বৃত্তের বাইরে পর্ব সাতচল্লিশ
বৃত্তের বাইরে পর্ব সাতচল্লিশ
পর্ব সাতচল্লিশ
সম্পাতিকে নিয়ে ভীষণ অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন শুভমিতা দেবী ।
সম্পাতি বাবাকে মোটামুটি পটিয়ে নিয়েছেন । কয়েকদিন আগে মন উদাসীর যে খেলাটা দেখিয়েছিল স্বয়ং কাঞ্জিলাল ডাক্তারও তাতে সিলমোহর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
আর ওই নকল ফোন কল ? সম্পাতি কচি মেয়েটি নয় যে কিছু বুঝবে না । রাজদীপ বা সে নিজে - যে যখনই ফোন করে - প্রথম কন্ঠস্বর থাকে রাজদীপের ।
এবার উল্টো হল । কলার চুপ ; কলিং এজেন্টই কথা বলে গেল । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল স্ক্রিণে রাজদীপ লাহার নাম ভেসে আসা ।
দু'জনে বসে ঠিক করে নিয়েছিল সম্পাতি বা রাজদীপ কেউ কারও ফোন নাম্বার সেভ করে রাখবে না । নং তো দুজনেরই মনে এবং বুকে খচিত রয়ে গেছে !
অতএব ডাক্তারের ইশারায় বিভূতিভূষণ যখন ফোন করেন সম্পাতির ফোনে রাজদীপের নাম জ্বলে উঠল । ডাক্তার কাঞ্জিলাল যে ভাবনা নিয়ে সম্পাতির ফোনে বিভূতিভূষণের নম্বর রাজদীপ লাহা সেট করে লুকিয়ে সম্পাতির বালিশের তলায় রেখে দিয়েছিলেন - সম্পাতি সেটাই হাতিয়ার করে নিল ।
ফোন তুলে - হ্যালো, কে বলছ !
ওপার প্রান্ত চুপ । সম্পাতি ট্রুকলার ডিফল্ট হিসাবে কল এবং ম্যাসেজ সেট করে রেখেছে । দেখল বাবার ফোন। তার সাথে একটা যে যোগসাজশ চলছে - বুঝতে তার বাকি থাকল না ।
ডাক্তার কাঞ্জিলাল যখন ওর বাবা মাকে উপদেশ দিচ্ছিলেন - তোরা মেয়েকে কোন রকম চাপ দিবি না । একটু নরম মনোভাব নিয়ে কথাবার্তা বললে কয়েকদিনের মধ্যে ও ঠিক হয়ে যাবে ।
সম্পাতি দরজার আড়াল থেকে সব শুনে নিয়েছে । বিভূতিভূষণ যে নরম মনোভাবের এবং শুভমিতা দেবী চরম- এটা যেন সম্পাতির মনে আরও একবার গেঁথে গেল ।
ডাক্তার কাকু চলে যাবার পর তাঁদের তর্ক থেকে একটা কথা সম্পাতির কাছে পরিস্কার হয়ে গেল যে তার মা ভীষণ ভীষণই রক্ষণশীল মনোভাবের ধারক এবং বাহক ।
অন্যদিকে তার বাবা কিছুটা হলেও মধ্যপন্থী । কথায় কথায় ' ম্যানেজ করে নাও ' বলতে বলতে তিনি নীচে নেমে গেলেন ।
শুভমিতা দেবী দরজা ঠেলে মেয়েকে দেখলেন - এখনও মুখে বালিশ গুঁজে পড়ে আছে ।
দু'পাটি দাঁতের সাহায্যে অদ্ভুত বিচিত্র শব্দ করে উচ্চারণ করলেন - পোড়ারমুখী আর ছেলে পেলে না !
শম্ভুকে নিয়ে বিভূতিভুষণ চলে গেলেন । শুভমিতা দেবী বামুন বউকে সদর দরজা বন্ধ করতে বলে ঘর গোছাতে লাগলেন ।
গাড়িতে উঠে বিভূতিভূষণ শম্ভুকে বললেন - মাঙ্গলিকী চল।
বিনা বাক্যব্যয়ে শম্ভু সিটি সেন্টারের পথ ধরল । তার মনে তখন বিশাল দোটানা চলছে। মাঙ্গলিকী মানে তো সেই রাজদীপ নামের ছেলেটার দোকান । তাহলে কি স্যার ওখানে যাচ্ছেন মেয়ের ব্যাপারে রাজদীপের সঙ্গে যুদ্ধ অথবা সন্ধি করতে ?
মাঙ্গলিকীর দরজায় গাড়ি থামল । বিভূতিভূষণ গুটিগুটি গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢুকলেন । রাজদীপ তখন সেখানে ছিল না ।
দোকানের কর্মচারীকে বললেন - মালিক কোথায় ?
- বারোটার পর আসবে স্যার । কিছু....
বিভূতিভূষণ হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন এবং আবার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন ।
কর্মচারীটি পিছু পিছু গাড়ি পর্য্যন্ত এসে বলল - ওকে কি ডেকে পাঠাব স্যার ?
বিভূতিভূষণ বললেন - না । ওকে বলে দিও আমার অফিসে এসে যেন দেখা করে ।
কর্মচারীটি বলল - আপনার নামটা যদি...
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চেয়ারম্যান মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ।
কর্মচারীটির তখন সাংঘাতিক অবস্থা । চেয়ারম্যান সাহেব নিজে দোকানে এসেছেন আর ....
কর্মচারীটি বলল - স্যার যদি পাঁচ মিনিট ওয়েট করেন -
এখনই চলে আসবে ।
বিভূতিভূষণের গাড়ি মুখের উপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল ।
রাজদীপ যখন শুনল বিভূতিভূষণ তার খোঁজে এসেছিলেন, তাকে অফিসে দেখা করতে বলেছেন - ভয় না পেয়ে সম্পাতিকে ফোন করল ।
রাজদীপ বলল - তোমার বাবা কিছুক্ষণ আগে আমার দোকানে এসেছিলেন। বলে গেছেন অফিসে দেখা করতে । তুমি কি পারবে ডেকে পাঠানোর কারণ জেনে নিতে ?
সম্পাতি বলল - বাবা ? তোমাকে ? এ্যাই ! ইয়ার্কি করছ না তো !
- আরে না না, এই ভাবে কেউ ইয়ার্কি করে নাকি ! উনি সত্যিই এসেছিলেন এবং দেখা করতে বলে গেছেন ।
সম্পাতি বলল - স্ট্রেঞ্জ !
মনে মনে ভেবে খুশী হল যে ডাক্তার কাঞ্জিলালের এডভাইসে কাজ হয়েছে মনে হচ্ছে ।
বলল - বাবা তো এখন অফিসে । বাড়ি এলে জেনে নেব ।
রাজদীপ বলল - আমার খুব চিন্তা হচ্ছে জানো ! কি ব্যাপার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না । তুমি একবার ওঁকে ফোন করে জেনে নাও না প্লীজ !
সম্পাতি বলল - হোল্ড অন । আমি দেখছি । বলে কল হোল্ডে রেখে বিভূতিভূষণকে ফোন করল ।
মেয়ের ফোন পেয়ে তিনি তো অবাক । মেয়ে তো তাঁকে সচরাচর ফোন করে না ! তাও আবার অফিসে থাকাকালীন !
যাই হোক ফোন ওঠালেন তিনি । বললেন - কি হল মা ?
- বাবা , একটা কথা বলতে তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম ।
- ঠিক আছে বল ।
- তুমি মাঙ্গলিকী গিয়েছিলে ?
- হ্যাঁ। কে বলল তোমাকে ? শম্ভু ?
জেনেও না জানার ভান করে বললেন ।
- না বাবা । শম্ভুদা নয় । রাজদীপই ফোন করে বলল ।
- ও । বুঝলাম । খবর তো পেলে , এবার রাখি বলে ফোন কেটে দিলেন ।
সম্পাতির কিছুই জানা হল না । রাজদীপকে বলল - সরি! আসল কথাটাই বলার সুযোগ পেলাম না । যাকগে তুমি ওখানে গিয়ে দেখা করে নাও ।
রাজদীপের মনে আশঙ্কা জমল । তথাপি না যেয়েও তো উপায় নেই । একজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে চলল বিভূতিভূষণের অফিসে ।
- স্যার ! মাঙ্গলিকীর প্রোপ্রাইটর আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলছেন !
আর্দালী বলল ।
- পাঠিয়ে দাও ।
রাজদীপ দুরু দুরু বুকে চেম্বারে ঢুকল । বিভূতিভূষণ দেখলেন একজন সুশ্রী , ধবধবে ফর্সা চেহারার যুবক তাঁর সামনে কেমন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বসতে বললেন ওকে ।
জিজ্ঞেস করলেন - মিঃ রাজদীপ লাহা ?
রাজদীপ বলল - ইয়েস স্যার ।
- হুম । অর্ডার বুক খুলুন । আমি কিছু অর্ডার দেব ।
রাজদীপ বলল - অর্ডার বুক তো আনিনি ?
চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন বিভূতিভূষণ ।
- উইদাউট অর্ডার বুক চলে এসেছেন ?
- আসলে আমি ভাবলাম - না মানে - ঠিক বুঝতে পারিনি, অথচ আপনি ডেকেছেন - তাই.... । আপনি বলুন আমি নোট করে নিচ্ছি ।
- তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের সুসজ্জিত প্যাণ্ডেল হবে । সঙ্গে আলো, পাখা, এসি, ফ্রিজ, ক্লোজড সার্কিট টিভি সব ফিট করতে হবে ।
লিখে নিয়ে বিভূতিভূষণের মুখের দিকে চেয়ে আছে রাজদীপ । বিভূতিভূষণ বললেন - এক হাজার চেয়ার, সেইমত ডাইনিং টেবিল উইথ কভার অফ বোথ । চারটে ঝাড়বাতি । ক্যাটারিং ...
সঙ্গে সঙ্গে রাজদীপ বলল - উই হ্যাভ নো ক্যাটারিং সিস্টেম ..
বিরক্ত হলেন বিভুতিভূষণ ।
- লেট মি ফিনিশ । আই নো ইউ ডোন্ট প্রোভাইড ক্যাটারিং
সার্ভিস ।
রাজদীপ লিখতে লাগল - ক্যাটারিং এর জন্য আলাদা প্যাণ্ডেল যাতে সুষ্ঠু ভাবে রান্না বান্না হয় ।
- কোন জায়গায় হবে ?
- আমার বাড়িতে । ১৮২এ স্টেশন রোড এই ঠিকানায়।
- কবে হবে ?
বিভূতিভূষণ মুচকি হেসে বললেন - আজই । সন্ধ্যে ছটা বাজার আগেই যেন কাজ শেষ হয়ে যায় ।
রাজদীপ জানে এটা অসম্ভব । এখন বারোটা বাজে। ছ'টা মানে চার পাঁচ ঘন্টার মধ্যে এত আয়োজন -
বলল - কোয়াইট ইম্পসিবল । অসম্ভব ব্যাপার ।
বিভূতিভূষণ বললেন - জানি । তবে সবই সম্ভব হবে - তার মন্ত্রও আমি জানি । তুমি শুধু একবার হ্যাঁ বলে দাও ।
কি মুশকিলেই না পড়া গেল ।
বিভূতিভূষণ বললেন - এটা কিন্তু সারপ্রাইজ । কেউ যেন জানতে না পারে । এমনকি আমার মেয়েও নয় ।
রাজদীপের মাথা ঘুরে গেল । বলল - দেখছি কতদূর কি করা যায় ।
হা হা করে হাসলেন চেয়ারম্যান সাহেব । বললেন - শুধু মেয়ের কথাটা পেড়েছি তাতেই মুঠো শক্ত হয়ে গেল । কমপ্লিট করতে পারলে তোমার জন্য মস্ত সারপ্রাইজ আছে।
এবার এস । আমি বাকি কাজগুলো গুছিয়ে নিই ।
( চলবে )