একজন সাদাকালো বাবা
একজন সাদাকালো বাবা
দুপুরের শেষ বেলাতে কলেজ থেকে ফেরার পথে ভিড় বাসে উঠে দেখি ঘড় ছোটা মানুষের ক্লান্ত মুখের মিছিল । পিছনের দিকে নারী সম্ভ্রম বাঁচিয়ে পঞ্চাষর্ধো এক সাদাকালো লোকের পাশে বসে পড়লাম। লোকটা খুবই বিনয়ী, পাশে বসা মাত্র আমাকে বললেন,
"তুমি চাইলে জানালার কাছে বসতে পারো "
ভ্রুকুটি করে আমি বললাম,
"না না আঙ্কেল অসুবিধা নেই...থ্যাংকস "
পুরুষের চোখ যে কখন কি চেয়ে বসে,ভিড় হলে শরীরের আকুতি জেগে ওঠে,প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় এ আমার বেশ জানা হয়েছে !
কিছুদুর যেতেই বাস থেমে গেলো,শহরের চীর পরিচিত ট্রাফিকজ্যাম । হঠাৎ পাশের লোকটা আমার দিকে খুলে ফিসফিস করে বললো-
মা, তোমার কাছে একটু খাবার জল হবে কি ? কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমার সাথে জল না থাকায় বললাম-"স্যরি আঙ্কেল, আমার
কাছে কোনখাবার জল নেই।" লোকটা বিনয়ের সাথে আমাকে ঠিক আছে বলে উদাস চোখ মেলে বাসের ভাঙা কাঁচের ফাঁকে আকাশের
দিকে চাইলো !
কিছুক্ষন পর নিজের খেয়ালেই আমাকে বলা শুরু করলো, " জানো মা, তোমার মতো আমারও একটা মেয়ে আছে গো, কলেজের হলে থাকে। আমি থাকি কল্যাণীতে,ওখানে আমার একটা ছোট মুদি'র দোকান আছে, আমার মেয়েটার মা নেই,গ্রামে আমার এক রত্তি ছোট ছেলেটা থাকে
তার কাকুর সাথে ।ফোনে আমি প্রতিদিনই আমার মেয়ের সাথে কথা বলি, ফোন করলেই মেয়ে আমাকে জানায়,সে ক্লাসে আছে অথবা লাইব্রেরীতে আছে নইলে হলে পড়ছে,পড়ার খুব চাপ যাচ্ছে,সামনে এক্সাম। আমিও খুব খুশী হই, এত খুশী হই যে চোখে জল চলে আসে । মেয়েটাকে আমি অনেক পড়ালেখা করাতে চাই, যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়েই। আমার মেয়েটার কোন আশাই আমি অপূর্ন রাখিনি,
যা চেয়েছে তাই দেয়ার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু,ভাগ্য বোধহয় বিধানে অন্য কিছু লিখেছেন, গতকাল বিকেল থেকে মেয়েটার ফোন বন্ধ পাচ্ছি, অনেক অপেক্ষায় থেকে আমি হলের এক টিচারকে ফোন দেই, টিচার আমাকে কিছুক্ষণ পর ফোন দিতে বলেন । আমি কিছু বাদে ফোন দিত
েই শুনি,সেই টিচার খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছেন আমার মেয়ে ৫ দিন হলো হলে নেই,সে নাকি বাড়ি যাবার জন্য ছুটি নিয়েছে ! কথাটা শোনামাত্র আমি টিচারকে বললাম, আমার ভুল হয়েছে স্যার, আমি বাড়িতে ফোন না করেই আপনাকে ফোন করেছি, আমি সত্যি দুঃখিত।"
আমি কিছুটা বিব্রতভাব আর আগ্রহ নিয়ে মাঝবয়সী মানুষটার কথা শুনছিলাম ! তারপর লোকটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "জানো মা, আমার মেয়েটা বাড়িতে যায়নি, কালও ওর সাথে আমার কথা হয়েছে,
সে নাকি ক্লাসেই ছিলো।গতরাতে আমি মোটেও ঘুমাতে পরিনি গো মা, অনেক
খোঁজ খবর নেবার পর মেয়ের এক বান্ধবীর
কাছে মাত্র জানতে পারলাম আমার মেয়েটা নাকি এখন দীঘা আছে ! এক ছেলের সাথে সাত দিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছে ! ....
তোমাকে কথাগুলো কেন বলছি জানি না মা, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো ? "
আমি মাথা নেড়ে না বললাম ! লোকটা আবার বলতে শুরু করলো, "আমার মাথাটা কাজ করছেনা, কাউকে কিছু জানাতেও পারছি না, এতে মেয়ের সন্মান চলে যাবে। তাই তোমাকে বলে একটু হালকা হলাম,কিছু মনে করোনা মা"। এইটুকু বলে লোকটা আবার আকাশের
দিকে চাইলো । আমি স্পষ্ট দেখলাম লোকটা কাদঁছে, তার শরীর কেপে কেপে উঠছে !
আমি মলিন চোখে এক বাবার কান্না দেখলাম, মেয়ে'র সন্মান চলে যাবার ভয়ে একজোড়া স্বপ্নমাখা পিতার চোখের কান্না ! একজন স্নেহময় বাবার বুকের চিৎকার আর আর্তনাদ যেন শুনতে পেলাম আমি ! আর সাথে সাথে নিজ মনে আমার বাবার মুখটা ভেসে উঠলো... আমি জীবনের অসংখ্যবারের মতো আবারও
মনে মনে বাবাকে প্রমিজ করলাম, আমি এমন কিছু করবো না যেন কোন ভিড় বাসে একদিন মেয়ের জন্য তাকেও কাঁদতে হয় !
আমি কিছুটা অপরাধি চোখে লোকটার হাতের উপর হাত রাখলাম, একজন পিতার অস্রুচোখে চোখ রেখে সেই অভাগা সন্তানদের জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম,যাদের সময়ের আমিও একজন প্রতিনিধি। সেই ভিড় বাসের সাদাকালো লোকটা জলচোখে তখন ও জানালার আকাশে যেন তার আদরের মেয়েটাকে খুঁজে ফিরছিলেন !