Debdutta Banerjee

Drama

4  

Debdutta Banerjee

Drama

ধুসর যাপন

ধুসর যাপন

5 mins
2.1K


পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট লাল বাড়িটা ক্যালেন্ডারে আঁকা ছবির মতো। সামনে ছোট্ট বাগান, কেয়ারি করা লিলি ফুলের ঝাড়, কালচে গোলাপের ফুল গুলো বেশ মিষ্টি।

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বনানী ভাবছিল কে হতে পারে ছেলেটা। কেনই বা দেখা করতে চায়!! তার নিস্তরঙ্গ শান্ত জীবনে আবার কি ঝড় উঠতে চলেছে কে জানে !! হঠাৎ করে একটা ফোন কল তার জীবনে এভাবে ঝড় তুলবে কখনো ভাবেনি সে।

কুয়াশার আড়ালে লাল বাড়িটা যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। একমনে বাড়িটা দেখে অমৃত। তারপর ছোট গেট খুলে নুড়ি পাথর বিছানো পথে ঢুকে আসে ভেতরে। বেলের জায়গায় জার্মান সিলভারের ছোট্ট ভারি ঘণ্টা, লাল দড়িতে টান দিতেই রিনরিন করে বেজে উঠল। একটি নেপালি মেয়ে ছুটে এসে দরজা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই অমৃত বলে -''মিসেস বনানী দে সরকার !!''

ওকে ছিমছাম সাজানো ড্রইংরুমে বসিয়ে মেয়েটি ভেতরে ঢুকে যায়। চারপাশটা ভালো করে দেখে অমৃত। কত রকম কিউরিও, হাতের কাজ। সাজানোর মধ্যে রুচির ছাপ রয়েছে। একটু পরেই এক মাঝ বয়সী মহিলা বেরিয়ে আসেন ভেতর থেকে।

অমৃত নমস্কার করে বলে -'' আপনি আমায় চিনবেন না হয়তো। একটা প্রয়োজনে এসেছি আপনার কাছে । ''

প্রতি নমস্কার জানিয়ে সামনের সোফায় বসে বনানী।

-''আনন্দ আমার দাদা ... সে জন্যই এসেছি। ''

অমৃতের কথায় চমকে ওঠে বনানী। বলে -''হঠাৎ .... এতদিন পর, আমার ঠিকানা কোথায় পেলেন?''

-''দেখুন, কেউ কি সারা জীবন লুকিয়ে থাকতে পারে ? খুঁজতে খুঁজতে পেয়েছি। '' অমৃতের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা।

সারা শরীর জুড়ে একটা অস্বস্তি ফুটে ওঠে বনানীর।

-''দাদা কোথায় ম‍্যাডাম ?''

ঘরের ভেতর যেন বাজ পড়েছে। এই নভেম্বরের ঠাণ্ডাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে বনানীর। বলে -''এতো দিন পর এসব পুরানো কথা বলে কি লাভ। ''

-''আমি আমার দাদাকে খুঁজছি, কি হয়েছে দাদার ? কোথায় সে ? ''

-''আনন্দ বেঁচে নেই। একটা দুর্ঘটনায় .... প্লিজ আমি ও সব ভুলতে চাই। আপনি চলে যান। '' বনানী উঠে দাঁড়ায়।

-''আজ না হয় চলে যাবো। কিন্তু কাল যখন পুলিশ নিয়ে আসবো কি করবেন ম‍্যাডাম?''

চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বলে অমৃত। -''আমি যদি বলি দাদাকে আপনি মেরে ফেলেছেন?''

-''পুলিশ জানে, একটা দুর্ঘটনায় আনন্দ মারা গেছিল পনেরো বছর আগে। আপনি চলে যান। ''

-''কিন্তু আমি মানি না। আমার মা মানে না। ''

-''আমার কিছু করার নেই। আপনি চলে যান। এত বছর পর ঐ সব পুরানো কথা টানাটানি করে কি লাভ। '' উত্তেজনায় বনানীর গলা কেঁপে ওঠে।

-''ওকে, তাহলে পুলিশ নিয়েই আসছি ম‍্যাডাম। '' অমৃত চলে যেতে নেয়।

-''শুনুন মিঃ অমৃত। সত্যি এটাই, আনন্দ আর নেই। প্লিজ, বিশ্বাস করুন।'' বনানীর চোখের কোন ভিজে ওঠে।

-''বাই দা ওয়ে, আপনার বসার ঘরটা সুন্দর সাজানো। কিন্তু দাদার কোনো ছবি দেখলাম না এখানে।

দাদা মারা যাওয়ার খবরটাও আমাদের দেওয়া প্রয়োজন মনে করেননি। অথচ আপনার মোহে দাদা নিজের মা ভাই এমনকি নিজের বাড়ি ছেড়েছিল একদিন। তবে আমিও শেষ দেখেই ছাড়বো।''

অমৃত বেরিয়ে যায়। দু হাতে মাথা টিপে সোফায় বসে পড়ে বনানী। হঠাৎ একদিন এমন কিছু ঘটতে পারে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। পনেরো বছর আগে যে গল্পটা শুুুরুুুতেই শেষ হয়েছিল এত বছর পর তা আবার নতুন করে শুরু হবে ও ভাবতেও পারেনি।

আনন্দর পরিবারের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না ও। শুধু শুনেছিল এক বছর আগে পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ওরা বেরিয়ে এসেছিল। তারপর ....

বাইরে একটা ঝড় উঠেছে, বিদ্যুতের ঝলকে চমকে ওঠে বনানী। কাছেই বাজ পড়েছে কোথাও। উথালপাতাল হাওয়া সাথে বৃষ্টি। কাজের মেয়ে নয়না সব জানালা বন্ধ করে দেয়। লাইট চলে যেতে বড় একটা মোম ধরিয়ে দিয়ে যায়। মোমের আলোয় ঘরটায় এক আলো আঁধারি পরিবেশ। বনানী তখন পিছিয়ে গেছে পনেরো বছর। একটা দুর্ঘটনা ওর জীবন ঘুরিয়ে দিয়েছিল একদিন।সেদিনও এমন বৃষ্টি ছিল।

ট্রেনেই দেখা হয়েছিল ওদের সাথে, কলেজের পর বহুদিন যোগাযোগ ছিল না। বনানী দে আর আনন্দ সরকার।বনানী অনাথ , বাড়ির অমতে আনন্দ ওকে বিয়ে করেছিল এক বছর আগে। অনাথ মেয়েকে বিয়ে করেছে বেকার ছেলে। তাই বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল আনন্দকে। আপাতত বনানী একটা চাকরী পেয়েছে কালিম্পঙে। আনন্দ টুকটাক এটাওটা করে সংসার চালাত এতদিন। এখন দুজনেই চলেছে পাহাড়ে। আনন্দ একটা কাজ ঠিক খুঁজে নেবে। খুব খুশি ছিল ওরা।

কলেজে ঢুকেই পরিচয় হয়েছিল বনানী দত্তর সাথে বনানী দের। শুধু নাম নয় চেহারাতেও বেশ মিল ছিল দুই বনানীর, দুজনেই ফর্সা, কোঁকড়া চুল, ছিপছিপে গড়ন। ভাগ্যটাও কিছুটা এক, বনানী দে অনাথ, আশ্রমেই মানুষ। আর বনানী দত্তর মা বাবা ছোটবেলায় গত হয়ে কাকার সংসারে আশ্রিতা সে। কলেজে উঠে একটা হোস্টেলে চলে গেছিল বনানী দত্ত, আর কারো সাথে সম্পর্ক ছিল না। তবে কিছু অমিল ও ছিল। বনানী দে ইংরেজিতে অনার্স, দারুণ পড়াশোনায়। খুব ভালো গান গায়। প্রচুর বন্ধু। আর বনানী দত্ত পড়াশোনায় মিডিওকার। মিশতে পারে না তেমন কারো সাথে, চুপচাপ থাকে। সেও চলেছে পাহাড়ে একটা রিসর্টের কাজ নিয়ে।

কিন্তু ভাগ্যের এক নিষ্ঠুর পরিহাসে গাড়িটা উল্টে গেছিল হঠাৎ। পাঁচশ ফুট নিচে জঙ্গলে ছিটকে পড়েছিল ছয়জন যাত্রী নিয়ে। একমাত্র বনানী দত্ত বেঁচে গেছিল কোনো ভাবে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পেরেছিল একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ডাক্তার নাম জানতে চাওয়ায় অতিকষ্টে শুধুই 'বনানী' বলেছিল ও। তারপরেই আবার জ্ঞান হারিয়েছিল। গাড়িতে একটা ব্যাগে বনানী দের যাবতীয় ডকুমেন্ট ছিল। বনানী দত্তর হাত ব্যাগে হয়তো একটা ভোটার কার্ড ছিল। কিন্তু সে ব্যাগ কোথায় ছিটকে গেছিল ভগবান জানেন। ওকেই বনানী দে ভেবে নেয় সবাই। যে মিশনারি স্কুলে চাকরী নিয়ে বনানী যাচ্ছিল তারাই খবর পেয়ে ওর ভার নেয়। দু মাস পর সুস্থ হয়ে উঠে বনানী দত্ত বনানী দে হয়ে যায়। এরপর নিশ্চিত চাকরী, নিরাপত্তার জীবন। প্রথম প্রথম আনন্দ আর বনানীর কথা মনে পড়লেও ধীরে ধীরে নিজেকেই বনানী ভাবতে শুরু করেছিল। কেউ কখনো ভুলটা ধরতে পারেনি। বনানী দে সরকার হয়েই কেটে গেছিল পনেরোটা বছর।

কিন্তু হঠাৎ করে যে জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে আসবে ভাবেনি কখনো।

একটা হিম শীতল অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। পনেরো বছর ধরে নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যের পরিচয় বয়ে চলছে শুধু পরিস্থিতির চাপে। কিন্তু কে মানবে ওর কথা !! এই চাকরী, এই নিশ্চয়তা , নিরাপত্তার জীবন কোনটাই তার নয়। এগুলোর লোভেই সে সত্যকে লুকিয়েছিল একদিন তাই বলবে সবাই।

হঠাৎ করে যে আনন্দর খোঁজে একদিন ওর ভাই চলে আসবে ও কখনো ভাবেইনি।

পরদিন সারাটা সময় আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে কেটেছে বনানীর, স্কুল যেতে পারেনি টেনশনে। বারবার মনে হয়েছে পুলিশ এলো বলে। সন্ধ‍্যায় কাজের মেয়েটি এসে বলে -''আপকা যো গেষ্ট কাল আয়া থা দিদি ও ঠিক হ‍্যাায় তো?''

-''কিউ রে ?'' ভয়টা আবার পেয়ে বসে নতুন করে।

-'' নেহি, কাল বিজলি গিরনেসে এক টুরিষ্ট চল বসা, ইয়েহি আপার কার্ট রোড মে... লোকাল নিউজ দেখিয়ে না দিদি। জানা পহচানা লাগ রাহা থা। ''

কাঁপা হাতে টিভিটা চালায় বনানী। লোকাল চ‍্যানেলে নেপালী লোকগীতি চলছে। নিচে অবশ‍্য নিউজ ফিড আসছে। ঐ তো .. ব্রেকিং নিউজ ** ( হিন্দিতে)

#কাল সন্ধ্যায় ঝড়ের সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে কালিম্পঙের আপার কার্ট রোডে।

#বাজ পড়ে মারা গেছেন একজন টুরিস্ট।

#পকেটে পরিচয় পত্রে নাম ছিল 'অমৃত সরকার। '

# তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি পুলিশ এখনো।

রিমোটটা রেখে উঠে দাঁড়ায় বনানী। ধীরে ধীরে মনস্থির করে, বনানী দে সরকার হিসাবে নিজের কর্তব্য পালন করতেই হবে। এক বিধবা মা নিজের সন্তানের অপেক্ষায় বসে আছে কোথাও। আগেরবার পারেনি, এবার পারতেই হবে। কৃতজ্ঞতা জানানো যে তার কর্তব্য।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama