বুনোদাদুর বন্যরা
বুনোদাদুর বন্যরা
“কাকু গ্রামে ঢোকার মুখে একটা বুলডোজার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম!”
“হুম রে, বুনো দাদুর বাড়িটা ভাঙা হবে।”
“সেকি! কেন?”
“কারখানা তৈরির জন্য জমিটা লাগবে হেমন্ত কাকার।”
“কারখানা! এখানে! কেন?”
“সে আর আমি কি করে বলবো! নে নে তাড়াতাড়ি মুড়ি গুলো খেয়ে নে দিকি, কত বেলা হলো ভাত খেতে হবে তো আবার।”
“হ্যাঁ খাচ্ছি। আচ্ছা কাকু ঠাম্মা তো বলতো বুনো দাদু নাকি বাড়িটা স্কুল তৈরি করার জন্য দিয়ে গেছেন, তাহলে ওটা ভেঙে কারখানা তৈরি হবে কিভাবে?”
“বুনো দাদু স্কুল তৈরি করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু লেখাপড়া করে বাড়ি সুদ্ধ জায়গাটা দেওয়ার আগেই তো উনি…”
“গ্রামে তো একটাও স্কুল নেই আজও, হেমন্ত দাদুকে বলো না তোমরা সবাই মিলে।”
“দূর বোকা, হেমন্ত কাকু যদি শোনার লোকই হত তাহলে বহু বছর আগেই ওখানে স্কুল তৈরি হয়ে যেত। টাকার কুমির হয়ে গেছে রে লোকটা, আশেপাশের জমিগুলোও তো কিছু টাকা ধরিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে। গরিব লোকগুলোকে পার্টির লোক ধরে এনে ভয় দেখিয়েছে আর তারাও তাই মেনে নিয়েছে। গ্রামটা আর আগের মতো থাকবে না রে রোদ।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাকু। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রোদ আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা কাকু কারখানা তৈরি করতে গেলে তো অনেক পারমিশন জোগাড় করতে হয় শুনেছি, হেমন্ত দাদু এতো সহজে পারমিশন পেয়ে গেল?”
“কাকার তো অনেক বড় বড় লোকের সাথে ওঠা বসা আছে, তাই পারমিশন পেতে নিশ্চয় অসুবিধা হয়নি।”
“তাহলে কাকু ঘরটা ভাঙা হলে চামচিকে গুলো কোথায় যাবে?”
“তারা কি আর আছে রে খ্যাপা। কালই তো কাকার লোকেরা এসে ঘরের ভেতরে আগুন লাগিয়ে দিলো, সব কটা চামচিকে পুড়েছে। সে কি আওয়াজ, উফফ যে না শুনেছে সে কল্পনাও করতে পারবেনা।”
“মেরে ফেললো!”
“হুম।” কাকুর মুখে এই সংক্ষিপ্ত উত্তরটাই রোদের বুকের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকলো; অতো গুলো চামচিকেকে মেরে ফেললো!
মুড়ি খেয়ে ঘুরতে বেরোলো রোদ। ঠিক ঘুরতে নয় অবশ্য, ওর ইচ্ছে শেষবারের মতো বুনো দাদুর বাড়িটা একবার দেখবে। কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়ির সঙ্গে। বুনো দাদু ছিলেন রোদের দাদুর এক তুতো কাকা, তাই তিনি মোটেও রোদের বুনো দাদু নন, রোদের বাবা-কাকদের দাদু কিন্তু গোটা গ্রামসুদ্ধ লোকই কোনো অজানা কারণ বশত লোকটাকে “দাদু” বলেই সম্বোধন করে আর তাই রোদরাও বলে বুনো দাদু। এই বুনো দাদু মানুষটাকে রোদ কখনো চোখে দেখেনি, তবে ঠাম্মার মুখে গল্প শুনে শুনে রোদ মনে মনে বুনো দাদুর একটা ছবি এঁকে ফেলেছে। ঠাম্মার মুখে শুনেছে নিঃসন্তান বুনো দাদু নাকি নিরক্ষর ছিলেন কিন্তু এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। তিনি নাকি পশু, পাখি আর গাছপালা এসবের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তাই তো বুনো দাদুর বাগানের আম, কাঁঠাল গাছে নাকি প্রত্যেকবছর যে ফল হতো তা গোটা গ্রামের লোক ফেলে ছড়িয়ে খেয়েও শেষ হতো না। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়, রোদ জানেনা বুনো দাদুর আশ্চর্য ক্ষমতার গুণ তাঁর মৃত্যুর পরেও কাজ করে কিনা তবে ও নিজের চোখে দেখেছে বুনো দাদুর বাগানে আম কাঁঠালের বাড় বাড়ন্ত। শুধু তাই নয়, রোদ শুনেছে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সাত বিঘা জমিতে বুনো দাদু যাই চাষ করতো তাতেই নাকি ব্যাপকহারে ফলন হতো, এমনকি যে বছর গ্রামে আর কারুর ভালো ফসল হতো সে বছরও বুনোদাদুর জমি ভরা থাকতো।
এসব তো গেল গাছের কথা। ঠাম্মা বলতেন বুনো দাদু নাকি বাড়িতে অনেকরকম পশু, পাখি পুষতেন। গরু, ছাগলের সঙ্গে ছিল বিড়াল, খরগোশ, টিয়া, ময়না এরকম আরও কতো কি। কোনো পাখিকে তিনি খাঁচায় রাখতেন না, পাখিগুলো সারাদিন নিজেদের ইচ্ছে মতো উড়ে বেড়াত কিন্তু বুনোদাদুকে ছেড়ে কখনোই যেতো না। রোদ দেখেছে এখনো বুনো দাদুর বাগানে কতরকম পাখি খেলা করে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের যেটা ছিল সেটা হলো বুনোদাদু নাকি চামচিকে পুষতেন। হ্যাঁ, বুনোদাদুর বাড়ির একটা গোটা ঘরজুড়ে ছিল চামচিকের বাসা। বুনো দাদু মারা যাওয়ার পর আরও কয়েকটা ঘরে তারা তাদের বসতি বিস্তার করে নিয়েছিল। ছোটবেলায় রোদরা ভাইবোনেরা খেতে না চাইলে মা ঠাকুমারা ভয় দেখাতেন বুনোদাদুর চামচিকের ঘরে ভরে দিয়ে আসবেন বলে। সেই থেকে চামচিকে ছিল রোদের কাছে এক ভয়ের জায়গা। কিন্তু তাও একবার চামচিকে দেখার অদম্য আকর্ষণে দাদুর কাছে বায়না করে সেই ঘরে ঢুকেছিল রোদ। দাদু টর্চের আলো ফেলতে দেওয়ালের সঙ্গে চিটে বসে থাকা হাজার হাজার চামচিকে ঝটপট করে উঠেছিলো একসঙ্গে, বড্ড বিরক্ত তারা। ওদের দেখে আতঙ্কে কেঁদে উঠেছিল রোদ, দাদুকে জাপটে ধরে বেরিয়ে এসেছিল সেখান থেকে। তারপর কোনোদিনও আর বায়না করেনি।
রোদের পড়াশুনার জন্য ওকে নিয়ে ওর মা বাবা শহরে চলে গেছেন আজ বহু বছর। তবু ছুটিছাটা পেলেই রোদ চলে আসে গ্রামে, এখন একটু বড় হয়েছে বলে বাস ধরে একাই চলে আসতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে বুনো দাদুর বাড়ির কাছে চলে এলো রোদ। বাড়িটা গ্রামের এক প্রান্তে, বাগান ঘেরা দোতলা একটা মাটির বাড়ি। বুনোদাদুর বাড়ির পর কিছুটা ফাঁকা দিয়ে শুরু হয়েছে সারিসারি চাষের জমি। রোদ দেখলো এবারে জমিগুলোতে চাষ হয়নি, হবেও না আর কোনোদিন। ওই জমিগুলোর জায়গা দখল করে দাঁড়াবে এক বিশাল দৈত্যের মতো কারখানা। ও প্রায়ই বুনো দাদুর বাড়িটা দেখে অবাক হতো, একটা মাটির বাড়ি কতটা মজবুত করে তৈরি করা ছিল যে আজ এতো বছরেও দেখভাল ছাড়াই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ জানে ওর অবাক হওয়ার দিন শেষ, আর কিছুক্ষন পরেই হয়তো বাড়িটা মাটির সাথে মিশে যাবে। বাড়ি ভাঙার লোকজন এখনো এসে উপস্থিত হয়নি দেখে ও বাগানটায় ঢুকলো। বাগান বলতে বড়ো বড়ো সব ফলের গাছ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার একটাও পাখি ডাকছেনা কেন এখানে! এমনটা তো কখনো হয়না। তবে কি ওরাও বুঝে গেছে এই জায়গাটার ভবিতব্য! বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোদ, চামচিকে গুলো ওর কাছে একটা ভয়ের জায়গা ছিল ঠিকই কিন্তু ওরা এভাবে মরে গেলো ভেবেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে রোদের। ও শুনেছে একবার নাকি ওদের গ্রামের সব থেকে ধনী মাইতি বাড়িতে ওদের ছেলে মেয়েদের পড়ানোর জন্য শহর থেকে একজনকে গৃহ শিক্ষক আনানো হয়েছিল। সেই লোকটির সঙ্গে বুনোদাদুর খুব হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে মিশে বুনোদাদু নাকি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তাই তাঁর ইচ্ছে ছিল নিজের বাড়িসুদ্ধ জমিটা স্কুল তৈরির জন্য দিয়ে যাবেন। কিন্তু লেখাপড়া করে দেওয়ার আগেই একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে বুনোদাদু মারা যান হঠাৎ করে। তাই এই সব বাড়ি, জমি এখন বুনোদাদুর একমাত্র ভাইপো হেমন্ত দাদুর দখলে। রোদ ভাবলো এখানে স্কুল তৈরি হলে কি সুন্দর ব্যাপারটাই না হতো কিন্তু তার জায়গায়… কারখানা, কালো কালো ধোঁয়া! ভেবেই শিউরে উঠলো রোদ, যে মুক্ত বাতাসের টানে সুযোগ পেলেই বারবার ছুটে আসে গ্রামে সেই মুক্ত বাতাসটাই হারিয়ে যাবে চিরতরে! এই শান্ত নীল আকাশটা কালো ধোঁয়ায় ঢাকা হয়ে যাবে!
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির থেকে ইতিমধ্যেই ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি। গাড়ির থেকে নামলেন হেমন্ত পাল, নিজেই ড্রাইভ করে এসেছেন এতটা। মনটা তার বিরক্তিতে ভরে আছে, ড্রাইভার ব্যাটা আর পেট খারাপ করার সময় পেলোনা, আজই করতে হলো! তার ওপরে ঠিকেদারের লোক খবর পাঠিয়েছিল যে বুলডোজারটা অনানো হয়েছিল সেটায় নাকি কিসব গোলমাল হয়েছে তাই আজ বাড়িটা ভাঙা যায়নি। সব মিলিয়ে হেমন্ত পালের মনটা তেতো হয়ে আছে। এই কারখানাটার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন তিনি, যতদিন না কাজ শেষ হচ্ছে ততদিন তাঁর মনে শান্তি নেই। তাঁর ছেলেটাও হয়েছে অকর্মণ্য, কিছু মুখ ফুটে না বলে দিলে করতে জানেনা। আজ যখন সে বলল বাগানের গাছগুলো কাটায়নি হেমন্ত বাবু তো আকাশ থেকে পড়েছিলেন, তাঁরই ভুল এত বড় কাজের দায়িত্ব এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেকে দেওয়া উচিৎ হয়নি। কিন্তু তিনিই বা করবেনটা কি এমন একটা দরকারি কাজে কলকাতায় ফেসে গেলেন যে এদিকটার কাজে নিজে এসে নজরই দিতে পারলেন না। ছেলেটা যদি ঠিকঠাক সব করতো তাহলে আজ এই সময় তাঁকে এখানে আসতে হতো না। অদ্ভুত ছেলে বটে তাঁর, কাজের বেলায় কিছু নেই আর মুখে বড় বড় কথা। বড়ো দাদুর ইচ্ছে মতো তাঁর শখ ছিল এখানে স্কুল করবে। হেঁ হেঁ হেমন্ত বাবু কি আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলেন নাকি, ছেলের কারখানার কাজে কেন এতো আলসেমি তিনি কি আর বোঝেননা নাকি! আরে বাবা এ কারখানা কি আর তোর বাবা নিজের জন্য করছে! সবই তো তোরই ভবিষ্যতের কথা ভেবে করা। যাইহোক এখন হেমন্ত বাবু যাবেন কয়েকজন মজুরের সাথে কথা বলে কালকেই ওই গাছ গুলো কাটার ব্যবস্থা করতে, তারপর ওগুলো বেচার কাজটাও সেরে ফেলতে হবে। তাঁদের বাড়ির প্রাক্তন মজুর দিনুর বাড়ি যাওয়ার আগে হেমন্ত বাবু ভাবলেন একবার তাঁর কারখানার জায়গাটা দেখে নিয়ে যাবেন।
বুনোদাদুর বাড়ির সামনে আসতেই হেমন্ত বাবুর কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো কিন্তু প্রথমে ঠিক বুঝে উঠে পারলেন না অস্বস্তির কারণটা। একটু এগোতেই টের পেলেন জায়গাটা অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ লাগছে, এমনকি একটা ঝিঁঝিঁও ডাকছে না। পকেট থেকে ছোটো টর্চটা বের করে জ্বালালেন হেমন্ত বাবু, আলোটা ফেললেন একটা আম গাছের ওপরে। আশ্চর্য এই গ্রামের লোকগুলো একটাও আম রাখেনি নাকি! একটাও আম দেখা যাচ্ছেনা যে! হেমন্ত বাবু এগিয়ে গেলেন গাছটার কাছে, তখনই মাথার ওপর সজোরে কিছু একটা পড়ে থেঁতলে গেল। হেমন্ত বাবু মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন পাকা আম; কাথটা পুরো মাথায় মাখামাখি হয়ে গেছে। ইসসস… মুখ থেকে একটা শব্দ করে সেখান থেকে ছিটকে সরে এলেন হেমন্ত বাবু আর তখনই মাথার ওপর আবার আক্রমণ। এবারের আঘাতটা এতো জোরে এলো যে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়েই গেলেন তিনি; সামনেই দেখলেন গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা মাঝারি সাইজের এঁচড়। ভুতুড়ে কান্ড নাকি রে বাবা! দেখে দেখে তাঁর মাথাতেই পড়ছে সব! টর্চটাও হাত থেকে কোথায় ছিটকে পড়লো কে জানে! চাঁদের আলোটা অবশ্য আছে, তাই খুব একটা অন্ধকার নেই।
কোনোমতে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন হেমন্ত বাবু। নাহ এখন আর দিনুর বাড়ি যাওয়া যাবে না তার আগে নিজের পৈতৃক বাড়িটায় গিয়ে পরিষ্কার হতে হবে। হেমন্ত বাবুর বাবা শরৎ বাবুও ছিলেন বেশ বৈষয়িক মানুষ, তাই তাঁর বাবা অর্থাৎ হেমন্ত বাবুর দাদু মারা যাওয়ার সাথে সাথে সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিয়ে আলাদা সংসার পেয়েছিলেন বা বলা ভালো নিজের দাদাকে পৈতৃক বাড়ি থেকে কিছু জমিজমার বিনিময়ে সমূলে উৎখাত করে দিয়েছিলেন। তাঁর ভালো মানুষ দাদাও অবশ্য কোনো প্রতিবাদ করেননি। যাইহোক এখন হেমন্ত বাবু সেই পৈতৃক ভিটে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন গ্রামেরই এক দরিদ্র পরিবারের হাতে। হেমন্ত বাবুরা মাঝে মাঝে জমিজমা তদারকের জন্য এসে বাড়িটায় কাটিয়ে যান কটাদিন।
আচ্ছা কিসের একটা আওয়াজ আসছে না! খুব ক্ষীণ অথচ একটানা শোনা যাচ্ছে, না না ক্ষীণ নয়, আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। কিসের আওয়াজ! খুব যেন চেনা চেনা লাগছে! আওয়াজটার উৎস সন্ধানে মাথাটা এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগলেন হেমন্ত বাবু কিন্তু নাহ কোথাও তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই থপ করে কিছু একটা এসে লাগলো হেমন্ত বাবুর নাকের ওপর। স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশে মুখ হালকা একটা চিৎকার করে তৎক্ষণাৎ জিনিসটাকে নাকের ওপর থেকে উৎখাত করলেন তিনি। ঘটনার আকস্মিকতায় জিনিসটার চেহারা দেখার সুযোগ না পেলেও নাকে লাগা গন্ধের চোটে মালুম করতে পারলেন ওটা একটা চামচিকে। বিস্ময়ের ভাবটা কাটতে না কাটতেই পুনরায় চমকে উঠলেন হেমন্ত বাবু, তাঁকে ঘিরে উড়ে বেড়াচ্ছে শয়ে শয়ে চামকিকে… এতই আধিক্য তাদের যে আশপাশটা কালো হয়ে উঠেছে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এতো চামচিকে এলো কিভাবে! সবকটাকে তো কাল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল! আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন হেমন্ত বাবু। চামচিকে গুলোর ডানার ঝটাপটি, নখের আঁচড়ে চিরে যাচ্ছে তাঁর চোখ, মুখ, হাত। পাগলের মতো নিজের হাতগুলোকে শূন্যে ছুঁড়ে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন ওদের, কিন্তু সবই বৃথা। জন্তুগুলোকে দমায় কার সাধ্যি!
একি, ওখানে কি কেউ এসে দাঁড়িয়েছে! চামচিকেদের ভীড় ঠেলে সহজে যেন দৃষ্টিও পৌঁছতে চাইছেনা সামনে। ওদেরই কোনো একটার আক্রমণে কেটে যাওয়া ঠোঁটের জ্বালা নিয়ে কোনোমতে হেমন্ত বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কে ওখানে!”
“আমি…”
অচেনা গলা শুনে হেমন্ত বাবু খানিক সতর্ক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনি?”
“আমি রে হিমু, আমি।”
হিমু! ডাকটা শোনা মাত্রই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল হেমন্ত বাবুর, ওই ডাকটায় তো তাঁকে একজনই ডাকতেন। সন্ধ্যে থেকেই একের পর এক ঘটে চলা অস্বাভাবিক ঘটনার দৌলতে এমনিতেই তাঁর নার্ভ গুলো দুর্বল হয়ে এসেছিল এবার যেন কথা বলার সব শক্তি হারালেন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিই আবার বলে উঠলো, “কিরে হিমু ভয় পেলি নাকি? তোর যে অনেক সাহস!” হেমন্ত বাবু মুখ খুলেও কোনো কথা বলতে পারলেন না, শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরোতে লাগলো মুখ থেকে। সেই ছায়ামূর্তি এবার হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো, “ভেবেছিলি আমার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে আমাকে মেরে ফেললে আমার সব সম্পত্তি এমনিই তোর নামে হয়ে যাবে, স্কুল তৈরি করার জন্য আমি আর দিয়ে যেতে পারবোনা কিছুই। কিরে তাই তো?”
উত্তর দিতে যেতেই আবার মুখ থেকে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরোলো হেমন্ত বাবুর।
“আমার তো নিজের কোনো সন্তান ছিল না তাই তোকেই সন্তানের মত ভালোবাসতাম। তুই আমাকে মেরে ফেলার পর আজ এতো বছর এখানেই ঘুরছে আমার আত্মা, মুক্তি পায়নি কিন্তু তাও আমি তোর কোনো ক্ষতি করিনি কারণ তুই তো আমার সন্তানের মতো ছিলিস। কিন্তু তুই তো আর মানুষ নেই রে হিমু, তুই আর মানুষ নেই। তোকে আর আমি ক্ষমা করতে পারবোনা, তোর অপরাধের তো শেষ নেই রে। গ্রামের গরিব মানুষগুলোকে ঠকিয়ে জমি হাতিয়েছিস, তারপর যে জমিতে আমি ইস্কুলের মতো একটা পবিত্র প্রতিষ্ঠান তৈরি করবো ভেবেছিলাম সেখানে তুই কারখানা বানাতে চাস! গ্রামের বিশুদ্ধ পরিবেশটাকে নষ্ট করতে চাস! এই যে এতো চামচিকে ঘুরতে দেখছিস, এদের সকলকে তুই কাল অন্যায় ভাবে মেরে ফেলেছিস। আমি তোকে ছেড়ে দিলেও এরা তো তোকে ছাড়বে না রে… হাঃ হাঃ হাঃ…”
বুনো দাদুর আত্মার বিকট হাসিতে কেঁপে উঠলো চারিদিক আর সেই সাথে হেমন্ত বাবু দেখলেন শয়ে শয়ে চামচিকে এবার তাদের বিক্ষিপ্তভাবে ওড়া থামিয়ে তাঁরই দিকে ধেয়ে আসছে একযোগে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। পালাবার শক্তি হারিয়েছেন তিনি, যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে আঁ… আঁ… আঁ… শব্দ করতে করতে দু হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন হেমন্ত পাল...
রোদ আজ ওর মা বাবার সাথে গ্রামে এসেছে। গোটা গ্রাম জুড়ে এখন বইছে খুশির হাওয়া কারণ আজ ওদের গ্রামের প্রথম স্কুল, “বসন্ত পাল স্মৃতি বিদ্যামন্দির” এর উদ্বোধন। হ্যাঁ বুনোদাদুর আসল নাম বসন্ত পাল, আর বুনোদাদুর বাড়িতেই তৈরি হয়েছে স্কুল। এর পুরো কৃতিত্ব অবশ্য হেমন্ত দাদুর ছেলে জ্যোতির্ময় কাকুর।
রোদ দেখলো একটা বড় গাড়ি এসে থামলো বুনোদাদুর বাড়ির সামনে। তার থেকে একে একে নামলো জ্যোতির্ময় কাকু, তাঁর মা আর সব শেষে যিনি নামলেন তাঁকে দেখে চমকে গেল রোদ; এ কি অবস্থা হয়েছে হেমন্ত দাদুর! রোগা জিরজিরে শরীর, বাদামি হয়ে যাওয়া চামড়া, কোটরে ঢুকে গেছে চোখ, পরনের কুর্তা পায়জামার অবস্থাও আলুথালু। চেনাই দায় দাদুকে! গাড়ি থেকে নেমেই দুহাতের মুঠোয় পিঠের ওপর একটা চাদর মেলে ধরে মাঠের দিকে ছুট লাগলেন হেমন্ত দাদু, ঠিক চামচিকের মতো; আর মুখে ক্রমাগত চিৎকার করতে থাকলেন, “ইস্কুল… ইস্কুল…”
শেষ।