একলব্য
একলব্য
এই নামটা মনে করিয়ে দেয় অর্থ ও ক্ষমতা জোর করে মেধাকে কিভাবে নষ্ট করে হারতে শেখায়। আর ছাত্র যেমন একলব্য তেমনি গুরু মহাভারতের মহারথী, রাজপরিবারের অস্ত্রগুরু মহাবীর দ্রোনাচার্য্য।
গুরুদক্ষিণা একলব্যর অসাধারণ।
যে দক্ষিণা তিনি দিয়েছেন সব জেনে বুঝেও তা ছিল অসাধারণ। আমরা সবাই জানি তার সেই অসাধারণ গুরুভক্তির কথা।
কিন্তু শুধু কি এটুকুই।
গুরুদক্ষিণা ছাড়াও কিন্তু মহাভারত জুড়ে তিনি রয়ে গেছেন এক বিরাট অংশ জুড়ে
কারন
গুরুদক্ষিণা দেওয়ার পরেই তিনি তার জীবন শেষ করে ফেলেন নি বা থামিয়ে নেন নি।
অসাধারণ বীরত্বের সাথে তিনি পরবর্তী জীবনটা কাটিয়েছেন
তার সেই বীরত্ব গাথা স্মরণ করে আজও এক শ্রেনীর ভারতীয় জনগোষ্ঠী বিশেষ রীতি অনুসরণ করেন
আসুন দেখে নেওয়া যাক তার অনন্য জীবন-
পালকপিতা- হিরণ্যধনুষ
পালকমাতা- সুলেখা
জন্মদাতা পিতা- দেবশ্রভা
সময়কাল- মোটামুটি 7500 বছর আগের
মতান্তরে 9500 বছর আগে বা তারও আগের
পরিচিতি:
************
নিষাদ রাজত্ব বিস্তৃত ছিল বর্তমান এলাহাবাদ থেকে মধ্যপ্রদেশের নর্মদা নদীর উত্তর তটের থেকে গুরগাঁও অব্দি এক বিস্তৃত অঞ্চলে। এই রাজ্যের নাম ছিল শৃঙ্গবেশ্বর মতান্তরে শৃঙ্বেরপুর।
তখন সেই অঞ্চলের রাজা ছিলেন হিরণ্যধনুষ।
যুবরাজ ছিলেন একলব্য।
একলব্য আসলে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয়।
জন্মদাতা পিতা দেবশ্রভা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেবের ভাই। সেই হিসেবে তিনি হলেন শ্রীকৃষ্ণের খুড়তুতো ভাই।
তবে খুব ছোট অবস্থায় একলব্য হারিয়ে গিয়েছিলেন জঙ্গলের মধ্যে। তখন তাকে ব্যাধরাজা হিরণ্যধনুষ আর রানী সুলেখা তাকে খুঁজে পান। তারাই তাকে দত্তক নিয়ে লালন পালন করে পুত্র জ্ঞানে বড় করে তুলেন।
অন্য আরেকটি মতে
একলব্যের জন্মের সময় জ্যোতিষীরা শিশুর জন্মপত্রিকা দেখে বলেন এই বাচ্ছা বড় হয়ে কুলনাশক হবে তাই তার পিতা তাকে জঙ্গলে পরিত্যাগ করেন।
শিশুকাল:
************
শিশু একলব্যের নাম ছিল অভিধায়ুমন্য।
ডাক নাম ছিল অভয়।
পাঁচ বছর বয়স হলে তাকে ভর্তি করা হয় পুলক মুনির গুরুকূলে। সেখানে তিনি অন্য সবার সাথেই শিক্ষা গ্রহন করেন।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায় অস্ত্রশিক্ষার দিকে। তার নিষ্ঠা একাগ্রতা মনোযোগ দেখে মুনি পুলক নতুন নামকরণ করেন একলব্য।
বিবাহ এবং পরিবার:
********************
তার বয়স চৌদ্দ বৎসর হলে পরে তার বিবাহ হয়।
কন্যার নাম সুনীতা।
পরে তাদের দুই পুত্র হয়। একপুত্রের নাম কেতুমান।
যিনি কুরুক্ষেত্রে কৌরব পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন এবং ভীমের হাতে মারা যান।
অপর পুত্রের বেপারে বিশদে কিছু জানা যায় না।
সম্ভবত সেই পুত্রের অকাল মৃত্যু হয়...
অস্ত্রশিক্ষা:
************
বেশ কয়েকদিন হস্তিনাপুরের অদূরে জঙ্গলে বসেছে শিবির। অস্ত্রশিক্ষার। হস্তিনাপুরের ভাবি উত্তরাধিকরি রাজকুমারদের চলছে শিক্ষা।
গুরু দ্রোনাচার্য্যর তত্ত্বাবধানে।
রয়েছে কৌরবদের একশত ভাই সাথে যুযুৎসু। রয়েছেন কর্ণ। রয়েছেন পঞ্চ পান্ডব। পুত্র অশ্বত্থামা।
সবাইকে মনোযোগ দিয়ে শিখিয়ে যাচ্ছেন গুরু দ্রোণ ।
শেখাচ্ছেন বিভিন্ন অস্ত্রের সাথে পরিচিতি। সেগুলোর ব্যবহার। কোন পরিস্থিতিতে কাজে লাগবে কোন অস্ত্র।
সাথে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ। দরকারে ফেরৎ আনা।
সব শিখিয়ে যাচ্ছেন একমনে।
শিখছেন শিক্ষার্থীদের দল।
তবে শিক্ষার্থী শুধু এরাই নন। আরও রয়েছে একজন। জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে একমনে দেখে যাচ্ছে তার দুটি চোখ। তার হাতেও তীর ধনুক।
গুরু দ্রোনাচার্য্যর প্রতিটি মুখনিসৃত শব্দ তার অন্তরে প্রবেশ করছে। মস্তিষ্কে বসে যাচ্ছে।
সেও রাজকুমারদের সমবয়সী। পরনে বাঘ ছাল।
গায়ের রঙ বেশ কালো। তবে লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী। পিঠে তুনির। হাতে ধনুক।
সে দেখছে শুনছে সব। সব বুঝছে।
শিবির শেষ হলেই ফিরে যাচ্ছে জঙ্গলের মাঝে এক জায়গায়। সেখানে তার সাজানো রয়েছে অনুশীলন ক্ষেত্র। একদম সেরম করেই সাজানো যেমনটা রয়েছে গুরু দ্রোনের। সেখানে অনুশীলন করে যাচ্ছে যা সে শুনে এল গুরুর কাছে।
এইভাবে কদিন চলল।
খুব ইচ্ছে হল তার দ্রোনাচার্য্যকে গুরু হিসেবে গ্রহন করার। পিতার কাছে বললেন সব খুলে।
পিতা জানতেন তারা ব্যাধ। শেখাবেন না দ্রোনাচার্য্য।
তবুও তিনি পুত্রের আগ্রহ দেখে সত্যি কথাটা বলতে পারলেন না। শুধু বললেন- তোমার যা ইচ্ছে তাই কর
একলব্যের ইচ্ছে প্রকাশ:
***********************
কয়েকদিন এভাবেই কাটল।
দোনামনায় রইলেন একলব্য।
অতঃপর একলব্য এলেন গুরু দ্রোনাচার্য্যর সম্মুখে।
পরিচয় দিলেন- তিনি একলব্য। জঙ্গলের শিকারী সমাজের তিনি হচ্ছেন যুবরাজ।
তারপর বললেন তার মনের কথা।
তিনি চান শিখতে গুরু দ্রোনাচার্য্যর কাছে।
গুরু দ্রোনাচার্য্য লক্ষ্য করে যাচ্ছেন একমনে একলব্যকে।
তার অভিজ্ঞ চোখ বলে দিচ্ছে এই ছেলেটির মধ্যে রয়েছে প্রতিভা। বলশালী। ক্ষমতাধর। ধৈর্য্যশীল।
শোনার ক্ষমতা রয়েছে যেমন তেমনি রয়েছে ক্ষমতা সেই শোনাকে কাজে পরিনত করার মত যোগ্যতা।
কিন্তু রয়েছে একটাই সমস্যা
সেটা হচ্ছে এই ছেলেটির মধ্যে নেই নিজেকে নিয়ন্ত্রনের শক্তি। নেই সঠিক ভালোমন্দ নির্ণয়ের ক্ষমতা।
এই অনিয়ন্ত্রিত বালককে যদি শেখানো হয় অস্ত্রশিক্ষা তাহলে হয়ে উঠতে পারে পরিণাম ভয়ানক
কিন্তু ছেলেটির ইচ্ছেশক্তির তারিফ করতে হয়।
মনে মনে তিনি ছেলেটির প্রতি সদয় হয়ে উঠছেন।
এরম আগ্রহী শিষ্যই তো চায় সব গুরু।
কিন্তু তিনি সমাজের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি।
সমাজের ভালোমন্দর দায় তারও।
না এই ছেলেকে শেখানো ঠিক হবেনা।
মুখে তিনি বললেন- হস্তিনাপুরের রাজকুমারদের ছাড়া তিনি কাউকে শেখাবেন না এই অস্ত্রশিক্ষা।
শুনে ব্যথিত মুখে চলে গেল সেই বালক।
গুরু দ্রোণ দেখলেন একমনে তার চলে যাওয়ার দৃশ্য।
আহা এরম শিষ্যকে যদি শেখানো যেত, গুরু হিসেবে তার নিজের জীবন স্বার্থক হত।
বালক ফিরে গেলেন তার গোপন জায়গায়।
পুরোন পদ্ধতি অনুযায়ী দেখে, শেখে আর অনুশীলন চালিয়ে যেতে শুরু করলেন।
মাটির দ্রোনাচার্য্য:
****************
সেদিন সন্ধ্যায় শিক্ষা শেষে সবাই ফিরে গেছেন নিজেদের শিবিরে।
একলব্য এলেন সেখানে। যেখানে গুরু দ্রোন দাঁড়িয়ে শিক্ষা দেন। সেখানের মাটি তুলে নিলেন যত্ন সহকারে।
ফিরে গেলেন তার অনুশীলনের জায়গায়।
বানালেন একটি মূর্তি গুরু দ্রোনের।
পরেরদিন থেকে সেই মূর্তি প্রণাম করে শুরু করে দিলেন অস্ত্রশিক্ষা।
অর্জুন-একলব্য দ্বৈরথ:
**********************
কেটে গেল বেশ কয়েকটি দিন।
একদিন জঙ্গলের মাঝে এক বরাহের পিছনে ছুটছেন অর্জুন। সেই বরাহকে বেশ কয়েকটি তীর মেরে ঘায়েল করেছেন অর্জুন। তাও ছুটছে বরাহ।
ওদিকে আরেক শিকারি বেরিয়েছেন জঙ্গলে।
তিনি একলব্য। অযথা তীর তিনি মারছেন না।
নিজেকে যতটা সম্ভব গোপন রেখে দৌড়চ্ছেন তিনি।
বরাহ তার উপস্থিতি সেরমভাবে টের পায়নি।
একলব্য শুধু চাইছেন বরাহের কাছাকাছি গিয়ে একটা সঠিক কোণ খুঁজে পেতে।
বরাহ ছুটতে ছুটতে চলে এল একলব্যর কাছাকাছি।
ব্যাস এসে গেল সুযোগ। চোখের পলকে মারলেন একটিই তীর। সোজা গিয়ে লাগলো বরাহের হৃদপিণ্ডে।
কয়েক পা ছুটেই বরাহ পড়ে গেল।
এসে গেল দুই শিকারি কাছাকাছি।
শুরু হল বিবাদ।
অর্জুন বললেন তিনি প্রথম তীর ছুড়েছেন সেই হিসেবে এই বরাহ তার শিকার। একলব্য বললেন এই বরাহ মরেছে তার তীরে সুতরাং এটা তার শিকার।
একরকম হার মেনে নিয়েই অর্জুন চলে গেলেন...
অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্তি
*****************
পেরোতে লাগলো সময়। কাটতে থাকল দিন।
কয়েক বছর পরে হল শিক্ষা শেষ।
কয়েকদিনের মধ্যেই শিবির গোটানো হবে।
এই সময়টা গুরু দ্রোণ দিয়েছেন সবাইকে ছাড়।
যে যার মত করে বেরিয়ে পড়েছে।
নিজেদের ইচ্ছেমতো কাটাচ্ছে সময়টা।
কৌরব দল বেরিয়েছেন শিকারে। সাথে রয়েছে তাদের কুকুর। কৌরবদের সব ভাই বিশ্রাম নিচ্ছেন এক জায়গায়।
দুঃশাসন এর পেয়েছে খুব জলের পিপাসা।
বেরুলেন জলাশয়ের খোঁজে।
অবশেষে এক জলাশয় পেলেন। পেট ভরে খেলেন জল।
জল খেয়ে চলে আসছেন এমন সময়ে দেখলেন এক অপরূপা সুন্দরী কন্যা।
এক নজরে দেখে চলেছেন দুঃশাসন। চোখের পলক পড়ছে না। জল আনতে আসছে সুন্দরী, কলসী কোমরে।
জলাশয়ে এসে কিছুক্ষণ বসলেন পা ডুবিয়ে।
হাত পা মুখ ধুলেন। তারপর কলসী ভরে জল নিয়ে চলে যাচ্ছেন...
কৌরবদের পতন:
******************
দুঃশাসন দৌড়ে এসে চেপে ধরলেন মহিলাকে।
একরকম অশ্লীল ভাবেই। মহিলা হলেন হতচকিত।
দুঃশাসন বললেন- এরম সুন্দরী মহিলার রাজার মহলে থাকা উচিৎ জঙ্গলে নয়।
মহিলা উত্তরে বললেন তিনি বিবাহিত।
কিন্তু কে কার কথা শোনে।
দুঃশাসন একরকম জোর করতেই থাকলেন
অবশেষে হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলেন মহিলা।
কলসী তার পড়ে রইল। দুঃশাসন নিলেন পিছু।
বাকি কৌরবরা ততক্ষনে চলে এসেছে দুঃশাসনের ডাকে।
একটি কুটির দেখা যাচ্ছে।
মহিলার লক্ষ্য সেই কুটির।
কাছাকাছি আসতেই জোরে চিৎকার করলেন মহিলা। বেরিয়ে এলেন বাঘছাল গায়ে এক যোদ্ধা পুরুষ।
হাতে তীর ধনুক।
মহিলা গিয়ে লুকোলেন তার পিছনে।
সব বললেন তিনি।
সব শুনে সেই পুরুষ দৃপ্ত কন্ঠে বললেন- অশ্লীলতা কোন পুরুষের শোভা পায়না। তাদের উচিত মহিলাদের সম্মান করা। আর আপনার পোশাক বলছে আপনি রাজপুরুষ। আপনার তো আরও উচিত এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। উল্টে রাজধর্ম ভুলে আপনি নিজেই করছেন অন্যায়।
দুঃশাসন বললেন- এই মহিলা রাজ অন্তঃপুরের যোগ্যা এই জঙ্গলে থাকার মত নয়। দরকারে তিনি মহিলার স্বামীকে বধ করে নিয়ে যাবেন মহিলাকে...
এই বলে করলেন আক্রমন।
বাকি কৌরবদের দল আক্রমন করল একযোগে।
কিন্তু সেই যোদ্ধা পুরুষ সংযোজন করলেন একটি তীর। উচ্চারণ করলেন এক মহামন্ত্র। সেই মন্ত্র জাগিয়ে তুলল এই তীরের ক্ষমতা। তারপর মারমূখী কৌরবদের উদ্দেশ্যে চালনা করলেন সেই তীর।সবার মাথায় আঘাত করতে থাকল সেই তীর। প্রতিটি আঘাতের সাথে তাদের প্রাণ হরন করে নিল সেই তীর। একশত কৌরব ভাইয়ের মৃতদেহ যেই পড়ে গেল সেই তীর ফিরে এল যোদ্ধার হাতে। যোদ্ধা পুরুষ রেখে দিলেন সেই তীর নিজের তুনিরে।
কৌরবদের শিকারি কুকুরটি ডেকে চলেছে অবিরাম।
আক্রমন করতে উদ্যত হল যেই বিরক্ত একলব্য চালিয়ে দিলেন একসাথে সাতটি তীর।
সাতটি তীর গিয়ে ভরে দিল কুকুরটির মুখ।
ব্যাস কুকুরটির ডাক হয়ে গেল বন্ধ।
মুখ সে আর বন্ধ করতে পারল না।
যদিও কুকুরটির কোনরকম ক্ষতি হলনা।
তবুও কুকুরটির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল...
শিবিরে:
*********
কুকরটি ফিরে গেল তাদের শিবিরে।
সেখানে অর্জুন তখন অনুশীলনে রত।
দেখলেন কুকুরটিকে। অদ্ভুত এক উপায়ে এই কুকুরটির ডাক বন্ধ। কিন্তু ক্ষতি হয়নি কোনরকম।
তিনি গেলেন গুরু দ্রোনের কাছে। গুরুও দেখে অবাক।
কি অদ্ভুত এই তীর সংযোজন।
মুগ্ধ হলেন তিনি। একে একে হাজির হলেন সমস্ত পান্ডব ভাইরা। সবাই চমৎকৃত হলেন এই অদ্ভুত তীর সংযোজন দেখে।
আলোচনা চলল বেশ কিছুক্ষণ এরপরে ধীরে ধীরে সবার খেয়াল হল কোথায় কৌরব ভাইরা। নেই তো ওরা।
শুধু ওদের কুকুরটি হাজির। মুখে তীর নিয়ে।
কিছু তো হয়েছে নিশ্চয়
পরিস্থিতি জটিল বেশ।
অনুধাবন করতে সময় লাগল না গুরুদেবের।
সবাইকে বললেন অস্ত্র নিয়ে এগুতে।
কুকুরটি আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেলেন কুটিরের কাছে। দেখলেন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কৌরবদের দেহ।
দ্রোনাচার্য্য'র মুখোমুখি:
**********************
এতজনের আওয়াজে বেরিয়ে এলেন সেই যোদ্ধা পুরুষ।
এসে গুরুর সামনে দাঁড়ালেন জোড় হাতে।
সাথে তার স্ত্রী সুনীতা।
বললেন সব খুলে। শুনে চমৎকৃত হলেন গুরু দ্রোন।
অদ্ভুত ক্ষমতা এই যোদ্ধার।
জিজ্ঞেস করলেন তার গুরুর কি নাম
যোদ্ধা বললেন- গুরু তার দ্রোণ ।
তিনি ভুলে গিয়েছেন তার কথা। তিনিই একলব্য।
মনে পড়ে গেল দ্রোনাচার্য্য'র সব কিছু।
এই বালক কিছু বছর আগে এসেছিলেন তার কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে।
তিনি শেখাননি তখন...
আনমনা হয়ে পড়লেন গুরু
এদিকে একলব্য বলে চলেছেন সব কথা।
কিভাবে তিনি গুরুর শিক্ষা প্রতিদিন দেখেছেন
তারপর গুরুর পা এর স্থানের মাটি নিয়ে এসে
গুরুর মূর্তি বানিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে শিখেছেন তিনি গুরুর শেখানো অস্ত্রশিক্ষা।
যোদ্ধা সাদরে নিয়ে গিয়ে দেখালো তার গুরুকে তার অনুশীলন ক্ষেত্র।
একপাশে রয়েছে দাঁড়িয়ে গুরু দ্রোনাচার্য্যর মূর্তি।
পুজো করা হয়েছে তার নিদর্শন বিভিন্ন সুগন্ধি ফুল রয়েছে ইতস্তত ছড়িয়ে।
অবাক হলেন দ্রোনাচার্য্য।
এও সম্ভব। এইরকম মনঃসংযোগ। এই রকম একাগ্রতা। এইরকম নিবেদিত প্রাণ।
এইরকম শিক্ষার্থী পাওয়া ভাগ্যের বেপার।
তবে কৌরবদের প্রাণহীন দেহ পড়ে রয়েছে।
তিনি বললেন একলব্যকে। লঘু পাপে গুরু দন্ড হয়ে গেছে। বন্দী করা উচিত ছিল এই অপরাধে।
এখন তিনি চান কৌরবরা প্রান ফিরে পাক।
"যথা আজ্ঞা" বলে একলব্য সংযোজন করলেন সেই তীর।
সেই তীর আবার প্রতিজন কৌরবদের মাথায় গিয়ে আঘাত করতে শুরু করল। একে একে প্রাণ ফিরে পেতে লাগলেন পান্ডব ভাইরা।
এরপর সেই তীর যথারীতি ফিরে এল একলব্যের কাছে।
সযত্নে রেখে দিলেন নিজের তুনিরে।
গুরুদক্ষিণা:
**************
অতীব চমৎকৃত হলেন দ্রোনাচার্য্য।
তবে তিনি কর্তব্য অবিচল।
বললেন অস্ত্র শিক্ষা তো শেষ।
এবারে ফিরবেন হস্তিনাপুর।
সেখানে তিনি কৌরব পান্ডবদের নেবেন গুরুদক্ষিণা।
এখন একলব্য দিক গুরুদক্ষিণা।
একলব্য জিজ্ঞেস করলেন- কি করতে হবে গুরুর জন্য?
গুরুদেব আজ্ঞা করুন, তিনি তাই করবেন...
গুরু চেয়ে নিলেন তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।
হতবাক হলেন একলব্য।
কিন্তু গুরু আজ্ঞা শিরোধার্য।
তিনি ছুরি দিয়ে কেটে নিলেন নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।
নিবেদন করলেন গুরু দ্রোনকে।
গুরুর আশীর্বাদ:
*****************
আশীর্বাদ দিলেন গুরু দ্রোণ ।
বললেন তার অর্জিত এই ধনুর্বিদ্যা বৃথা যাবে না।
তিনি অচিরেই অন্যতম সেরা ধনুর্বিদ হিসেবে খ্যাতনামা হবেন তবে তিনি যখনই অন্যায়ের পথে যাবেন তখন তার ধনুর্বিদ্যা আর কাজে আসবে না। তখন তার মৃত্যু হবে।
গুরু দ্রোন ফিরে গেলেন হস্তিনাপুর।
তার সমস্ত শিষ্যদের নিয়ে...
গুরু দ্রোনাচার্য্য তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ গুরুদক্ষিণা হিসেবে স্বীকার করার পর কিন্তু থেমে থাকলেন না একলব্য। তিনি তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে তীর ধরবার অনুশীলন চালিয়ে গেলেন। খুব শীঘ্রই সফলও হলেন।
মধ্যমা ও তর্জনী দিয়ে তীর ছুঁড়বার এক অন্য কৌশল রপ্ত করেন।
হয়ে উঠলেন এক অনন্য যোদ্ধা।
এক অনন্য তীরন্দাজ।
শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধের দ্বৈরথ:
***************************
এদিকে শ্রীকৃষ্ণ ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন মামা কংসের শ্বশুর জরাসন্ধের আক্রমণে। হঠাৎ হঠাৎ আক্রমন করে জরাসন্ধ প্রভুত ক্ষতি করছেন মথুরার। লোকজন মারা যাচ্ছে। ঘর সম্পদ ফসলের নষ্ট হচ্ছে।
নিষাদ ব্যাধরাজ হিরণ্যধনুষ খুবই উপকৃত হয়েছিলেন জরাসন্ধের দ্বারা। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি যেকোন যুদ্ধে সহায়তা করতেন জরাসন্ধকে।
সেই হিসেবে পরবর্তী যুবরাজ একলব্য ছিলেন জরাসন্ধের পক্ষে।
জরাসন্ধ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মামা কংসের শ্বশুর।
জামাতা কংসর বধের পরে জরাসন্ধের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে শ্রীকৃষ্ণের উপরে। আর যেহেতু নিষাদরা সাহায্য করত জরাসন্ধকে সেই সূত্র ধরে একলব্য হয়ে যান
শত্রু শ্রীকৃষ্ণের।
রুক্মিণী শ্রীকৃষ্ণ প্রেমকথা:
******************************
বিদর্ভ রাজ ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণী।
এদিকে রুক্মিণী আর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে বাড়ছে প্রেম। ব্যাপারটা জানাজানি হতে সময় লাগলো না।
ঠিক হল বিয়ে দেওয়া হবে দুজনের।
কিন্তু বাধ সাধলেন ভাই রুক্মিনী ।
তিনি কোনভাবেই এই বিয়ে দিয়ে জরাসন্ধের রোষের মুখে পড়তে রাজি নন। কারন জরাসন্ধ চেয়েছিলেন রুক্মিনীর বিবাহ হোক বন্ধু শিশুপালের সাথে।
মূলতঃ কূটনৈতিক কারণেই রুক্মিনী এই বিবাহের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি তার পরিবারকে বুঝিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন এই বিবাহ সমস্ত বিদর্ভ রাজ্যকে বিপদে ফেলতে পারে। এমনকি রাজা ভীষ্মক পর্যন্ত সিংহাসন চ্যুত হতে পারেন।
উল্টোদিকে শিশুপালের সাথে বিবাহ সব দিক থেকেই তাদের রাজত্ব শক্তিশালী করবে। সবদিক থেকে রক্ষাও করবে।
তাই ঠিক হল চেদিরাজ শিশুপালের সাথেই বিবাহ দেওয়া হবে রুক্মিণীর।
উল্লেখ্য
শিশুপাল ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের আরেক মাসতুতো ভাই। পিতা বাসুদেবের আরেক বোন ছিলেন শ্রুতদেবী।
তারই পুত্র ছিলেন শিশুপাল।
গোপনে দ্রুত চিঠি পাঠালেন রুক্মিণী, শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে।
বিষয়বস্তু ছিল- যেন তাকে অপহরণ করেন শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায়। কোনরকম যুদ্ধ নয়।
তিনি চান না তার আত্মীয়রা কেউ মারা যাক...
সেই চিঠি পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ অপহরণ করলেন রুক্মিনীকে।
এই অপহরণের সময় শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন নিরস্ত্র।
তিনি কোনরকম অস্ত্র নেন না, যাতে যুদ্ধ এড়ানো যায়।
কারন সেইসময় নিরস্ত্র কারুর সাথে যুদ্ধ করা ছিল অন্যায়। কাপুরুষতা।
অপহরণের খবর পেয়ে শিশুপাল তাড়া করলেন শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে। সাথে এলেন একলব্য।
অবশেষে যখন একলব্য প্রায় শ্রীকৃষ্ণকে ধরে ফেলেন।
তখন সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন শ্রীকৃষ্ণ একলব্য।
সামনে পড়ে থাকা একটি বড় পাথর তিনি তুলে আছড়ে দেন একলব্যের মাথায়।
জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন একলব্য।
চাইলে বধ করতে পারতেন শ্রীকৃষ্ণ।
কিন্তু রুক্মিণীর কাউকে বধ না করার ইচ্ছের সম্মান রেখে শ্রীকৃষ্ণ তাকে ছেড়ে দিলেন।
সাময়িক সন্ধি:
***************
শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীর বিবাহের পরে একলব্য ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে দুজন চলতে শুরু করেন।
এরপরে হয় রাজসূয় যজ্ঞ।
রাজসূয় যজ্ঞ এর সময়ে একলব্য একজোড়া নতুন জুতো ভেট দিয়ে সম্মান জ্ঞাপন করেন যুধিষ্ঠিরকে।
একলব্যের প্রতিজ্ঞা:
*********************
কিছুদিনের মধ্যেই
শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় মল্লযুদ্ধে ভীম বধ করেন জরাসন্ধকে। উপকারী রাজার এহেন মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন একলব্য।
তিনি প্রতিজ্ঞা করেন। দ্বারকা সমেত শ্রীকৃষ্ণ সহ সমস্ত যাদবদের হত্যা করবেন।
সেই অনুযায়ী তিনি বারংবার সুযোগ খুঁজতে থাকেন দ্বারকা আক্রমনের।
শেষে একবার ভয়াবহ আক্রমন করেন।
কিন্তু পরাজিত হন।
সবকিছু খুইয়ে ভয়ঙ্কর রকমের আহত হয়ে তিনি ফিরে আসেন দুর্যোধনের কাছে।
দুর্যোধন তখন তার সহায়তা করেন।
একলব্যকে রাজা করে দেন সমগ্র হস্তিনাপুরের আশেপাশের জঙ্গল এলাকার। সাথে প্রভুত অর্থ সম্পদ সাহায্য করেন।
মৃত্যু:
******************
এরপরে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমনের ছক করতে থাকেন। শেষে একদিন দুর্যোধনের অনুরোধে নিরস্ত্র শাম্বকে পেয়ে তাকে বন্দী করেন।
পুত্রের খোঁজে আসেন পিতা।
একলা পেয়ে নিরস্ত্র শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমনের চেষ্টা করলে শ্রীকৃষ্ণ আবার একটি বড় পাথর নিয়ে মারেন একলব্যের মাথায়। খুলি টুকরো হয়ে ভেঙে মারা যান একলব্য।
শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদ:
*******************
মারা যাওয়ার আগে একলব্যের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে গুরু দ্রোনাচার্য্যর উপরে। তিনি বলেছিলেন যদি একলব্য তার অধীত বিদ্যার যদি অপপ্রয়োগ করে তাহলে সে মারা যাবে। সেই অভিশাপ যদি না দিতেন দ্রোনাচার্য্য তাহলে আজ তিনি তার প্রতিশোধ নিয়ে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারতেন।
মৃত্যুর আগে একলব্য তাই শ্রীকৃষ্ণর কাছে চান আশীর্বাদ দ্রোনাচার্য্য বধের
শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে দ্রোনাচার্য্য বধের আশীর্বাদ দিয়ে দেন।
এই আশীর্বাদের ফলে একলব্যের পুনর্জন্ম হয় ধৃষ্টদ্যুম্ন রূপে রাজা দ্রূপদের ঘরে।
তারপর কি হল?
সে আরেক গল্প..
****************************
কি বলা যায় একলব্যকে?
নিষ্ঠা ধৈর্য্য সাহস ভক্তি বীরত্ব কোনকিছুই তো কম ছিল না।
ছিল না শুধু নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।
ছিল না ভালোমন্দ নির্ণয়ের ক্ষমতা।
এটুকুই তাকে তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করে ফেলেছিল।
তাহলে কি এটাই শিক্ষা মহাভারতের?
একলব্যের জীবনীর মাধ্যমে এটাই বলে মহাভারত
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ আর ভালোমন্দ নির্ণয় আগে
শিশু অবস্থায় থেকেই অনুশীলন করতে হবে
নাহলে পরে যতই শেখ, যতই উপযুক্ত হও, সব বিফলে যাবে
আরেকটা প্রশ্ন ভাবায়
সেটি হল জ্যোতিষীরা বলেছিলেন এই শিশু হবে কুলনাশক। পরে সেটি যথার্থ প্রমাণিত হয়েছিল যখন নিজের কাকার ছেলে শ্রীকৃষ্ণের বিপক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। বধ করেছিলেন নিজের বংশ যদু বংশের অনেককে।
তাহলে সবই কি পূর্ব নির্দিষ্ট?
আমরা কি শুধুই সময়ের হাতের পুতুল?
কে জানে হয়ত তাই হবে
তবে প্রত্যেকের ভূমিকা যাই হোক না কেন, দিতে হবে নিজের সেরাটা। এটাই হয়ত জীবনের বৈশিষ্ট্য...
বর্তমান যুগে প্রাসঙ্গিকতা:
************************
আজও মধ্যপ্রদেশের গহীন জঙ্গলে থাকেন নিষাদ সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষ আজও তীর ছুঁড়েন তর্জনী আর মধ্যমা ব্যবহার করে।
তারা এভাবেই সম্মান জানান তাদের পূর্বপুরুষ একলব্যকে।
বর্তমান গুরগাঁও এর অদূরে খাঁদসা নামের এক গ্রামে এক মন্দির রয়েছে যেখানে একলব্য তার গুরুকে দিয়েছিলেন নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দক্ষিণা।
বলা হয় এই মন্দিরের স্থানে, একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন গুরু দ্রোনাচার্য্য।
তারপর সেখানে মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন নিজের হাতে। সেই হিসেবে এই মন্দিরটি মহাভারতের সময়কালের।
এছাড়াও উল্লেখ্য যে এই মন্দির থেকেই 10 কিমি দূরে রয়েছে গুরু দ্রোনাচার্য্য মন্দির।
এই দ্রোনাচার্য্য মন্দির ঠিক সেখানেই তৈরি যেখানে থাকতেন গুরু দ্রোনাচার্য্য।
এই গুরুগ্রাম বর্তমানে যার নাম গুরগাঁও সেটি দান করেছিলেন পিতামহ #ভীষ্ম যখন দ্রোনাচার্য্য হয়েছিলেন কৌরব পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু।
আজ কর্ণাটক সরকার চালু করেছে একলব্য খেল রত্ন পুরস্কার। এই পুরস্কারটি দেওয়া হয় খেলায় যারা বিশেষ ভাবে বিশেষত্ব অর্জন করেছেন।
প্রশ্ন উঠতেই পারে
অর্জুন ভীম কর্ণ এসব মহারথীদের বাদ দিয়ে কেন একলব্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে
মনে রাখতে হবে একলব্যের আঙ্গুল ছিল না
তা সত্ত্বেও তিনি অন্য আঙ্গুল দিয়ে অন্যভাবে সেই বাধা অতিক্রম করেছেন।
জীবনের বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে যারা খেলায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তাদের জন্যই বিশেষত এই পুরস্কার।
