Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Classics

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Classics

ধর্ষিতা মেয়েটি

ধর্ষিতা মেয়েটি

5 mins
469


একটা নারীর উপরে যখন জীবনের অভিশাপ হয়ে ঘটে কোন ধর্ষণের মত পাশবিক অপরাধ, তখন মেয়েটি দুই দিকের আঘাতে আহত হয় - একদিকে শারীরিক ক্ষত এবং তার সাথে সাথে এক গভীর মানসিক ক্ষত। শরীরের ক্ষত হয়তো এক সময়ে মিলিয়ে যায়, কিন্তু মানসিক ক্ষত সহজে মিলিয়ে যায় না। এই অসহনীয় মানসিক কষ্ট তাকে সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।


ধর্ষণের পর মেয়েটি যখন আত্মহত্যার জন্য ফাঁসি দিতে ফ্যানের সাথে নিজের ওড়না লাগাচ্ছে তখন তার চোখে এক ফোঁটা জল আসলো! ধর্ষিত হওয়ার সময় থেকে শুরু করে এখনো অবধি মেয়েটির চোখে জল আসে নি ,নরম হৃদয়টা যেন কঠিন হয়ে ছিলো, ঠিক আত্মহত্যার একটু আগে এক ফোঁটা চোখের জল পড়লো!

আর তাতেই যেন থমকে দাড়ালো মেয়েটি ! মেয়েটির মনে হল - ধর্ষিত হলাম আমিই, আবার নিজের প্রাণটাও আমিই দিতে যাচ্ছি?

ওই পশুটা তো ঠিকই বেঁচে যাবে!

না আর নয়, আমি আর কোনো বোনের ইজ্জত হারাতে দেবো না!

এই অত্যাচারের বিচার দেখেই যাবো!

হ্যাঁ ফাঁসি ওই পশুটার দেখবো!


নিজের পরনের ছেঁড়া জামাটা নিয়ে সে তার বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো , যে বাবার সামনে সে ঘোমটা দিয়ে থাকতো, আজ তার সামনে সে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া জামা গায়ে।

অসুস্থ বাবা তার গায়ের চাদরটা দিয়ে মেয়ের শরীরটা ঢাকলো।

মেয়েটির বাবার বুঝতে বাকি রইলো না তার মেয়ের সাথে কী ঘটেছে।

নিজের আদরের রাজকন্যাকে এমন দৃশ্যে কোনো বাবা দেখতে চাইবে না।

তবুও বাবা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

বললো ” মা তোর কিছুই হয়নি।

তুই আমার রাজকন্যা সেই ছোট্ট রাজকন্যাই।

হয়তো মেয়েটির বাবা চাইছে না কাউকে বা পুলিশকে কিছু বলুক। কারণ সমাজের নোংরা মানুষরা তার মেয়েকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। তার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সে কাউকে জানাতে চায় না।

কিন্তু মেয়ে যে সেটা মানবে না, তার শরীরের আঁচড়গুলো যে এখনো জ্বলছে।

বাবার প্রতিবাদী মেয়েটা যে চুপ করে থাকবে না।


কী করবে ভেবে পাচ্ছিলো না মেয়েটি ! ছুটলো পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ তো প্রমাণ ছাড়া কিছুই করবে না কারণ এটা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পরে না।

তাকে প্রমাণ দিতে হবে সে আসলে ধর্ষিতা নারী কিনা।

স্নেহার জন্য এই যেন খুবই বেদনাদায়ক! ধর্ষিতা হলাম আর সেটার প্রমাণও লাগবে!

নিয়ে যাওয়া হলো মেডিকেলে ডাক্তারি পরীক্ষা হবে আসলেই সে ধর্ষিতা কিনা।

শুরু হলো পরীক্ষা!

পরীক্ষা টা এত নোংরা ভাবে করা হয় সেটা সে আগে জানতো না, এ যেন আরেকবার ধর্ষিত হলো!

এটা তার চেয়েও বেশি লজ্জাজনক মেয়েটির জন্য!

এখানে আসার চেয়ে বুঝি মরে যাওয়াটাই ভালো ছিলো!

মনে মনে ভাবতে লাগলো।

চোখের অশ্রু এবার আর এক ফোঁটা না বেশ কয়েক ফোঁটা ঝরতে লাগলো!


অনেক ডাক্তারি পরীক্ষার পর

প্রমাণ পেলো আসলেই একজন ধর্ষিতা নারী সে । মুহূর্তেই খবরটা ছড়িয়ে পড়লো!

ছুটে আসলো সাংবাদিক!

সমস্ত নিউজ চ্যানেলে তার ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে ধর্ষিতা নারী হিসেবে।

সবাই ওই ধর্ষকের বিচার চাচ্ছে।

দেশের প্রায় সবাই ধর্ষকের বিচার চাচ্ছে। মেয়েটি লক্ষ্য করলো সবাই বিচার চাচ্ছে, তাহলে এই ধর্ষকগুলো কে?

আসলে এটাই খুব বড় রহস্য।

কয়েক মুহূর্তেই সারাদেশ মেয়েটিকে চিনে ফেললো!

খবরের কাগজে ছাপা হলো মেয়েটির ছবি সাথে তার বাবার ছবিও!

এটা দেখে মেয়েটি ভাবলো ধর্ষিতা এবং ধর্ষিতার পরিবারকে সবাই চিনলো তবে ওই পশুগুলোর ছবি কেউ প্রকাশ করলো না!

না মেয়েটির চোখে আর কয়েক ফোঁটা অশ্রু বইছে না ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো।

সেদিনই যদি মরে যেত এই সুন্দর ধরণীটা দেখতে পেতো না! যেখানে ধর্ষিতা নারীর ছবি পরিবারসহ প্রকাশ পায়! ধর্ষকের ছবি আড়ালেই থেকে যায়।

এবার সত্যিই অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করছে মেয়েটির ! কার জন্য সে মরবে?

এখানে মরেও যে শান্তি পাওয়া যাবে না মৃত ছবিটাও তুলে খবরে প্রকাশ করা হবে, এই সেই ধর্ষিতা নারী ! হয়তো কবরেও শুয়ে থাকতেও পারবে না, কবর থেকে উঠানো হবে ময়না তদন্ত করা হবে!

এসব কিছুর পরেও মেয়েটির মনে একটাই বিশ্বাস হয়তো কখনো বিচার হবে সেই মানুষ রূপী পশুটার।

কিন্তু মেয়েটি এটাও ভাবে যেখানে ধর্ষক জেনেও কিছু শিক্ষিত আইনজীবী ধর্ষকের পক্ষে আইনি লড়াই করে সেখানে বিচার কার চাইবে? যেখানে আইনজীবীরাই এক একটা বড় ধর্ষক হয়ে দাঁড়ায়।

তবুও মন যে চায় ধর্ষকের বিচার হোক।


সমাজে মেয়েটির নাম এখন সবার মুখে মুখে! কিন্তু সব মানুষ তার দিকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকায়।

সে কি অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা?

নাতো সবকিছুই ঠিক আছে! তবুও কেন এই দৃষ্টিভঙ্গি?

মনে মনে এসব ভাবতে থাকে মেয়েটি ।

তার সহপাঠীদের সবার বিয়ে হচ্ছে! চোখের সামনে হই হুল্লোড় করে তাদের বাবা বিয়ে দিচ্ছে!

এসব দেখেই যাচ্ছে! তাকে যে কেউ বিয়ে করতে রাজি হবেনা।

সারাদেশ জানে সে ধর্ষিতা নারী! চোখের জল যে আর নেই! যাক ভালোই কান্নাটা কে কেমন জানি শত্রু মনে হয় এখন।

মেয়েটি ভাবতে থাকে সেই ছোটবেলার কথা। কত সুখী ছিলো তাদের পরিবার। তার গ্রাম সম্পর্কিত মামা ছিলো খুব ধনী লোক। গ্রামের সর্দার ছিলো। তাকে তার মামা ভীষণ ভালোবাসত আর আদর করতো। সে সময় মামা বলেছিলো তার ছেলের বউ করে নেবে মেয়েটিকে । তাহলে দুটি পরিবার এক এক হয়ে যাবে । তার মামী তাকে শাড়ী পরিয়ে সাজিয়ে দেয় যতবার সে মামার বাড়িতে যায়।কপালে একটা চুমো দিয়ে চোখে কাজল লাগিয়ে দিতো।

তবে খুব আশ্চর্যের বিষয় এখন তারা মেয়েটির পরিচয় দিতে অস্বীকার করে তারা। তার আদরের মামী বলে সে যেন মামার বাড়িতে না যায়। মামা তাকে চিনতেও রাজি না।

তার শরীরের কি এমন দাগ লাগলো যে সবাই এমন করবে তার সাথে?

এসব ভাবছে আর হাসছে - সেদিন যদি মরে যেত প্রিয় মানুষগুলোর ব্যবহারটা দেখতো না।

একজন ধর্ষিতা নারীর সাথে কি ঘটতে পারে, সেটাও দেখা হলো।

মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়! আর বলে - আমার কি কখনো বিয়ে হবেনা? আমি কি এতটাই অপবিত্র?কি দোষ ছিলো আমার?

ধর্ষিত হয়ে বিচার না চাওয়াই কি আমার জন্য শ্রেয় ছিলো?

সেদিন কি মরে যাওয়াই ভালো ছিলো?

ধর্ষিত হয়ে চুপচাপ থাকো এটাই কি ধর্ষণ গল্পের সারমর্ম?

প্রশ্নগুলোর উত্তর কে দিবে?

মেয়েটি সেটা জানেনা! সে আকাশের দিকে এখনো তাকিয়ে আছে।

তার শরীরে এখন আর সেই জোশ নেই যেটা ফাঁসির দড়ি ছেড়ে বলেছিলো যে আর কোনো বোনের ইজ্জত হারাতে দিবো না। ওই পশুগুলোর বিচার দেখেই যাবো।

এ জোশ আর কেন শরীরে আসছেনা সেটাও মেয়েটির জানা নেই।

এখনো আকাশের দিকেই তাকিয়েই রইলো। ঘরে ফিরলো না!

অনেকদিন হলো স্নেহাকে দেখা যাচ্ছে না। বেশ কয়েকদিন হলো মেয়েটির নিঃশ্বাস টা প্রকৃতি অনুভব করছে না।

কোথায় গেলো মেয়েটি কেউ জানেনা।

মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এজন্য তার বাবারও কোনরকম মাথা ব্যথা নেই।

মেয়েটি কি এতটাই বোঝা হয়ে ছিলো সমাজে?

তার বেশ কয়েকদিন পর মেয়েটির নিথর দেহটা পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রাণহীন সেই দেহ। অনেক শকুন ভীড় করেছে লাশের গন্ধে। শকুনরা ছিড়ে খাচ্ছে মেয়েটির দেহটা।

শীতের ওই উত্তরের বাতাসে ভেসে আসছে না সেই ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ।

আকাশ বাতাস যেন ভারী হয়ে আছে, পাখির কিচিরমিচির যেন আজ অন্যরকম শোনা যাচ্ছে!

প্রকৃতি কি শূন্যতা অনুভব করছে ওই অপবিত্র মেয়েটার জন্য?

কে জানে হয়তো প্রকৃতির খুব আপন ছিলো মেয়েটি ।

তবে আজ মেয়েটি হয়তো খুব খুশি।

তার সুন্দর দেহটা সত্যিই শকুনে ছিড়ে খাচ্ছে!

কোন মানুষ রূপী শকুনরা ছিড়ে খাচ্ছে না।

হ্যাঁ মেয়েটি আজ পৃথিবীর মাঝে নেই।

তবে পৃথিবী সত্যি কি আজ বোঝা ছেড়ে বাঁচলো?হয়তো না!

পৃথিবীর মাঝে এরকম শত মেয়ের বাস।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy