Sayantani Palmal

Romance Classics

2  

Sayantani Palmal

Romance Classics

দৃশ্যান্তর

দৃশ্যান্তর

11 mins
942


দৃশ্য -এক


    “ শুনছ কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে।” স্বামীর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলেন রমলা।

“ এত রাতে আবার কে এল? বাবু ঠাকুর দেখে ফিরল কি?”

“ আরে বাবু তো একটু আগেই ফিরে গেছে।”

“ তাহলে আবার কে আসবে?”

“ আরে কে কে না করে দরজাটা খুলেই দ্যাখো না।” মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠেন রমলা। কড়া নাড়ার শব্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাইরের ঘরে এসে বিভাস দেখলেন বাবু আর রুমিও উঠে এসেছে।

“ চোর নয় তো?” ভীত স্বরে বলে রুমি।

“ উহু, চোরও জানে রে তোর বাপের পকেট ফাঁকা গড়ের মাঠ।” মুখ বিকৃত করে বললেন রমলা।

ইতিমধ্যে বাবু এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। চিরকাল ই তার ভয় ডর একটু কম।

“ তুই!” কয়েক সেকেন্ড পরে বাবুর বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে। তার চেহারায় অস্বস্তি আর কিঞ্চিৎ ভয়ের যুগপৎ সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

“ হুম, আমি।”

“ তুই হঠাৎ এখানে এত রাতে?”

“ কেন রে দাদা? আমাকে এখানে আসতে নেই বুঝি আর নিজের বাড়ি আসার জন্য আবার সঠিক সময় লাগে নাকি?” বক্তার ঈষৎ বেদনা মিশ্রিত প্রশ্নের উত্তরে বাবু নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

“ কে রে বাবু?” রমলা এগিয়ে আসেন। দরজায় দাঁড়ানো দামি টপ আর জিন্স পরিহিতা দেবী ভেনাসের মত রূপের অধিকারিণী মেয়েটির সাথে এই ঘুপচি গলির ছোট্ট একতলা বাড়িটা বা এবাড়ির নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন সংগ্রামের ছাপ বহনকারী চেহারার মানুষগুলো কিছুই যেন মেলে না। এ বাড়ির দরজায় সে যেন বড় বেমানান ।

“ মধু তুই!” রমলার প্রতিক্রিয়াও যেন বাবুকে অনুসরণ করে।

“ হ্যাঁ, মামিমা। সেই যে ভালো ছেলে দেখে আমার বিয়ে দিলে তারপর থেকে তো আর আমার খোঁজখবর নাও নি। তাই আমিই চলে এলাম। কেমন আছি কেমন সংসার করছি জানতে চাইবে না?” তার কণ্ঠস্বরে যেন কিঞ্চিৎ ব্যাঙ্গের আভাষ। 

বাবুর পাশ দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল মেয়েটি। বাইরের ঘরের কম পাওয়ারের টিমটিমে হলদেটে বাল্বের আলোয় এতদিন পরে ভাগ্নীকে দেখে বিভাসবাবুর মনের মধ্যে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। বাপ-মা মরা মেয়েটাকে কতদিন পরে দেখলেন! বিভাসবাবু পেয়েছিলেন বাবার গড়ন আর বোন রেণু পেয়েছিল তাঁর মায়ের মত কাটা কাটা মুখশ্রী। রেণু প্রতিভাময়ী ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও নাটক, থিয়েটার এসব করত। অভিনয়ের সূত্রেই আলাপ হয়েছিল মধু ওরফে মধুমিতার বাবার সাথে। বিয়েও করেছিল দুজনে কিন্তু মধুর বাবা ছিল পাঁড় মাতাল। রোজগারের টাকা মদেই উড়িয়ে দিত। মধু যখন এক বছরের তখন লিভারের অসুখে মারা গেল ওর বাবা। রেণু ছোট্ট মধুকে নিয়ে এসে উঠলো এবাড়িতে। স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় রমলার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভয়াবহ। রমলার ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য রেণু উদয়াস্ত পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করতে থাকে কিন্তু একসময় শরীর জবাব দিয়ে দেয়। প্রায় মাস ছয়েক অসুখে ভোগার পর রেণু সব বন্ধন ছিঁড়ে চলে যায়। মামা-মামী থাকা সত্ত্বেও চোদ্দ বছরের মধু সেদিন এই পৃথিবীতে বাস্তবিকই একলা হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে মামীর লাথি ঝাঁটা আর মামাতো ভাই-বোনের খবরদারিতে যাহোক করে দিনাতিপাত করত সে। ব্যক্তিত্ব জিনিসটার কোনও কালেই বিভাসবাবুর চরিত্রের সাথে ভাব হয়নি তাই নির্বিবাদে স্ত্রী-সন্তানদের মধুর প্রতি এই অন্যায় আচরণ মেনে নিতেন। শুধু একটা সাহস করে একটা কাজ করেছিলেন ভাগ্নির পড়াশোনাটা বন্ধ হতে দেননি। মেয়েটাও মন দিয়ে লেখাপড়া করত। টিউশন করে নিজের খরচ চালাত। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইত কিন্তু মধু কলেজে পড়ার সময় বাবুর এক বন্ধুর সাথে রমলা মধুর বিয়ের ঠিক করে। একদিন হঠাৎ করেই একটু সিঁদুর দান, মালা বদলের মধ্য দিয়ে মধুর বিয়ে সাঙ্গ করে তাকে এবাড়ি থেকে বিদায় করে। তারপর থেকে আর মধুর কোনও খোঁজ পাননি বিভাসবাবু। সে নাকি বড়লোকের সুন্দরী বউ হয়ে বেজায় ভালো আছে আর অহংকার চুঁইয়ে পড়ছে তার সারা শরীর থেকে তাই এই গরীব মামাবাড়ির কথা তার মনে পড়ে না। এমনটাই শুনেছিলেন বিভাসবাবু।

আজ দামী পোশাকের মোড়কে মোমের পুতুলের মত মধুকে দেখে বিভাসবাবুর মনে হচ্ছে নাই বা তাঁদের মনে রাখলো, অভাগী মেয়েটা সুখের মুখ দেখেছে, ভালো আছে এই অনেক। মা-বাবা দুজনেই দেখতে ভালো ছিল বলে জন্মগত ভাবেই আলো ছড়ানো রূপ পেয়েছিল মধু। আজ যেন সেই রূপ হীরক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। দুচোখ ভরে ভাগ্নিকে দেখছিলেন বিভাসবাবু। মুগ্ধতার রেশ কাটলো রমলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে, “ ব্যাপার কি বলত? কি জন্য এসেছিস তুই?” ঝাঁঝিয়ে উঠলো রমলা। তার এই ব্যবহার একেবারে অপ্রত্যাশিত না হলেও কিছুটা অবাকই হলেন বিভাসবাবু। 

“ কেন মামীমা? কারণ ছাড়া এমনি বুঝি কেউ নিজের লোকের কাছে আসে না?” শান্ত ভাবে বলল সে।

“ দ্যাখ, মধু দি সামনেই আমার বিয়ে। তোর মত সং সেজে রাস্তায় খদ্দের ধরা মেয়ে আমাদের আত্মীয় এটা জানলে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি ভাববে কে জানে!” রুমি তার হবু শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।

“ রুমি, ঠিকই বলেছে। কি দরকারে এসেছিস বলে তাড়াতাড়ি ফোট এখান থেকে। বেশ্যাগিরি করে তো ভালোই কামাচ্ছিস মালুম হচ্ছে।” বলে উঠলো বাবু।

“ এসব কি বলছ দাদা! তোমরা আমার এত ভালো বিয়ে দিলে!” বাঁকা হেসে বলল মধু।

“ ন্যাকামি করিস না মধু। সত্যিটা সবাই জানি। এখন তাড়াতাড়ি বিদায় হ এখান থেকে। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। ভাগ্যিস মহুয়া বাপের বাড়ি গেছে।” ফুঁসে উঠলো বাবু।

“ তাই নাকি রে দাদা! ঠিকই বলেছিস ভদ্রলোকের বাড়িতেই তো বাড়ির মেয়েকে বিক্রী করে সেই টাকায় বাইক কেনা হয়, গয়না কেনা হয়। বাড়ির মেয়ের সম্মান ভেট দিয়ে নেতার কাছ থেকে সরকারী চাকরি ম্যানেজ করা হয়!” মধুর কণ্ঠে ব্যঙ্গ আর বেদনার যুগপৎ সঙ্গমিশ্রন।

“ তোরা এসব কি বলছিস? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” সংসারের মূল্যহীন মানুষটাও যে এঘরে উপস্থিত সেটা সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। রমলা প্রমাদ গুনলেন। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি। ছেলেমেয়ে দুটোর কাণ্ডজ্ঞান নেই। এত বছর যে সত্যিটা লুকিয়ে রাখলেন আজ সেটা ফাঁস করে দিল। যতই ছেলে চাকরি করুক ভালোই জানেন তাঁর বল ভরসা ওই বিভাসবাবু। সে যতই মানুষটাকে তাঁরা গ্রাহ্য না করুন। আজ যদি বিভাসবাবু জানতে পারেন যে বিয়ের নামে মধুকে দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন আট লক্ষ টাকায় শুধু তাই নয় ওই দালালের মাধ্যমেই মধুকে কাল্টু দত্তের কাছে পাঠিয়ে বাবুর জন্য পুরসভার চাকরীটা হাতিয়ে ছিলেন তাহলে মুশকিল হয়ে যাবে।

“ ও কিছু না। কি বলতে কি বলছে ওরা।” সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন রমলা। অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন বিভাসবাবু।

“ মধু, তুই আমাকে সত্যিটা বল। আমি বেশ বুঝতে পারছি বিয়ের নামে এরা তোর সাথে খারাপ কিছু করেছে।” বিভাসবাবুর এমন গাঢ়, গম্ভীর কন্ঠস্বর আগে কেউ শোনেনি।

 টানা টানা কাজল পরা নিঃসঙ্গ চোখ দুটোকে এই মুহুর্তে নোনতা জলের ধারা সঙ্গ দিচ্ছে, “ মামা, ছাড় না ওসব পুরনো কথা। রুমির বিয়ে শুনে এই কিছু গয়না এনেছিলাম।” হ্যান্ডব্যাগের চেনটা খুলতেই বাল্বের মিটমিটে আলোতেও চকচক করে উঠে নিজেদের মূল্যবান অস্তিত্ব জানান দিল ভেতরের জিনিস গুলো। ততোধিক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো রমলা আর রুমির চেহারা।

“ তাই নাকি! তুই আমার জন্য এনেছিস ওগুলো?” রুমির কথায় লোভের ছোঁয়া।

“ হ্যাঁ রে। মামিমা সব সময় বলত না আমার বাড়তি পেটটার জন্য তোর আর দাদার ভাগে খাবার কম পড়ে তাই ভাবলাম নিজের নারীত্বের সম্মান বিসর্জন দিয়ে দাদার সেই বাড়ন্ত খাবারের হিসেব তো মিটিয়ে দিয়েছি এবার তোর ক্ষতিপূরণ করার পালা।নিবি তো এগুলো?” খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো শেষ করল মধুমিতা।

ব্যাগটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল সে।

“ বুঝলি মধু, তোর কাছ থেকে কিছু নেওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই কিন্তু বোনের জন্য এনেছিস না নিলে কষ্ট পাবি তুই তাই রেখেই যা ওগুলো।” তড়িঘড়ি বলে ওঠেন রমলা। 

“ বলছি কি মধু তুই যদি কিছু টাকা পয়সা দিয়েও আমাদের হেল্প করিস তো খুব ভালো হয়। বুঝতেই পারছিস বাবার ওই সামান্য চাকরি আর আমার বেতনও আহামরি কিছু নয়।” বাবুর গলার স্বর সোনার ছোঁয়ায় বদলে গেছে। করুণ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো মধুমিতার ঠোঁটে।

“ ওই ব্যাগের তলায় পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। নিয়ে নিও।” দরজার দিকে পা বাড়াল সে।

“ মধু শোন তোর যদি আর কিছু দেওয়ার থাকে আমাকে ফোন করিস নাহলে এমনি রাত্রি করে চলে আসিস। কেউ জানতে পারবে না আর তোর বৌদিও এখন লক্ষী পুজো পর্যন্ত বাপের বাড়িতে থাকবে।” 

“ না রে দাদা। আজ তো দশমী আজই আমার বিসর্জন। আর কোনও দিন তোদের সম্মান নষ্ট করতে আসব না।” ধীর পায়ে বেরিয়ে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সে। বিভাসবাবু ইচ্ছে করেই ডাকলেন না।


দৃশ্য-দুই


    অন্ধকার গলি বেয়ে একলা হেঁটে যাচ্ছে শুভজয়। চারিদিক পুজোর আলোকে আলোকোজ্জ্বল কিন্তু মানুষের মনে কেন এত অন্ধকার! ভেবে পায়না সে। 

“ শুভ।” মিষ্টি ডাকটা শুনে ঘুরে তাকাল সে। অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে চোখে হাজার বছরের ব্যাকুলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছন দিকে।

“ আমাকে চিনতে পারলি না?” উদ্বিগ্ন প্রশ্ন তার।

“ না, মানে….।” একটু থমকে যায় শুভজয়।

“ আমি সেই বাংলা কোচিং সেন্টারের মধুমিতা।” নিজেকে চেনানোর চেষ্টা করে মধু।

“ ওহো, এবার চিনতে পেরেছি। কি খবর তোর? কি করছিস এখন?” মধুমিতা কোনও উত্তর দেয় না। নিশ্চুপ হয়ে দুচোখ ভরে শুভজয়কে দেখে। এই সেই ছেলেটা যে আর পাঁচটা ছেলের মত মধুকে কোনও দিন সস্তা ভাবে নি। বয়সটা দশ পার হবার পরই মধু বুঝতে পেরেছিল তার এই অসাধারণ রূপ তার কাছে আশীর্বাদ নয় অভিশাপ। বাপ মরা মেয়ে বলে সে যেন সবার কাছে সহজলভ্য। মা মারা যাবার পর তো মনে হলো চারিদিকে শুধুই দাঁত-নখ সর্বস্ব শ্বাপদের বাস। কিন্তু এদের মাঝেও শুভজয় ছিল অন্যরকম। মেয়েদের প্রকৃত সম্মান দিতে জানত। একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে ভাঁটা আর তার বন্ধুরা মধুকে প্রায় ঘিরেই ধরেছিল। সেই মুহুর্তে মধুর মনে হয়েছিল আর তার রক্ষা নেই কিন্তু সেদিন তার কৃষ্ণ সখা হয়ে আবির্ভুত হয়েছিল শুভজয়। বড় পুলিশ অফিসারের ছেলে শুভজয়কে ভাঁটারা বেশি ঘাঁটায় নি। শুভর ভয়ে মধুকেও আর কিছু বলেনি কোনও দিন। সেদিনের পর থেকে কোচিং এর পর মধুকে পাড়ার মোড় পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে যেত শুভ। কিন্তু বিনিময়ে তার কোনও প্রত্যাশা ছিল না। এমন নয় যে তার কোনও প্রেমিকা ছিল। শুভর সাইকেলের পাশে পাশে হাঁটত মধু। তার মনে হত এমনি করে সারাজীবন যদি সে হাঁটতে পেত। শুভ বন্ধুত্বের গন্ডী তে নিজেকে আবদ্ধ রাখলেও মধুর মনের গহনে সদ্য ফোটা কুঁড়ির মত জন্ম নিয়েছিল পবিত্র এক ভালোবাসা। যার সুবাস সে কখনও বাইরে ছড়াতে দেয় নি। কোচিংয়ের শেষ দিনে শুভ বলেছিল, “ দেখিস আবার কোনও দিন এমনি রাস্তাতেই হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে আমাদের।” উচ্চ মাধ্যমিকের পর শুভজয় বাইরে পড়তে চলে যায়। আর কখনও দেখা হয়নি তাদের।

“ কি রে চুপ করে আছিস কেন? আর পুজোর দিনে ফাঁকা রাস্তায় একলা কি করছিস?বিপদ হতে পারে তো।”

“ তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর শরীরটাকে পণ্য করে যাকে পেট চালাতে হয় তার আবার কিসের বিপদ রে।” হেসে বলে মধু।

“ মানে? কি বলছিস তুই খুলে বল।” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে শুভজয়।

মধু আস্তে আস্তে কিভাবে সে যৌন পল্লীতে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল সমস্ত বলে শুভকে। হতবাক শুভ বলে ,” “তারপর কি হলো?”

“ জানিস শুভ, যৌনপল্লীর ওই স্যাঁতস্যাঁতে ঘুপচি ঘরে যখন নোংরা মাতাল গুলো আমার শরীরটা ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত তখন ঈশ্বরের কাছে শুধু মুক্তি প্রার্থনা করতাম। তারপর একদিন বুঝলাম এই অন্ধকার থেকে আমার মুক্তি সম্ভব নয়। সমাজের চোখে আমি নষ্ট মেয়ে। তখন ঠিক করলাম আমি এই অন্ধকারেই রানীর মত থাকব। সুযোগ বুঝে এক খদ্দেরের সাহায্যে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন ভাবে কাজ শুরু করলাম মানে যৌনপল্লীর রং মাখা বেশ্যা থেকে বড়লোকদের শরীরের ক্ষিদে মেটানোর যন্ত্র অর্থাৎ কলগার্লে পরিণত হলাম। একটা সুবিধে হলো এতে টাকা প্রচুর। বুঝলি শুভ বড়লোকরা এ ব্যাপারে খুব উদার। গাড়ির কাঁচে ভিখিরি টোকা মারলে বিরক্ত হয় কিন্তু কলগার্ল এর চাহিদা মেটানোর বেলায় কোনও কার্পণ্য নেই। আমার এখন নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালেন্স। কোনও অভাব নেই আমার। বড়লোকদের মত জীবনযাপন করি। আমার রূপ আর পেটে বিদ্যে থাকায় আমি তথাকথিত অভিজাত পুরুষদের খুব পছন্দের।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভজয়ের দিকে তাকিয়ে মধু বলল, “ খুব ঘেন্না হচ্ছে আমার প্রতি তাই না রে শুভ?” 

হা হা করে হাসতে আরম্ভ করলো শুভজয়।

মধুর মুখটা করুণ হয়ে উঠলো, “ হাসছিস কেন শুভ?”

“ হাসির কথা বললে হাসবো না? যারা টাকার বিনিময়ে তোকে ভোগ করে তারা হলো সাধু আর তোকে করবো ঘেন্না!”

“ তুই এখনও একই রকম আছিস শুভ।” আদ্র স্বরে বলল মধু।

“ তাই নাকি!” হাসতে হাসতে বলে শুভ।

“ আমার সাথে আগের মত একটু হাঁটবি শুভ?”।

“ ম্যাডামের যা মর্জি।”

বেশ কিছুটা পথ নিশ্চুপ হয়ে হাঁটতে লাগলো দুজনে। কিছু সময় নিস্তব্ধতা অনেক কথা বলে। অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মধুমিতা কোনও দিন ভাবেনি আবার এই মুহূর্ত ফিরে পাবে যখন সে আর শুভজয় পাশাপাশি হেঁটে যাবে।

“ বাঁচাও, বাঁচাও।” একটা আর্ত চিৎকারে চমকে উঠলো ওরা।



শেষ-দৃশ্য



   অসহায় ভাবে দীনেশ বাবু আর রিতাদেবী দেখছেন তাঁদের চোখের সামনে তাঁদের আদরের দিয়াকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে শয়তান গুলো। কি কুক্ষণেই যে ঠাকুর দেখে ফেরার পথে শর্টকাট হবে বলে এই অন্ধকার গলি রাস্তাটা ধরেছিলেন! আজ সব শেষ হয়ে যাবে তাঁদের। জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটা দেখতে পারবেন না বলে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললেন দুজনে।

   প্রবল পৌরুষে আক্রান্ত কালুয়া ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল দিয়ার নরম শরীরটার ওপর। তার শাগরেদরা যাকে মাটিতে চেপে ধরে আছে। “ ওক” একটা হেঁচকি তুলল কালুয়া। অদৃশ্য একটা হাত তার গলাটা অমানুষিক শক্তিতে চেপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তার সঙ্গীরা অবাক হয়ে দেখছে কালুয়ার নেশাতুর লাল চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। দিয়াকে আর তার বাবা-মাকে ছেড়ে কালুয়ার কাছে ছুটে এল তারা কিন্তু সেই অদৃশ্য শক্তির কাছে তাদের সব বিক্রম ব্যর্থ । কয়েক মুহুর্ত পরে কালুয়ার নিষ্প্রাণ দেহটা ছেড়ে দিয়ে সেই বজ্রমুষ্টি আক্রমণ করল তার দুষ্কর্মের সংগীদের। পালাবার চেষ্টা করলেও দিয়ার জন্য দেবদূতের ন্যায় আগত সেই অদৃশ্য শক্তি তাদের মুক্তি দিল না তাদের। অদৃশ্য এক বৃত্তের মধ্যে আটকে পড়ল তারা। কালুয়ার পরিণতি হলো তাদেরও। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার প্রতিঘাত সামলে একটু সম্বিৎ ফিরতেই দিয়ার বাবা স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটলেন।

   শুভজয়ের বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে মধু বলল, “ নিজের আব্রু রক্ষা করতে পারিনি। আজ এই মেয়েটাকে সর্বনাশ থেকে বাঁচিয়ে আমি শান্তি পেলাম শুভ কিন্তু আমি যা করলাম তাতে তোর অবাক হওয়া স্বাভাবিক।” একটু থেমে মধু আবার বলল, “ আজকের ব্রেকিং নিউজ কি জানিস শুভ? বিখ্যাত অভিনেতা দীপক রায় পথ দুর্ঘটনায় নিহত। দীপক বাবু ছাড়াও গাড়িতে অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবতীর দেহ পাওয়া গেছে। গোপন সূত্রে খবর যুবতীর নাম মধুমিতা দে। হাই সোসাইটির লোকজনদের সঙ্গ দেওয়া একজন কলগার্ল।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মধু আবার অভয় দিল, “ভয় পাস না শুভ। তোর কোনও ক্ষতি আমি করব না। ভালোই হয়েছে আজ দশমীতে আমার এই অভিশপ্ত জীবনের বিসর্জন ঘটে গেছে। ইহলোকের সীমানা পেরিয়ে অন্য লোকে পাড়ি দেয়ার আগে আমি শুধু একবার আমার ছেলেবেলা কাটানো বাড়িটা যেখানে আমার মায়ের গন্ধ আছে সেখানে ফিরতে চেয়েছিলাম আর…….।” থেমে যায় মধুমিতা।

“ আর...।” অস্ফুটে জিগ্যেস করে শুভজয়।

“ আর শুধু একবার তোর কাছে আসতে চেয়েছিলাম। আমার সব ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। এবার ইহজগতের সব মায়া মুক্ত আমি।”

মধুমিতার হাতটা ধরে শুভজয় গাঢ় স্বরে বলল, “ চল সেই কিশোর বেলার মত দুজনে হেঁটে যাই তবে এবার আর আমি তোকে ছেড়ে যাব না যুগ যুগ ধরে এভাবেই দুজনে হেঁটে যাব।”

“ শুভ তুই!”

“ হুম, আমিও। আজ দুপুরবেলা আমি খুন হয়েছি। যাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবেসে ছিলাম সেই স্ত্রী আর তার প্রেমিক দুজনে মিলে আমাকে খুন করেছে। ওরা এখন পুলিশের হেফাজতে আর আমি এতক্ষন অতৃপ্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম কিন্তু তুই আমার কাছে ফিরে এসে আমার সব অতৃপ্তি দূর করে দিয়েছিস। আমাকেও কেউ এমন ভালোবাসে যে মৃত্যুর পরেও আমার কাছে ফিরে আসতে চায়।” শুভজয়ের মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মধুমিতার ঠোঁটেও একচিলতে হাসি।

  পাশাপাশি হাত ধরে দুটো ছেলেমেয়ে হেঁটে চলেছে অনন্তের পথে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance