Sayandipa সায়নদীপা

Romance

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Romance

ছোটি সি বাত

ছোটি সি বাত

12 mins
776


গল্পটা এমন কিছু নতুন নয়, বরং বেশ পুরোনো। এটা আমার, আপনার, আমাদের সবার জীবনের কোনো না কোনো সময়ের গল্প। 


   সময়টা বসন্ত কাল, প্রকৃতি আবার সেজে উঠছে নতুন করে। তাতাইদের কলেজ ক্যাম্পাসে একটা কাগজ ফুলের গাছ ছিল। শীত পড়তে না পড়তেই গাছটা কেমন ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিল, এখন বসন্তের আগমনে আবার রং লেগেছে তার মনে। গাছটার নীচে বাঁধানো বেদীটা লালে লাল। কলেজের গেট পেরিয়ে সবার প্রথম যে বেঞ্চটা নজরে পড়ে সেটার দিকে তাকাল তাতাই, দিশানের তো ওখানেই থাকার কথা, ওখানেই তো থাকে সে, কিন্তু কই আজ নেই তো! তাতাইয়ের ডাস্ট এলার্জি আছে, কোনোদিনও বাসে আসার সময় খুব ধোঁয়া ধুলো যদি নাকে ঢোকে তাহলে ভয়ঙ্কর রকম শুকনো কাশি শুরু হয় ওর, কাশির দমকে মনে হয় বমির সঙ্গে পেটের ভেতরের কলকব্জা বেরিয়ে আসবে। এই রকম দিনগুলোয় বাস থেকে নেমে শানকে একটা ফোন করে দেয় সে, "শান একটা ক্লোরমিন্ট কিনে রাখ।" কলেজে নেমেই ক্লোরমিন্টটা মুখে দিয়ে শান্তি পায় সে, কাশিটাও বন্ধ হয়ে যায়। এক টাকার ক্লোরমিন্টের প্যাকেটে দুটো করে চুইংগাম থাকে, একটা নিজে খেয়ে আরেকটা শানের মুখে ভরে দেয় ও। আজও সেই রকমই একটা দিন, কিন্তু শান গেল কোথায়!!! আশেপাশে তাকাতে তাকাতেই তাতাইয়ের নজর পড়ল কাগজফুলের গাছটার দিকে। বেদীটায় দুটো মানুষ বসে আছে। তার মধ্যে একটা যে শান তা বলে দিতে হয়না, আরেকজনকে একটু ভালো করে খেয়াল করতেই তাতাই চিনতে পারল, ও রাশি। ইকোনোমিক্সে পড়ে। শান আর রাশি একই স্যারের কাছে পল সায়েন্স পাস পড়ত দুই বছর। দুজনে বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল। থার্ড ইয়ারে পাস সাবজেক্ট নেই, তাই দুজনের দেখাও হয়নি বোধহয় বহুদিন। তবে হোয়াটসএপে যোগাযোগ আছে বলেই ধারণা তাতাইয়ের। অবশ্য সামনাসামনি গল্প করা আর চ্যাটে গল্প করার মধ্যে পার্থক্য অনেক। ওদের দিকে এগিয়ে গেল তাতাই। তাতাইয়ের দিকে নজর পড়তেই শান উঠে এসে ওর হাতে ক্লোরমিন্টটা গুঁজে দিয়ে রুক্ষ গলায় বলল, "পূজারা বাগানের দিকে গেছে।" একটু যেন থতমত খেয়ে গেল তাতাই। শানের আচরণে স্পষ্ট ইঙ্গিত, সে চায় তাতাই ওখান থেকে চলে যাক। খারাপ লাগল তাতাইয়ের। সে মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল খানিক, তারপর কি মনে হতে পেছন ঘুরতেই দেখতে পেল শানের হাতে রাশির হাত, গাছের থেকে কাগজ ফুল ঝরে পড়ছে ওদের মাথার ওপর। স্তম্ভিত হয়ে গেল তাতাই…. তবে কি ও যা আশঙ্কা করছিল সেটাই সত্যি! তবে মেয়েটা রাশি হতে পারে বলে ও ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি। না চাইতেই চোখে জল চলে এলো তাতাইয়ের, পা দুটো ভারী হয়ে এলো। একটু এগিয়েই একটা সিমেন্টের বেঞ্চে ধপ করে বসে পড়ল তাতাই। সে ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে প্রতিবারের মত, কিন্তু…


                   ★★★★★


ঝগড়াটা কিভাবে শুরু হয়েছিল ঠিক মনে পড়ছে না তাতাইয়ের, কিন্তু ওই যা হয় আরকি… দুটো মানুষ কাছাকাছি থাকলে মাঝেমাঝে মনোমালিন্য তো আসাই স্বাভাবিক, তা বলে কি এমন হল যে ফাটল ধরল তাদের সম্পর্কে! গন্ডগোলের আয়ুটা তো বেশিদিন নয়, তার মধ্যেই শান…! নাকি তার আগে থেকেই, গন্ডগোলটা তারই রেশ! আর ঝগড়ার রেশটা টানতে ইচ্ছে করছিলো না, এমনিতেই কলেজ তো শেষের মুখে, ক্লাস বন্ধ। সামনাসামনি দেখা হওয়ার সুযোগ থাকেনা। তার ওপর পড়াশুনো সামলে ফোনের ওপারে যেটুকু কথা তাতেও ঝগড়া ঠিক যেন মানা যায়না। আজ ফিজ জমা দেওয়ার দিন ছিল, তাতাই ভেবেছিল অনেকদিন পর দেখা হচ্ছে যখন তখন মিটিয়ে ফেলবে মনোমালিন্য, কিন্তু সে সুযোগ বোধহয় আর নেই। এই ক'দিনেই যদি সম্পর্কটা ভাঙার ছিলো তাহলে কাছাকাছি এসেছিল কেন? তাতাই ভাবত সে এখন অনেক পরিণত হয়ে গেছে, আর নিশ্চয় সহজে ভেঙে পড়বে না। কিন্তু তাও আজ কেন এতো কষ্ট হচ্ছে???


    শানের পিসতুতো দাদার বিয়ে, ব্যস্ততা তুঙ্গে। এর মাঝেই কি নিয়ে যেন একটা ফোনে মন কষাকষি হয়েছিল। ঠিক করে মনেও পড়ছে না কিছু। তাতাই তারপর শানকে ফোন করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শান ফোন তোলেনি, কেটে দিয়েছিল…


"কিরে একা একা কি ভাবছিস?" 

আচমকা কে যেন কাঁধে হাত দিতেই সম্বিৎ ফিরল তাতাইয়ের। সাকিব দাঁড়িয়ে সামনে। নিজেকে সামলে নিয়ে তাতাই বলল,

"কিছু না রে। ওদিকে শুরু হয়ে গেছে?"

"না না। তা শান কোথায়?"

"জানিনা।"

"একটা ছেলেকে দেখলাম ওই কাগজ ফুলের গাছটার তলায়, শানের মত লাগল। কিন্তু মেয়েটা অন্য ডিপার্টমেন্টের।"

"ওহ।"

আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তাতাইয়ের। সাকিব নাছোড়বান্দা। ছেলেটা এমনই। কলেজ ক্যান্টিন হোক বা কলেজ ফেরৎ কোনো রেস্টুরেন্টে দেখা, কিংবা টিউশন শুরুর আগের কিছু মুহূর্ত--- তাতাই যখনই ভাবে শানের সাথে একান্তে কিছু সময় কাটবে তখনই সাকিব এসে হাজির হয়েছে মাঝে। দুজনেরই ভালো বন্ধু,ছেলেটা সরলও বটে, তাই ওকে এড়িয়ে যাওয়া যায়না। কিন্তু একেক সময় প্রাইভেসির বড্ড অভাব বোধ করে তাতাই। শানেরও একই রকম অভাববোধ হয় কিনা কে জানে! অবশ্য তার কেনই বা হবে! 

"ওই কিছু কি হয়েছে?" তাতাইকে আবার থম মেরে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল সাকিব। তাতাই দুদিকে ঘাড় নাড়ল শুধু।



    দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। ফাইনাল পরীক্ষার আগে কালকেই হয়তো শেষ দেখা। সাকিব তাতাই আর শানকে টেনে টেনে এনেছিল লাইব্রেরিতে। মিনিট পাঁচেক পরই শান ট্রেন আছে বলে উঠে চলে যায়। অথচ এই শানই একসময় একটার পর একটা ট্রেন ইচ্ছে করে মিস করত তাতাইয়ের সঙ্গে সময় কাটবে বলে। ফিজ জমা দেওয়ার দিন শান রাশির সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল লাইনে, কিছুই বলতে পারেনি তাতাই। অন্যরা ওকে জিজ্ঞেস করছিল, "কিরে শানের সঙ্গে ওই মেয়েটা কে?"

"ওর বন্ধু।" জবাবটা দিতে গিয়ে নিজেরই গলাটা কেঁপে গিয়েছিল তাতাইয়ের। শান দাদার বিয়েতে ব্যস্ত, ইন্টারনাল এসেসমেন্টের সাজেশনগুলো তাতাই রেডি করে ওকে পাঠিয়েছিল হোয়াটস্যাপে। শান ছোট্ট করে লিখেছিল, "thnx"... ব্যস আর কিছুনা। ওই ছোট্ট শব্দেই যেন অনেককালের বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। কালকে পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে শানকে বলতে শুনেছিল একটা প্রশ্ন ঠিক করে লিখতে পারেনি। কথাটা সে সাকিবকে বললেও তাতাই আগে বাড়িয়ে বলেছিল, "আমি তো ওই প্রশ্নটা ভালো করে রেডি করে পাঠিয়েছিলাম, পড়লি না কেন?"

"আমি নিজের পড়া নিজের মতো করে করেছি। কারুর উপর নির্ভর করা আমার পছন্দ নয়।" সেদিনের মতোই রুক্ষ স্বরে জবাব দিয়েছিল শান। তাতাইয়ের মনে হয়েছিল এই একটা কথাতেই যেন শেষ আশার আলোটুকুকেও নিভিয়ে দিলো মানুষটা। 

 

   আজ শান উঠে যাওয়ার পর তাতাই দেখেছিল শান কলেজ থেকে বেরিয়ে না গিয়ে ওদের ক্লাসের অন্য ছেলেদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। সাকিবেরও নজরে পড়েছিল ব্যাপারটা। বিচ্ছিরি লেগেছিল তাতাইয়ের, নিজেকে অপমানিত মনে হচ্ছিল। তাতাই আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, "আমি আসছি। ভালো করে পরীক্ষা দিস।"

"আরে দাঁড়া আমিও যাবো।" সাকিবও উঠে পড়ল ওর সঙ্গে। লাইব্রেরী থেকে বেরোতে বেরোতে সাকিব জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে তোদের?"

"কিছুনা।"

"আমি তোদের এতো ক্লোজ ফ্রেন্ড, আমার থেকে লুকোতে পারবিনা।"

"কি হয়েছে সেটা আমিও ঠিক জানিনা যে তোকে জানাবো কিছু। যা তুই দেখছিস চোখের সামনে তা আমিও দেখছি।"

"সেদিন সেই মেয়েটা…"

"আমি কিছু জানিনা, বাস এসে গেছে আমার।" 

আর দাঁড়ায়নি তাতাই। বাসটা প্রচন্ড ভীড় হওয়া সত্ত্বেও ঠেলেঠুলে উঠে পড়েছিল। ওখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না।



"না জানে কিউ হোতা হ্যা ইয়ে জিন্দেগী কে সাথ, আচানক ইয়ে মন

কিসি কে জানে কে বাদ করে ফির উসকি ইয়াদ

ছোটি ছোটি সি বাত..."



ব্লুটুথ স্পিকারে গান চলছে নিজের ছন্দে। তাতাইয়ের কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কান্না আসছে না। হয়তো কাঁদলে মনটা কিছুটা হালকা হত। মনে অনেক গুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে--- কবে? কেন? কিভাবে? হয়তো প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলে মনে শান্তি হবে না। লাইটটা বন্ধ করে ব্যালকনিতে বসেছিল তাতাই। ফোনটা বাজলো টুং টাং করে। আজকাল ফোনটা বাজলেই তাতাইয়ের হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে, মনে হয় যেন শান ফোন করছে। কিন্তু ফোনটার কাছে গেলেই ভুল ভাঙে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। মোবাইলের স্কিন জুড়ে একটা নাম… প্রশান্ত। গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে ফোনটা ধরল তাতাই, "হ্যালো ব্রো।"

"তা ব্রো কি ডিসাইড করলি বল।"

"আমি তো আগেই বলেছি রে আমায় পক্ষে যাওয়া পসিবল না, সামনে পরীক্ষা তার ওপর বাবা মাও…"

"ধুরর তুই না একেবারে রসকষহীন! চল রাখলাম এখন, নন্দিনীকে ফোন করে দেখি তার কি খবর।"

"ওকে বাই।"

"বাই।" ফোনটা রেখে দিলো প্রশান্ত। তাতাই কান থেকে ফোনটা নামানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখলো আরেকটা কল ঢুকলো--- সাকিব। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর সাথে, তবুও এড়ানো তো যায়না। অগত্যা ফোনটা ধরল তাতাই। 

"কার সাথে কথা বলছিলি? শান?"

"নাহ, প্রশান্ত।"

"ওহ তোর সেই বুজুম ফ্রেন্ড। তা যাচ্ছিস নাকি ওর সঙ্গে?"

"তুই কি করে জানলি?"

"তুইই তো সেদিন বলেছিলি, ভুলে গেলি?"

"ওহ হবে হয় তো। মনে নেই। বল কি বলছিলি?"

"শান ফোন করেছে ফেরার পর থেকে?"

"নাহ। কেন বলতো?"

"আমি জানতে চাই ছেলেটা ভাবছে কি! এভাবে কতদিন চলবে? লাস্ট তোকে কবে ফোন করেছিল?"

"মনে নেই।"

"চ্যাট করেছিস?"

"নাহ।"

"বাহ্ ওয়ান্ডারফুল। শোন তৃষা তুই বলে সহ্য করছিস, ও কি ভাবছে টা কি? আমি কিন্তু ওকে বেশ কিছুদিন ধরে ওয়াচ করছি। ভেবেছিলাম তোদের ঝামেলা তোরা মিটিয়ে নিবি কিন্তু ওই রাশির সাথে সেদিনের হাসাহাসি আর প্রকাশ্যে তোকে এরকম এভয়েড করা, আই কান্ট টেক দিস এনি মোর।"

সাকিবের কথায় কিছু বলল না তাতাই। সাকিব একটু অপেক্ষা করে আবার নিজ থেকেই বলে উঠল, "ও যদি তোর সাথে খারাপ করে না তাহলে আমার থেকে খারাপ কিন্তু কেউ হবে না।"

"ছাড় না সাকিব।"

"নাহ, ছাড়ার জায়গায় নেই এটা। আমি ওর সাথে এক্ষুণি কথা বলছি।"

"নাহ সাকিব প্লিজ।"

"কেন?"

"আমাকে নিয়ে কোনো কথা বলবি না ওর সঙ্গে, প্লিজ।"

"আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তুই এভাবে সহ্য করছিস কেন? কিছু একটা কর। শোন ওকে বল এভাবে দু'নৌকায় পা দিয়ে চলা যায়না।"

"হুমম।"

ফোনটা রেখে দিল তাতাই। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সাকিব যদি কথা বলতে যায় তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বই ভালো হবে না। অবশ্য ভালো হওয়ার আর কি আছে কে জানে!!! ফোনটা রেখে আবার ব্যালকনির দিকে যেতে গিয়েই তাতাইয়ের মাথায় যেন হঠাৎ ধাক্কা দিলো সাকিবের ক'টা কথা। যখন ফোনে সে বলছিল কথাগুলো তখন ওগুলোকে অতোটা মন দিয়ে শোনেনি কিন্তু এখন…"ওকে বল এভাবে দু'নৌকায় পা দিয়ে চলা যায়না।" 

সত্যিই তো শুধু যে শান দু নৌকায় পা দিয়ে চলছে তা না, এর জন্য তো তাতাইয়ের নিজের নৌকোটাও টলোমলো হয়ে গেছে। এই যে ভর সন্ধ্যেবেলায় ও না পড়ে অন্ধকার ঘরে বসে আছে, প্রতি মুহুর্তে অদ্ভুত একটা একাকীত্ব কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে… এভাবে কতদিন চলবে? শান যদি ওর সাথে আর থাকতে না চায় ঠিক আছে, কিন্তু সেটা মুখে বলুক। নাহ, এভাবে আর চালানো যাবে না। ঘুরে গিয়ে ফোনটা তুলে নিলো তাতাই। শানের নম্বর ডায়াল করল, অন্যদিনের মতোই আজও রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল ফোনটা। ফোনটা কান থেকে সরালো তাতাই, ওর বুকে এখন যেন হাতুড়ি পিটছে কেউ। দ্রুত আঙ্গুল গুলো চলল… "যদি কোনোদিনও একবারের জন্যও আমাকে বন্ধু বলে ভেবে থাকিস তাহলে কল ব্যাক করবি, চিন্তা করিস না বেশি সময় নেবো না।"


   তাতাইয়ের বিশ্বাস ছিল ফোনটা আসবেই। এলো,দেড় ঘন্টা পর। 

"বল কি বলবি?"

ওপ্রান্ত থেকে ডি.জের আওয়াজ ভেসে আসছে প্রচন্ড ভাবে। তাতাইয়ের মনে পড়ে গেল, আজ শানের পিসতুতো দাদার বৌভাত। একটা লম্বা শ্বাস নিলো তাতাই, তারপর বলল,

"তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে, খুব দরকারি। কলেজে আসিস একবার।"

"কাল তো…"

"আমার কথা বলতে হয়তো আধঘন্টা লাগবে, বা দশ মিনিটেও মিটে যেতে পারে সব টুকু যদি তুই চাস সেরকম।"

"কি এমন কথা?"

"কি কথা সেটা তুইও জানিস, কিন্তু হয়তো চাইছিস আমি আগ বাড়িয়ে বলি তাই কালকেই বলবো নাহয়।"

  ফোনটা রেখে সাকিবকে ব্যাপারটা জানিয়ে একটা মেসেজ করল তাতাই, বলল যে কাল শানের সঙ্গে একলা কথা বলবে ও। সাকিবকে ব্যাপারটা না জানালে এক্ষুণি হয়তো আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গিয়ে পরিস্থিতি হিতে বিপরীত করে দেবে।


                  ★★★★★


আজকে রোদ উঠেছে প্রচন্ড। কলেজ ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে তাতাই আর দিশান। এই সময় ক্লাস থাকে না বলে ক্যান্টিনে লোকজনের আনাগোনা খুবই সীমিত। ফ্যান চলা সত্ত্বেও দরদর করে ঘামছে ওরা। তাতাইয়ের মনে পড়ে গেল যেদিন প্রথম ওরা ক্যান্টিনে খেতে এসেছিল একসাথে, সেদিন তাতাই শানকে ঘামতে দেখে অবাক হয়ে বলেছিল, "তোকেও এতো ঘাম দেয়!!! আমি ভাবতাম আমাকেই শুধু…"

"আর আমি ভাবতাম আমাকেই শুধু…"

এরপর হাসিতে গড়িয়ে পড়েছিল দুজন। সেদিনের মতোই আজও সেই একই ক্যান্টিন, একই মানুষ, শুধু পরিস্থিতিটা ভিন্ন। 


"কি বলবি বল, বাড়িতে অনেক কাজ আছে।"

প্রথম নীরবতাটা ভাঙল শান। তাতাই প্রায় বছর আড়াই আগের নস্টালজিয়ায় ডুবে গিয়েছিল, সম্বিৎ ফিরতে লাগলো কয়েক সেকেন্ড, আর কয়েক সেকেন্ড লাগলো নিজেকে প্রস্তুত করতে। এখন ওকে সেই প্রশ্নটা করতে হবে যেটা করতে গিয়ে ওর গলা কাঁপবে নিশ্চিত, "তোর কি কাউকে ভালো লাগে? মানে নতুন করে কাউকে…"

"কাকে?" শানের গলায় বিস্ময়।

তাতাই অধৈর্য, "সেটা আমি কি করে জানবো?" 

"নতুন কেউ…! নতুন বৌদির বোনের কথা বলছিস?"

এই প্রশ্নে তাতাইয়ের মনে পড়ে গেল শানের পিসতুতো দাদার বিয়ের ঠিক হওয়ার পর শান তাতাইকে রাগাবে বলে ফেসবুকে একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলেছিল, "আমার দাদার হবু শালি, কি স্মার্ট কি সুন্দরী দেখেছিস!"

এরপর ওরা খুনসুটিতে মেতে ছিল সেদিন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাতাই,

"নাহ। আমি রাশির কথা বলছি।"

"রাশি! তোর কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? রাশি আমার কত ভালো বন্ধু জানিস না? তাকে নিয়ে এইসব…"

"ভালো বন্ধু হলেই কি নিজের গার্লফ্রেন্ডকে তাড়িয়ে সেই মেয়েটার হাত ধরে বসতে হয়?"

"কি বলতে চাইছিস কি?"

"বুঝতে পারছিস না? ফিজ জমা দেওয়ার দিন কি করেছিলি মনে নেই?"

"নাহ নেই।"

"আচ্ছা তাহলে আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমি কলেজে ঢোকার সাথে সাথে আমার হাতে ক্লোরমিন্টটা গুঁজে দিয়ে আমাকে সেখান থেকে তাড়ালি।"

"এভাবে বলছিস কেন? আমার সাথে রাশির অনেক দিন পর দেখা হয়েছিল, ও ওর একটা প্রবলেমের কথা শেয়ার করছিলো তাই ভাবলাম তোরা হয়তো দুজনে দুজনের উপস্থিতিতে কম্ফোর্টেবল ফিল করবি না, তাই তোকে বলেছিলাম ওদিকে পূজারা আছে। তাড়াতে যাবো কেন?"

"তাই নাকি? আচ্ছা মেনে নিলাম এটা। কিন্তু আমি কিছুটা এগিয়ে পেছন ঘুরতে যে দেখলাম তোরা হাত ধরে বসে আছিস?"

"তোর কল্পনার জাল এখানে বিস্তার করিসনা প্লিজ।"

"তুইও জানিস কল্পনা নয়, আমি নিজের চোখে দেখেছি।"

"ভুল দেখেছিস, আমি কেন অন্য একটা মেয়ের হাত ধরতে যাবো খামোকা?"

"শান আমাকে যদি অন্য কেউ এসে বলতো এই কথাটা তাহলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু নিজের চোখকে কি করে অবিশ্বাস করি বল?"

"কিন্তু তোর চোখ তোকে ধোকা দিয়েছে, এটাই সত্যি। আমি রাশির হাত ধরিনি।"

"কিন্তু…"

"এক মিনিট…"

"কি?"

"রাশির ফোনটা আমি কয়েকবার হাতে নিয়েছিলাম ওর হাত থেকে, তুই দূরের কোনো এঙ্গেল থেকে সেটা দেখেই ভাবিসনি তো যে আমি ওর হাত ধরে আছি? ইয়েস, এটাই হয়েছে। দেখ তোর আমাকে বিশ্বাস নাহলে করিসনা,কিন্তু তুই যতবার আমাকে জিজ্ঞেস করবি আমি একই কথা বলবো।"

"তাহলে মেনে নিচ্ছি তোর জীবনে নতুন কেউ আসেনি। কিন্তু আমার সাথে এরকম ব্যবহার করছিস কেন? আমাকে এভয়েড করছিস কেন?"

"আমি এভয়েড করছি নাকি তুই করছিস?"

"আমি? দিনের পর দিন ফোন না ধরা,মেসেজের রিপ্লাই না করা এগুলো কে করছে?"

"আমি তো বলেই ছিলাম দাদার বিয়ের কদিন ব্যস্ত থাকবো তাই কথা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু…"

"কিন্তু কি?"

"তোর তো আমাকে পছন্দ নয়। আমি তোর কাছে মূল্যহীন।"

"মানে?"

"প্রশান্তর মত ভালো আমি হতে পারবো না তো কোনোদিন। হি ইজ এ পারফেক্ট গাই।"

"ওই কি বকছিস? মাথার ঠিক আছে তো? এর মধ্যে প্রশান্ত এলো কি করে?"

"সে তো ছিলই বরাবর। তোর কাছেই সবসময় শুনতাম পুরু এই পুরু সেই… আর তারপর প্রশান্তর সাথে যে তুই বাইরে যাচ্ছিস সেই একবারও আমাকে জানলি না হ্যাঁ?"

"আমি পুরুর সাথে বাইরে যাচ্ছি!! গাঁজা খেয়েছিস নাকি? আমি নিজেই জানিনা আমি পুরুর সাথে কোথাও যাচ্ছি বলে।"

"কিন্তু সাকিব যে বলল!"

"সাকিব! হে ভগবান…!!! সেদিন পুরু আমায় ফোন করে বলে আমরা অবিনাশ স্যারের কাছে যে দশ জন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তাম তারা সবাই মিলে একদিন বেলপাহাড়ি ঘুরতে যাবে প্ল্যান করেছে। তো আমাকেও ডাকছিল, আমি তখনই না বলে দিই। মে বি সাকিব তার পরেই ফোন করছিল একটা পড়া জানবে বলে, তাই কথাটা বলা হয়ে যায় ওকে। আমার তো নিজের মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা।"

"উফফ সাকিব…!!!! ও আমাকে এমন ভাবে বলল যে…"

"আর পুরু আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুদের একজন, আমার ভাইয়ের মত বলতে পারিস, রাখি বাঁধি প্রত্যেক বছর।"

"আয়াম সরি, আমার মাথার ঠিক ছিল না। এমনিতেই তোর সাথে কিছু নিয়ে একটা আর্গুমেন্ট হয়েছিল তার ওপর সাকিব ওটা বলতে আমার মাথার ঠিক ছিল না।"

"সাকিব… সব সময়, যখনই তোর সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাই তুই ওকে নিয়ে এসে হাজির হোস।"

"ও হ্যালো ম্যাডাম, আমি ওকে আনিনা, তুই আনিস।"

"আমি আনিনা… মে বি ও নিজেই চলে আসে।"

"আসলে ও ভাবে ও আমাদের এতো ভালো বন্ধু যে আমরা ওর কিছু লুকোতেই পারিনা।"

"এটা কেমন কথা। যত ভালো বন্ধুই হোক, আমাদের প্রাইভেট লাইফ বলেও তো কিছু আছে নাকি!"

"ও হয়তো ভাবে আমাদের প্রাইভেট লাইফ ওকে ছাড়া নয়। 

একেকদিন জানিস তো তোকে অনেক কিছু বলার থাকে কিন্তু ও থাকায় বলতে পারিনা। আমার ভালো লাগে না, ট্রেন মিস করে ওর সাথে গল্প করার জন্য বসে থাকতে… ওর সাথে তো আমার দেখা হয় অন্য সময়ও, আমি ওর বাড়ি যাই, ও আমার বাড়ি আসে কিন্তু…"

"কিন্তু তোর আর আমার দেখা হয়না এতো ফ্রিকোয়েন্টলি। তোকে ফোন করলেও একেক সময় বিজি পাই। ও কল করে তোর সাথে কথা বলে ঘন্টার পর ঘন্টা।"

"হুমম… তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?"

"সাকিব… আমদেরই দোষ হয়তো।"

"হুমম, আমরা কোথায় যাবো কি করব সবসময় সেটা হয়তো ওকে বলা ঠিক হয়নি। সবাই তো সমান নয়, ও ভেবে নেয় আমরা ওকেও আসতে বলছি।"

"সেটাই। আর একটা কথা শান, এবার থেকে আমার ওপর কোনো কারণে রাগ হলে বা কোনো কিছু খারাপ লাগলে প্লিজ কথা বলিস। এভয়েড করা, বা চুপ করে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। 

   আজ যদি আমরা কথা না বলতাম তাহলে আমাদের সমস্যাগুলোর কথা বুঝতেই পারতাম না।"

"ইয়েস, এ সিম্পল টক ক্যান মেক থিংস মাচ বেটার।"

"ইয়াপ।"


Rate this content
Log in