Chitta Ranjan Chakraborty

Romance Tragedy

3  

Chitta Ranjan Chakraborty

Romance Tragedy

বনফুল

বনফুল

8 mins
278


সেবার আমি পুজোর ছুটিতে শিলিগুড়ি পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম। পিসেমশাই গত হোয়েছেন কয়েক বছর হলো।পিসি,তোতন,তিতলি এই তিনজনকে নিয়েই পিসির সংসার।আমি যাওয়াতে ওরা ভীষণ খুশি হোয়ছে।আমিও যেনো লেখাপড়ার চাপ থেকে মুক্ত বিহঙ্গ।তিতলি আর তোতনের বায়না ওদের বাড়িতে আমাকে একমাস থাকতে হবে।আমি বললাম,ঠিক আছে,এবার এক বছর থেকে যাবো।পিসির চোখে মুখে বয়সের চাপ পড়েছে,সব কাজকর্ম করতে কষ্ট হয়।তাই একজন মেয়েকে কাজের জন্যে রেখেছে।তিতলির কাছে শুনলাম ও নেপালি।ওর নাম ফুলমতি।সুন্দর চেহারা,পাশের বস্তিতে থাকে।ওর বাবা ওদের ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।ওর মা লোকের বাড়িতে জনমজুর খাটে। ফুলমতি ছোটবেলা থেকেই পিসির বাড়িতে থাকে। লেখাপড়া জানে না, পিসি ভীষণ ভালো মনের মানুষ।ফুলমতি কে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করে।ওকে সন্ধেবেলায় লেখাপড়া করায়, ও খুব ভালো বাংলা বলতে পারে।


আমরা রোজ বিকেলে লুডো খেলতে বসি।পিসি বলেছে ফুলমতি কে নিয়ে খেলতে।তিতলি বলে, ও খুব ভালো খেলে।প্রথমদিন খেলে দেখলাম ও খুব চালাক মেয়ে, খেলায় খুব পটু।এমনি রোজ আমরা সময় হলেই খেলতে বসি। পিসিকে কাজের ব্যাপারে ওকে কিছুই বলতে হয় না।বাড়ির সবাই ওকে ফুল বলে ডাকে।আমিও ওকে ফুল বলে ডাকি। ও আমাকে দাদা বলে ডাকে।কয়েকদিনের মধ্যে যেনো ফুলমতি আমার মনের খুব কাছে এসে গেলো

একদিন ও বাথরুমে স্নান সেরে শরীরে কাপড় জড়িয়ে আমার মুখোমুখি হলো।ওর স্নান করা মুখ আর শরীর দেখে আমি চমকে উঠি,সারা গা শিউরে ওঠে।ফাগুনের আবহে পলাশ ফুল ফুটে ওঠার জন্যে সময় গুনছে।যেমন ওর মুখ তেমন তার শরীর।ভেজা চুলে সুন্দর সুগন্ধ বেরোচ্ছে। সে ও হঠাৎ আমাকে দেখে চমকে ওঠে।নিজেকে সামলে নিয়ে একটু মুচকি হেসে দ্রুত চলে গেলো। তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর পিসি বললেন তোরা শুধু বাড়িতেই থাকিস যা, একটু পাহাড়ে ঘুড়ে আয়।পিসির কথাশুনে আমি রাজি হয়ে গেলাম।তিতলি তো মহানন্দে লাফিয়ে উঠলো। তারপর পিসি ঠিক করে দিলেন পরদিন সকালেই আমরা মিরিক যাবো আবার সন্ধের আগেই ফিরে আসবো। তারপর দিন সকালে উঠে স্নান সেরে রেডি হলাম।পিসি বললেন ফুল ও তোদের সাথে যাবে।আমি আপত্তি করলাম,তোমার কাজে অসুবিধা হবে।আমরা তিনজনেই যাবো।পিসি বললেন কোনো অসুবিধা হবেনা।গতকাল রাতে ও সমস্ত কাজ সেরে রেখেছে।সবার জন্যে পরোটা আর আলুরদম করে রেখেছে।আমি তো শুনে অবাক হলাম আর মনে মনে ভাবলাম ফুল গেলে ভালই হবে।আমাদের ঘোরাটা ভালোই হবে।আমরা চারজন সকালেই খেয়েদেয়ে রওনা দিলাম।একটা ভাড়া করা গাড়ি নিলাম।তোতন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো,আমি,তিতলি,ফুল পেছনে বসলাম। ফুল আমার পাশে বসলো।গাড়ি ছুটলো দুর সবুজ পাহাড়ের দিকে,চারিদিকে শুধু সবুজের মেলা। পশুপাখির কলরব।পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি এদিকওদিক দুলছে।গাড়ির দোলনের তালে ফুল যেনো আমার ওপরে এসে পড়ছে।ওর চুলের ঘ্রাণ শরীরের মোহময় গন্ধ আমার মনে শিহরণ তুলছে।ওর শরীরের চাপ তো নয় আমারই পাওনা এক বিশেষ অনুভূতি।তিতলি বার বার রাস্তার দুপাশের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল,আমি শুনছি কি না শুনছি শুধু হুঁ হুঁ করে যাচ্ছি।আর মনের সুখে ফুলের নির্যাস উপভোগ করছি।


একসময় মিরিক এ গিয়ে পৌঁছলাম। কি অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে বড় বড় গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের নিচে উপরে রঙিন বাড়িগুলো মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে। কি অপূর্ব দৃশ্য, পাহাড়ের সামনে একটা লিখে হাজার হাজার কাতল মাছ, পর্যটকরা রুটি মুড়ি কিনে মাস্তের খাওয়াচ্ছে, আমরাও কিছু বিস্কুট কিনে মাছেদের খাওয়ালাম। সামনে এগিয়ে যেতে বিরাট এক লেক। তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নৌকায় রেস্টুরেন্ট। পাশে অনেক ফুচকা চাওমিন মোমোর দোকান আছে। সবাই ডাকছে। এসব দেখে দেখে লেকপার হয়ে পাইন গাছের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। এই সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল, অসময়ের বৃষ্টি আমরা তৈরি হয়ে যায়নি, তাড়াহুড়ো করে পাইন গাছের নিচে দাড়ালাম, রাস্তায় এত পিচ্ছিল যে আমি পড়ে গেলাম, ফুল আমাকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে গেল। তিতলি তো হেসে লুটোপুটি। আমি ওঠার চেষ্টা করবো কি ফুলকে ধরে অন্য এক অনুভূতিতে কাদায় পড়ে থাকলাম দাড়ি। অবশেষে তোতন এসে ধরে তুলল দুজনকে।পাহাড়ি কাদামাটিতে আমার সমস্ত শরীর মুখ আর ফুলের শরীর মুখ বীভৎস চেহারা ধারণ করলো। আমি লজ্জায় মুখ লুকানোর মতো রুমাল দিয়ে মুখ চোখ মুছতে লাগলাম। এমন কাদামাটি আরো যেন সারা গায়ে কাদা হয়ে গেল। আমার এই অবস্থা দেখে পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে। তিতলি আর ফুল দুজনেই জোরে জোরে হাসছে ওদের হাসি দেখে আমার ভীষণ রাগ হল। আরো জোরে বৃষ্টি নামল। আমি থাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলাম। বৃষ্টিতে আমার শরীরের সব কাদাজল ধুয়ে যাচ্ছে। এ দেখে ফুলও আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। দুজনে ভিজছি আর ভিজছি। এ ভেজা যেন অন্য এক অনুভুতি পাওনা। অবশেষে বৃষ্টি থেমে গেল আমরা গাড়ির কাছে চলে এলাম। ভেজা কাপড় পাল্টানোর কোনো উপায় ছিল না। শীতে কাঁপতে শুরু করলাম দুজনেই। আমি বললাম, অনেক হয়েছে পাহাড় দেখা, এবার বাড়ি চলো সবাই। পিসির দেওয়া খাবার গুলো খেয়ে গাড়ি করে রওনা দিলাম। আবার ফুল আমার পাশে বসে ঠান্ডায় কাঁপছে, বারবার আমার দিকে চেপে আসছে, শরীর দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরছে ওর শরীরের কাদা জলের ঘ্রাণ, শরীরের ওম আমাকে মোহিত করে তুলেছে।


আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম।

এভাবে কয়েকদিন পর মায়ের ফোন এলো বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য।বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মনটা আমার ভারাক্রান্ত হয়ে আসলো, শুধু ফুলের জন্য। আমি নিশ্চুপে চোখের জল মুছলাম। আমি খেয়াল করিনি আমার পাশে ফুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের সব কথা শুনেছে। আমাকে ফুল বলল, দাদা তুমি চলে যাবে? আর কটা দিন থাকলে হয়না? আমি বললাম, না রে তা হয় না, লেখাপড়া আছে কলেজ খুলবে আর মায়ের শরীর ভালো না, ও চুপচাপ শুনে চলে গেল।

রাতের খাবার খেয়ে আমি আমার ঘরে ফোন নিয়ে বসে আছি এমন সময় জানলার পাশে একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম প্রথমে চমকে গেলাম পরে ভাবলাম ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। মনে হয় ফুল কাজ সেরে যাওয়ার পথে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে আমাকে দেখছে। ধীরে ধীরে আমি জানলার পাশে দাঁড়ালাম, দেখলাম ঠিক ফুল দাঁড়িয়ে আছে আমি অচেনার ভান করে বললাম কে? ওখানে কে দাঁড়িয়ে? ফুল নিচুস্বরে বলল,দাদা আমি ফুল। আমি বললাম, এত রাত্রে এখানে কি দরকার তোর। তোর কি কাজ শেষ হয়ে গেছে? ও বললো হ্যাঁ, তোমাকে একটা কথা বলবো বলেই এসেছি। আমি বললাম কি কথা বল। ও বলল, দাদা তুমি আর কটা দিন থেকে যাও বাড়ি যাবেনা। আমি বললাম, কেন রে? এই কথা বলছিস? আমাকে বাড়ি যেতেই হবে। ও বললো না যাবে না। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। হঠাৎ আমার সারা শরীরে এক বিদ্যুতের শিহরণ লাগলো। আমি ওকে বললাম ঠিক বুঝে উঠতে পেলাম না। নিজেকে সংযত করে বললাম না তা হয় না রে, এটাতো নিজের বাড়ি নয়, আর পড়াশোনা করতে হবে। অনেকদিন তো থাকলাম আবার আসব। ও বলল না হয় আর কটা দিন থেকে যাও। আমি বললাম না রে মা বাবা বকবে আবার তাড়াতাড়ি আসবো, শুধু তোর জন্য। তোকে যে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ও বলল আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি দাদা। আমার কথা রাখো কটা দিন থেকে যাও। আমি বললাম আচ্ছা দেখি। ও আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে কাঁ আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কাঁদতে নিষেধ করলাম কিন্তু আমার চোখেও জল ভরে এলো।

পিসি যে কখন থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা শুনছিল বুঝতে পারিনি, পিসি বলল ফুল ঘরে যাসনি? এতো রাতে ওখানে কি করছিস? ঘরে যা। আমাকে বলল প্রীতম শুয়ে পড়ো রাত অনেক হয়েছে। ফুল চলে গেল আমিও লজ্জায় মাথা নিচু করে শুয়ে পড়লাম।

রাতে ঘুম হয়নি, অনেক বেলা তে উঠলাম। চা খেয়ে পিসিকে বললাম, আজ চলে যাব। পিসি বলল সে কিরে পাগল ছেলে, আর কটা দিন থেকে যা, তিতলি ও বলল তাই করো দাদা আর কটা দিন থেকে যাও। আমি বললাম মা ফোন করেছে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে, পড়ার ক্ষতি হচ্ছে। পিসি বলল আজ নয় কাল যাস।

সেদিন ফুলকে বারকয়েক দেখলাম, কিন্তু আমার সামনে একটিবারও এলো না। বিকেলেই সব কাজ সেরে পিসি কে বলল, মাসি আজ আমি বাড়ি চলে যাব। পিসি বলল সে কিরে কেন যাবি? ফুল বলল, মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ তাই যেতে বলেছে। পিসি বলল, আচ্ছা যাবি যা কাল সকালেই চলে আসিস। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। রাতের ঘটনার জন্য নিজেকে দোষী মনে হল ফুল কেন আমাকে না বলেই চলে গেল? অভিমান? না রাগ আমার উপর?

রাতেই আমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম স্থির করলাম সকালেই চলে যাব।পরদিন সকালে উঠে চা খেয়ে এই ব্যাগ নিয়ে বের হলাম। পিসি,তিতলি, তোতন সবাই বলল, এ কিরে খেয়ে দেয়ে যাবি তো? আমি বললাম না অনেক কাজ আছে। মা ফোন করেছে সকালেই যেতে হবে। এই বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। অপেক্ষা করলাম ফুলের জন্য। ভাবলাম ওর সঙ্গে দেখা হবেই। কিন্তু না লজ্জায় ওদেরকে ফুলের কথা বলতেও পেলাম না। চরম হতাশা আর অপরাধী মন নিয়ে চলতে লাগলাম।

হঠাৎ পিছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম দাঁড়াও দাদা দাড়াও। ফিরে দেখি ফুল ডাকছে। আমি বললাম এ কি রে কোথা থেকে এলি, একি তোর চেহারা হয়েছে? ও বলল, বাড়ি থেকে এসেছি।আমি জানতাম আজ সকালে তুমি চলে যাবে তাই রাস্তার মোড়ে ভোর সকাল থেকেই বসে আছি আর সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আমি বললাম কেন? ও বলল, তোমার জন্য দাদা, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। এক কাজ করো দাদা আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে চলো। বাড়ির সব কাজ আমি করবো তোমার কাছে লেখাপড়া শিখব। নারে সে হয় না, ও বলল কেন হয় না, আমি ছোট জাত বলে? ও কাঁদতে লাগলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললাম, আজ আসি রে এরপরে মায়ের সাথে কথা বলে তোকে নিয়ে যাব। ও বলল, না আমাকে নিবে না আমি জানি। শোনো, আজ থেকে ও বাড়িতে আর কাজে যাব না। আমি বললাম কি করবি? ও বলল, মায়ের সাথে জন খাটবো। আমি বললাম না ওখানে আছিস ভালো আছিস, কাজ বাদ দিস না। ও বলল, কার জন্য বাড়িতে যাবো দাদা? তুমি থাকলে যেতাম। আরেকটি কথা শোনো এই কথাটি তোমাকে রাখতেই হবে। আমি বললাম কি কথা, ও বলল আর কোনদিন তোমার সাথে আমার দেখা হবে না। তাই তোমাকে আমার ভালবাসার চিহ্ন দিলাম। এই বলে, রুমালে বাধা বনফুলের গাঁথা মালা আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো,আর বলল আমাকে ভুলে যেও না


দাদা,আমি তোমাকে কোনদিন ভুলতে পারবোনা। মালাটা ছিঁড়ে ফেলো না। আমি সারারাত জেগে মালাটা গেঁথেছি। বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল, আমিও বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি করবো বুঝতে পারলাম না। ও নিজেকে সামলে নিয়ে আমার প্রণাম করে বলল যাও দাদা, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমিতো বনফুল, বনেই আমার স্থান, দেবতার পায়ে নয়। বলেই ছুটে চলে গেল। আমি ওকে ডাকার সাহস পেলাম না। নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম আর বনফুলের মালা থেকে কত রকমের সুন্দর ঘ্রাণ আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গেল। নিজেকে ভুলে গেলাম, মালাতি বুকের কাছে চেপে ধরলাম আর ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance