Debdutta Banerjee

Drama

3  

Debdutta Banerjee

Drama

এক অন্য রকম রূপকথা(শেষ পর্ব)

এক অন্য রকম রূপকথা(শেষ পর্ব)

7 mins
16.7K


দিয়া ভুরু কুঁচকে ওকে দেখছিল। কোন রকম সৌজন‍্য না দেখিয়েই মুখ বেঁকিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে খেতে বসে গেল ,ঐ অন্য মহিলা এসে ওদের পরিবেশন করছিল। 

তিন্নি পায়ে পায়ে নিজের ঘরে চলে এলো। খুব মা'র কথা মনে পড়ছিল আজ। মা কে না জানিয়ে জীবনে প্রথম এতো-বড় একটা ডিসিশন নিজে নিয়েছিল সে। আসলে নিজের বাড়িটা দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা ছিল ভেতরে। ছোট থেকেই সে জানত তার বাবা নেই। মা একাই একটা স্কুলে পড়িয়ে তাকে মানুষ করছিল। ছোটবেলা বাবার কথা জানতে চাইলে মা তাকে এক রূপকথার গল্প বলতো। বড় হতেই একদিন মা তাকে খুলে বলেছিল আসল সত্য। তার উচ্চ শিক্ষিতা মা রমা দেবীর বিয়ে হয়েছিল এই নারায়নগড়ের জমিদার বাড়িতে। শিক্ষা আর সৌন্দর্যের সাথে মায়ের বংশ মর্যাদা থাকলেও সেই সময় দাদু না থাকায় মামা আর দিদা তেমন খোঁজ না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। আসলে দাদুর রাজ রোগের চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত দিদা আর মামা এই বিয়ের প্রস্তাবে হাতে স্বর্গ পেয়েছিল। মা অনেক বলেছিল একটু সময় দিতে তাকে। একটা চাকরী সে পেয়েই যাবে। কিন্তু মায়ের কথা কেউ শোনে নি। পাহাড়ে কনভেন্টে পড়া রমা দেবীকে এক মাথা ঘোমটা দিয়ে এক গা গহনা পরে সব শিক্ষা আর সংস্কারকে ভুলে এই বাড়ির বৌ হয়ে আসতে হয়েছিল। আর বৌভাতের রাতেই জানতে পেরেছিল এই বাড়ির একমাত্র পুত্র শুধু অশিক্ষিত নয়, একটা মদ্যপ লম্পট। কিন্তু এ বাড়ির বৌদের পুরুষদের উপর কথা বলা বারণ। আর রাজ- রক্তে অমন দোষ একটু আধটু নাকি থাকেই। রমা-দেবী মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। তবে শাশুড়ি পরমা দেবী ওকে আগলে রাখতেন দু হাতে। বাড়ির কাজ কিছুই করতে হতো না, বিশাল লাইব্রেরিতে বই পড়ে আর গান শুনে আর পূজা আচ্চায় সময় কেটে যেত। স্বামী শৌর্য নারায়ণ অর্ধেক দিন মদে চুর হয়ে ভোর রাতে বাড়ি ফিরত। কখনো ফিরত না। দিনের বেলা তার অন্য রূপ, স্ত্রী শিক্ষিতা বলে বেশি কাছে আসত না সে। এই দম বন্ধ করা পরিবেশে এক বছর কাটিয়েও রমা-দেবী বংশধরের খবর দিতে পারেনি, আসলে স্বামীর সাথে সম্পর্কই গড়ে ওঠে নি সে ভাবে। 

এই সময় এ বাড়িতে এসেছিল রমা-দেবীর দূর সম্পর্কের দেওর রূপ। বয়সে হয়তো রমা-দেবীর থেকে কয়েক বছরের ছোট। ও ভর্তি হয়েছিল এখানকার এক কলেজে। শিক্ষিত বৌদির সাথে দেওরের সম্পর্কটা ছিল হনুমান আর সীতার মতোই পবিত্র। ছোট ভাই এর মতো আদরে শাসনে রূপকে বেঁধে ফেলেছিল তার বৌরানী। ঘন্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরীতে তাদের সাহিত্যচর্চা চোখে পড়েছিল শৌর্যের। এই অসম বয়সী বন্ধুত্ব সহ্য হয়নি তার স্বামীর। বেশ কিছুদিন লক্ষ্য করে স্ত্রীর উপর স্বামিত্ব ফলাতে গেছিল সে। ততদিনে রমা-দেবীও পুরানো হয়ে মুখ খুলতে শিখেছে। কিন্তু প্রবল পরাক্রমে স্ত্রী কে নিজের পায়ের কাছে নতজানু দেখতে ইচ্ছুক শৌর্য অত্যাচারের রাস্তাই বেছে নিয়েছিল। স্ত্রী কে ধর্ষণ করে পুরুষত্ব দেখাতেই সে ভালবাসতো। আর সব সময় ভয় দেখাতো রূপকে মেরে ফেলার। ঐ একটা দুর্বলতা ছিল রমা-দেবীর। রূপের এ ব্যাপারে কিছু করার ছিল না, সে নিজেই আশ্রিত এ পরিবারে। দাদার অত্যাচার সে নীরবে মেনে নিত।এভাবেই একদিন রমা দেবী টের পেয়েছিল তার মধ্যে বংশধরের অস্তিত্ব, শাশুড়ির মধ্যস্থতায় রাতের অত্যাচার বন্ধ হল এবার। সাত মাসে সাধ দিয়ে তাকে কলকাতায় মায়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল। শ্বশুর বলেছিলেন বংশ প্রদীপ নিয়েই ফিরতে। 

কিন্তু কপালে যদি সুখ না থাকে কে কি করতে পারে। মেয়ে হওয়ার খবরে সবাই ভেঙ্গে পড়েছিল। শ্বশুর নাতনীর মুখ দেখতেও যাননি। বাপের বাড়ি থাকতে থাকতে শক্ত হয়ে উঠেছিল রমা দেবী। এর মধ্যেই খবর পেয়েছিল রূপ ছাদ থেকে পরে মারা গেছে । সবটাই পরিষ্কার হয়ে গেছিল চোখের সামনে। মেয়েকে আঁকড়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিল সে। এক খুনি লম্পটের সংসারে আর ফিরে যায়নি। স্কুলে চাকরী নিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠে গেছিল একাই। এক বছর পর খবর পেয়েছিল শৌর্যের আবার বিয়ে দিচ্ছে ওর বাবা। প্রতিবাদ করে নি সে। সিঁদুর পরা বন্ধ করে নিরামিষ খেতে শুরু করেছিল। ভগবান বোধহয় আর সইতে পারেন নি। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই শৌর্য রোড এ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। আর তক্ষুনি জানা যায় নতুন বৌ অন্তঃসত্ত্বা। দীর্ঘ ন মাসের পূজা পার্বণ যজ্ঞ সব কিছু উপেক্ষা করে এ বারেও এলো কন্যা সন্তান। এ খবরে বিছানা নিয়েছিলেন প্রতাপ নারায়ণ চ‍্যাটার্জী। এতটুকু মায়ের কাছেই শোনা।

নাতনী দিয়াকে কোলে নিয়ে বিধবা ছোট বৌ এ বাড়িতেই ফিরেছিল। কিন্তু রমা দেবী কোনদিন আসেনি কোনো দাবী নিয়ে।

দরজার ঠকঠক আওয়াজে সম্বিত ফেরে তিন্নির। ওড়নাটা গায়ে দিয়ে দরজা খুলতেই সামনে দিয়া।

তিন্নিকে দেখে হিস হিসে গলায় বলে ওঠে -" এখানে আসার কারণ যদি সম্পত্তির দাবী হয়, ফিরে যেতে দেবো না তোকে। এ সব আমার। তুই এসেছিস যখন বন্ডে সই দিয়ে যাবি যে তোর কোনো দাবী নেই।"

তিন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। দিয়া বলে, -" এখন চল বুড়োর ঘরে, ডাক পড়েছে দু-জনের।"

তিন্নি ওর পেছন পেছন আবার প্রতাপ নারায়ণ চ‍্যাটার্জীর ঘরে যায়। ঘরে দু জন লোক, একজনের কালো কোট বলছে সে উকিল। অন্য জনের গলার স্টেথো বলছে সে ডাক্তার। এছাড়া বড়মা, আর দুপুরের সেই মহিলা রয়েছেন। বৃদ্ধ ওদের বসতে বলে বলতে থাকেন,-" আজ আমার বংশে বাতি দেওয়ার লোক নেই। আমার দুই নাতনী এই সম্পত্তির ভাগ পাবে সবাই হয়তো তাই ভাবছে। কিন্তু আমি অন্য কিছু ভেবেছি। আমার বন্ধু দিবাকরের দুই উপযুক্ত নাতি রয়েছে, তারা ব‍্যবসা করে। ভাল পরিবার। আমি ঠিক করেছি আমার দুই নাতনীর সাথে এদের বিয়ে দিয়ে তবেই সম্পত্তি এদের ওয়ারিশের নামে করে যাবো। আর যদি নাতনীরা এতে রাজি না হয় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে।"

ঘরে অপার নিস্তব্ধতা। 

হঠাৎ দিয়া বলে ওঠে,-" তুমি জান আমি অভিকে ভালবাসি। ওকেই বিয়ে করবো। কেন এসব বলছ?"

-" করো, আমি বাধা দেবো না। এই সম্পত্তির জন্য অভি তোমার আগে পিছে ঘোরে। সম্পত্তি না পেলে ও তোমার দিকে তাকিয়েও দেখবে না।"

-"কিন্তু আপনি এটা করতে পারেন না। দিয়ার একটা ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই ?" ঐ মহিলা দিয়ার মা বলে ওঠে।

-" দিয়া যদি মানুষ হতো ,তুমি যদি ওকে মানুষ করতে, তবে হয়তো এমন বলতাম না। আর সাঁঝবাতি কে আমি এখনো চিনি নি, তবে যে টুকু খোঁজ নিয়েছি ওর জীবনে কেউ নেই। আর বড় বৌমা ওকে ভালোই মানুষ করেছেন। ও আমার কথা রাখবে ।" বৃদ্ধ গমগমে গলায় বলেন।

-" কিন্তু ওরা আজ চব্বিশ বছর এ বাড়িতে নেই, ওদের আবার কিসের দাবী? " চিৎকার করে ওঠে দিয়ার মা। বলে, -" এতো-বছর সব সহ্য করে এই বাড়িতে পড়ে রয়েছি কি এসব শোনার জন্য ? আমি এসব মানবো না। "

তিন্নির ভাল লাগছিল না। এ বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক ঠিক কোথায় সে বুঝে পায় না। সে নিজেও চাকরী করে, মা ও চাকরী করে, যথেষ্ট সচ্ছল না হলেও দু জনের দিব্যি চলে যায়। এ সম্পত্তির লোভে নয়, এ বাড়ির গল্প শুনে বাড়িটা আর বাড়ির লোকদের একটি বার দেখার জন্য সে এসেছিল।কৌতূহলের অবসান হয়েছে।

 সে ধীরে ধীরে বলে, -" আমি এ সব কিছুই চাই না। আমি কাল মা এর কাছে ফিরে যাবো। এই বাড়িটা আর আপনাদের দেখতে এসেছিলাম। এ অভিশপ্ত সম্পত্তি আমি নিতে চাই না। আর বিয়ে আমি মায়ের কথা মতো করবো। মা আমায় একা বড় করেছে, জীবনের কঠিন সময়টা একা মায়ের ভরসায় কাটিয়েছি। আমার একটাই পরিচয়, আমি রমা দেবীর মেয়ে সাঁঝবাতি, এই চ‍্যাটার্জী পদবীটা যদি ছুঁড়ে ফেলতে পারতাম ভাল হতো। কিন্তু হায় আমাদের সমাজ!! পদে পদে এখানে একটা পদবী প্রয়োজন, সে পদবী মালিক যদি জানোয়ার ,খুনি, রেপিষ্ট ও হয় কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কিন্তু পদবী না থাকলে সে খারাপ, বেজন্মা। যেন সে নিজের ইচ্ছায় এ পৃথিবী তে এসেছে। যাই-হোক, আমি কাল ভোরেই ফিরে যাবো। আমাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন না দয়া করে।" আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে যায় তিন্নি। এ ঘরে তখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

পরদিন সকালে তিন্নি বেরিয়ে আসার আগে শেষবার প্রতাপ নারায়ণের ঘরে ঢোকে বিদায় নিতে। অসহায় বৃদ্ধর চোখে জল। বলেন, -"এ বাড়ি ছেড়ে আমাদের ছেড়ে যাস না মা। এ বুড়ো বয়সে আর শক্তি নেই লড়াই করার। এ সব তোদের সম্পত্তি, বড় বৌমাকে ডাক, সব বুঝিয়ে দিতে চাই।"

 তিন্নি বলে -" আপনি কোনো ট্রাষ্ট বা অনাথ আশ্রমকে দিয়ে দিন এসব। আমরা এসব নেবো না। ট্রাষ্টকে দিলে আপনার নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে চিরদিন। " 

ও ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে ও বাড়ি ছেড়ে। পরমা-দেবী তিনতলার ঠাকুর ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখেন। আপন মনে বলেন, "দুর্গা দুর্গা।"

 বাইরে আসতেই তিন্নি দেখে কালকের সেই বৃদ্ধ রিক্সা ওয়ালা দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই রিক্সায় চড়ে এগিয়ে যায় ষ্টেশনের দিকে। মা জানত এক বন্ধুর বাড়ি এসেছে সে। মা কে ফোনে বলে দেয় সে ফিরে আসছে। ট্রেনের অপেক্ষায় শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়ায়। সকালের এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ছুঁয়ে যায় তাকে।মনটা ভাল হয়ে যায়। রূপকথার দেশ থেকে এবার বাড়ি ফেরার পালা।

বেশ কয়েক মাস পর রেজিস্ট্রি পোষ্টে একটা মোটা খাম আসে তিন্নির নামে। খুলে দেখে একটা ট্রাষ্টের কাগজ, তাকে ট্রাষ্টি করে নারায়ণগড়ের সব সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে গরীবদের উদ্দেশ্যে। আর একটা চিঠি, প্রতাপ নারায়ণ সস্ত্রীক বেনারস চলে গেছেন সন্ন্যাস নিয়ে । দিয়া আর তার মা কে মোটা মাসোহারা আর শহরের বাড়িটা দিয়ে গেছেন।

তিন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দলিলের দিকে!

সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama