বসন্ত-ছুঁলো-তোকে(প্রথম পর্ব)
বসন্ত-ছুঁলো-তোকে(প্রথম পর্ব)
রোজকার মতোন আজও রীতেশ তার নিজের কেবিনে বসেছিল.. হঠাৎ থিয়ার মেল। শনিবার কাজের চাপ কিছু বেশীই থাকে। তার মাঝে যেন অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে এলো মেলটা। মেয়েটার মাথা যে কোনপথে চলে,.. তা বোধহয় আজো অবধি বুঝে উঠতে পারলোনা রীতেশ। কিছুদিন আগে নিজেই প্রচন্ড ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল.. আর আজ আবার মিস্ করছে বলে মেল।
সল্টলেকের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে রীতেশ আজ প্রায় বছর চারেক হল। বাড়ি দুর্গাপুরে। একান্নবর্তী পরিবার, বাড়িতে বাবা মা কাকা কাকী স্ত্রী সব মিলে অনেক লোকজন। তার একটি দুই বছরের ছেলেও আছে। এখানে বাগুইহাটিতে একটি ফ্ল্যাটে অনির্বানের সাথে থাকে। রীতেশ এখন আঠাশ, অনির্বান তার থেকে দুই বছরের ছোট তাদেরই কোম্পানিতে জুনিয়র।
থিয়ার সাথে তার আলাপের ঘটনাটা বেশ হাস্যকর। অনির্বানের সাথে বাসের সীট নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়া লেগেছিল তার। রীতেশের গাড়িতেই যায় দুজনে, সেদিন সার্ভিসিংএ ছিল। প্রায় পাঁচ মিনিট শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াইয়ের পর রীতেশ বাধ্য হয়েছিল অনির্বানকে টেনে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে। পরে অবশ্য সেই নিয়ে দুজনেই খুব হাসাহাসি করত। এটা বছর দুই আগেকার কথা.... এই দুই বছরে তারা দুজনে যে কি করে এতো কাছাকাছি চলে এলো,.. তা আজো অবধি ভেবে পায়নি সে।
একান্নবর্তী পরিবার একটু রক্ষণশীলও বটে। স্ত্রী রিমার সাথে আলাপ পরিচয় কিছুই তেমন ঘটার সুযোগ ঘটেনি। কাজের চাপে ওখানে প্রায় যাওয়াই হয়না। ঋক্ ছোট, ওখানকারই স্কুলে পড়ছে তাই তাদেরও এখানে এসে থাকা সম্ভব নয়। এখানকার আত্মীয়হীন কেজো মরুভূমিতে দুটোই ওয়েসিস.. অনির্বান আর থিয়া। একমাত্র সেই জানে তাদের কথা।
থিয়া একটি আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়ায়। তার চরিত্র বর্ণনা করতে গেলে পুরো একটি বই লেখা হয়ে যায়। বয়স বাইশ। কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। মনের তলকূল অতল জলে। অনেক চেষ্টা সত্বেও এই দুই বছরে তাকে কি একটুও বঝতে পেরেছে রীতেশ,.... বোধহয় না। তবে এটুকু বুঝেছে যে তিন চারদিনের বেশী একে অপরকে না দেখে থাকতে পারেনা!! এই তো গেল বুধবার থিয়ার মেজাজটা এমনিই খারাপ ছিল। মায়ের ফোনে বিয়ের তাগাদা শুনে, তার মধ্যে রীতেশের হাল্কা মজা.... ব্যস ঘিয়ে আগুন!!
"বেশ তো কাকিমা যখন এতো করে বলছেন এবারে বিয়ে করলেই তো পারিস। মাথা ঠান্ডা হবে, পাগলামোটাও একটু কমবে।
ব্যস আর পায় কে,, গটমট করে থিয়ার প্রস্থান। অনেক দৌড়েও অনির্বান ধরতে পারেনি। রীতেশ বিশেষ চেষ্টাও করেনি। জানে মাথা ঠান্ডা না হলে ধরতে পারলেও ফিরিয়ে আনতে পারবেনা। ফোন অবশ্য তারপরে বেশ কয়েকবার করেছে, লাভ হয়নি। তারপর এই শনিবার মেল। আজ আবার তার দূর্গাপুরে যাওয়ার কথা। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে চলে যায় রীতেশ। অফিস থেকে ছটার আগে তো বেরোনো হবেনা। কথা হয়েছে অফিসের বাইরে থিয়া অপেক্ষা করবে। কিছুক্ষণ তার সাথে সময় কাটিয়ে রওনা হয়ে পড়বে রীতেশ।।
লাঞ্চ টাইমে ক্যান্টিনে না গিয়ে নিজের কেবিনেই বসল সে। আজ অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে বিলি কাটছিল.... এক বছর আগে বোলপুর বেড়াতে গিয়েছিল সে আর থিয়া। মেয়েটার খুব প্রিয় জায়গা,, সেখানে গিয়ে যেন এক অন্য মেয়ে। অত রাগ কোথায় হাওয়া.. সারাক্ষণ হাসিখুশি। খোওয়াইয়ের পারে দুজনের হাত ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে গল্প করতে করতে রীতেশকে জানিয়েছিল কেন সে বিয়ে করতে চায়না। বাবা মায়ের ঝগড়া দেখেই বড়ো হয়েছে সে। সে মায়ের কাছেই থাকে,, বাবাকে গত পাঁচ বছরে আর দেখেনি তাদের ডিভোর্সের পর থেকে। মা শিলিগুরিতে একটি বেসরকারী হাসপাতালে নার্স। অনেক কষ্ট করেই বড়ো করেছেন তাকে। বাবা থাকাকালীনও না থাকার মতোনই ছিল। মেয়েটির উপর বেশ একটু মায়াই পড়ে গেছে রীতেশের।।
ছটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়েই গেটের সামনে থিয়াকে দেখতে পেল। তুঁতে রঙের টপে খুব মিষ্টি লাগছিল তাকে। থিয়াকে গাড়িতে তুলে সোজা সল্টলেকেরই নামকরা একটি রেস্তোরার দিকে রওনা দিল। কথা ছিল কিছুক্ষণ খাওয়া দাওয়া আড্ডা দিয়ে রওনা হয়ে পড়বে। দুটো চাউমিন অর্ডার করে বসল তারা। রীতেশ কিন্তু লক্ষ্য করল হাসিখুশির মধ্যেও মাঝে মাঝে যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে থিয়া.... কারণটা জিজ্ঞেস করবে কিনা সবে ভাবছে.. এমন সময় থিয়াই বলে উঠল....
"মা আবার কাল একই কথা তুলল ফোনে,, জানিনা কেমন একটা অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছি মায়ের মধ্যে।
মুহূর্তে রীতেশের কাছে সব জলের মতোন পরিষ্কার। থিয়ার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে....
"এতো ভাবিসনা ব্যাপারটা নিয়ে। কাকিমার বয়স হচ্ছে তো তাই বেশী চিন্তা করেন। তুই একটু বুঝিয়ে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে।।
রেস্তোরাটি থেকে বেড়িয়ে রীতেশ থিয়া বেশ কিছুক্ষণ একটু ঘোরাঘুরি করল পাশের একটি মলে। থিয়ার মুখ কিন্তু থমথমে থেকে খুব বেশী স্বাভাবিক হলনা আর সেদিন।
রাত নটা নাগাদ দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হল সে। অনেকটা রাস্তা, যদিও রীতেশ প্রত্যেকবারই একাই যায়,, আজ তার মনটা কিন্তু বেশ খারাপ হয়েই আছে। হাল্কা করে রেডিওটা চালিয়ে দিল। বারবার মাথায় ঘুরেফিরে আসছে থিয়ার মুখটা। মেয়েটা যে কেন আজ এতো বেশী মনমরা ছিল.. না: আর বেশী এই নিয়ে ভাববেনা। থিয়া এমনিই খুব মুডী মেয়ে এখন এরকম,, আবার পরক্ষণেই ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো রীতেশেরই গলা জড়িয়ে ধরে কত গল্প করবে।।
প্রায় রাত বারোটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে গেল রীতেশ। এতোদিন পরে আবার আসতে পেরেছে.... সকলে হৈহৈ করে উঠল। সবথেকে আগে ছুটে এল ঋক্। রিমা অন্য সময়ের মতোই শান্ত, ধীর স্থির। বাবা মা কাকা কাকীর হাজারটা প্রশ্ন,, চেহারা খারাপ নিয়ে বকাবকি প্রত্যেকবারের মতোই শেষ হওয়ার পর কোনোমতে নিজের ঘরে ঢুকতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বোন জয়ি এর মধ্যেই একবার এসে ফুট্ কেটে গেল..
"দাদা এসব বাজে গল্পে সময় নষ্ট করিসনা,, একজনের চোখের জলে কিন্তু আর বাড়িতে জলের ড্রাম কিনতে হচ্ছেনা। আর কদিনে মনে হয় পুকুর হয়ে যাবে"!!!!
তাড়া করল রীতেশ। রিমার সাথে এমনি তার সম্পর্ক স্বাভাবিক,, আলাদা করে কোনো বিশেষ সদ্ভাব গড়ে ওঠার সময় বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি। কিছুটা বাড়ির পরিস্থিতি,, কিছুটা রিমার অতিরিক্ত শান্ত স্বভাব,, কিছুটা বা রীতেশের কাজের ধরণের জন্য। রিমা ডাঁকসাইটে উকিল রমেশ সেনের মেয়ে হওয়া সত্বেও তার স্বভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত,, ভদ্র নম্র শান্ত। সবই ছিল স্বাভাবিক,, হয়তো বা একটু বেশীই তারই মধ্যে যেটুকু খালি ছিল,, হয়তো সেটাই পূর্ণ করেছিল থিয়া।
পরেরদিনটা রীতেশের ওখানেই থাকার কথা ঋক্ ধরে বসল.. এতো পরে পরে আসে বাবাকে আরো দুদিন থাকতে হবে। আর আজ রবিবার তারা সকলে সামনের একটি খুব সুন্দর বাগানবাড়ি আছে,, সেখানে পিকনিকে যাবে। সবাই মানে সব্বাই একেবারে পনেরো জন। রীতেশও একটু চুপচাপই থাকে বাড়িতে,, বন্ধু বলতে মেজ জ্যাঠার মেয়ে জয়ি। তাই সে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল না। কিন্তু ছেলে জিদ্ ধরেছে। কাজের চাপে ছেলেটাকে তেমন সময় দিতেই পারেনা। খানিকটা ঋকের মুখের দিকে তাকিয়ে, খানিকটা জয়ির আব্দারে রাজি হয়ে গেল সে। জয়ি কলেজে ফার্স্ট ইয়ার ইংলিশ অনার্স, সকলের সাথে সমান মিশতে পারে আর মেয়েটির যেটা সবথেকে বড়ো গুণ.... প্রাণবন্ত হওয়ার সাথে সাথে এই বয়সে এতো পরিণত মনের মেয়ে খুব একটা দেখা যায়না। তাই দাদার বৌদির প্রতি এই ঔদাসীন্য আর কারুর না হলেও তার চোখ এড়ায়নি। শান্ত স্বভাবের এই রিমাকে সে ভীষণ ভালোবাসত,, আর তাই তার হয়ে তার খুব প্রিয় দাদাকেও মাঝে মধ্যে হুল ফোটাতে ছাড়তোনা।।