বিরহ জ্বালা
বিরহ জ্বালা
কলেজ থেকে ফেরার পথে,মল্লিকা বাসে বসেছিল, সুদীপের অপেক্ষা সে দুঘন্টা করছে।সে ধৈর্য হারায় নি,অনেক কথা তাকে আজই বলতে হবে।পরে আর এমন নিরিবিলিতে দেখা হবে কি না সন্দেহ।তাকে কলেজ আসতে আজই মা নিষেধ করেছিল, আর হয়ত তার কলেজ আসাই হবে না।
তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা, বার বার মল্লিকা তার হাত ঘড়ি দেখছিল।সুদীপের কলেজ আলাদা।দ্বাদশ শ্রেণী অবধি তারা একসাথে গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়াশোনার করলেও এখন মল্লিকা বর্ধমান উওমেন্স কলেজে বি এ ইতিহাস অনার্সের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। সুদীপ বিবেকানন্দ কলেজে, কেমিস্ট্রি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
শীতের বেলা একটু অন্ধকার নেমেছিল ।সুদীপ আর মল্লিকার একই গ্রামে বাড়ি তাই বাসরুট একই, যদিও মল্লিকার কলেজের আর্টসের অনার্স ক্লাস অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। আগের বাস ধরে মল্লিকা বাড়ি যায়।সুদীপের সাথে দেখা করতে সে আজ দু ঘন্টার বেশী আপেক্ষা করছিল।
মাঝে মধ্যেই সুদীপ জন্য এমন অপেক্ষা সে করে।সুদীপের অনার্স ক্লাস শেষ হতে প্রায় দিনই পাঁচটা হয়,তারপর সে বর্ধমান তিনকোনিয়া বাস টার্মিনাল আসে। বিবেকানন্দ কলেজ মোড় থেকে দক্ষিণ দামোদর লাইনে বাস ধরে দুই তিন কিলোমিটার পথ বর্ধমান মুল বাস টার্মিনাল তিনকোনিয়া তাকে তো আসতেই হয়।
এখান থেকেই তার গ্রামের বাড়ি কুরমুন যেতে নবদ্বীপ গামী রুটের বাস পাবে। সেও বাসে চল্লিশ মিনিটের পথ। মল্লিকা রিকশা ধরেই উওমেন্স কলেজ থেকে বর্ধমান তিনকোনিয়া বাস টার্মিনাল চলে আসত।
সুদীপকে বাসে উঠতে দেখে মল্লিকা সুদীপকে কাছে ডাকল।পাশের সিটটা মল্লিকা তার কলেজ ব্যাগ রেখে দখল করেছিল সুদীপের জন্য। আজ তারা একই সাথে সকাল নটার বাসে গ্রাম থেকে বর্ধমান এসেছিল।
মল্লিকা ওবেলা সুদীপকে কিছু কথা বাস থেকে নেমে বলতে চেয়েছিল,সুদীপ জানায়,তার এখন অনার্স প্রাকটিক্যাল ক্লাস আছে, তাই তাড়া আছে, সুদীপ দাঁড়ায় নি । মল্লিকা বেশ বুঝছিল সুদীপ তাকে বেশ কিছুদিন এড়িয়ে যাচ্ছে।আজ সে ছাড়বে না।পাসে বসিয়ে সুদীপের বাম হাতের কব্জিটা টিপে ধরে বলে।
"আমার দুটো কথাও তুই শুনবি না!"
সুদীপ লজ্জা পাচ্ছিল, বাসে আরও মানুষ, তাদের নজরে পড়তে পারে।একটু গম্ভীর হয়ে বলে
"হাতটা ছাড় না!"
মল্লিকা খুব আস্তে আস্তে স্মিত হেসে রসীকতার সুরে বলে,
"যদি না ছাড়ি!"
সুদীপ ভীষন লাজুক মল্লিকা জানে ,সুদীপ খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলে,
"সেটা তোর খুশী! তোরা মেয়ে, তোদের তো অনেক অধিকার।"
"একদম আজ ঝগড়া করবি না!"
মল্লিকার গলার স্বর শুনে সুদীপ বুঝতে পারছিল, মল্লিকার মন ভারাক্রান্ত কাঁদো কাঁদো, তাকিয়ে দেখে,মল্লিকার দুচোখ আজ জলে ভরে গেছিল।
সুদীপের মনটাও খুব ভেঙ্গে গেছে। সংযত হয়ে বলল,
"নিজেকে শক্ত কর,যেটা বাস্তব মেনে নে।"
"তুই তো বলেই খালাস, কিন্তু আমি পারছি কৈ। তুই আমাকে এখন আর না পছন্দ কর,তোকে কিন্তু আমি আজও ভালোবাসী। "
"ন্যাকামী বাদ দে,কদিন পর তোর বিয়ে, আমাকে ভালোবেসে কী স্বর্গ উদ্ধার করবি!"
"আজ শুধু কলেজ এসেছি তোর সাথে শেষবার মত একটু নিলিবিলি মনের কথা বলতে। পরের বাসে যাবি! চল না একটু নেমে যাই, পরের বাস তো আধ ঘণ্টার পরই ছাড়বে,আমি তো তোর জন্য দু ঘন্টা ধরে বসে অপেক্ষা করছি।তিনটে বাস ছেড়ে শেষে তোর দেখা পেলাম।আমার জীবনের শেষ অনুরোধ একটু রাখবি না!"
মল্লিকার মুখে অনুনয়ের সুর,কেমন আবেগঘন তার চোখের চাহনি।
সুদীপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
"চল, তোর শেষ অনুরোধ ফেলি কী করে! তবে চারদিন পর তোর ফুল শয্যা, বরের সোহাগে আপ্লুত হবি,এসব তখন ভাবলে তোর নিজেকে বোকা বোকা লাগবে। তোর ভাবী বর শুনেছি ব্যাঙ্ক অফিসার, কলকাতায় পোষ্টিং, তোকে নিশ্চয়ই কলকাতায় নিয়ে যাবে।সুখে থাকবি।"
মল্লিকা এর কোন উত্তর দিল না।শুধুমাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,মানসিক ভাবে যেন সে খুব ক্লান্ত ।
কলেজের ব্যাগ সহ দুজনেই বাস থেকে নেমে আসে।মল্লিকা বলে,
"চল তোর নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে, বিরিয়ানি না মোগলাই কী খাবি!"
সুদীপ হাসে কেমন বিষন্ন হাসি,
"এই স্মৃতি গুলো নতুন করে তৈরি করা কী খুব দরকার ছিল!"
মল্লিকার চোখে জল,
"তুই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ ,আমার প্রথম ভালোবাসা, প্রথম প্রেম, দেহটার বিয়ে হবে।মনটা তোর জন্য চির জীবন হা হুতাশ করবে।"
"ছ মাস পরে দেখব,পথে দেখা হলে চিনতে পারবি না।কথা বলবি না।আর বর যদি সঙ্গে থাকে,আমি যদি কথা বলতে যাই ,ন্যাকা সেজে চিনবি না বা আমায় আপনি দাদা বলে হয়ত সম্ভাষন করবি।"
" মজা করছিস ! তুই আমাকে একদম ভালোবাসিস না বল!"
"তুই যা খুশী ভাব,আমার কিছুই যায় আসে না।তবে তোকে জীবনে পাবো না,এই সত্যিটা আমি অনেক দিন আগেই জানি। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার বোকামি আমি করব না।তুই ভীষণ সুন্দরী,ধনীর মেয়ে, আবার পড়াশোনা করে , চাকরী পেয়ে স্বাধীন হবি , নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করবি সেটাও জানি অসম্ভব, তোদের বাড়ী ভীষণ রক্ষণশীল।
তোর বাবা দাদারা ভীষণ জেদী, রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী, সিনেমার মত তোকে নিয়ে পালাব,বা লায়লা মজনু হব,সে অবাস্তব স্বপ্ন দেখার মত আমি মূর্খ নই ।আমার দুটো বোন, বাবা অসুস্থ, মা টেলারিং চালিয়ে আর এমব্রোডারি কাজ করে সংসার চালায়। আমাকে প্রাইভেট টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ করতে হয়। আমি আজ আর স্বপ্নে ভাসি না।কঠোর বাস্তব দুনিয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি।"
"তুই তো বেশ আমাকে ভুলে থাকবি।আমি কেন তোকে ভুলতে পারছি না!"
"আর দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার আসলে এখন আর প্রেম আসে না, ভবিষ্যত নিয়েই দুশ্চিন্তায় পাগল ।"
"তবে তুই কেন আগে আমাকে নিয়ে এত ভাবতিস! আমার ছবি এঁকে লুকিয়ে দেখাতিস, কবিতায় কত কল্পনা করে আমার রূপ সৌন্দর্য অন্তরের কথা ছন্দ মিলিয়ে লিখে দেখাতিস!"
"তখন বাবা ভালো আয় করত। রোড কনট্রাকটার ছিল, অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ ছিল। বাবার কিডনির বড় অপারেশন হল,অনেক টাকা খরচ হল,বাড়িটা আজও তোর বাবার কাছেই বন্ধক আছে।বাবা বেঁচে আছে এটাই, কিন্তু আয় করার ক্ষমতা নেই। আমার পিছনে আজ দাঁড়ানোর মত কেউ নেই,বাবার ভরসা সাহস কী জিনিস আজ আমি বুঝি,বিশ্বাস কর আমার খুব ভয় করে,আমি ভীষণ চাপে আছি।"
সুদীপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,"তোরা মেয়েরা বড় আবেগপ্রবন, বাস্তবটা ভাবিস না,আমি আজ আর সেই আগের সুদীপ নেই। প্রেম দুরে থাক রাতে ঘুম আসে না।একটা কাজ না পেলে কী হবে জানি না।দুটো বোন,বড় হচ্ছে, জানিস তো সব !"
সুদীপের চোখে জল একটু চুপ থেকে নিজের আবেগ আর ধরে রাখতে পারে না বিমর্ষ মনে বলে,
"তোর বিয়ে হবে, বিশ্বাস কর আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তোকে আর গ্রামে তেমন দেখতে পাবো না। অনেকটাই নিয়মে থাকবি, এমন স্বাধীন থাকবি না। তুই তখন পর পুরুষের সম্পত্তি। তোর প্রতি ভালোবাসা কেন তখন তাকানোও অপরাধ,কিন্তু তোকে দেখলেই মনটা কেমন যেন করে, এখনও তোকে ভীষণ ভালোলাগে মনেহয় --"
সুদীপ চুপ করে গেল, দুচোখ জলে ভরে গেছে,গলার স্বর কেমন আর্দ্র, কথা আটকে গেল।দু ঠোঁট চেপে যেন আপ্রাণ কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
মল্লিকা সুদীপকে দেখে বিচলিত,ভাবে সুদীপ আজও তাকে কী ভীষণ চায়, ভালোবাসে! বুঝতে পারে, বরং তার ধারনাটাই ভুল, যে সুদীপ আজ তাকে ভুলে গেছে কেমন উদাসীন। হয়ত সে পরিস্থিতির শিকার, তাই এখন নিজেকে দুরে রাখে। অন্তরের কষ্ট বাইরে থেকে কজন মানুষ বোঝে!মল্লিকা সুদীপের দিকে তাকিয়ে ছিল কেমন হতাশাভরা অতৃপ্ত মনে।তার চোখের জল ।
ক্লাসে সুদীপ ফাস্ট বয় ছিল, সেকেন্ড বয় সাথে অনেক নম্বর তফাত থাকত। সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যাদবপুর শিবপুরে চান্স পেয়েছিল, জয়েন্টে ভালো ফল করে। ঠিক তখন ওর বাবার খুব বাড়াবাড়ি।আর্থিক দুর্দশার কারনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন ছেড়ে, বাড়ি থেকে যাতায়াত করা সম্ভব তাই বর্ধমানের কলেজে ভর্তি হয়।তার পর সুদীপ কেমন হয়ে গেছে,কঠিন জগতটা সে চিনে গেছে। পড়াশোনা ছাড়াও আবৃত্তি, যোগাসন খেলাধুলা সবেতেই তাকে স্কুলে শিক্ষক ছাত্র ছাত্রী এক ডাকে চিনত। সবার প্রিয় ছিল,দেখতেও ছিল খুবই সুন্দর।
সুদীপ যদিও জাতে ব্রাহ্মণ, মল্লিকার বনিক ঘরের মস্ত ধনীর কন্যা আর রীতিমত সুন্দরী,একই ক্লাসে মল্লিকা সুদীপ, গ্রামের কো এডুকেশন স্কুলে পড়ত। প্রেমে সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই তারা পরস্পর হাবুডুবু। জাতপাত বা আর্থিক বৈষম্য এত সব জানার বয়স তাদের ছিল না।আর ধনী না হোক সুদীপের বাবা রোড কনট্রাকটার হিসাবে তার ভালো উপার্জন ছিল। আজ সব ইতিহাস।
তার মা এককালে কত সখ আল্লাদ করেছে, কত বেড়ানোর ছবি,পাহাড় সাগর ,জঙ্গল,তীর্থ মন্দিরের ফটোগুলো আজও অ্যালবামে রাখা।আর আজ তার মা! বাইরের দিকে গ্রামের রাস্তা সংলগ্ন দরজার ঘরটাতে টেলারিং চালায়। কত রাত অবধি, চোখে চশমা,সূক্ষ কাজ করতে দেখতে মনে হয় কষ্ট হয়।তবু ছেলেকে বলে।পড়াশোনাটা কর। প্রাইভেট টিউশন দুচারটে করলেও তার আপত্তি। সুদীপ গোপনে টিউশন করে গ্রামে নয় বর্ধমানে, মা জানে না।
সুদীপ খুব মেধাবী তাই অসুস্থ বাবা আর অসহায় গরীব মা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে।দুটো বোন তার চেয়ে তিন আর ছয় বছরের ছোট, ওদের কথাও সুদীপকে ভাবতে হয়।তাই তার ব্যক্তিগত জীবনের কৈশোর প্রেম ভালোবাসা এখন সব অবান্তর অলীক মনে হয়।এই বয়সেই মেধাবী সুদীপ বাস্তব জগতটা চিনেছিল আর মা বাবা সংসারের প্রতি দ্বায়িত্ববোধটা ব্যক্তিগত তার সুখ আনন্দের চেয়েও বেশী গুরুত্ব পেতো। বাবা মা যে তাকে অবলম্বন করে কত স্বপ্ন দেখে! বোনেদের ভরসা সে অস্বীকার করবে কী করে!
মল্লিকা দেখলেই তার খুব কষ্ট হয়,সাত আট বছরের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। যেটা তারা ছাড়া এতটা ঘনিষ্ঠতা কেউ জানত না।দুজনেই যেন দুজনকে চোখে হারাত। মল্লিকার নরম দুটো হাত নিজের দুহাতে বন্দী করে কতদিন সুদীপ বসে থাকত নির্জনতায় কোন ঘন আড়ালে,মল্লিকার চোখ বুজে আসত,এক আবেগ আর আনন্দ অনুভূতি তার পরিতৃপ্ত মুখে ফুটে উঠত।জীবন ভর যেন এ চার হাত মল্লিকা এক দেখতে চাইত।
সুদীপ এর বাইরে কোন দুষ্টমী করত না।বরং মল্লিকা সুদীপকে আদর করে কবার আলত চুমু দিয়েছিল। তাকে ঘিরে অসাধারণ কটা কবিতা সুদীপ লিখেছিল।মৌখিক শুধু তারিফ করে মল্লিকার যেন মন ভরেনি।আদরে আবেগে সুদীপকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে আলত চুমু খেয়ে খুশী প্রকাশ করেছিল। সুদীপের মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে ওঠে।আনন্দে হৃদয় তোলপাড় করে আবার মল্লিকার সাধনায় কবিতা লিখতে প্রেরণা পায়।এত বড় পুরষ্কার যেন আর জগতে নেই সুদীপের মনে হত !
মল্লিকা আজও ভীষণ চায়,সুদীপকে নিয়ে সে ঘর করতে চায় সারাটা জীবন। সুদীপের সাথে তার দীর্ঘ সাত আট বছরের ঘনিষ্ঠতা। সুদীপের শান্ত স্বভাব, বিনম্র মানসিকতা তার জানা। নিজের ইচ্ছা চাহিদা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয় না। ক্লাসের ফাস্ট বয়, সেকেন্ড বয়ের চেয়েও অনেক নম্বর তফাত থাকত। তবু ভীষণ বিনয়ী, নিজের মেধা বুদ্ধির বরাং করত না।ক্লাসের সবচেয়ে কম মেধা ফেলে হ্যাট্রিক করা যে ছেলেটি, তার সাথেও খুব আন্তরিক।মুখে সদাই হাসি, কখনও মারামারি বা মুখে কুকথা বলত না।ভীষণ দ্বায়িত্ববোধ, কত তাকে পড়াশোনার বিষয়েও সাহায্য করেছে।
সুস্বাস্থের অধিকারী, সৌখিন,পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অল্পে সন্তুষ্ট। কখনও ক্লাসে কারও সাথে ঝগড়া করত না ।
ক্লাসের অন্য মেয়েদের সাথে অভব্য ব্যবহার করত না, কুদৃষ্টিতে তাকাত না।মল্লিকা বরং তার দিকে তাকাত, যেচে কথা বলত, প্রেম আর তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক যেন মল্লিকার তরফেই বেশী বেশী সক্রিয়তা ছিল। তবে ,মল্লিকাকেও সুদীপ খুব ভালোবাসে, সম্মান দেয়।খুব লাজুক স্বভাবের জন্য একটু সে হয়ত দুরত্ব রাখত।
মেধাবী সুদীপ, মল্লিকাকে নিয়ে কত কবিতা লিখত, মল্লিকাকে সব পড়তে দিত, ছন্ম নাম মল্লিকা কখনও তিলোত্তমা,কখনও রূপবতী কন্যা, কখনও ঊর্বসী, শকুন্তলা বা রাধা ! তার রূপ,নরম হৃদয় আর প্রেম ভালোবাসার বর্ননায় ফুটিয়ে তুলত।তখন সুদীপ নাইন টেনে পড়ে। কিশোর বয়সে সুদীপের কাব্য প্রতিভায় মল্লিকা মুগ্ধ হত, কিন্তু শ্রোতা তো একজনই ! তাতেই সুদীপ উৎসাহ পেতো, মল্লিকার ভালো লাগলেই তার যেন সব শ্রম সার্থক।
মল্লিকার একবার শরীর খারাপ হয়েছিল,কদিন স্কুল যায়নি।সুদীপের মনটা অস্থির হয়েছিল।খবর নিতে পড়াশোনার বাহানায় লাজুক সুদীপ তাদের বাড়ী চলে যায়। অনেকক্ষণ কথা বলে।মল্লিকার মা তাকে স্নেহ করে। পাড়া প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ পরিবারের ভদ্র ছেলে, মেয়ের সহপাঠী মেধাবী ,তাই যত্ন করে ঘরে সুদীপকে ডেকেছিল। তখন সুদীপদের অবস্থা সচ্ছল। বাবা রোড কনট্রাকটার আয় ভালো ছিল ,মোটর সাইকেল ছিল। পাকা বাড়ী তৈরী সবে তখন হয়েছে।তার বাবার বেড়ানোর বড় সখ ছিল।অনেক টাকা এ জন্য তার প্রতি বছর খরচ হত,সৌখিন সচ্ছল মানুষ সঞ্চয়ে মন ছিল না ।মল্লিকারা রীতিমত গ্রামে সেরা ধনী, অনেক চাষ জমি,গোলদারী দোকান,আবার এম আর ডিলার, ট্রাক ট্রাক্টর ভাড়া খাটিয়ে অনেক আয়।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালি নেতা।
মল্লিকা ধনী বাবার আদুরে কন্যা। কিন্তু বাবা দাম্ভিক আর মেজাজী। পুত্র দুটো পাটির মস্তান।মারধর ভীতি প্রদর্শন এসবে ওস্তাদ। গ্রামের মানুষ তাদের একহাত মেপে চলত।
সুদীপ তাকে কিছুদিন আগেই বলে দিয়েছে আমার ভবিষ্যত অনিশ্চিত,বড় কঠিন, আমার কথা ছাড়। নিজের মত চল। তোর বাবা দাদারা আমার জন্য তুই এখন বিয়ে করবি না এসব জানলে আমাদের বিপদ হতে পারে। বাড়িটা তোর বাবা কাছে বন্ধক আছে। দোহাই তোকে, আমাকে ভুলে যা। বাবার সম্বন্ধ করা পাত্রকে বিয়ে কর। বাধ্য হয়ে মল্লিকা এ বিয়ে মেনে নিয়েছিল।
তার মনে জুড়ে এখনও সুদীপ,সেটা মাকেও কোনদিন বলেনি। যদি তাতে সুদীপের কোন ক্ষতি হয়!এমনিতেই তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাড়া মহলে গুঞ্জন ছিল, মেয়ের মা হিসাবে মল্লিকার মায়ের এটা মোটেও পছন্দ ছিল না।সুদীপ বামুন ঘরের ছেলে ভালো,দেখতে ও স্বভাবে ভালো, কিন্তু এখন দীন দরিদ্র দশা, দুটো বোন, আর অসুস্থ বাবা,মা টেলারিং চালায়।ছি ছি এমন ঘরে এত বড়লোক ধনী আভিজাত্য ঘরের মেয়ের প্রেম মানা অসম্ভব।
ছেলেটা পড়াশোনা করে, মেয়ের বয়সী, চাকরি না পেলে খাবে কী! আর তারা ব্রাহ্মণ না হতে পারে, গন্ধ বনিক সম্প্রদায়ের বাইরে ছেলে বা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার তারা চরম বিরোধী। নিজের জাতি গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাইরে তারা আত্মীয়তা কুটুম্ব করে না। কানা ঘুষো শুনেছে মেয়ে নাকি শহরে সুদীপের সাথে মেলামেশা করে, কত গল্প করে একসাথে হোটেল রেস্টুরেন্টে খায়।যত না তার চেয়েও মানুষ তিল কে তাল করে।মল্লিকার নামে পাড়ার কিছু চাটুকদার ধনী মানুষের কাঙ্গাল লাগাতার মল্লিকা আর সুদীপের নামে মল্লিকার মায়ের কান ভারী করত।
বাড়িতে তাই সিদ্ধান্ত নেয়, আর পড়াশোনা দরকার নেই, বিয়ে দিয়ে দেবো,পরে বর ইচ্ছা করলে পড়াবে।পাল্টি ঘরে একটু দুরে বাড়ি, ভালো পাত্র পেয়েছিল। কলকাতায় কর্মস্থলে ছেলে থাকে,নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে, এক রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যাঙ্ক অফিসার। চাপা রং, উচ্চতা কম, আর বয়স একটু মেয়ের তুলনায় বেশী।মল্লিকার তখন উনিশ কুড়ি পাত্র ত্রিশ একত্রিশ।
মল্লিকা কিছুই করার ছিল না। ইদানিং যে কোন কারনে হোক, পরিস্থিতির চাপে সুদীপ যখন আর তার সাথে সম্পর্ক চায় না।এড়িয়ে যাওয়ার সব সময়ই চেষ্টা করে।
কী লাভ! অশান্তি আর জল ঘোলা করে! সুদীপকে পাওয়ার জন্য মা বাবার কাছে মল্লিকা আবার জেদ জোর করবে সেটাই বা কীসের জোরে! মল্লিকা কিন্তু সুদীপের জন্য অপেক্ষা করতে রাজী ছিল,আরও ক বছর। যদি সুদীপ তাকে ভরসা দিত।
সে এম এ পড়ত,বি এড পড়ত। সেও মাষ্টারীর চেষ্টা করত।এখন আর তার এসব কথা বাড়ির মানুষ ভরসা করে না। বিয়ে দিয়ে ফ্যামিলির বদনাম বন্ধ করতে চায়,সুদীপের রূপে মোহগ্রস্থ মেয়েকে যেন ভবিষ্যতে দারিদ্র্যতায় ভুগতে না হয়। সুগার্জেন হিসাবে তাদের একটা দায় আছে। মল্লিকা দাদারা ক্ষমতাসীন দলের মস্তান। গ্রামের মানুষ তাদের ভয় করে।শান্ত নিরীহ সুদীপ তার দাদাদের এড়িয়ে চলে।এই বেকার যুগে মেধাবীরাও যে চাকরী পাবেই ভরসা নেই। তবে মল্লিকা একশ শতাংশ নিশ্চিত , সুদীপের যা মেধা ভালো চাকরী সে পাবেই। হয়ত কবছর আরও অপেক্ষা করতে হবে।
খানিকক্ষন দুজনেই চুপ ছিল, মল্লিকা আজ সুদীপকে মটন কষা বিরিয়ানি খাওয়াল, সুদীপ খেতে চাইছিল না। মল্লিকা তাকে হাতে ধরে অনুরোধ করে বলল,
"তোকে কেন! কোন বন্ধবীকেও বিয়েতে কার্ড করব না,এ বিয়ে আমি চাইছি না। তোদের বাড়ীতে আমার বিয়ের নিয়ন্ত্রণের কার্ড হয়ত বাবা প্রতিবেশী হিসাবে করবে ।তুই আমার বিয়েতে আসবি না জানি। আমিও চাই না তুই আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আয়। এটাই ভাব না! আমার বিয়ের ভোজ তোকে আগাম খাওয়াচ্ছি।তোকে তো পেলাম না , এই টুকু আমার শেষ অনুরোধ রাখ। তারপর মল্লিকার দুচোখ জলে ভরে যায়,বাক রুদ্ধ হয়ে মুখ নামিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
সুদীপ বলে,"গরীব ছেলেদের ভালোবাসতে নেই,তাতে কষ্ট বাড়ে,ভবিষ্যত নষ্ট হয়।লাভ কিছু হয় না।আবেগ ইমোশনাল খুব খারাপ,কেবল দুঃখ দেয়,ক্ষতিই হয়। পেপারে কত পড়ি,অনেক মেয়েও আবেগে বাবা মা বাড়ি ঘর,জাত কুল,ধর্ম সব ছাড়ে। ভালোবাসার ইমোশনাল মনের জন্যে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, যাদের মধ্যে বেশীরভাগ ভবিষ্যতে কাঁদে,কেউ প্রকাশ্য কেউ বা গোপনে। "
"আমি তোকে ভালোবেসে কিন্তু কোন ভুল করিনি সুদীপ। তুই এত মেধাবী, ঠিক কাজ পাবি, আমি অপেক্ষা করব, আমি বাবাকে ঠিক বোঝাব। যার সাথে আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে ব্যাঙ্ক অফিসার, কিন্তু আমার চেয়েও দশ বারো বছরের বড়,দেখতে তোর কাছে কিছুই নয়,আর তোর মত এমন মন কজনের হয়!তোকে পেলে জীবন ভর আমি কত স্বাধীনভাবে সুখে থাকতে পারতাম,কেউ বুঝতে চায় না। তুইও আমায় গাছে তুলে মই কেড়ে নিল। এত স্বপ্ন দেখালি কেন!তোর প্রতি আমার ভীষণ রাগ হয়।এ বিয়েতে আমি সুখ পাবো না বিশ্বাস কর!"
সুদীপ মাথা নিচু করে বিষন্ন মনে দাঁড়িয়েছিল কোন উত্তর দেওয়ার মত তার মনের পরিস্থিতি ছিল না।শুধু বলল, "আমায় ক্ষমা কর! তোকে দুঃখ দেওয়া আমার কোন অভিপ্রায় নেই,আমি হতভাগা নিরুপায় । তোকে এ জীবনে পেলে আমি কী কম খুশী হতাম!জীবন ধন্য মনে করতাম,যদি আমার অন্তরটা তোকে দেখাতে পারতাম--"সুদীপে গলা আবেগ তাড়িত হয়ে থেমে গেল।
"যে কারণেই হোক ,তুই কেমন আমাকে ছেড়ে সড়ে যাচ্ছিস বেশ কিছুদিন বুঝতে পারছি,খুলে বলছিস না কিছু!কী করব এখনও বল না ! তুই শুধু আমায় কথা দে! বাকীটা আমি বুঝে নেবো।"
মল্লিকার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে এখনও যেন সুদীপের দিকে অপলক চেয়েছিল।
প্লীজ তুই ইমোশনাল হোস না। তোর মনে খুব কষ্ট মানছি,পরে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে!আর তুই এমন করলে আমার--" সুদীপ চুপ করে গেল।
মল্লিকা কৌতুহলী মনে জিজ্ঞেস করে "তোর কী !"
সুদীপ খানিকক্ষন চুপ থাকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে "তোকে বলতে মা নিষেধ করেছিল, প্লীজ আর কাউকে বলবি না ! আমায় কথা দে।"
"বেশ কথা দিচ্ছি এবার বল!"
"তোর দাদা মাকে একরকম হুমকি দিয়েছে, আমি বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত যেন না বাড়াই। মা আমাকে সতর্ক করেছে,তোদের কাছে আমাদের বাড়িটা বন্ধক আছে।বাবা অক্ষম অসুস্থ, দুটো ছোট বোন,আর মা , প্লীজ এমন কিছু তুই করিস না ,আমরা যেন বাস্তুচ্যুত না হই!চরম বিপদে পড়ে আমরা সবাই মারা পড়ব। তুই আমাকে অধম স্বার্থপর যা খুশী ভাব, ইচ্ছা হলে বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষ ভেবে আমার গালে যত খুশী চড় মার!আমি নিরুপায়, তুই ক্ষমা করে দে।"
কেমন কাতর অসহায় দৃষ্টিতে মল্লিকার দিকে সুদীপ তাকিয়ে দুচোখ জলে ভরা ,মুখে কেমন অসহায় অপরাধী ভাব।
মল্লিকা মুখ নামল, খানিকক্ষন নীরব থাকে পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
"আমি মরে গেলেও তোর বা তোদের বাড়ির কোন বিপদের কারণ হবো না, তুই বিশ্বাস রাখতে পারিস।"
সন্ধে ছ টা বেজে গেছিল, ছটা দশের বাসটা তারা চাপবে, বিরিয়ানির দোকান থেকে বাস ধরার জন্য তখন ফিরছে,শীতের সময় অন্ধকার নেমেছিল বাসস্ট্যান্ডের কটা দুরে নিয়নের হালকা আলো,দুটো বাসের আড়ালে একটু যেন আলো আধাঁরে হঠাৎই মল্লিকা ,সুদীপে সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল, দুচোখ জলে ভর্তি,মন যেন আজ তার বশ মানে না। অস্থির আর চঞ্চলতায় দিশেহারা,সুদীপকে ছাড়তে তার মন চাইছিল না। আবেগ অবরুদ্ধ গলায় বলে,
"এটাই কী আমাদের শেষ বারের মত কাছাকাছি আসা!"
সুদীপের চোখেও জল,মল্লিকা তার মুখের দিকে এক পলকে তাকিয়ে কেমন হতাশভরা অসহায় মুখ!
"মল্লিকা তুই ভুলে যা আমাকে, কেন অকারণ নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস! "
মল্লিকা বলে "তবে আমাদের ভালোবাসা কী মিথ্যা!"
"আমি কিন্তু তা বলি নেই,আমাদের ভালোবাসার মধ্যে কোন মিথ্যা বা প্রতারণা নেই।আমাদের ভালোবাসা সেই বাল্য থেকে,তোকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখতাম। তারপর বাবা অসুস্থ হল, অসুখের চিকিৎসার করে আজ আমরা নিঃস্ব, তখনই বাস্তবটা চিনে গেছি।মন থেকেই প্রেম হারিয়ে গেছে।আত্মীয়স্বজন, বাবার বন্ধু বান্ধব সব কেমন মুখোশ ধারী, কেউ সেই বিপদের দিনে আসে নি।কেবল শুকনো সহানুভূতি আর সব লেকচার দিল। দারিদ্র্যতার জ্বালায় আমি আজ দিশেহারা,মায়ের করুন অসহায় মুখটা সব সময় যেন চোখে ভাসে ।"
সুদীপকে মনমরা বিষন্ন দেখাচ্ছিল ,দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"আজ আমি আর তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি না, মনটাই তো মরে গেছে, কবিতা লিখি না, ছবিও আঁকি না। সব ইতিহাস, তুইও এবার আমার জীবনে ইতিহাস হয়ে যাবি -- " বলতে বলতে সুদীপের কেমন গলারুদ্ধ হয়ে আসে, দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব কাঁদতে লাগল।
মল্লিকা সুদীপকে সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা পায় না, সুদীপের দু হাত চেপে ধরে সেও খুব কাঁদছিল।
মল্লিকা ভাবছিল,সে তো কোন ভুল করেনি! কেন তাকে আরও কবছর সময় দেওয়া হল না!তার কেন নিজের ভাগ্য নিজের গড়া বা সঙ্গী পছন্দ করার পূর্ণ অধিকার থাকবে না!এটাই কী সভ্য আধুনিক সমাজ!একটা পুতুলের মত এক প্রতিষ্ঠিত মানুষের বৌ হয়ে থাকতে হবে বাকী জীবন!দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত তার পছন্দের পুরুষের সৌন্দর্য ,সহিষ্ণু হৃদয় ,অকৃত্রিম ভালোবাসা উপভোগ করার কেন অধিকার থাকবে না! এটাই কী তার ব্যক্তি স্বাধীনতা!
আজ যেন মল্লিকা জীবন যুদ্ধের দাবা খেলায় তার বিপক্ষের দেওয়া শেষ চালে কিস্তি মাতের ঠিক যেন পূর্ব অবস্থায় !তার যে শেষের ঘুঁটিটাও বন্দী! হোক না সে তার বিচারে মন্ত্রি! কিন্তু পরিস্থিতির কঠিন চাপে যেন আজ সে নিজক দুর্বল বোরে!শেষটা তাকে সঙ্গ দিল না। আত্মসমর্পণ করল, পরাজয়ের কান্না ছাড়া তার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

