ছবির পরিচয়
ছবির পরিচয়
"দাদা, তোর মায়ের সম্পর্কে কিছু মনে আছে?"
বোন বাণীর কথাটা শুনে চমকে উঠল বিদ্যুৎ। বাণীর গলাটা কাঁপছে।
"কী হয়েছে তোর?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইল বিদ্যুৎ। বাণী আগের মতোই কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "আমি ফোনে তোকে সব বলতে পারব না। তুই শুধু বল মাকে তোর মনে আছে?"
"সত্যি বলতে কিছুই মনে নেই। আমি তখন মাত্র দুই বছরের যখন তুই হলি আর তার এক বছর পর মা চলে গেল।"
"হুমম। আর বাবাকে?"
"মানে?"
"মানে আছে দাদা। তুই আমার সঙ্গে এক্ষুণি দেখা করতে পারবি কোথাও?"
"এক্ষুণি! কেন? বিকেলে বাড়িতে গিয়ে নাহয়…"
"বাড়িতে সম্ভব নয় দাদা।"
একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে বিদ্যুৎ আর বাণী। বাণীর মুখটা থমথম করছে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না বিদ্যুৎ। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীরবতা ভাঙল বিদ্যুৎই, "কী হয়েছে তো বল। কী এমন কথা যা বাড়িতে বলতে পারবি না?"
বিদ্যুতের প্রশ্নের বাণীর গলার কাছটা একটু ওঠানামা করল। তারপর বাণী নিজের ফোনটা নিয়ে একটা ছবি ঘুরিয়ে দিল বিদ্যুতের দিকে, "চিনতে পারছিস?"
ফোনটা হাতে নিয়ে বিদ্যুৎ দেখল কোনো এক এলবাম থেকে তোলা একটা ছবি, অনেক পুরোনো হবে। দুটো একদম ছোট বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছে। ছবিটা বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পরেই চমকে উঠল বিদ্যুৎ, "আমরা!"
"হ্যাঁ আমরা।"
"কোথায় পেলি এই ছবি? এটা তো আগে দেখিনি।"
একটা ঢোক গিলল বাণী, "দেখা সম্ভবও ছিল না।"
"কেন?"
"এটা আজ আমি অজিত দার বাড়ি থেকে পেয়েছি।"
"অজিত দা... মানে তোর কলিগ?"
"হ্যাঁ।"
"তার বাড়িতে আমাদের ছবি কী করে?"
"জানি না। অজিত দার ছেলের অন্নপ্রাশনের দিন সাইক্লোন হয়েছিল মনে আছে তোর?"
"হ্যাঁ।"
"কেউ তো যেতে পারিনি ওই দিন, তাই আজকে অজিত দা আমাদের ওর বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই আড্ডা চলছিল। আড্ডা চলতে চলতেই ওর বোন এসে আমাদের বাড়ির সব এলবাম দেখাচ্ছিল। দেখাতে দেখাতে হঠাৎ একটা অনেক পুরোনো এলবামে এই ছবিটা আমি দেখতে পাই।"
"তুই জিজ্ঞেস করিসনি কিভাবে এল?"
"করেছি। তবে এটারও আগে অন্য একটা ছবি ছিল। সেটা দেখ…"
এই বলে বাণী ফোনে আরেকটা ছবি খুলে দেখায় বিদ্যুৎকে। ছবিটা বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পরেই আচমকা উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ।
"এ...এ… এটা…"
"আমারও তোর মতোই অবস্থা হয়েছিল। এটা সত্যিই সে। আমরা এর আগে তার বিবাহিত অবস্থার কোনো ছবি কখনও দেখিনি।"
"কিন্তু… তুই জিজ্ঞেস করিসনি কিছু?"
"করেছিলাম।"
"অহনা বলল এটা ওদের বড় কাকিমা। মারা গিয়েছেন।"
আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল বিদ্যুৎ, "আর এই ছবি দুটো?"
"ওদের বড় কাকুর প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়ে মানে এই বড় কাকিমার সন্তান।"
"এরা এখন কোথায় জানতে চাসনি?"
"চেয়েছিলাম। অহনা বলেছে এরা নিরুদ্দেশ।"
"তুই… আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুই…"
"ওদের বড় কাকুকেও দেখলাম।" দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বাণীর চোখ দিয়ে, "ভদ্রলোকের গলার ওপর ঠিক এই রকম একটা আঁচিল।" এই বলে নিজের গলার আঁচিলটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল বাণী। প্রায় মিনিট পাঁচেক হতভম্বের মত বোনের আঁচিলটার দিকে তাকিয়ে রইল বিদ্যুৎ। তারপর অস্ফুটে বলে উঠল, "এসবের মানে কী!"
"জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।"
"কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? আমাদের নিশ্চয় কিছু ভুল হচ্ছে।"
"ভুল! এইসব চোখের দেখা ভুল বলতে চাইছিস?"
"কাকতলীয় হতে পারে।"
"কী কাকতলীয় হবে?"
"হয়ত এটা মায়ের যমজ বোন।"
"আর তার সন্তানরা হুবহু আমাদের মত দেখতে? আমার শরীরে হুবহু এই ভদ্রলোকের মত আঁচিল? সবটা কাকতলীয় বলতে চাইছিস?"
"তাহলে আমরা এতদিন যার কাছে আছি, যাকে বাবা বলে জেনেছি তিনি কে?"
"এর উত্তর তো একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।"
"বাচ্চা দুটো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল বলছিস… নিরুদ্দেশ…?"
"হুমম।"
★★★
দরজাটা খুলে বেশ অবাক হলেন সুনির্মল বাবু। তাঁর ছেলেমেয়ে কখনও একসঙ্গে বাড়ি ফেরে না, আজকে দুজনেই একসঙ্গে এসে হাজির।
"কী রে তোরা আজ একসঙ্গে!"
"হ্যাঁ বাবা।"
ছেলেমেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে সোফায় বসল। সুনির্মল বাবু একটু অবাক হলেন, ওরা তো ঘরে ঢুকেই আগে বাথরুমে যায়। আজকে কী হল হঠাৎ!
"তোরা বাথরুমে যাবি না?"
"যাব। তার আগে তুমি একটু বোসো, কথা আছে।" বলল বাণী। ভ্রূ কুঁচকে সোফায় বসলেন সুনির্মল বাবু, "কী ব্যাপার বলত?"
"বাবা, মা ঠিক কবে মারা গিয়েছিল?"
"চোদ্দই এপ্রিল, উনিশশো একানব্বই।"
"তিরিশ বছর হয়ে গেল, তাই না?"
"হ্যাঁ রে।"
"বাবা, মায়ের আর তোমার কখনও একসঙ্গে ছবি দেখিনি তো।" বলল বিদ্যুৎ। চমকে উঠলেন সুনির্মল বাবু। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, "সুযোগ হয়নি।"
"তোমাদের বিয়ের এলবাম।"
"নেই।"
"মায়ের বিবাহিত অবস্থার কোনো ছবি?"
"নেই।"
কথাটা বলেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন সুনির্মল বাবু, "কী বলতে চাও খোলসা করে বল। এভাবে জেরা কোরো না।"
"আপনি কে?" এবার সরাসরি প্রশ্ন করল বাণী। সুনির্মল বাবু সাময়িক হতভম্ব হয়ে গেলেন, পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "নিজের বাবার পরিচয় ভুলে গিয়েছো নাকি?"
"হয়ত।"
"আমার নাম শ্রীযুক্ত সুনির্মল চৌধুরী, একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক।"
"বেশ। আর আমাদের নাম কী?"
"সেটাও ভুলে গিয়েছ? যাইহোক, মনে করিয়ে দিই। শ্রীমান বিদ্যুৎ চৌধুরী আর কুমারী বাণী চৌধুরী।"
"আর আমাদের মায়ের নাম কী? পুরো নাম বলবেন।"
এবার গলাটা কেঁপে উঠল সুনির্মল বাবুর। প্রায় মিনিট খানেক চুপ করে থাকার পর কোনোক্রমে বললেন, "শ্রীমতী ইলা মিশ্র।"
বাণীর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল, বিদ্যুতের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে উচ্চারণ করল, "দাদা…"
বাণীর হাতের উপর হাত রাখল বিদ্যুৎ। তার বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে। সে একটা জোরে শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আমার মায়ের স্বামীর নাম কী?"
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না সুনির্মল বাবু। ধপ করে আবার বসে পড়লেন সোফায়।
"কী হল, আমার মায়ের স্বামীর নাম বল।" কান্নাভেজা গলায় বলল বাণী।
"শ্রীযুক্ত…"
"শ্রীযুক্ত?"
"শ্রীযুক্ত শম্ভুনাথ মিশ্র।" কথাটা বলেই দু'হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন সুনির্মল বাবু।
"এদের চেনেন?"খানিক পরে বাণীর গলা শুনে মুখের ওপর থেকে হাত সরালেন সুনির্মল বাবু। মেয়ের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা পুরোনো ছবি। ছবির মানুষ দুটোকে বিলক্ষণ চেনেন তিনি। আস্তে আস্তে মাথাটা নাড়লেন। একটা ঢোক গিলে বিদ্যুৎ বলল, "এনাদের ছেলেমেয়ে অনেক ছোটবেলায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল।"
"নিরুদ্দেশ!" চমকে উঠলেন সুনির্মল বাবু, "কে বলেছে?"
"ওদের পরিবার থেকে জেনেছি। এই তাদের ছবি।"
বাণী আবার একটা ছবি দেখাচ্ছিল ফোনে, সেদিকে তাকালেন না সুনির্মল বাবু। একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল তাঁর মুখে। ছেলেমেয়ের চোখে চোখ রেখে বললেন, "বল, কী বক্তব্য তোমাদের।"
"আপনি কে? আমরা আপনার কাছে এলাম কী করে?"
"সে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।"
"আপনি বাধ্য। উত্তর না দিলে আমরা…"
"তোমরা কী?"
"কিছু একটা ব্যবস্থা নেব।" এবার জোরে হেসে উঠলেন সুনির্মল বাবু। বাণী চিৎকার করে বলল, "আমাদের মা মারা গিয়েছিল কিন্তু বাবা বেঁচে ছিল। তাও আপনার কাছে আমরা এলাম কী করে? আর আমাদের বাড়ির লোক জানে আমরা নিরুদ্দেশ।"
"এখন এত বছরের সম্পর্ক অগ্রাহ্য করে বাড়ির লোকের কাছে ফিরে যেতে চাও? আমি এতই খারাপ রেখেছিলাম তোমাদের?"
"খারাপ ভালোর প্রশ্ন আসছে না, আসছে সত্যির প্রশ্ন। আমরা কী সত্যিই তোমার সন্তান?"
"হ্যাঁ, তোমাদের আমি নিজের সন্তান বলেই জানি। কিন্তু আজকে বলছি আমার রক্ত তোমাদের শরীরে নেই।"
"তাহলে? কেন আমাদের পরিবার থেকে দূরে রেখেছেন? কেন আমাদের বাবা ভাবেন আমরা নিরুদ্দেশ?"
"উনি তা ভাবেন না, উনি মুখে বলেন।
যাইহোক, উত্তরটা আমি দিতেই পারতাম কিন্তু দেব না। তোমরা আমাকে বিশ্বাস করবে না। একটা ঠিকানা দিচ্ছি, সেখানে চলে যাও, তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।"
"কার ঠিকানা?"
"অলোক রঞ্জন মল্লিকের, ইলা মিশ্রের দাদা। তোমাদের মামা যার সঙ্গে তোমাদের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে।"
★★★
আমাদের গ্রামে হরিনারায়ন চৌধুরী ছিলেন নামী গানের শিক্ষক। গ্রামের সমস্ত অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়েরা তাঁর কাছে গান শিখতে যেত। ওই গান শিখতে গিয়েই কিভাবে যেন ইলা আর সুনিৰ্মলের মন দেওয়া নেওয়া হয়। ইলার যখন বিয়ের বয়স হয় তখন সুনির্মল তার বাবাকে বলে সে ইলাকে বিয়ে করতে চায়। ততদিনে সুনির্মল স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরী পেয়েছে। সুনির্মল ছেলে হিসেবে যে খুবই ভাল সে নিয়ে কারুর সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সুনির্মলরা ছিল সদগোপ আর আমরা ব্রাহ্মণ। বেজাতে মেয়ের বিয়ে দিলে আর বংশের মান থাকবে না এই ভয়ে বাবা রাজি হলেন না। ওরা অনেক কাকুতি মিনতি করল। এমনকি হরিনারায়ন চৌধুরী নিজেও কথা বলতে এলেন কিন্তু বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। অনতিবিলম্বে পালটি ঘর দেখে ইলার বিয়ে হয়ে গেল। সুনির্মল মনের দুঃখে ঘোষণা করল সে সারাজীবন বিয়ে করবে না। সে একপ্রকার বিবাগী হয়ে গেল বলা চলে। চৌধুরী বাবুও শোকে বেশিদিন বাঁচলেন না। এদিকে পরিবারের চাপে বিয়ে করলেও ইলাকে তার স্বামীর পছন্দ হল না। শ্যামলা গায়ের রং বলে অবহেলা করত সবসময়। এমনকি অনেক সময় ঘরের বাইরেও বের করে দিত রাতে। এদিকে টাকাপয়সার প্রয়োজন হলেই বাপের বাড়ি থেকে আনতে পাঠাত। বাবা নিজের ভুলটা বোধহয় ততদিনে বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু কিছু করার ছিল না। বাবাও চলে গেলেন কিছুদিনের মধ্যে। ততদিনে ইলার একটা ছেলে হয়েছে। বছর দুয়েক পর একটা মেয়েও হল কিন্তু ইলার অবস্থার পরিবর্তন হল না। ক্রমশ ইলার শরীর ভেঙে পড়তে পড়তে ইলা পৃথিবী থেকেই চলে গেল। ইলার স্বামী হল মুক্ত। সে আবার বিয়ে করবে কিন্তু পায়ের বেড়ি হল ছেলেমেয়ে। তাদের আমার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেল। কিন্তু আমার তখন রোজগার কম, নিজের সংসার রয়েছে। আমার স্ত্রীর ঘোর আপত্তি। ভাবছি আইনের সাহায্য নেব। এমন সময় গ্রামে এল সুনির্মল। সব শুনে সে বলল সে তার ভালোবাসার মানুষ ইলার ছেলেমেয়েকে সে দত্তক নিতে চায়। তার বক্তব্য ছিল এমন অবহেলায় ইলার পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু তাকে চলে যেতে হল। ইলার সন্তানদের সেই অবহেলা সে পেতে দেবে না। ভালোবেসেও ইলাকে সুনির্মল স্ত্রী হিসেবে পায়নি কিন্তু খাতায় কলমে লেখাপড়া করে ইলার সন্তানদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করল সে। আমাকে বলল তাদের নিয়ে সে অনেক দূরে চলে যাবে। সে চায় না তার সন্তানরা কখনও জানুক তাদের সঙ্গে যাদের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের কাছেই তারা ছিল অবাঞ্ছিত।
ট্রেনে করে ফেরার পথে বিদ্যুতের কাঁধে মাথা দিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছিল বাণী। তাদের কানে শুধু বাজছিল মামার বলা শেষ কথাগুলো।
স্টেশনে নেমেই প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ির সামনে এল তারা কিন্তু বাড়ির দরজায় দেখল বিশাল বড় একটা তালা ঝুলছে। চমকে উঠল ভাইবোন। বাবা কোথায় গেলেন! ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তারা। ভেতরে ঢুকতেই টেবিলের ওপর রাখা কাগজটা দেখতে পেল। বাণী ছুটে গিয়ে কাগজটা তুলে নিয়ে দেখল সেটা আসলে একটা চিঠি। বাণী পড়তে শুরু করল,
প্রিয় বিদ্যুৎ ও বাণী,
আশা করি এতক্ষণে তোমরা তোমাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছ। কিন্তু আমি সেই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর আজও পেলাম না- কোন সম্পর্কটা বড়? রক্তের নাকি আত্মার? আমার মনে হত আত্মার, আমি আজও তাই বিশ্বাস করি। সারাটা জীবন তোমাদের নিজের সন্তান ভেবে কাটিয়ে দিলাম। আগামীদিনেও তাই ভেবে যাব। ইলাকে আমি ভালোবেসেছিলাম, ইলার সঙ্গে আমি ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম। সে ঘর আমাদের বাঁধা হয়নি। কিন্তু তোমরা আমার জীবনে আসার পর আমার মনে হয়েছিল আমাদের সেই না বাধা ঘর বুঝি এবার সত্যিকারের বাঁধা হবে। ইলা তোমাদের মা ছিল, থাকবেও আমাদের স্মৃতির মধ্যে, আর আমি হব তোমাদের বাবা। তোমরা হবে আমাদের সন্তান। কিন্তু তোমাদের কাছে রক্তের সম্পর্কটাই বড়। তাই তো মাত্র একটা দিনে দুটো ছবি দেখে তোমরা নিমেষে আজ তিরিশ বছরের সম্পর্ক অগ্রাহ্য করে দিতে পারে। আঙ্গুল তুলতে পারলে আমার দিকে। নিমেষে বাবার স্থান থেকে নামিয়ে দিতে পারলে একজন প্রতারকের স্থানে। যাইহোক, সন্তানদের তো চিরকাল মা-বাবারা ক্ষমা করে দিয়ে আসেন। তোমরা না মানলেও আমি তো নিজেকে তোমাদের বাবা ভাবি, আমিও তাই রাগ করে নেই তোমাদের ওপর। তোমরা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছ। আগেই উইল করে আমার বাড়িটা তোমাদের ভাইবোনের নামে দিয়ে দিয়েছিলাম। তাই আমার দায়িত্ব শেষ। আমি চললাম। ঠিকানা বলা নিষ্প্রয়োজন। ভাল থেকো।
ইতি,
এক প্রতারক
চিঠিটা বিদ্যুতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল বাণী। চিঠিটা পড়ে কেঁপে উঠল বিদ্যুৎও। ভালোবাসা এমনও হয়! একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে এতটা ভালোবাসতে পারে যে তার মৃত্যুর পর তার সন্তানদের নিজের সন্তান বলে মানুষ করে অবলীলায়!
"এখন কী হবে দাদা? বাবাকে কোথায় খুঁজব? বাবা যে বড় অভিমানী। আমি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি দাদা… "
"অন্যায় আমরা দুজনেই করেছি। এমন একটা মানুষকে আমরা সন্দেহ করেছি যে মানুষটা আমাদের মত দুই অবাঞ্ছিতকে বুকে তুলে নিয়েছিল।"
"বাবা আমাদের কোনোদিনও ক্ষমা করবে না আর?"
"জানি না। তবে বাবাকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। বাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব দরকার হলে।"
"কিন্তু বাবাকে খুঁজবি কোথায়?"
"কিছু একটা করতেই হবে। যে করেই হোক বাবাকে আমি খুঁজে বের করবোই। চল বেরিয়ে চল, আর দেরী করিস না।"
"হ্যাঁ, চল। তবে তার আগে একটা কাজ সেরে নিই দাঁড়া।"
এই বলে নিজের ফোনটা বের করে দুটো ছবি খুলে মুছে ফেলল ছবি দুটো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "চল দাদা, আমাদের বাবাকে খুঁজে আনি…"
সমাপ্ত।