Himangshu Roy

Drama

3  

Himangshu Roy

Drama

বন্ধুত্বের গোল

বন্ধুত্বের গোল

3 mins
7.4K


বিকেলবেলা যখন আমরা খেলতে যেতাম মাঠে পুবের গোলপোস্টটার পিছনে কমল দাদু আর অমল দাদুকে বসে থাকতে দেখতাম প্রতিদিন।বয়স বেশী বলে দাদু বলে ডাকি।দুজনেরই বয়স সত্তর পেরিয়েছে।কমলদাদু অমল দাদুকে অমলা বলে ডাকে আর অমল দাদু কমল দাদুকে কোনাই বলে ডাকে।স্কুলে নাকি কমলদাদু খুব কানমলা খেত পড়া না করার জন্য।বৃষ্টির জন্য আমরা যদি কোনোদিন নাও আসতাম,তবু দেখতাম যে ওনারা দুইজন বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন।মাঝেমাঝে আমি ভাবি বুড়োদুটো এত কীসের গল্প করে যে শেষই হয় না!শুনেছি যে ছোটবেলা থেকেই কমলদাদু আর অমলদাদুর বন্ধুত্ব।স্কুলে কমলদাদু ছিল ভীষণ ডানপিটে,সারাক্ষণ মারামারি করত এরসাথে ওরসাথে ।ভাব ছিল শুধু অমলদাদুর সাথে।দুইজনে স্কুলের ফুটবল খেলতেন ।কমল দাদু নাকি কোনোদিম পেনাল্টি মিস করেন নি ।োঅমলদাদু স্কুলে বরাবর প্রথম হতেন, দুজনের মধ্যে অমিলও ছিল প্রচুর ।কমলদাদুর শরীর স্বাস্থ্য ভালো,অমলদাদু ছিলেন প্যাঁকাটির মত,এখনও তাই।

আসলে বন্ধুত্বে বৈপরিত্য না থাকলে বন্ধুত্বে উত্তাপ থাকে না।

সেদিন বিকেলবেলা অমলদাদুর সাথে কমলদাদুকে না দেখে অবাক হয়েছিলাম। তারপর দুইদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ,অমলদাদুও মনমরা হয়ে বসে থাকে অপেক্ষায়।একদিন সাহস করে অমলদাদুর কাছে গিয়ে বললাম

- দাদু তোমার বন্ধু কই ,দুদিন ধরে দেখছি না

- জানি না রে। আমার চিন্তা হচ্ছে কোনাইটার কোনো অসুখ করল নাতো, নাহলে তো আসতই।

-তুই একটু খোঁজ নিয়ে আয় না বাবা

আমি হেঁচকি তুলে বললাম

-আমি তো ওই বাড়ীতে যাই না। ওনার ছেলে যে রাগী মানুষ ,দেখলে ভয় লাগে।

-খালি যাবি আর কী করছে দেখে চলে আসবি

যেতে ইচ্ছে না থাকলেও বুড়োটার অনুরোধ ফেরাতে পারলাম না।সাইকেল নিয়ে কমলদাদুর বাড়িতে গেলাম।কমলদাদু হুইলচেয়ারে বসে রোদ পোয়াচ্ছেন,গাঁটগোট্টা শরীরটা ভেঙ্গে গেছে। এই দুইদিনেই এরকম অবস্থা ,দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বললাম কী হয়েছে দাদু

-দুইদিন আগে স্ট্রোক করেছিল,ডান পা টা অচল হয়ে গেছে।

এমন সময় কমলদাদুর ছেলে আসলো বলল

-কেরে তুই এখানে কী করতে এসেছিস

আমি আমতা আমতা করে বললাম

-অমলদাদু বলল তাই খোঁজ নিতে এলাম

অমলদাদুর কথা শুনে কমলদাদুর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

-ওই বুড়োটার জন্যই তো আজ এই অবস্থা।বুড়োর ভিজে ভিজে অসুখ করবে আর সব ঝক্কি পোয়াতে হবে আমাকে।যা ভাগ এখান থেকে।

আমিও প্রায় পালিয়েই এলাম।

কমলদাদু আর আসে না,মনে হয় ওনার ছেলেই আসতে দেন না।তবে অমলদাদু এখনো প্রতিদিনই আসে,..মাঝেমাঝে আমিই ওনার কাছে গিয়ে গল্প করি।আগামী রোববার কমলদাদুর নাকি জন্মদিন ,অমলদাদু বলল

-জানিস প্রতিবার জন্মদিনে ও আমাকে নতুন নতুন উপহার দিত ,কখনো আম ,কখনো পেয়ারা চুরি করে ।একবার তো মার ও খেয়েছিল ,তবু লিচু চুরি করে ঠিক এনেছিল আমার জন্য।বলে হাসতে লাগল অমলদাদু ...আর একবার তো ওর নতুন বউর রান্না নিয়ে এসেছিল টিফিন বক্সে করে,আর একবার ছএলের বউর রান্না করা খিচুড়ি দুজনে মিলে খেয়েছিলাম।বলতে বলতে হাসতে থাকে অমল দাদু..হাসতে হাসতে কখন চোখ দিয়ে জল পড়েছে খেয়াল করেন নি।

আমিও কেমন জানি হয়ে গেলাম।মাঠে কমলদাদুর নাতি আসত আমি ওকে বললাম সব...

তারপর ঠিক করলাম দুই বুড়োকে সারপ্রা্ইজ দেব।শনিবার রাতে আমি অমলদাদুকে আর কমল দাদুকে ওনার নাতি নিয়ে আসব।সেইমত আমরা গোলপোস্ট সাজালাম ।তারপর কমলদাদুকে এনে গোলপোস্টের সামনে বসানো হল ।সামনে ফুটবল,গোলকিপার আর আমরা চিৎকার করছি দাদু গোল দাও,দাদু গোল দাও...দাদু হুইল চেয়ারে বসে।এমন সময় পিছন থেকে অমলদাদু এসে চিৎকার করতে লাগলেন ...কোনাই মার,..কোনা মার..গোল দে.....

আমরা অবাক চোখে দেখছি...কমলদাদু আস্তে আস্তে হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন......তারপর বলে মারলেন কিক.......

আশেপাশের পরিবেশ যেন থমকে গেছে,কারও মুখে টুঁ শব্দ নেই.. আমরা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছি।কমলদাদু পড়ে গেলেন মাটিতে কিন্ত বলটা বামদিকের কোনা ঘেঁষে জাল কাঁপিয়ে দিল।

গোল!! গোল!!গোল!!!

আমরা চিৎকার করে উঠলাম।অমলদাদু কমলদাদুকে জড়িয়ে ধরলেন ,বলতে লাগলেন...

-কোনাই, কোনাই তুই গোল দিয়েছিস..আমরা জিতে গেছি ,বন্ধুত্ব জিতে গেছে বলে কাঁদতে লাগলেন।

আমদেরও দুই বুড়োর আবেগের বহিঃপ্রকাশ কাঁদিয়ে ছাড়ল।

আসলে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই এরকম উচুঁ নীচু ধনী গরীব কোনো বাঁধনে আটকে থাকে না।বন্ধু মানে একটা অসীম ধারকত্বের কথার প্যানডোরার বাক্স ,সুখ দুখ হাসিরা আটকে থাকে যেখানে।বুড়ো হলেও কথা ফুরায় না।বন্ধু মানে খামখেয়ালীর একশেষ ,বন্ধু মানে না বলা ভালোবাসা।

তবে এতদিনে বুঝতে পারলাম কমল দাদুর নাম কোনাই কেন কেক কাটলাম ,দুই বুড়োর খুশি দেখে কে বলবে এদের বয়স সত্তরের উপরে!

আমাদের খেলা চলছে আগের মতই ,দুই বুড়োও আসে।পরিবর্তন হয়েছে এই যে বুড়োদুটো এখন আমাদের জন্যও চুপটি করে কিশমিশ নিয়ে আসে।


https://sabujkali.blogspot.com/?m=1


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama