বিষাক্ত পৃথিবী
বিষাক্ত পৃথিবী


কাটফাটা রোদ উঠেছে আজ, বর্ষা এবার নাকি দেরিতে আসবে। খালের ধারে বুড়ো আমলকি গাছের পাশের ঘরটা বিশু বাগদির। জল তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে বিশুর। বারান্দার কোনে মাটির কলসিতে রয়েছে ডিপ টিউবয়েলের জল, দুগ্গা সকালে লাইন দিয়ে এনে রাখে রোজ। গ্ৰামে আগে বাইশটা ডিপ টিউবয়েল ছিল। জলের স্তর নামতে নামতে এখন মাত্র দুটো দিয়ে জল আসে। কলসির জল গড়িয়ে খেতে যায় বিশু, টলটলে কিন্তু কষাটে জল !! বিষাক্ত জল। এই জলে নাকি বিষ রয়েছে। বিশু অবাক হয়ে জলের দিকে তাকায়।
সরকার বলেছে এই জলে বিষ আছে। এই গ্ৰামের মাটির নিচের জলে ভয়ঙ্কর মাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া গেছে। তাই সচেতনতার নামে প্রচার চালাচ্ছে। মাইকে ভেসে আসছে আওয়াজ।
নিজের দু হাতের খসখসে চামড়ার দিকে তাকিয়ে বিশু ভাবে বিষ রক্তে মিশেছে বহু আগেই।
ঐ যে খালের ধারে আমলকি গাছের নিচে কাদা মাটি নিয়ে দুই নাতি খেলছে ওদের কাছে এগিয়ে যায় সে। ওদের মাটি মাখা কচি হাত তুলে ধরে বিশু। এই কচি হাতের সঙ্গে নিজের হাতগুলো মেলাতে চেষ্টা করে সে। একসময় এভাবেই কাদা মাটি ঘেঁটে সেও বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছে কিন্তু তখন এখানে বিষ ছিল না এখানে। এদের কচি চামড়াতেও পড়েছে বিষের ছোবল। দুই নাতির হাতের খসখসে চামড়ায় রয়েছে আর্সেনিকের দাগ।
আগে যখন জলা, পুকুর, খাল, বিল বুজিয়ে একটার পর একটা বাড়ি উঠছিল সরকার তখন তাকায়নি। নদীর বুকে একটার পর একটা ভেরী, ইট ভাটা এসব দেখেনি। জল জঙ্গলের জায়গা ছিল ওদের এই গ্ৰাম। আজ জল নেই। উন্নয়নের নামে অগভীর নলকূপ বসিয়ে মাটির নিচের জলকে টেনে নিয়েছে যখন সরকার বোঝেনি কি ক্ষতি হচ্ছে। বিশু নিজেও তো বহুবার গেছিল মাষ্টার দাদার সঙ্গে পিটিশন জমা দিতে!! কি লাভ হয়েছিল ? তখন সরকার কান দেয়নি। ফাইলের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছিল ওদের আবেদন নিবেদন।
আজ সেই সরকার রঙ বদলে বলছে এই জল বিষাক্ত!!
যাবে কোথায় গায়ের মানুষ। গাছ কেটে কেটে একের পর এক ফ্যাক্টরি হয়েছে, চাষের জমির মাঝে সব উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি। এত এত মানুষ এসেছে থাকতে। জল লাগে না তাদের ? জলের জন্য একের পর এক পাম্প বসেছে। এই মরা খাল নাকি গঙ্গার অংশ, কত জল ছিল এখানে। ছোটবেলায় বিশু বাবার সাথে ডিঙিতে চড়ে কত জায়গায় গেছে এ পথে। আজ নালার মত নোংরা জল, গন্ধে টেকা দায়।
একে একে অনেকেই গা ছেড়ে শহরে যাচ্ছে। যাদের সামর্থ্য রয়েছে যাচ্ছে। বিশু এই ভিটে মাটি ছেড়ে এ বয়সে কোথায় যাবে। একটা ছেলে ছিল, কি এক বিরল রোগে টেনে নিল ভগবান। সেও নাকি ঐ আর্সেনিকের জন্য। বৌটার ক্যানসার , নিজের চামড়ায় এই সব রোগ। নাতি দুটোকেও ছাড়েনি ঐ আর্সেনিক।
এসব হয়েছে নাকি ঐ জল থেকে। অথচ এতদিন জানত জল মানেই জীবন। সেই জল আজ বিষ হয়ে ওদের রক্তে মিশে গেছে।
আজ আবার একটা দল এসেছে জল পরীক্ষা করতে। এদের দেখলেই রাগ হয় আজকাল বিশুর। শহরের লোক ওরা, সবাই বোতলের জল খায়। পেটি পেটি বোতল নিয়ে আসে। আর গ্ৰামের উপর পরীক্ষা চালায়। ফিরে যায় যখন ঐ সব খালি প্লাস্টিকের বোতল আর খাবারের প্যাকেট গড়াগড়ি খায় ওখানে। সবগুলো শকুনের জাত। এবার পুরো গ্ৰামটা ধীরে ধীরে দখল করবে ওরা।
দুই নাতিকে নিয়ে ছুটে যায় বিশু, কাদা মাখা খসখসে চামড়ার হাত গুলো তুলে ধরে ওদের সামনে। বলে -''পারবা বাবুরা... আমাগো ছামড়া গুলান ফিরাই দিতে ? এই শিশুগুলারে দেখো গো? এরাও রেহাই পায় নাই। ''
কর্মকর্তারা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ওদের। দুই নাতি ঐ খসখসে হাতে দাদুকে সরিয়ে নিতে চায়।
কিন্তু বিশু পাখি তাড়াবার মত লাঠিটা মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে যায়। মুখে হ্যাট হ্যাট শব্দ। আজ ও সবাইকে তাড়াবে।
ওর বৌ ছুটে আসে। ছেলেটা মারা যেতেই মাথাটা গেছে বিশুর। কিন্তু দুগ্গার শরীরে আজ আর শক্তি নেই বিশুকে আটকানোর।