' ভারতবাসীর সঙ্গে তার তফাৎটা কোথায় ? করোনার জন্য লক্ষ কোটি দিন মজুর, ক্ষেত মজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, ছোট দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের কাজ হারিয়ে চরম কষ্ট সহ্য করে গৃহবন্দী, ঠিকমত খাওয়া জুটছে না তাদের, ভিন রাজ্যে আটকে পড়া মজুর, শ্রমিকরা চরম বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখে - তখন একই কারণে তাদের মত মেয়েরাও কর্মহীন। ডেলি লেবাররা, মিস্ত্রীরা, ছোট দোকানদাররা কাজ খুইয়ে ভ্যানে করে শাক সব্জি,মাছ বেচছে শুধু মাত্র আপতকালীন বেঁচে থাকার জন্য। আর আজ সে যে কাজটা করলো, সেটাও তো তিনটে প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্যই ।


কন্ঠনালীর কাছে গ্লানির একটা অস্বস্তি এতক্ষণ দলা পাকিয়ে ছিল, সেটা যেন আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে তপুর। দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। নির্ঘাত বাপি এসেছে। ওর কমিশনটা এখুনি ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে দিতে হবে। তারপর বাবার একাউন্টেও টাকা পাঠিয়ে তাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে হবে। নিজের অজান্তে চোখের কোণে জমে ওঠা জল আঁচলের খুঁট দিয়ে মুছে ঘরের দরজা খুলতে গেল তপু। আসলে নানা রঙে ভরা এই জীবন, তাই তো জীবন বহুরূপী।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy