একমুঠো আঁবির
একমুঠো আঁবির
রাত প্রায় 11 টা। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ।নীরব, নিস্তব্ধ রাত্রিতে বাবার অপেক্ষায় বসে আছে সুবর্না।আগামীকাল ষষ্ঠী, বাবা আজও এসে পৌঁছায়নি-এসব কথাই ভাবছিলো সে।
সুবর্নার বাবা একজন আর্মি অফিসার। গত পুজোতেও ছুটি পায় নি।এবার বাবার সাথে পুজো করারা বায়না করেছে ছোট্ট মেয়েটা।তাই তো মেয়ের সাধ মেটাতে ষষ্ঠীর দিন বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছে।সহকর্মী মৈনাকের সাথে মেয়েকে নিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতে কিছু কেনাকাটা করে। লাল পাড় সাদা শাড়ি, কাঁচের চুড়ি আর একপাতা টিপ কিনে নেয় সুবর্নার জন্য।হঠাৎ মৈনাকের মোবাইলে একটা কল আসে।কথায় আছে,গভীর রাতের ফোন কল মানেই দুঃসংবাদ। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে তার। অফিসের নাম্বার দেখে কলটা রিসিভ করতেই ভেসে আসে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর-উৎসবমুখর পরিবেশে বর্ডার ঘেষা অঞ্চলে হঠাৎ জলদস্যুর উদ্ভবের কারণে মৈনাকের ছুটি বাতিল হয়েছে। ছোট্ট মেয়েটার সাথে পুজো করার জন্য এতদিন ধরে তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন বালির বাঁধের ন্যায় ভেঙ্গে পড়ে। দ্রুত পোশাক পরিধান করে অফিসে উপস্থিত হয় মৈনাক। তারপর কিছু সদস্য নিয়ে বর্ডার ঘেষা অঞ্চলে উপস্থিত হয় সে।রাত 3 টে নাগাদ পরিবেশ যেন হঠাৎ করেই বদলে যায়। আকাশের চাঁদ ততক্ষণে ঘোলাটে হয়ে এসেছে।চাঁদের ম্লান আলোয় তারা দেখতে পায় কয়েকজন মুখোশধারী মানুষকে।জলদস্যুরা সহজে ধরা দিতে চায়না, এক পর্যায়ে গোলাগুলি শুরু হয়। হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে মৈনাকের গায়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।
অন্যদিকে বাবার অপেক্ষায় বসে আছে সুবর্ণা। অপেক্ষার প্রহর যেন কিছুতেই শেষ হয় না। এভাবেই কখন যে ঘুমিয়ে যায় বুঝতে পারে না। শেষ রাতের দিকে বাবাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসে।তারপর দোর খুলে ঘর থেকে বের হয়। চারিদিকে ঢাক ঢোলে,কাসরের বাজনা। হঠাৎ আর্মির পোশাক পরিহিত কয়েকজন মানুষকে দেখতে পায় সুবর্না।বাবা এসেছে ভেবে অবিরাম আনন্দে ছুটে যায় সে।কিন্তু, এই আনন্দ আর সইল না।সাদা চাদরে ঢাকা রক্ত মাখা মুখটা দেখে জ্ঞান হারায় সে।
পুরো পুজো টাই যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। আজ দশমী।সুবর্না তার বাবার কেনা শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে থাকে।রক্তমাখা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। একটু দূরেই দেখতে পায় গাঁয়ের সকলে সিঁদুর খেলায় মেতেছে। অশ্রু ভেজা চোখে ধোঁয়াশার মত ফুটে উঠে যেন বাবার রক্ত মাখা মুখটা। মনে হয় যেন হেসে বলছে- "আমি যে শুধু তোর বাবা নই,দেশেরও সন্তান।এই যে চারিদিকে এত আনন্দ আমিই যে এনে দিয়েছি।পৃথিবীর সব খারাপকে মুছে দিয়ে রঙিন সূর্য নিয়ে এসেছি তোদের জন্য। "হ্যা,তাই তো ভোরের আলোয় বাবার রক্তমাখা মুখটা তো নতুন সূর্যের মতোই প্রজ্জ্বলিত ছিল।সুবর্নার মনে হয়-সব অশুভ আর অসুন্দরকে মুছে দিয়ে যেন সিঁদুরের রং আর রক্ত এক হয়ে মিশে গেছে নবসূর্যের সাথে।
একমুঠো সিঁদুর হাতে নিয়ে সুবর্নাও মেতে উঠে সিঁদুর খেলায়-অশুভ আর অসুন্দরের বিদায়ে।