চোরাবালি
চোরাবালি
মিটিং চলাকালীন ব্যাগের মধ্যে মুঠোফোনের বারংবার কম্পন শর্মীকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। অফিসের সময় খুব কম ফোন আসে শর্মীর। আসলে গত কয়েক বছর ধরে নিজেকে আত্মীয়, বন্ধু, সমাজ সকলের থেকে এমন ভাবে গুটিয়ে নিয়েছে ও যে, ফোন আসাই কমে গেছিল। এই জিও নম্বরটা কয়েকমাস আগেই নেওয়া, মাত্র কয়েকজন নম্বরটা জানে। কোনোরকমে মিটিংটা শেষ করে ফোনটা বের করেই শর্মীর কপালে চিন্তার ভাঁজ, ঋতমের স্কুল থেকে ফোন। ওর ক্লাস টিচার ফোন করেছেন তিনবার। দ্রুত হাতে নম্বরটা রি-ডায়াল করে করিডরে এসে দাঁড়ায় সে। ওপাশে রিং হচ্ছে। এক, দুই, তিন, প্রতিটা সেকেন্ড আশংকার দোলাচলে কাটতে থাকে । অবশেষে....
ও পাশে ফোনটা তুলতেই শর্মী নিজের পরিচয় দেয়।
-"ম্যাম, আপনাকে একটু স্কুলে আসতে হবে । ঋতমের একটু প্রবলেম ....." মিস দত্তার কথা শেষ হওয়ার আগেই শর্মী বলে ওঠে, -"কি হয়েছে ঋতমের? কোনও এক্সিডেন্ট?"
-"না তেমন কিছু নয়। ও ঠিক আছে। বাট.... আপনি একটু আসুন। আমরা ওয়েট করছি। "
ফোনটা কেটে দেয় ওধার থেকে।
একরাশ উদ্বেগ নিয়ে শর্মী বসের ঘরে ছুটির কথা বলতে ছোটে। ঘড়িতে বারোটা।সাড়ে বারোটায় স্কুল ছুটি হয়। ট্যাক্সি নিলে মনে হয় পৌঁছে যাবে ।
স্কুলের সামনে বারোটা পঁচিশে যখন নামলো, গার্জিয়ান আর কার-পুলের ভিড়। সেইসব কাটিয়ে অফিসের দিকে এগিয়ে গেলো সে। প্রিন্সিপালের ঘরেই ছিল ঋতম। মিস দত্তা যা বলল তা এই যে আজ টিফিনের সময় ঋতম হঠাৎ সাম্যকে খুব মেরেছে। সাম্যকে বাঁচাতে গিয়ে করণ আর আর্য ওর হাতে মার খেয়েছে। মিসদের হস্তক্ষেপে অবশেষে ঋতমকে ছাড়ানো হয়।এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এমন হল।
পাঁচ বছরের ঋতম কিছুতেই বলছে না কি হয়েছিল। বাকিরাও বলতে পারছে না। শর্মী মাথা নিচু করে বসে ছিল। সিঙ্গেল পেরেন্টস বলে এতো ভালো স্কুলে ভর্তি করতে ওকে অনেক ধরাধরি ও টাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। দু বছর হল ছেলে এখানে পড়ছে । ঋতম এমনিতে খুব শান্ত। কিন্তু শর্মীর কথারও কোনও উত্তর দিল না ঋতম। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে শর্মী ছেলে নিয়ে বার হয়ে এলো। ভাগ্য ভালো যারা মার খেয়েছে আগেই এসে তাদের মায়েরা নিয়ে গেছে। নয়তো এখন শর্মীকে আরও কিছু কথা শুনতে হতো। ওর ফোন নম্বর রয়েছে সাম্যর মায়ের কাছে। হয়তো ফোন করবে। চারদিকে চোরাবালি, শর্মী পথ খোঁজে।
ছেলেকে না বকে অনেক করে জানতে চাইল শর্মী যে কি হয়েছিল। ঋতম চুপ। ঠোঁটের কোন আর কপাল ফুলে রয়েছে। বাড়িতে পৌঁছে ছেলে কিছু খেতেও চাইলো না। হাত পা ধুইয়ে সর্বদা কাজের মেয়ে মিতুর হাতে ওকে দিয়ে শর্মী দেখল ঘড়িতে দুটো কুড়ি। চাইলে হাফ- ডে অফিস করা যায়।
ঋতম চুপ করে খাটে বসে রয়েছে। ঠিক বাবার মতো। রাগ হলে প্রিয়ম এমন করত। শর্মী গিয়ে ছেলের পাশে বসে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে যায়। ছিটকে সরে যায় ঋতম।
শর্মী বলে, -"তাহলে কি আমি অফিস চলে যাবো ? ভেবেছিলাম আজ যখন ফিরেই এসেছি একটু শপিং মল, গেম জোন আর ভালো চাইনিজ ....."
-" আমার কিচ্ছু চাই না, কোথাও যাবো না, " চিৎকার করে ঋতম পাশের টেবিলে সাজিয়ে রাখা খেলনাগুলো ছুঁড়ে ফেলে। মিতু দৌড়ে এসে ওকে চেপে ধরতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ছোট্ট শিশুটা। শর্মী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তবে কি বাবার অভাবে ছেলেটা এমন ....
কিন্তু শর্মী তো ওকে কখনো বুঝতে দেয়নি বাবার অভাব। আগেরবার ফাদারস-ডে' তে ও মারপিট করেছিল স্কুলে। কে নাকি ওর বাবা নেই বলে ওকে কিছু বলেছিল।
প্রিয়ম ডিভোর্সের পর একবারও ছেলের খোঁজ নেয় নি। সাত মাসের ছেলেকে নিয়ে একলা পথ চলা শুরু করেছিল শর্মী। চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতে প্রতি মুহূর্তে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বেঁচে ওঠার চেষ্টা করে চলেছে ও।
তিনবছর মা ছিল সাথে। হঠাৎ করে মা ও চলে গেছিল হার্ট এ্যাটাকে। মিতু ছিল বলে এখনো পারছে ও। এখনো মাঝে মাঝে বিনিদ্র রাত্রে প্রিয়মের ফেসবুকে দেখে ওর সুখী পরিবারের ফটো। পৃথাকে বিয়ে করেছিল ডিভোর্সের দু মাসের মধ্যেই। তিনবছরের রেহানকে নিয়ে ওদের সুখের সংসার। নিজের ঔরসজাতর খোঁজও নেয় না প্রিয়ম। শর্মী শুধু ছেলের দিকে তাকিয়ে জীবনে আর কাউকে আসতে দেয়নি।
-"দিদি, ঋতমের বোধহয় জ্বর এসেছে। গা টা গরম। " মিতুর ডাকে আবার ছেলের ঘরে আসে শর্মী। ঘুমিয়ে গেছে, এখনো গালে চোখের জলের দাগ শুকিয়ে। আলতো করে কপালে হাত রাখতেই তাপটা অনুভব করে। এরপর থার্মোমিটার, জলপট্টি, ওষুধ, কিন্তু প্রতিবারের মতো জ্বর বেড়েই চলেছে। ঘুমন্ত ছেলেকে বুকে চেপে 'ওলা' বুক করে শর্মী ছোটে ডাক্তারের কাছে। এমন আগেও হয়েছে। ছেলে তার খুব চুপচাপ, কষ্ট চেপে রাখতে গিয়ে ..... সেবার কনভালসনে চলে গেছিল ।
-"আপনাকে আগেও বলেছি, ওর মনের মধ্যে একটা বড় শূন্য স্থান আছে। যেটায় ধাক্কা খেলে ও সহ্য করতে পারে না। ছোট তো, আপনি ওকে একটু বেশি সময় দিন। " ডাক্তার সেন বলেন শর্মীকে।
'সময়', শর্মী ভেবে পায় না আর কি করে সময় দেবে। কত মা তার মতো একা বাচ্চা মানুষ করে। শর্মীর বাবা মারা গেছিল ও যখন আট বছরের। শর্মী আর ওর ভাইকে মা একাই বড় করেছিল। ছেলের দিকে তাকিয়েই চাকরি করে সে। খোরপোষ নেয়নি প্রিয়মের থেকে, ছেলের খরচাও নেয় না। অফিসের আগে পরে পুরো সময় ছেলেকে দিয়ে রেখেছে।অবশ্য স্কুল থেকে একটায় বাড়ি ফিরে সপ্তাহে পাঁচদিন সন্ধ্যা অবধি ওকে মিতুর কাছে থাকতে হয়। এতে কিছু করার নেই শর্মীর।
-"দেখুন খেলনা বা জিনিস দিয়ে নয়, ভালবাসা দিয়ে ওকে কাছে টানুন। জিনিস পেয়ে পেয়ে ও এমন হয়ে গেছে এসবের গুরুত্ব নেই ওর কাছে। না পাওয়ার দিকটাও ভাবুন একবার। ও সাবকনসাসে যা বলেছে আপনি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। ওর বন্ধু ওকে বলেছিল আপনি হয়তো এরপর ওর জন্য নতুন বাবা নিয়ে আসবেন, সে ওকে হোস্টেলে দিয়ে দেবে, তাতেই ও ক্ষেপে গেছিল। মিস বোস একা বাচ্চা বড় করা একটা চ্যালেঞ্জ। "
ডাঃ সেনের মুখে এমন একটা কথা শুনে অবাক হয়ে যায় শর্মী। দিন চারেক আগে অফিসের এক কলিগের সাথে 'সিসি-২' তে গেছিল। সাম্যর মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল সেখানেই। মহিলার কথাবার্তা ভালো লাগেনি সেদিন। সাম্যর সামনে নিশ্চই এসব আলোচনা করেছে ঐ মহিলা। নাহলে এতোটুকু ছেলের মাথায় এসব আসবে কেন? সমাজের এই চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে শর্মী।
-"অবশ্য আজকাল এমন কেস প্রচুর আসে যেখানে বাবা মা দু জনেই চাকরী করে, নিজের নিজের জগতে ব্যস্ত। বাচ্চাকে সময় দেয় না। চাইল্ড ক্রাইম বাড়ছে দিন দিন। আগে একান্নবর্তী পরিবারে সবার আদরে অনেক ভাই বোন একসাথে বড় হত। এখন অণু পরমাণু পরিবারে একা একটা বাচ্চা, বন্ধু বলতে টিভি যা আসলে প্রচুর ভুলভাল শেখায়। আপনি ওকে ব্যস্ত রাখার জন্য আঁকা, ক্যারাটে এসব শেখান। যত বেশি এসবে ব্যস্ত থাকবে তত ভালো। আর না পাওয়ার দুঃখটা ওকে বোঝান। আপাতত কাল জ্বর না আসলে ছুটি দেবো ।"
অলস পায়ে ছেলের কেবিনের দরজা ঠেলে ঢোকে শর্মী, ঘুমিয়ে আছে ঋতম।লাল ঠোঁট দুটোয় অভিমানের ছোঁওয়া। প্রিয়মের মতোই হয়েছে ছেলেটা। শর্মী মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরে ঋতম। ঠিক চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতে যে ভাবে সবাই বাঁচতে চায়!!
আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঋতমকে নানারকম বই পড়ে শোনায় শর্মী, মিতুকেও বলেছে দুপুরে ওকে বই পড়ে শোনাতে। এইট পাশ মিতু বাংলাটা ভালোই পড়ে। নিজের ছোটবেলার গল্প বলে ছেলেকে। তবুও সেদিন রাতে ছেলে গলা জড়িয়ে বলল, -"আমার স্কুলে সবাই তোমায় খারাপ বলে মা। বলে তুমি বাবাকে ছেড়ে দিয়েছ, একা থাকো ..... ওরা আমার সাথে মেশে না। খেলতে চায় না। আমার কোনও বন্ধু নেই মা!! "
শর্মী কথা খুঁজে পায় না। শিশুমনের সহজ সরল প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। প্রিয়ম বিয়ে করে সংসার করছে সেটাও তার দোষ। প্রিয়মের পৃথার সাথে সম্পর্ক ছিল, তবুও ওকে বিয়ে করে ওর জীবনটা এভাবে তছনছ করল , তবুও সমাজ তার দিকেই আঙ্গুল তোলে সর্বদা। এরা কেমন মা, যারা নিজেদের বাচ্চাদের মনে এসব ঢুকিয়ে দিচ্ছে এ বয়সে ! এতো ভালো স্কুলে ছেলেকে পড়ানোর এমন ফল ! সমাজটাই তলিয়ে যাচ্ছে চোরাবালিতে। বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
আস্তে আস্তে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শর্মী বলে, -"ওরা যা ইচ্ছা বলুক, তুমি মারপিট করবে না আর। আমি তোমায় অনেক ভালবাসি। বাবা তো সবার থাকে না। আমারও ছিল না। তুমি বই পড়ো। "
রবিবার ছেলেকে আর মিতুকে নিয়ে শর্মী একটা অনাথ আশ্রমে যায়। ছেলেকে বোঝায় যে এদের বাবা মা কেউ নেই। বাড়ি নেই। কিন্তু এরাও লড়াই করছে । বাচ্চাগুলোকে নানারকম উপহার দেয় ঋতম, ঐ টুকু পেয়ে ওদের খুশি দেখে ঋতমের মুখেও খুশির ছোঁওয়া। সারাদিন ওদের সাথে হেসে খেলে ঋতম আজ অন্য মানুষ। অনেক বন্ধু পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছে।
রাতে বাড়ি ফিরে মা কে জড়িয়ে ধরে বলে -"এখন আমার অনেক ফ্রেন্ড। আর আমি লাকি যে আমার তুমি আছো। ওদের যে কেউ নেই। আমরা আবার যাবো তো? "
-"না বাবু, ওদের সাথে আমরা আছি, তুমি আছো, ভগবান আছেন। নিশ্চই আবার যাবো ওখানে। "
নানারকম গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায় ঋতম। ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শর্মী ভাবে এ ভাবেই লড়াই চালাতে হবে চোরাবালির বুকে।