দূর_তবু_দূর_নয়
দূর_তবু_দূর_নয়
অরুন্ধতী একাই চলল দিল্লী ট্রেনে করে। ফরাসি দূতাবাসের রিসেপশনিষ্টের পোস্টের জন্য চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে,এই প্রথম একাকী যাত্রা তার। একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগলেও মেনে নিয়েছে ও,এখন থেকে একাই তো ওকে পথ চলতে হবে,হাত ধরবার কেউ নেই পাশে। এদিকে মনে মনে উত্তেজনা,কি হয় কি হয়। কতদিন থেকে একটা চাকরির জন্য ছটফট করছে,যদি লেগে যায়,মনে মনে প্রার্থনা করে ও। ট্রেনটা যে থেমে আছে সে খেয়ালও নেই ওর। একসময় জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখে 'মুঘলসরাই' স্টেশন এসে গেছে। দৃষ্টি সরিয়ে নেবার সময় হঠাৎই চোখে পড়ল কুণাল,ওর প্রাক্তন স্বামী,ওই ট্রেনেরই যাত্রী সেও,প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিল যাতে কুণালের সঙ্গে চোখাচোখি না হয়ে যায়। কুণাল কি ওকে দেখেছে নাকি? বুঝতে পারছে না। সেই বাড়ী ছেড়ে আসার পর কুণালের মুখ আর দেখেনি ও তবু কেন আজ এতদিন পর বুকের মাঝে এমন ধড়াসধড়াস শুরু হল ওর? ও তো কুণালকে ঘৃণা করে এখন। তবে,তবে কেন? ঘৃণার মাঝেও কি ভালবাসা লুকিয়ে রয়েছে ওর অবচেতনে? চাকরীর চিন্তা মাথা থেকে উধাও,সবটুকু জুড়ে এখন শুধুই কুণাল। মনে মনে আজ ফিরে গেল সেই প্রথমদিনে, যেদিন কুণালের দৃষ্টিতে ছিল তার জন্য আবেশ মাখানো। সেই দৃষ্টিতেই তো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল ও।
কলেজ লাইব্রেরীতে সদ্য কলেজে ঢোকা অরুন্ধতী একটা বইয়ের খোঁজ করার সময় ফার্স্ট ইয়ারের কুণালের সঙ্গে হল পরিচয়। সেই প্রথম পরিচয়েই কুণালের দৃষ্টিতে বাঁধা পড়েছিল ও। ক্রমে লাইব্রেরীতে দেখা হতে লাগল প্রায়ই। লাইব্রেরী যাওয়াটাও একটা নেশার মত হয়ে গেল দু'জনেরই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। পড়া কত হত তা ওরাই জানে,কিছু সময় পরপরই হত ওদের চারচোখের দৃষ্টি বিনিময়,পরে শুরু হল হাসি বিনিময়,দু'জনেই বুঝল দূরে দূরে থাকা আর সম্ভব নয়,তাই এল কাছাকাছি,পাশাপাশি। হল মন দেয়া নেয়া। কুণাল দেরি করেনি বেশি সুন্দরী বিত্তবান বাবার মেয়েকে গেঁথে ফেলতে। সে অরুন্ধতীকে পড়াশুনায়ও সাহায্য করত। এভাবে সম্পর্কটা গাঢ় ও দৃঢ় হল ক্রমে।
কুণাল গ্র্যাজুয়েশন করে কলেজ ছাড়ে,মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে,চাকরীর জন্য প্রস্তুতি নেয় আর দু'বেলা টিউশন। দেখা হত কম। দুজনেই অস্থির দেখা করার জন্য। এরই মধ্যে কুণাল একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরী জোগাড় করে ফেলল আর অরুন্ধতীকে বিয়ে করতে চাইল। "বিয়ের পর বাকী পড়াটুকু হবে,আমার কাছে থেকে যত খুশি পড় তুমি,এটাই আমার ইচ্ছে। তোমায় ছেড়ে আর থাকতে পারছি না।" কি যে ভাল লাগল অরুন্ধতীর,সেও কুণালকে পাবার জন্য এতটাই অধীর তখন,রাজী হয়ে গেল। বাড়িতে কুণালের কথা জানাতেই বাধ সাধলেন তার বিত্তবান পিতা। কিন্তু প্রেম যে বাধা মানে না,তাই নিজেরাই বিয়ের পরিকল্পনা করে সেইমত এগোতে লাগল। একদিন কলেজে গিয়ে আর বাড়ী ফিরল না ও। রেজিস্ট্রি বিয়ে করে একেবারে কুণালের বাড়ী। এরপর বাবা-মায়ের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগই রইল না ওর। এতটা তার বাবা-মা ভাবতে পারেন নি। তবু মা কিছুদিন পর একটু নরম হলেও বাবার কাঠিন্যে কিছু বলার সাহস পাননি। আর সত্যি তো,একমাত্র সন্তান,কত আশা ধূমধাম করে বড় ঘরে বিয়ে দেবেন তাঁরা,কিন্তু মেয়ে সে সুযোগ তো দিলই না,উপরন্তু এভাবে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে বাবার মাথা হেঁট করাল সমাজের কাছে। বাবা কিছুদিন বাইরে বেরনো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন পাছে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে এ ব্যাপারে। কিন্তু কাজের মানুষ,কতদিন আর কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকা যায় ! মাকেও আত্মীয় স্বজনের কাছে কম জবাবদিহি করতে হয় নি তখন।
অরুন্ধতী অবশ্য সুখেই ছিল কুণালের কাছে,তারও বাবার ওপর অভিমান কম নয় কুণালকে স্বীকার করে না নেওয়ার জন্য। কত আদরে, যত্নে,বৈভবের মাঝে মানুষ সে,কিন্তু কুণালরা নেহাতই ছাপোষা শ্রেণীর,বাবার আপত্তিটা সেখানেই,কোনোদিক থেকেই মেলে না তাদের সঙ্গে। আর অরুন্ধতীও যেন বাবাকে দেখিয়ে দিতে চায়,প্রকৃত ভালবাসা পেলে আর সবই তুচ্ছ হয়ে যায় যদিও অনেক সময়ই তার কষ্ট হয়,এত কষ্ট করে হিসাব করে থাকা অভ্যাস নেই যে তার,কিন্তু কুণালের ভালবাসায় ও তখন মগ্ন তাই মেনে নিতে পেরেছিল সব।
ভালই চলছিল,কুণাল অরুন্ধতীর পড়ায় সবরকম সাহায্য করত। B.A পাশ করে M.A পাশ করার পর অরুন্ধতী যখন নেট দেবে স্থির করল,গোল বাধল তখনই। কুণাল ওকে পড়ায় ডিস্টার্ব করা,কারণে অকারণে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করল। বিভিন্ন কাজে ওকে আটকে দিত,একদিন বলল,"মায়ের হাত থেকে রান্নার দায়িত্বটা নাও,আর কতদিন মা রেঁধে খাওয়াবে?" অরুন্ধতী সব মেনে নিয়ে সারাদিন সংসারের কাজকর্ম,কুণাল যেমন চায়,আর রাত জেগে পড়াশুনো করতে লাগল। কিন্তু না,কুণাল সেখানেও বাধ সাধল। রাতে তার বিছানায় অরুন্ধতীকে চাই। অরুন্ধতীর এতটা এগিয়ে যাওয়া বোধহয় মেনে নিতে পারছিল না সে,হীনমন্যতায় ভুগছিল,তাই যে কোনো উপায়ে ওকে আটকাতে চাইছিল। অরুন্ধতীর আর নেট দেওয়া হল না। কিন্তু কুণাল তাতেও খুশী নয়,সর্বদাই তার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করা তার নিত্য ব্যাপার। একদিন অরুন্ধতী তার বিরোধিতা করতেই জুটল গালে এক চড়। না আর মেনে নেয় নি সে,রাতটা কোনোমতে বাড়ীতে কাটিয়ে পরদিনই অরুন্ধতী বেরিয়ে পড়েছিল ঘর ছেড়ে কাউকে কিছু না বলে। কিছুদিন এক বান্ধবীর বাড়ীতে থেকে কিছু টিউশন জুটিয়ে সারাদিন পরিশ্রম করত দুটো পয়সা রোজগারের আর সাথে চাকরীর খোঁজ। না,বাবা-মায়ের কাছে ফিরে ও যায়নি,যাবেই বা কোন মুখে। কুণালও আর তার খোঁজ করেনি,তাতে অভিমান আরো গাঢ় হয়েছিল অরুন্ধতীর। বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান,জেদ তারও কম নয়। সব ভালবাসার জায়গা থেকে নির্বাসিত হয়ে তার জেদ আরও বেড়ে গেল। আর্থিক অবস্থা একটু স্থিতি হলে সে এক লেডিস হস্টেলে চলে যায় আর বন্ধুর মাধ্যমে কুণালের সঙ্গে তার মিউচুয়াল ডাইভোর্সও হয়ে যায়। সেদিন ও কুণালের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকায়নি আর অরুন্ধতী ওভাবে বাড়ী ছেড়ে চলে আসায় কুণালের শ্লাঘায় আঘাত লেগেছিল তাই সেও বিনা দ্বিধায় ডাইভোর্স দিয়ে দিয়েছিল।
নাঃ মাথাটা ভার হয়ে গেছে অরুন্ধতীর আর ভাবতে পারছে না সে,ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার কিন্তু সে তো কুণালের ভাবনা কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারছে না,কুণালের ভাবনা তাকে সে রাতে ঘুমাতে দিল না। এরপর আর দেখতে পায়নি সে কুণালকে। অনেক কষ্টে মনকে ঠাণ্ডা করে অরুন্ধতী চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে এল কলকাতায়। আবার নিজের মত ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একদিন হোস্টেলে ফিরে ও চাকরীর চিঠি পেল,বুকের মধ্যে চেপে ধরল আনন্দে। কুণালের থেকে দূরে চলে যাবার জন্য আরো আগ্রহী ছিল ও এই চাকরীটায়।
এরপর নির্দিষ্ট দিনে ও গিয়ে চাকরী জয়েন করল। মন দিয়ে কাজ বুঝে নিতে কটা দিন সময় লাগল ওর। ক'দিন পর লাঞ্চ আওয়ারে এম্ব্যাসীর রেস্টুরেন্টে টিফিন করতে গেল। টিফিন শেষে বেরিয়ে আসার সময় চমকে গেল কুণালকে কাউন্টারে দেখে,রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের পদে বহাল হয়েছে কুণাল। দু'জনে অপলকে চেয়ে আছে দু'জনের পানে। এ ও কি সম্ভব! যার কাছ থেকে দূরে যাবে বলে চলে এল সে এতদূরে,সে ও সাথে এল চলে!!!