বিষকন্যা
বিষকন্যা


প্রায় সাত বছর পর এভাবে অফিস পার্টিতে তিয়াসা বৌদিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। বৌদি যে আমাদের এই ব্রাঞ্চে কাজ করে তাও জানতাম না। অবশ্য আমি মাত্র একবছর এই কোম্পানিতে আছি। সবে বদলী হয়ে এই ব্রাঞ্চে এসেছি। 'বেষ্ট পারফরম্যান্স অফ দা ইয়ারে'র পুরস্কারের জন্য তিয়াসা সেন নামটা শুনেই অবাক হয়েছিলাম। নামটার সাথে পরিচিত চেহারাটাও মিলে যাওয়ায় আনন্দ হয়৷সামনে গিয়ে অভিনন্দন জানাতেই বৌদি খুশি হয়েছিল আমায় দেখে।এই তিয়াসা বৌদিকে খুব কাছ থেকে চিনতাম একসময়। আমরা ভাড়া থাকতাম যে বাড়িতে সেই বাড়ির ছোট বৌ হয়ে এসেছিল বৌদি প্রায় বারো বছর আগে। নীলাভ দা ছিল সরকারী কনট্রাকটর, বৌদির বাবা মা ছিল না, পিসির কাছে মানুষ। পিসি মারা যেতেই পিসে এই বিয়েটা দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছিল। ঐ বাড়ির বাকি তিন বৌ বৌদিকে খুব একটা পছন্দ করত না বুঝতাম। বৌদি দারুণ দেখতে ছিল তাই হয়তো নীলাভ দা এক দেখাতেই বিয়েটা করে ফেলেছিল। আমাদের পাশের ঘরেই ওরা থাকত। বৌদি সারা দিন বাড়ির সব কাজ করেও সময় করে পড়তে বসতো। প্রাইভেটে এম.এ করছিল শ্বশুর বাড়ির অমতে। এই নিয়ে টুকটাক অশান্তি হত। এর পর বৌদি একটা চাকরী জয়েন করতেই শুরু হল রোজ অশান্তি। ঐ বাড়ির সবাই বৌদির বিপক্ষে। নীলাভ দা ও বলেছিল চাকরীর দরকার নেই। তবু বৌদি দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছিল। এর মধ্যেই বৌদির একটা বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। জে্ঠিমা ওকে আগেই অপয়া বলত। এবার সবাই মিলে যা-তা বলা শুরু করল। এর কিছুদিনের ভেতর নীলাভদার বাবা মারা যেতেই সবাই আরও বেশি করে সব কাজেই বৌদির দোষ বার করত। বৌদিকে কখনো প্রতিবাদী হতে দেখিনি। এরপর বৌদির দ্বিতীয় বাচ্চাটাও নষ্ট হতে সবাই ওকে বিষকন্যা বলতে শুরু করেছিল। বৌদি একদিন শুধু বলেছিল ডাক্তার রেস্ট নিতে বলার পরেও ওকে দিয়ে বাড়ীর সব কাজ করানো হত। কাপড় কাচা, অত বড় দোতলা বাড়ি মোছা, সবার জন্য জলখাবার, ছুটির দিনের রান্না ! অজুহাত দেওয়া হত ও রোজ অফিসে যায়। তাহলে এগুলোও পারবে।
এভাবেই চলছিল। পরের বার বৌদির একটা ফুটফুটে মেয়ে হতেই শুরু হয়েছিল নতুন ঝামেলা। কেন মেয়ে হল? এই অপরাধে বৌদি প্রায় একঘরে। এবার নীলাভদা মদ খেয়ে এসে গায়েও হাত দিত। আমি ভাবতাম বৌদি কেন কোথাও চলে যায় না! চাকরী তো করে! কেন এতো অত্যাচার সহ্য করে?এরপর আমি পড়তে চলে যাই দিল্লী। দু বছর পর ফিরে শুনলাম নীলাভদার লিভার ক্যানসার। বৌদি চাকরী বাঁচিয়ে, মেয়ে সামলে দু বেলা হাসপাতালে যেত। বাচ্চাটাকে সারাদিন একা পেয়ে ওর মনটাও সবাই মিলে বিষিয়ে দিয়েছিল। মায়ের প্রতি ওর টান ছিলনা। ঠাম্মা আর বড়মার কাছেই থাকত নিন্নি। দুদিন রাতে ফোনে কথা বলতে বারান্দায় গিয়ে বৌদিকেও দেখেছিলাম বারান্দার কোনে বসে৷একমাসের ভেতর নীলাভদা চলে গেল। কিন্তু বৌদি নির্বিকার। সবাই বলত খুব শক্ত, জেঠিমা সব সময় বলত বিষকন্যা। মেয়েকে জেঠিমাই রাখত বেশি। অফিস থেকে ফিরে বৌদি দেখত মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। জেঠিমার বাক্যবাণের বর্ষণে টের পেতাম বৌদি ফিরেছে৷এর কয়েকমাস পর জেঠিমাও চলে গেছিল ঘুমের ভেতর। নীলাভদার দাদাদের সাথে বৌদির নিত্য অশান্তি শুরু হয়েছিল। নিন্নিকে ডে-বোর্ডিং এ রেখে বৌদি অফিস যেত। রাতে নিয়ে ফিরত। বাচ্চাটা বৌদির কাছে থাকতে চাইতো না। জেঠু আর বড়মার কাছে যেতে চাইত।এর তিনমাসের মধ্যেই একদিন ওদের বাড়িতে তুমুল অশান্তি শুরু হল। বৌদি নাকি নিজের অফিস কলিগ কে বিয়ে করবে! এক মহিলা এসে দাবী করছিল তার স্বামীর সাথে বৌদির অবৈধ সম্পর্কের জেরে স্বামী দুই সন্তান সহ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এখন তিয়াসা বৌদিকে বিয়ে করতে চলেছে। বৌদিকে সেদিন প্রথম চিৎকার করতে শুনেছিলাম। কিন্তু কি হচ্ছে কিছুই বুঝি নি। পাড়ার অনেকেই চিৎকার শুনে ওদের বাড়ি এসেছিল সেদিন। আমায় বাবা জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অল্প বয়সে এ সব নোংরামির মধ্যে থাকতে দেয়নি।পরদিন দেখেছিলাম বৌদিকে চলে যেতে। নিন্নিকে দেয়নি ওরা। বৌদি কেস করেছিল। কিন্তু ওরা উকিল দিয়ে প্রমান করেছিল বৌদির চরিত্র বাজে। মেয়েও যেতে চায়নি। ওরা বলত বৌদি বিষকন্যা, মেয়েকে মেরে ফেলবে।আমরা সে সময় ওদের বাড়ি ছেড়ে বাগুইহাটিতে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যাই৷ ওদের সাথে আর যোগাযোগ ছিল না।
এতবছর পর বৌদিকে এভাবে দেখে মনটা কেমন করছিল। খাবার নিয়ে বৌদির টেবিলে গিয়ে বসলাম। বৌদি বলল একাই আছে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। মেয়েকে পায়নি, পরে অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম বৌদির কাজের ও চরিত্রের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে এই অফিসে। অবশ্য এখানে বৌদি ছয় বছর কাজ করছে। আগের খবর কেউ জানে না। মনটা খুঁতখুঁত করতো এটা ভেবে যে বৌদি কি সত্যি কারো ঘর ভেঙ্গেছিল !কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানলেই বোধহয় ভালো।