দন্তরুচি
দন্তরুচি


প্রিয়তোষের সামনের দুটো দাঁত, যাকে ইংরাজিতে incisor বলে, তার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। সেই যখন ওনার চার বছর বয়েস, তখন উনি ছুটে এরোপ্লেন দেখতে যাচ্ছিলেন, রাস্তার মাঝখানে কোথা থেকে একটা চৌকাঠ এসে পড়ল বুঝতেই পারলেন না, আর ব্যাস মুখ থুবড়ে ধপাস। গেলো সামনের দাঁত দুটো ভেঙ্গে। মা বরফ লাগাতে লাগাতে বললেন,” উট-মুখো কোথাকার, ওরকম ভাবে উপর দিকে তাকিয়ে দৌড়ায়? “
আচ্ছা আপনারাই বলুন মানুষ নিচের দিকে তাকিয়ে এরোপ্লেন দেখবে কি করে? যাক ভাগ্যি ওগুলো দুধের দাঁত ছিল তাই আবার গজালো। কিন্তু গজালো তো গজালো একেবারে গজালের মত গজালো। তারপর থেকে প্রিয়তোষ চান বা না চান উনি সবসময়ে দন্ত বিকশিত করেই রাখতেন।
কিন্তু এও বেশিদিন রইল না। একবার উনি ওনার বড় মামার সাথে সবজি বাজারে গেছেন। তখন ওনার বারো বছর বয়স। একটা ষাঁড় কেন জানিনা ক্ষেপে গিয়ে ওনাকে মারল এক ধাক্কা। ব্যাস আবার উনি মুখ থুবড়ে পড়লেন, ধপাস। আর আবার গেলো সামনের দাঁত দুটো ভেঙ্গে। বড় মামা দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে বাঁধিয়ে দিলেন দুটি দাঁত। প্রিয়তোষ খুব খুশি, আর দাঁতগুলো বেরিয়ে থাকে না।
কিন্তু গোল বাঁধল বছর পনেরো বাদে। প্রিয়তোষের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পিসিমা এসে প্রিয়তোষকে সাবধান করে দিলেন, “ খবর্দার বাবু। বাঁধানো দাঁতের কথা যেন শশুর বাড়ির লোকেরা কেউ জানতে না পারে। ওরা কিন্তু ফোকলা ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না।“ প্রিয়তোষ চুপ করে রইলেন, সত্য গোপন করা বা মিথ্যা কথা বলা এর কোনটাই তাঁর পছন্দ না । পিসি বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই চুপ করে রইলেন। কিন্তু ফুলশয্যার রাত্রে প্রিয়তোষ আর থাকতে পারলেন না। ঘরে ঢুকেই চোখবন্ধ করে বউয়ের দিকে না তাকিয়েই গড় গড় করে বলে ফেললেন,” তোমাকে আমি একটা কথা জানাতে চাই, যেটা আমার বিয়ের আগেই বলা উচিত ছিল, কিন্তু পারিনি পাছে জানতে পারলে তুমি আমায় বিয়ে না কর।“ এতটা বলে একটু দম নিলেন প্রিয়তোষ।
নবপরিণীতার সশঙ্কিত মুখটা ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি মারছে, না জানি এই লোকটা কি বলবে?
“আমার সামনের দুটো দাঁত বাঁধানো।“
বউয়ের খিলখিল হাসির আওয়াজে চোখ মেলে তাকালেন প্রিয়তোষ । তারপর তিনিও হেসে ফেললেন।
“তুমি কিন্তু কাউকে বোলো না।“
স্ত্রী সরযূ হেসে বললেন,” ঠিক আছে কথা দিলাম, কাউকে বলবো না।“
ভাগ্যিস বলে দিয়েছিলেন কথাটা, পরেরদিন বউ দেখতে এসে পাশের বাড়ির নতু পিসি টুক করে বলে বসলেন, “ আহা এমন প্রতিমার মত মেয়ের শেষকালে কিনা ফোকলা বর!” ওনার কথা শুনে আশপাশের মহিলাদের সঙ্গে নতুন বউও ফিক করে হেসে ফেললো। আচ্ছা এই মহিলাদের কুঁদুলি করা ছাড়া কি আর কোন কাজ থাকে না?
স্ত্রী সরযূ কথা রেখেছেন। সেই ঘটনার পর অনেক বছর কেটে গেছে। দেশের বাড়ী ছেড়ে প্রিয়তোষ সপরিবারে কোলকাতায় চলে এসেছেন। বাড়ী করেছেন। ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দাঁত নিয়ে আর কোনদিন কোন কথা হয় নি।
প্রিয়তোষ কয়েক বছর হল রিটায়ার করেছেন। নাতির তিন বছরের জন্মদিন। মেয়ে বলেছে এ বছর জন্মদিনে আসতেই হবে। অগত্যা প্রিয়তোষ তাঁর স্ত্রী সরযূকে নিয়ে রওয়ানা হলেন রায়পুর, মেয়ের বাড়ী। মেয়ে জামাই খুব খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি নাতি তাতাই। সে দাদুকে একেবারেই ছাড়ছে না। দাদু বাড়ী ঢোকার সময় থেকে সে সর্বক্ষণ তার দাদুর সাথে। সে সব কাজ দাদুর সাথে করছে। দাদুর কোলে চড়ে ঘুরছে, দাদুর হাতে খাচ্ছে। রাতে ঘুমাতেও গেলো দাদুর সাথে । দাদু ওকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
পরের দিন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠেই তাতাই নিজের ছোট্ট দাঁতের ব্রাশটা নিয়ে ছুটে চলে এলো দাদুর কাছে, “দাদু তুমি আমায় ব্রাশ করিয়ে দাও।“
প্রিয়তোষ তখন নিজে ব্রাশ করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কিন্তু নাতির আবদার না রেখে উপায় নেই। তাই আগে নাতিকে ব্রাশ করিয়ে দিলেন। তারপর তাতাই বলল, “এবার তুমি দাঁতে কিচকিচ করে দাও।“
“সেটা আবার কিরে?”
“ওমা তুমি জানো না, মা দাতে আঙ্গুল দিয়ে ঘসে দেখে , যদি কিচ কিচ আওয়াজ হয় তাহলে ব্রাশ ঠিক হয়েছে।“
তা আঙ্গুল দিয়ে কিচ কিচ করা হল। আওয়াজ শুনে নাতি খুব খুশি। নিজের ব্রাশ হাতে নিয়ে সে লাফাতে লাফাতে চলে গেলো তার মায়ের কাছে।
নাতি চলে যাবার পর প্রিয়তোষ নিশ্চিন্তে নিজের ব্রাশ করার তোড়জোড় শুরু করলেন। নাতি যে ফিরে এসে দাদুর পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে দেখছে দাদু কিভাবে ব্রাশ করে, সেটা উনি খেয়ালই করেন নি। তাতাই লক্ষ্মী ছেলের মত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু গোল বাঁধল যেই প্রিয়তোষ বাঁধানো দাঁতটা খুলে বেসিনে রাখলেন। তাতাই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে তীর বেগে ছুটে চলে গেলো রান্নাঘরের, তারপর ওর মায়ের শাড়ীর আঁচল ধরে টানতে টানতে চেঁচাতে লাগলো ,” মা শিগগির এসো , দাদু দাঁতগুলো খুলে খুলে বেসিনে ফেলে দিচ্ছে।“
হৈচৈ শুনে বাড়ির সবাই মায় কাজের মাসি অবধি, জড়ো হয়ে গেলো বেসিনের সামনে। প্রিয়তোষ হাতে দাঁতটা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বেসিনের স্যামনে দাঁড়িয়ে, তাতাই আঙুল দিয়ে প্রিয়তোষের দাঁতের দিকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো ,” ওই দেখ! ওই দাঁতটা, ফেলে দিয়েছিল, এখন আবার তুলে নিয়েছে।“
মেয়ে জামাই একসাথে বলে উঠলো,” বাবা তোমার দাঁতটা বাঁধানো?”
প্রিয়তোষ অসহায়ের মত সরযূর দিকে তাকালেন। সরযূর সহাস্য উত্তর , “ আমি বলিনি বাবা!”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। একমাত্র তাতাই সবার মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইতে লাগলো, এতো গম্ভীর একটা সমস্যায় হাসার কি আছে সে তা বুঝে উঠতে পারলো না।
সমাপ্ত