একটা স্বপ্নভঙ্গের গল্প
একটা স্বপ্নভঙ্গের গল্প


সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা থমথমে হয়ে ছিল। পূজো শেষ করে ঘাটে চুপ বসেছিলেন ঠাকুরমশাই প্রজাপতি ব্রহ্মা, আজ তার কথা ভীষণ মনে পড়ছে । আকাশে কালো মেঘ, সূর্যের দেখা নেই। বৃষ্টি আসবে।
পিছন থেকে একটা গলার আওয়াজ পেয়ে ঠাকুরমশাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন। কিছু বলবার দরকার হলো না, শিষ্যের মুখ দেখেই ঠাকুর বুঝে ফেললেন কি হয়েছে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করলেন।
প্রতি বছরই এই হয়। এই দিনটায় এসে ব্রাহ্মণী বড্ড বিচলিত হয়ে পড়েন। সামলে রাখা যায় না তখন।
হন হন করে ঠাকুরমশাই হাঁটতে লাগলেন নিজের কুটিরের দিকে। এই সময়গুলোতে অসহায় বোধ করেন উনি। রাগ হয়ে যায় তখন। ব্রাহ্মণীর এই অবুঝপনার সত্যি কোন মানে হয় না। এতোগুলো বছর কেটে যাবার পরেও…
কুটিরে প্রবেশ করার মুখে হাঁসটা এসে পায়ে ঠুকরে দিলো। উহুহুহু করে উঠলেন ঠাকুরমশাই। ব্রাহ্মণীর যতো উৎকট শখ। হাঁস আবার কেউ পোষে নাকি ? রাগটা আরও চাগিয়ে উঠলো ওনার।
ঘরে ঢুকে ঠাকুরমশাই একটু থমকে গেলেন। ভেবেছিলেন বাড়িতে ঢুকেই ব্রাহ্মণীকে বেশ দু-কথা শোনাবেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখলেন ঘর অন্ধকার। বাইরের ঘন মেঘ সত্ত্বেও ঘরে আলো জ্বালা হয় নি। শ্বেতবস্ত্রা ব্রাহ্মণীকে আবছা দেখা যাচ্ছে – জানালার পাশে। মুখখানা হাতে ভর দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। যন্ত্রটা অবহেলায় কোলের পড়ে রয়েছে। ব্রাহ্মণের পায়ের আওয়াজ পেয়েও মুখ ঘোরালেন না।
ঠাকুরমশাই আস্তে আস্তে ব্রাহ্মণীর পাশে এসে বসলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। শুধু দেখলেন ব্রাহ্মণীর চোখের কোলে একটি মাত্র অশ্রূ শিশিরবিন্দুর মতো লেগে রয়েছে।
ঠাকুরমশাই খুব নরম সুরে বললেন “ এই তুমি এরকম করছো কেন বলো তো! এরকম করতে নেই।“ ছায়ামূর্তি উত্তর দিলো না।
ঠাকুরমশাই আবার খুব নরম সুরে বললেন “এরকম ভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। ও তো আর ফিরবে না। এতোগুলো বছর তো কেটে গেলো…”
“হ্যাঁ, এতগুলো বছর।“ বললেন ব্রাহ্মণী। “ সত্যিই ওর মতো কেউ তো এলো না গো। তুমিও তো আর কাউকে আনতে পারলে না। পারলে ?”
প্রজাপতি ব্রহ্মা চুপ করে রইলেন। হঠাৎ ওই হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার জন্যে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। একটা অক্ষম বেদনা পাঁজরে এসে ধাক্কা দিলো। মনটা বড্ডো খারাপ হয়ে গেলো ওনার।
সত্যি তো কতোগুলো বছর কেটে গেলো। আর কেউ এলো না, যার হাতে সরস্বতী তাঁর বীণাখানি তুলে দিতে পারেন। বলতে পারেন
“এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার।
যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার।“
আজকের দিনেই ছেলেটা চলে গিয়েছিলো। একাশী বছর আগে। ২২শে শ্রাবণে।