Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action

4  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action

বৃত্তের বাঁধনে (Part 6)

বৃত্তের বাঁধনে (Part 6)

13 mins
245


'ভাসানের সুরে বোধনের গান'

মূহুর্ত :

---------

ঢেউ মাটিতে বসে অর্ভির সাথে বরনডালা সাজাচ্ছে... সমুদ্র, সামপ্রিয় দু'জনে মিলে ঠাম্মিকে সামলে উঠতে পারছে না... একে তো পুত্রশোক, তার উপর এই বয়সে এসে এত বড় সত্যের মুখোমুখি হওয়া... যতই হোক, তিনি তো মা... তাই সন্তানের অনৈতিক অন্যায়ের দায় কিছুটা হলেও তার উপরও বর্তায়... যতই তিনি সত্যিটা আজ প্রথম জানুন না কেন !!! এটাও তো তিনি প্রথমদিন থেকেই জানতেন যে, তার বর্তমান বৌমা কোনোদিনই সংসারের উপযোগী ছিল না... আত্মকেন্দ্রিকতাই তার জীবনের প্রথম লক্ষ্য ছিল আর দাম্ভিকতাই অহংকার... মানুষকে মানুষ বলে গ্রাহ্য করতো না বলেই হয়তো প্রাঞ্জলবাবুও কোনোদিনই তার সাথে মানিয়ে উঠতে পারেন নি বা বলা ভালো মানিয়ে নিতেই চান নি... তাই তো তিনি না পেরেছেন ভালো স্ত্রী হতে, না পেরেছেন বৌমারূপে কন্যা হতে, আর না পেরেছেন একজন ভালো মা হতে... শুধু জন্মটুকুই যেন বেশি প্রাধান্য পেরেছিল, ব্যাস আর কিছু নয়... তাই যে মেয়েকে কোলে পিঠে করে মানুষ করলেন, ঠাকুমা হওয়া স্বত্ত্বেও যে মেয়ের প্রতি তার মাতৃত্ববোধটাই বেশি- সেই মেয়ে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, স্বেচ্ছায় তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে নিজেকে... ছেলের থেকেও বেশি ওই মেয়ে তার আপন ছিল... তাই জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে বড্ড অসহায় বোধ করছেন... হয়তো অনেক আপনজন আজ তার পাশে আছে, তার উপর আরো কিছু নতুন রক্তের সম্পর্ককে স্বীকৃত দেবার জন্য তিনি তৈরি হচ্ছেন মানসিকভাবে, তবুও এতজনের মাঝেও একাকীত্ব যেন তাকে গ্রাস করছে... যতই হোক ওই কন্যাসম নাতনি-টিই যে তার একমাত্র পৃথিবী... বড় আপনার... যদিও সত্যিটা সামনে আসার পর থেকে ঢেউ নিজেই ওনাকে বুঝিয়েছে যে, সব কুসংস্কার দূরে ঠেলে দিয়ে ওর বড়মাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে বরন করে ঘরে তুলতে... এইটাই যে ওদের সত্যিকারের ঘর, ওদের প্রাপ্য অধিকার যা থেকে দীর্ঘদিন ওরা দূরে ছিল, বলাবাহুল্য তাদের রাখা হয়ে ছিল... বরং ঢেউ নিজেই তো জবর দখল করে অন্যের অধিকারে বাঁচছে, যেটা আসলে অন্যায়... তাই তো সে নিজে বড়ো নিস্পৃহ হয়ে গেছে... সবকিছুর মধ্যে থেকেও যেন কিছুর মধ্যেই নেই, এতটাই প্রবল সেই নির্লিপ্ততা... ঠিক যেন, চড়া সুরে বাঁধতে গিয়ে তানপুরার তার ছিঁড়ে গেছে... তানপুরার সাথে লেগে আছে ঠিকই, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে পড়ে আছে.... কোন সুরের অনুরণন ঘটছে না তাতে...

ঠাম্মিকে সামলাতে সামলাতে সমুদ্রের চোখ বারবার ঢেউ-এর দিকে চলে যাচ্ছে... সাদা চিকনের সালোয়ার পড়ে আছে... ভেজা চুল, কপালে ব্যান্ডেজ, ছিপছিপে চেহারা, পানপাতার মতো মুখখানা, তুলিতে আঁকা দেবীর মতো দুটো চোখ... ঠিক যেন দশমীর বির্সজনের আগের বিষাদময়ী মাতৃপ্রতিমা... একমনে কাজ করে যাচ্ছে... বরনডালা সাজিয়ে অর্ভি টেবিলে রেখে দেয়... ঢেউ-এর ইশারায় অর্ভি আর সামপ্রিয় ঠাম্মিকে নিয়ে ঠাম্মির ঘরে চলে যায়... সমুদ্র বোঝে, ঢেউ মাটি থেকে উঠতে পারছে না, এতটাই অত্যাচারের তীব্রতার মাত্রা... তাই ঢেউ-এর অনিচ্ছা সত্বেও সে এগিয়ে এসে ঢেউকে ধরে মাটি থেকে তোলে...

ঢেউ : আম... আমি ঠিক আছি... একদম ঠিক আছি... আপনি ব্যস্ত হবেন না...

বলেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় সমুদ্রের কাছ থেকে... মুখটা ফিরিয়ে রেখেই বলে ওঠে,

ঢেউ : আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে !!!

সমুদ্র : বলো...

ঢেউ : আমার ঘরে আসুন...

সমুদ্র : একান্তে কথা বলবে... হঠাৎ ??

ঢেউ : একান্ত কথা আছে, এটা ঠিকই... তবে একান্তই ভীষন প্রয়োজনীয়, আর ব্যক্তিগতও... জানি, আমার সাথে কথা বলতে আপনার ভালো লাগছে না হয়তো, তাও আবার এইভাবে একান্তে... কিন্তু কি আর করব !!! আপনি ছাড়া আর তো কাউকে এইগুলো বলাও যাবে না... তাই উপায়ান্তরও নেই আমার কাছে... আসলে আমার ঘরটা যে এবার খালি করতে হবে....

সমুদ্র : কোথায় যাবে তুমি !! ঢেউ !!! এইভাবে বলতে পারলে আমায় !! তুমি কি জানো না তুমি আমার...

ঢেউ-এর চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায় সমুদ্র... ওই চোখের দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছে, "প্রেমে পড়া বারণ... কারণে অকারণ... আঙ্গুলে আঙ্গুল রাখলেও হাত ধরা বারণ"

ঢেউ : (শান্ত স্বরে) চিন্তা করো না বেদ... একদিন না একদিন এই বাড়িটা আমায় ছাড়তেই হতো আর হবেও... আমি তাই নিয়ে আর কষ্টও তেমন পাইনা... হয় তো এইটাই ভবিতব্য... আমার পাপের কৃতকর্মও বলতে পারো... তবে এই মুহূর্তে আমি কোথাও যাচ্ছি না... এখন শুধুমাত্র বাবাইয়া-র Study Room-এ shift করে যাব... আমার ঘরটা দাদাভাই আর বৌদিভাই-এর জন্য ছেড়ে দিতে হবে তো, না কি !! তার উপর একটা পুঁচকে আসছে... তার জন্য একটা Cot কিনতে হবে... আর একটা আলমারি...

সমুদ্র : পুঁচকের জন্য আলমারি !!!

ঢেউ : হ্যাঁ... ও যেদিন এই বাড়িতে আসবে, আমার ঘরটা পুরোটা বেলুন, খেলনা দিয়ে সাজিয়ে দেব...

ঢেউ বেশ উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নাড়তে নাড়তে সমুদ্রকে অনেক পরিকল্পনা বলতে থাকে... কতটা সমুদ্র-এর কানে ঢুকলো বলা মুশকিল, তবে সে কিছুটা বিভোর চোখে ঢেউ-এর দিকে তাকিয়ে থাকে... কত্তদিন পর ঢেউ প্রাণখুলে হাসছে... শিশুরা বোধহয় এমনই হয়... নিষ্পাপ, পবিত্র, ফুলের মতো... তাই তো শিশুর কথা বলতে গেলেই গম্ভীর মানুষের মুখেও একফালি হাসি এসে পড়ে...

সমুদ্র : (মুগ্ধ চোখে) বেশ, তাই হবে... তবে একটা জিনিষ ভালো লাগলো, জানো তো- তোমার মুখে অনেকদিন পর পুঁচকের জন্য একটু হলেও হাসি খেলে গেল... এই উজ্জ্বলতা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল...

ঢেউ-এর মুখের হাসি পলকে কোথায় হারিয়ে যায় !!! নিজেকে একটু সংবরন করে সে বলে,

ঢেউ : আমাকে খুব তাড়াতাড়ি একটা কাজ জোগাড় করতে হবে... আপনি আমাকে একটা Working Woman Hostel-এর খোঁজ দিতে পারবেন !!!

সমুদ্র : (মনে মনে) যতই তুমি আমার থেকে পালানোর চেষ্টা করো না কেন !! যতই জীবনের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখো না কেন !! তোমার বেদ থাকতে তুমি শুধুই কষ্টই পাবে, আর আমি তা হতে দেব- এটা কোনোদিনও হবে না... তোমার মুখের ওই হাসিটুকুই আমি হৃদয়ে ধারণ করেছি, তা আমি কোনোদিনও হারিয়ে যেতে দেব না... এটা আমার নিজের কাছে আমার নিজের প্রতিজ্ঞা... আর... আর তোমার কাছেও...

সমুদ্র নিজেকে সামলে নিয়ে প্রকাশ্যে বলে ওঠে,

সমুদ্র : কেন !!! নিজের বাড়ি থাকতে... ঢেউ !!! এ কোন অভিমানের শাস্তি নিজেকে দিচ্ছো তুমি, ঢেউ !!!

ঢেউ : (প্রকাশহীন কান্নাটা দমিয়ে রেখে) আমার নিজের বলতে কিছু নেই বেদ... আ... আপন বলতে কেউ নেই... কারুর আপন নই আমি... আমার পুরো জীবনটাই তো প্রতারণা... প্রতারণা... এতদিন যা নিজের বলে ভাবতাম, তা ছিল কেবলই ভ্রম... এক মরীচিকার পেছনে সারাটা জীবন অজানা আকর্ষণে ছুটে বেরিয়েছি... বুঝি নি, যেটা আমার ছিল না... আগামীতেও তা কখনোই আমার হতে পারবে না...

সমুদ্র : ঢেউ Please...

ঢেউ : না বেদ... সত্যিটা তো সত্যিই হয়... আর আপনাকেও তো খুব বেশিদিন আমার জীবনের সাথে জড়িত রাখতে পারব না... আর একমাস পর অর্ভি আর সামপ্রিয়র বিয়ে... আপনি কনের দাদাভাই বলে কথা...

সমুদ্র : তো !!!

ঢেউ : আপনি না মানলেও সমাজের আমাকে দেখার দৃষ্টিকোণটা বদলাবে না... আমার একটা চাকরির খুব দরকার বেদ... তাতে আমি আমার NGO-টাও চালাতে পারব আর...

সমুদ্র : আমার কাছে কিন্তু পরিষ্কার হলো না ঢেউ... তোমার সাথে অর্ভির বিয়ের কি সম্পর্ক !!!

ঢেউ : (একটু ম্লান হেসে) বেদ বাবু, কনের দাদাভাই-এর সাথে যদি আমার মতো একটা মেয়ের জীবন জড়িত থাকে, সেটা কনের জন্য...

সমুদ্র : আমি না তোমাকে বুঝতে পারছি না ঢেউ... চিনতে পারছি না.... সব কুসংস্কারের বেড়া ভেঙ্গে তুমিই ঠাম্মিকে দিয়ে বড়মাকে বরন করে ঘরে আনছো... আর আমি তোমার এই সিদ্ধান্তকে শুধু Support-ই করছি না, শ্রদ্ধা জানাচ্ছি... কোনো মা-এর থেকে বড় শুভাকাঙ্খী কেউ হতে পারে না... আর বড়মারও এতদিন যা যা অপ্রাপ্তি ছিল, সব ওনার প্রাপ্য... কিন্তু এগুলো কি কথা ঢেউ !!!

ঢেউ : আমার জন্মের জন্য এতগুলো জীবন এত বছর ধরে তছনছ হয়ে গেল... আবার আমার সাথে আপনার জীবন জড়িত হয়ে গেলে আমার জন্মের সত্য নিয়ে হাজারটা কথার জন্য অর্ভির বিয়েতে অঘটন কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করব বলুন তো !!!

কথাগুলো বলতে বলতে আবেগতাড়িত ঢেউ সমুদ্রের খুব কাছে চলে আছে... সমুদ্র দুই হাতে ঢেউ-এর কাঁধ দুটো শক্ত করে ধরে ঢেউ-এর চোখে চোখ রেখে কিছু বলতে গেলে ঢেউ দুই হাত দিয়ে সমুদ্রের দুটো হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,

ঢেউ : বেদ, সুখ বড় আপেক্ষিক ব্যাপার, সহজে ধরা পড়ে না... ধরা দিলেও তা অল্প সময়ের জন্য আসে, আবার চলে যায়... আমি জানি না, ভালোবাসার অনুভূতি কি !!! কিন্তু বাবাইয়ার জীবন-এর সত্যিটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, যদিও ওদের ভালোবাসার খাতাটা শূন্য রয়ে গিয়েছিল তবুও ওদের অনুভূতির খাতা যেমন পূর্ণ ছিল, তেমনই পরিপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল ওদের মনের মণিকোঠায়... মাঝে মাঝে অপ্রাপ্তির মাঝেও থাকে প্রেমের পরিপূর্ণতা... সত্যি বলতে কি, কাউকে গোপনে, অতি সংগোপনে মনের গহীনে রেখে নির্দ্বিধায় ভালোবাসা যায়... অনুভূতি দিয়ে আগলে রাখা যায় প্রিয় মানুষটিকে, টিকিয়ে রাখা যায় সম্পর্ক- নামহীন সম্পর্কের আড়ালে... এইভাবেই না জানি, শুধু নামের অভাবে কত পবিত্র ভালোবাসার সম্পর্ক নামহীন হয়ে থেকে যায় এই স্বার্থপর পৃথিবীর বুকে...

সমুদ্র : সম্পর্ক নামহীন হোক ঢেউ, প্রকাশহীনও হোক... ক্ষতি নেই... তবু সেই সম্পর্ককে কোনো গভীরতায় যেন বাধা না যায়, মনের টানটাই যেন সেখানে প্রাধান্য পায়... দেখনদারিটা নয়... আমি শুধু স্যারকেই নয় ঢেউ, নিজের কাছেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম যে আমি তোমার হাত কখনো ছাড়বো না... আমি নিজের কাছে, নিজের আদর্শের কাছে কিভাবে প্রতিজ্ঞাচ্যূত হবো বলো !!!

(মনে মনে) আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না ঢেউ... সেটা সম্ভব নয় আর আমার পক্ষে...

ঢেউ চোখে প্লাবন নিয়ে সমুদ্রের থেকে দূরে সরে আসে,

ঢেউ : জানো বেদ, আজ আমারও খুব ইচ্ছে করছে কেউ এসে আমার হাতটা সারাজীবনের মতো শক্ত করে ধরুক, যাতে এই ভাঙাচোরা, রক্তাক্ত অন্তরটা নিয়ে অস্তিত্বহীন আমিটা কারুর কাঁধে একটু মাথা রাখি... একটা সত্যিকারের অন্তরের বাঁধন থাকুক আমার জীবনে, যার জন্য আমার অস্তিত্বটা আমি অনুভব করতে পারি... আজ তোমাকে সত্যিই বলতে ইচ্ছে করছে....

সমুদ্র : কি !!!

ঢেউ : সেটা অপ্রাসঙ্গিক... আমার জীবনটা জীবনের চোরাবালির ঘূর্ণির আর্বতে পড়ে গেছে বেদ... যেখানে আমি আর কাউকে জড়াতে পারব না... (কান্নাভেজা গলায়) তোমাকেও না... (দৃঢ়গলায়) তাতে যদি তোমাকে আদর্শচ্যূত হতে হয়, আমি ধরে নেব আমার পাপের খাতায় আরো একটা সংযোজন হলো...

সমুদ্র ঢেউ-এর থেকে মুখ ফিরিয়ে জানলার বাইরে দিকে তাকিয়ে থাকে... বোঝে, এইসময় ঢেউকে কিছু বোঝানো যাবে না... সে বড় এলোমেলো হয়ে আছে... ভেতর ভেতর ভেঙ্গেচুরে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে... ঢেউ মুখে যাই বলুক, কিছুতেই ওর পাশ থেকে সরে গেলে হবে না... মেয়েটা নিজেকে সামলানোর মতো অবস্থায় নেই... ঢেউকে আগলে রাখতে হবে, বুক দিয়ে পরম মমতায় এখন আগলে রাখতে হবে...

'কাঠ গোলাপের সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি, আবছা দিনেই তোমায় ভালো লাগে'

এদিকে, তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ঢেউ একটা টুল নিয়ে এসে তার আলমারির উপর থেকে নিজের ট্রলিটা নামায়... ট্রলিটা ফাঁকা থাকলেও পুলিশি অত্যাচারে আহত ঢেউ-এর হাতে ঢেউ আবার ব্যাথা পায়... একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ঢেউ-এর গলা দিয়ে, কিন্তু সমুদ্র-এর কাছে তা চাপা থাকে না... দৌড়ে আসে সমুদ্র...

সমুদ্র : এ কি !!! ঢেউ !!! (ঢেউ-এর হাত থেকে ট্রলিটা নিয়ে নেয়) তুমি আমাকে বললে না কেন !!! এই শরীরে একা একা... (ঢেউ-এর হাত ধরে) হাতটা ধরে নামো... আস্তে আস্তে...

হাতের যন্ত্রণায় মূহুর্তের জন্য ঢেউ-এর চোখে অন্ধকার নামে... ঢেউ টলে গেলে সমুদ্র ঢেউকে শক্ত করে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে... ইতস্ততঃবোধ করলেও নরম হাতে ঢেউ-এর গাল ছুঁয়ে উৎকন্ঠিত স্বরে বলে,

সমুদ্র : ঢেউ... ঠিক আছো তুমি !!! কি হলো !! কথা বলছো না কেন !!! ঢেউ !!!

ঢেউ ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে... ম্লান হেসে বলে,

ঢেউ : আমি... আমি ঠিক আছি... আসলে এই হাতটায় খুব যন্ত্রণা করছে... ব্যাথা থেকেই হঠাৎই মাথাটা কেমন !!!

সমুদ্র ততক্ষণে ঢেউকে ধরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়েছে... নিজেও তার পাশে বসেছে... এবার বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ না করে সমুদ্র ঢেউ-এর হাতটা নিজের অঞ্জলির মধ্যে নিয়ে বলে,

সমুদ্র : আমার একটা কথা রাখবে ঢেউ !!!

ঢেউ : বলো....

সমুদ্র : একা একা স্যারের Study Room-এ থেকো না... ঠাম্মির ঘরে shift করে যাও... আমি তোমাদের দু'জনকে নিয়েই তাহলে একটু নিশ্চিন্ত থাকবো... যতই হোক, ঠাম্মি তো তোমায় আঁকড়েই এতদিন বেঁচেছে... আর তুমিও... এই মূহুর্তে সত্যিই তোমাদের দু'জনের দু'জনকে খুব দরকার... আর একটু ভরসা রাখো তোমার বেদ-এর উপর- একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে... যাবেই... Please ঢেউ, আমার কথাটা রাখো... Please...

ঢেউ এক গভীর দৃষ্টি নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকায়... হঠাৎই বলে ওঠে,

ঢেউ : আচ্ছা বেদ, তোমার আর বাবাইয়া-র মনন, চিন্তন তো একই তন্ত্রীতে বাঁধা ছিল... তুমি বলতে পারো, বাবাইয়া কেন সেদিন মায়ের সব Blackmail মেনে নিল !!! কেন প্রতিবাদ করলো না !!! সত্যের জন্য কেন লড়লো না !!! খুব বেশি হলে কি হতো !!! মা আমাকে abort করে দিত...

Abortion Procedure-টা মনে আসতেই আৎকে ওঠে, ওই ছোট্ট ভ্রূণটার কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে সমুদ্র... মনে মনে এবার ঢেউকে ধমক দেবার জন্য প্রস্তুত হয় সে...

সমুদ্র : ঢেউ !!!

(মনে মনে) তোমার এই কথাগুলো বলতে কতটা কষ্ট হচ্ছে, তা আমি জানি... কিন্তু তাও এই মূহুর্তের শাসনটা খুব জরুরী তোমার জন্য, ঢেউ !!!

ঢেউ : বলো না বেদ, তাহলে সেদিন কি আজকের থেকে বেশি রক্তাক্ত হতাম আমি !!! বলো !! বলো না !!! কেন সারাজীবনের জন্য এত বড় পাপের গুরুভার আমার উপর দিয়ে গেল বাবাইয়া !!! সেদিন আমি মরে গেলেই তো...

আর বলতে পরে না ঢেউ... সমুদ্রের বুকে মাথা রেখে সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরে একেবারেই ঢেউ-এর মতো আছড়ে পড়ে... সমুদ্রও কিছু বলে না... শুধু দুই হাত দিয়ে ঢেউকে আগলে রাখে... কাঁদতে দেয়... সমুদ্র যাকে তার গোটা আকাশ দিতে প্রস্তুত, তার এই পরিণতি সমুদ্রকে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দিলেও সে জানে এই কান্নাটা ঢেউ-এর জন্য কতটা জরুরি....

ঢেউ : বলো না বেদ, আমি কি পেলাম !!! শুধু যন্ত্রণাই সার !!! ছোট্ট থেকে মাকে পাই নি... বাবাইয়ার কাছ থেকে স্নেহ পেলেও বাবাইয়া নিজেকে বরাবর Study-তে আবদ্ধ করে রাখতো... না মাকে পেয়েছি, না বাবাকে... আজ আমার পরিচয় আমি 'অবৈধ' (সমুদ্র আরো শক্ত করে ঢেউকে আঁকড়ে ধরে)... কেউ ছিল না আমার... কেউ রইলো না... কেউ আপন নয় আমার... আমার অস্তিত্বটাই 'অবৈধ'...

সমুদ্র : এইভাবে ভেবো না ঢেউ... এইভাবে ভাবতে নেই... আর এক মিনিট দাঁড়াও...

বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সিঁদুর কৌটো বার করে সমুদ্র... ঢেউ অবাক হয়ে যায়... অজানা আশঙ্কায় সমুদ্রের বুক থেকে ছিটকে সরে গেলে সমুদ্র ঢেউ-এর হাতটা টেনে ধরে... ওর মনের টানাপোড়েনটা উপলব্ধি করেই বলে ওঠে,

সমুদ্র : ভয় পেয়ো না ঢেউ... তোমার অনিচ্ছায় আমি তোমায় এটা পরাবো না... ভালোমা মানে আমার মামীমা আমাকে এটা রাখতে দিয়েছে... এটা নাকি আমার মায়ের সিঁদুর কৌটো... মৃত্যুর আগে এটা আমার মা, আমার মামার হাতে দিয়ে যায় তার ভাবি পুত্রবধুর প্রথম আর্শীবাদস্বরূপ... তাই তো তোমার জন্মপরিচয় উন্মোচিত হবার পর সিয়ার মুখে তোমার ভেঙ্গে পড়ার কথা শুনে আর তোমার বৈধ সামাজিক স্বীকৃতি তথা সুরক্ষার জন্যই ভালোমা এটা আমায় দিয়েছিল তোমায় পরিয়ে আমার স্ত্রী হিসেবে আমাদের বাড়িতে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য...

কিন্তু আমি যে সেটা চাই না... (ঢেউ-এর চোখে তখন একরাশ প্রশ্ন) সত্যি বলতে কি, তোমার আর আমার সম্পর্কটাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেবার জন্য এই সিঁদুর-এর জোরটুকুর আমার প্রয়োজন নেই... যেটা প্রয়োজন সেটা হলো আমাদের মনের টান, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সব পরিস্থিতিতে পাশে থাকার আশ্বাস... যেটা বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটার থেকে বেশি জরুরি...

ঢেউ : কিন্তু সমাজ তো আজও সিঁদুর দিয়েই বৈধতা, অবৈধতা বিচার করে... আমাকে ঠাম্মি ছোটোবেলা থেকে শিখিয়েছে, ওই সিঁদুর-এর জোর কতটা !!! সাত জন্মের বাঁধন ওই সিঁদুর...

সমুদ্র : আর তাই তোমরা মেয়েরা যুগের পর যুগ পণের বলি হও তাই তো !!!

ঢেউ : (সমুদ্রের বুকের উপর হাত রেখে) বেদদদদ !!!

সমুদ্র : (চোখে আগুন জ্বেলে, দৃঢ় স্বরে) সব সমস্যার সমাধান অন্ততঃ বিয়ে নয়... (মূহুর্তে নিজেকে সামলে, নরম সুরে) কতগুলো আইনি কাগজ শুধুমাত্র আমাদের সম্পর্কের বৈধতা দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না... অবশ্যই বিবাহ বন্ধন প্রয়োজনীয়... তবে সেটাই একমাত্র সম্পর্কের নির্ণায়নের যোগ্যতা বলে আমি মানি না... যদি তাই হতো, তাহলে তোমাকে অন্ততঃ এই নরকযন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না... আমরা সামাজিক জীব, বেঁচে থাকতে গেলে সমাজের মানুষগুলোকে সাথে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে... তবে সেটা কখনোই যেন মাত্রা না ছাড়ায়... নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত মাপকাঠির দাড়িপাল্লায় মেপে সমাজের দ্বারা নির্ণয় হবে, সেটা আমি তোমার আর আমার নিজের কারোর সাথে হতে দিতে পারব না... ক্ষমা করো আমায়....

ঢেউ চুপ করে থাকে... হঠাৎই সে তার কপালে ব্যান্ডেজের ওপর সমুদ্রের স্নেহের অধরপরশ পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে কেঁপে ওঠে... নিমেষের মধ্যে মনখারাপটা উধাও হয়ে যায় ঢেউ-এর... এই প্রথম যেন তার নিজেকে মূহুর্তের জন্য পরিপূর্ণ বলে মনে হলো... পরিপূর্ণতা পেল তার নারীসত্ত্বা... না, তবে এতদিন কি তার নারীত্ব ব্যর্থ ছিল !!! অবশ্যই নয়... তার কলস পরিপূর্ণ ছিলই, শুধু আজ কেউ এসে তা সমাদরে গ্রহণ করলো... মর্যাদা দিল তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের... আর ফুৎকারে উড়িয়ে দিল বৈধতা-অবৈধতার কাল্পনিক এক বেড়াজাল... তাই আজ কিছুটা নিঃসঙ্কোচেই সে ঠিক যেমন তার বাবাইয়াকে ছোট্টবেলায় ঘুমের ঘোরে অকারণে ভয় পেলে আঁকড়ে ধরতো, ঠিক তেমনই তার বাহুপল্লব দিয়ে সমুদ্রকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়... সমুদ্র যেন ঢেউ-এর বাহুবন্ধনের মধ্যেই খুঁজে পেল পরম শান্তি, তার গোপন ক্ষতে হঠাৎই যেন প্রলেপ পড়ে গেল খানিকটা... ঢেউ-এর এই বন্ধনে ছিল না কোনো কামের ছোঁয়া, ছিল শুধু মমত্ব, ভরসা, বিশ্বাস আর নির্ভরতা... ইতস্ততঃভাবে ধীরে ধীরে সমুদ্র তার দুই হাত তুলে ঢেউকে তার ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ করে... সমুদ্র অনুভব করে ঢেউ তার মনে এখনো তার জন্য কোনো ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করতে পারে নি, বা করলেও বুঝতে পারে নি... কিন্তু সমুদ্র-এর ভালোবাসা তার সব দ্বিধাবোধ কাটিয়ে দিতে পেরেছে... তাই যে মমত্ব দিয়ে সে সমুদ্রকে ভরিয়ে দিয়েছে, সেটাই সমুদ্রের জন্য অনেক... সম্পর্কে Space-টা ভীষন জরুরী, আর জরুরী অপেক্ষা সঠিক সময়ের আগমনের... সময় বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়... মুছে যায় বহু মান-অভিমান... মুক্তি পায় এক নিখাদ ভালোবাসা...

ঢেউ : আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যেও না বেদ... Please... কখনো ছেড়ে চলে যেও না... আমি মরে যাব... একদম মরে যাব... জানো, থানায় ওই অফিসারটা আমাকে.... (ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে)... আমি শুধু তোমার অপেক্ষাতে ছিলাম... আমি জানতাম তুমি আসবে... আমি জান....

অনেকদিনের জমে থাকা কান্না আজ ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে নেমে আসে গাল বেয়ে... পরিস্থিতির ঘেরাটোপে সম্পূর্ণ অনুভূতি অনুভূত না হলেও ঢেউ শুধু এটুকু বোঝে, তার পাশে থাকার জন্য তার মনের মানুষটি আজ উপস্থিত, সে ঠিক তাকে আগলে নেবে... তবে দায়িত্বটা আজ থেকে তাদের দু'জনেরই... কারন সম্পর্কটা তাদের... তাকে বেঁধে রাখার জন্য যত্নটা তাই প্রয়োজন- চিরদিনের বন্ধনে বাঁধা পড়লো যে তারা...

হঠাৎই সমুদ্রের উষ্ণ ঠোঁট নেমে আসে ঢেউ-এর আঁখি পল্লবের উপর, গালের উপর... ক্ষণে ক্ষণেই ঢেউ-এর চোখ থেকে ঝরে পড়ছিল বিন্দু বিন্দু জলরাশি... সমুদ্রের অধর শুষে নিতে গাল দিয়ে বয়ে আসা বাঁধ না মানা আকুল এক বারিধারাকে... মূহুর্তের মধ্যেই সমুদ্র ঢেউ-এর অধরে আলতো করে অধর রেখে স্পর্শ করলো তার প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিটা... আর ঢেউ শরীর দিয়ে উপলব্ধি করতে শুরু করলো তার ভিতরের প্রথম নারী হৃদয়ের ভালোবাসা... ভালোবাসার মধ্যে একে অপরের প্রতি এই অনুভূতিগুলো সত্যিই অমূল্য... আর ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ সবসময়ই একেবারেই অন্যরকম হয়, কারন সেই স্পর্শের মধ্যেই থাকে একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ভরসা, নির্ভরতা আর নিঃশর্ত-নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণ...

'খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা,

খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা,

কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে,

গোধুলিবেলার পান্থ জনশূণ্য এ মোর প্রান্তরে'

                                                    (কবিগুরু)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance