Debasmita Ray Das

Romance

0.8  

Debasmita Ray Das

Romance

বসন্ত-ছুঁল-তোকে(শেষ পর্ব)

বসন্ত-ছুঁল-তোকে(শেষ পর্ব)

6 mins
10.5K


রবিবার ঘুম ভাঙতে বেশ দেরীই হল রীতেশের, প্রায় নটা। উঠে দেখে সবাই প্রায় তৈরী। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল তারা। মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেল। খুব সুন্দর জায়গা, গাছ গাছালির মধ্যে একদম প্রকৃতির নরম বাহুডোরের মধ্যে। পাশে পুরোনো একটি মন্দির। ছেলেবেলায় এখানে মাঝে মাঝেই চড়ুইভাতি করেছে, মনে পড়ে যায় রীতেশের। আশ্চর্যের ব্যাপার এতোক্ষণে থিয়ার পাঁচ-ছয়বার ফোন এসে যায়, আজ একবারও আসেনি। মেয়েটার মনটা যদিও ভাল নেই, তাও কেমন যেন একটু অস্বাভাবিকত্বের গন্ধ পায় রীতেশ। নিজেই ফোন করবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ঋক্ ছুটে এল, তার সাথে এখন বল খেলতে হবে। বাবাকে এতো সময় কাছে পেয়ে তাকে আর পায় কে!! ইতিমধ্যে ওদিকে শতরঞ্চি পেতে শুরু হয়ে গেছে গানের লড়াই। ক্রমে একক গান। রিমার গলা খুব সুন্দর তাকেই আগে ধরা হল। রীতেশ খেলছিল ঠিকই, কিন্তু একটু হলেও তার মনটা এদিকেই পড়ে ছিল। আসলে রোজকার কাজের জগতে এমন একটা দিন তো সবসময় পায়না তারা। সারাদিন দারুণ কাটানোর পর তারা যখন বাড়িতে ফিরে এল, আগের দিনের মন খারাপের অস্বস্তিটা প্রায় রীতেশের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। আরো দুটো দিন বাড়িতে এরকম দারুণ হৈচৈ করে বুধবার খুব সকালে আবার কাজের জগতে রওনা হয়ে পড়ল রীতেশ। তবে তাকে খুব অবাক করে দিয়ে এই কদিনে থিয়ার কোন কল মেসেজ্, চ্যাট্ কিচ্ছু আসেনি, একবারের জন্যও না। তবে সেও বিশেষ মাথা না ঘামিয়ে ভাবল থাক, কোলকাতায় পৌঁছেই একেবারে দেখা করে নেবে।

   

    কোলকাতায় ফেরামাত্র কাজের চাপে প্রায় নাওয়া খাওয়া ভোলার জোগাড় রীতেশের। বুধবারই একটু দেরী করে জয়েন করে গিয়েছিল রীতেশ। প্রথম কয়েকদিন কিছু জরুরি এসাইনমেন্টস ছিল, সেগুলো মেটাতে মেটাতেই বাড়িতেও একটাও ফোন করা হলনা তার। কদিন পর একটু ফাঁকা হয়ে থিয়াকে একটা ফোন লাগালো সে। অদ্ভুত ভারী গলায় ধরল থিয়া। জানতে পারা গেল এতোদিন কোনো খবর না আসার কারণ। গত পাঁচ-ছয়দিন ধরে ভাইরাল ইনফেকশনে বিছানায়। ব্লাড টেস্ট করা হয়েছে যার রিপোর্ট পাওয়ার কথা সেদিন। রীতেশের তীব্র অনুশোচনা হল। ঈশশ্ মেয়েটার এমন অবস্থা, একা থাকে, আর সে কিনা এতোদিনে একবারো থিয়ার খবর নিতে পারলোনা। বলল....

"একদম চিন্তা করিসনা তুই, রেস্ট নে, কাল শনিবার আমার ডে অফ্ আছে। সকালবেলাই চলে আসছি।''

রীতেশের বোধহয় জানা ছিল না যে এই প্রমিসটাও তার আর রাখা হবেনা!! জানল সেদিন রাতেই। ঋকের প্রচন্ড বায়নায় এবং কিছুটা জয়ির বুদ্ধিতে বড়ো জ্যাঠাও যার কথাতেই পুরো বাড়ি চলত, হার মানতে বাধ্য হলেন। ঠিক হল ঋকের সামার হলিডে, সুতরাং এখন কটা দিন রিমা ও ঋক্ রীতেশের কাছেই থাকবে। ফোনটা এল ঠিক আটটা নাগাদ। আনন্দের মধ্যেও জয়ির হাল্কা খোঁচাটা বেশ কানেই লাগল রীতেশের....

"আজকে অবধি যা আনন্দ করবার করে নে,, কাল থেকে তোর হিসাব নেওয়ার লোক এসে যাচ্ছে। এখানে আবার জলের ড্রাম ফের নিতে হবে.. এটাই যা দু:খ!'' রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল রীতেশ। জয়ি এতো বুদ্ধিমতী মেয়ে আর এমনই সবটা বোঝে,,ওর কাছে কিছু লুকানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই। শুধু মনটা খচখচ করতে লাগল এটা ভেবে যে, কালও থিয়ার কাছে যাওয়া হচ্ছেনা। খুব সকাল সকালই হাওড়া যেতে হবে ওদেরকে আনতে, সাথে আসছে জয়ি। একদিন থেকে আবার পরেরদিনের গাড়িতেই ফিরে যাবে সে।

  এলার্ম না বাজার কারণে উঠতে বেশ দেরীই হল সেদিন। উঠেই দেখে সওয়া নটা, ট্রেনের টাইম দশটা। মাথায় হাত রীতেশের। কোনোমতে পড়ি কি মরি করে দৌড়াল সে। পৌঁছে দেখে স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে রিমা , জয়ি ও ঋক্। যথারীতি ঋক্ ছুটে এসে বাবার কোলে উঠে গেল। জয়ি ফুট্ কাটল....

"আজ যেন আবার অফিসের বাহানা করে পালাসনা দাদা, অবশ্য পালাবিই বা কোথায়? তোর খুঁটি সাথে নিয়েই এসেছি।''

রীতেশ একবার রিমার দিকে আড়চোখে তাকাল। বিশেষ কোন রূপান্তর চোখে পড়ল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল তারা। খুব বড় না হলেও রীতেশের ফ্ল্যাট বেশ সুসজ্জিত, তার রুচিবোধের পরিচয়বাহক। অনির্বান অফিস কোয়ার্টারে কয়েকদিনের জন্য বলে-কয়ে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল।

 অনেকটা জার্নি করে এসেছে তাই দুপুরে তারা খাবার অর্ডার করে নিয়েছিল। সারা দুপুর চলল আড্ডা। রাতের ডিনার বাইরে করা হল জয়ির অনারে। অনেক রাতে জয়ি, ঋক্ অন্য ঘরে শুতে যাওয়াতে রিমাকে একা পেয়ে রীতেশ জিজ্ঞেস করল....

"তোমার ভাল লাগবে তো এখানে? বাড়িতে অতো লোকজন জয়ি, এখানে কেউ নেই''

প্রথম বার রিমার গলায় অভিমানের সুর বাজল।

"তুমি তো আছো, অবশ্য তোমার যদি ভাল না লাগে''-

   হতভম্ব হয় রীতেশ। রিমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে কতোদিন তার দিকে ভাল করে একবার চেয়ে দেখেনি। মনটা একটু খারাপ হয়। এমনি এমনি তাদের মধ্যে দূরত্ব এমন বাড়েনি, তার জন্য সে নিজেও অনেকখানি দায়ী সেটা খুব বুঝতে পারে। বছর চব্বিশের রিমার মধ্যে একটা আলাদাই শ্রী আছে, সবথেকে বেশী তার স্বভাবটা এতো ভাল। হঠাৎ করে রীতেশের মনে কেমন জানি এক অদ্ভুত অনুশোচনা হয়। রিমাকে সে বড়োই বঞ্চিত করেছে কিছুটা পরিস্থিতি, কিছুটা কাজ, কিছুটা বা থিয়ার কারণে। মুখে কিছু না বলে তাকে আলতো করে একটু কাছে টানল রীতেশ। সেদিন অনেক রাত অবধি গল্প করল তারা.... যা বেশ কয়েক বছর পর এই প্রথম হল।।

  পরেরদিনটা ছিল রবিবার। খুব সকালে জয়িকে স্টেশনে ড্রপ করে গাড়িতে রিমা আর ঋকের সাথে সোজা নিকো পার্ক রওনা দিল রীতেশ। ছুটির দিন পুরোটাই কাটল ঋকের হুটোপুটিতে নানারকম বায়নায়। রিমাকেও বেশ খুশি খুশি লাগছিল। রীতেশের মনটাও সত্যিই ছিল একদম অন্যরকম। থিয়ার জন্য একটু মনকেমন যে ছিলনা তা নয়, বিশেষত: মেয়েটা অসুস্থ বলে। কিন্তু ঋকের লাফালাফি বেশী মনখারাপের সুযোগ দিলনা। বাবাকে পেলে আর তাকে পায় কে! দিনটা দারুণ আনন্দের মধ্যে দিয়েই কেটে গেল।

    পরেরদিন অফিস পৌঁছেও অনেক্ষণ আগের দিনের রেশ ছিল তার মধ্যে। অনির্বানের সাথে একবার দেখা হল। হাল্কা একটু কথাও হল। সে কথা দিল একদিন দেখা করতে আসবে তাদের সাথে। পরের কয়েকটা দিন প্রায় দুই সপ্তাহ মতোন কাজের চাপে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়ল রীতেশ। মাঝে একবার দিন দুয়েকের জন্য দিল্লীও যেতে হয় তাকে। সেখানে তাদের একটি নতুন প্রজেক্ট হচ্ছে তাই। যেই সময়টা এখানে ছিল রিমা আর ঋককে যতোটা পারে সময় দেয় রীতেশ। থিয়ার সাথে মাঝেমাঝে কথা হয় ফোনে। তার শরীর একটু ভাল, রিপোর্টে খারাপ কিছু বেরোয়নি। তবে খারাপ ধরণের ভাইরাল, তাই ডক্টর দিন পনেরোর বেড রেস্ট দিয়েছেন। তার সাথে এই সময়ে কথা বলার সময়ে রীতেশের বারবারই মনে হয়েছে যে সেই আগের থিয়ার যেন কেমন পরিবর্তন হয়েছে। কেমন অদ্ভুত লাগে তার!

  এর মধ্যেই অনির্বানের ফোন এল একদিন। ভবানীপুরের কাছে সে নাকি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে, বৌদিকে নিয়ে একদিন আসতে হবে। রীতেশ কথা দিল আসবে। কিন্তু সেই সপ্তাহে আর হলনা। পরের সপ্তাহে রবিবার যাবে বলে ঠিক করল। রিমাকে বলাতে সে তো খুবই খুশি হল। অনির্বানের কথা সে অনেক শুনেছে। সেইমতোনই অনির্বানকেও জানানো হল। রীতেশেরও বেশ ভালোই লাগছিল, কাজের চাপে বেশ কয়েকদিন ওর সাথে বেশী দেখাই হয়নি। যদি একবারো জানত যে আরো বেশ কিছু তার জানা এখনো বাকি-

   

    রবিবার পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছটা নাগাদ অনির্বানের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছালো তারা। সেকেন্ড ফ্লোরে কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল অনির্বান। বেশ খুশি খুশি লাগে তাকে। এগিয়ে এসে ঋককে কোলে তুলে নেয়। রীতেশ দেখে তার মধ্যেও অদ্ভুত এক পরিবর্তন! অবাক হওয়ার ছিল এখনো অনেক বাকি, যা হল ভিতরের ঘরে ঢুকে। হতবাক্ রীতেশ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল খাটের দিকে- যেখানে শুয়ে রয়েছে থিয়া! একি চেহারা হয়েছে তার! চোখ প্রায় কোটরে ঢুকে গেছে, মুখ শুকনো, অনেক রোগা আগের থেকে। এই কদিনের ঝড়ে চেহারা যেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে তার! আর এই ঝড়ে তার বরাবরের সাথী অনির্বান, যার পরম সেবায় আজ থিয়া অনেকটাই সুস্থ। এক নিমেষে আজ ডাকার কারণ রীতেশের কাছে ভালভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কিছুটা বা তার নিজের ভুলও। রিমা কতোকটা অবাকই হয়েছিল থিয়াকে দেখে। পরে অনির্বান আলাপ করিয়ে দেওয়াতে থিয়ার পাশে গিয়ে বসল। তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

" তুমি সেরে ওঠ, তারপর একদিন সকলে মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসব।''

 রীতেশ দেখল থিয়ার চোখ ছলছল করছে। মুখে কিছু না বলেও যেন অনেককিছু বলছে তার চোখদুটি। এর মাঝেই রিমা অনির্বানের সাথে ফ্ল্যাট ঘুরে দেখার জন্য বাইরে যেতেই, তাকে একটু একা পেয়ে থিয়া তার হাতটা ধরে বলল,

"প্লিজ তুমি কিছু মনে কোরোনা, তোমার সাথে কথা হত, কিন্তু কি করে যে তোমায় জানাবো ভেবে পেতাম না। এই কদিন যেভাবে কাটিয়েছি, তুমিও ব্যস্ত ছিলে। অনির্বানদা না থাকলে,থিয়ার মুখে হাত রাখে রীতেশ।

"ব্যস আর কিছু বলতে হবেনা,আমি সব বুঝতে পেরেছি, নিজের ভুলটাও। রিমাকে আমি কখনো চিনতে চেষ্টাই করিনি, সুস্থ হয়ে ওঠ খুব শিগগিরি। অনির্বান সত্যি খুব ভাল ছেলে।

     হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল অনির্বান আর রিমা। ঋকের সাথেও সে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। অনেক আড্ডা খাওয়া-দাওয়ার পরে বিদায় নেওয়ার আগে রিমা থিয়াকে দিয়ে প্রায় প্রমিস্ করিয়ে নিল খুব শিগগিরি তাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা! রীতেশের মনে যেন এক অন্য অনুভূতি, কিছুটা খারাপ লাগার ছোঁয়া থাকলেও, খানিকটা যেন স্বস্তির আভাসও পেল মনের মধ্যে। রিমার সাথে এই কদিনে অনেকটাই সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে তার। গাড়িতে ফেরার পথে রিমাও বারবার বলছিল ওদের দুজনকেই তার খুব ভাল লেগেছে। রেডিওতে তখন তার খুব পছন্দের একটা গান বাজছে। কিছু না বলে রিমার কাঁধে হাত রেখে তাকে আলতো কাছে টানে রীতেশ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance