বিপরীতার্থক
বিপরীতার্থক


সুন্দর ফুলের মতো সাজানো গ্রাম। গ্রামের জমিদারও খুব প্রজাদরদী। কিন্তু তার বয়স হয়ে গেছে। এখন তার পক্ষে গ্রাম চালানো খুব সমস্যা। তারপর কে জমিদার হবে সেটা নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। সেরকম যোগ্য লোক পাওয়া মুশকিল। হিসাবে তার পরিবারের কেউ হওয়া উচিত। কিন্তু তার ছেলে যে রকম চরিত্রের অধিকারী তাতে তার জায়গায় খাপ খায় না। তবু কিছু করার নেই। হয়তো গদিতে বসেই শাসনের নামে শোষণ শুরু করে দেবে।
গ্রামের পাঠশালার পন্ডিত রামচরণ শর্মা। সকলের শ্রদ্ধা করে তার জ্ঞানের জন্য। এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় গ্রামের কয়েকজন তার কাছে এসেছে। তিনি নিজেও এর সমাধান বুঝতে পারছেন না তো বাকি সবাইকে কি বলবেন। হিসাব মত ঠিকই আছে। জমিদারের পর তার ছেলে জমিদার হবে। এতে বাধা দেবার জায়গা নেই। আর সে কেমন হবে তা তো আগে থেকে বলা যায় না। পরে তো ভালো শাসকও হতে পারে। তাই তিনি সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে বললেন। সকলে ফিরে গেল যার যার বাড়িতে। চিন্তিত ভাবে বসে রইলেন পন্ডিতমশাই। এই সমস্যার সমাধান তো তার কাছে নেই। তিনিও গ্রামের একজন সাধারনপ্রজা। জমিদার সবার উপরে। আর আগে থেকে কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। যদি সাত তাড়াতাড়ি হয় তবে পরে দেখা যাবে।
পাঠশালার শিক্ষার্থীরা অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে। পরে আসা গ্রামের অধিবাসীরাও চলে গেছে। বেলা প্রায় ডুবতে চলেছে। পন্ডিতমশাই পাঠশালার দরজা টেনে দিয়ে বেরোলেন সেখান থেকে। অনেকটা পথ হেঁটে গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হবে তাকে। এখন বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলেও তিনি সোজা বাড়ি চলে যাবেন না। যেতে যেতে গ্রামের মানুষের সুবিধা অসুবিধা জানতে জানতে যাবেন। আবার সেগুলোর সমাধান কিভাবে করা যায় তার চেষ্টা করবেন।
গ্রামের মানুষের প্রচুর অসুবিধা। কিন্তু সমাধানের পথ কম। জমিদার ভালো বলে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু সেই জমিদারের জায়গায় তার ছেলে যদি জমিদার হয় তাহলে তো সে পথও বন্ধ হয়ে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে সবার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন পণ্ডিতমশাই।
কয়েকদিনের মধ্যে যে আশঙ্কা পন্ডিতমশাই আর গ্রামের অনেকেই করছিলেন সেটাই সত্যি হলো। জমিদারের ছেলে জোর করেই তার বাবাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই জমিদার হয়ে বসেছে। গ্রামের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েছে সে। প্রথমেই সে জমিদারকে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। তার ডানা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। সেটা করেছে তার নিজের অযোগ্য ছেলে।
এখন চলছে তার ছেলের সব আদেশ। সেটা ন
্যায় না অন্যায় তা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। যা তার নিজের মনে হচ্ছে সেটাই সবার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এই আশঙ্কায় সবাই করছিল।
পন্ডিতমশাইও পাঠশালায় যাবার পথে এই খবর শুনলেন। তারা আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো। এখন কি হবে? তিনি পাঠশালায় গিয়ে তার পড়ানোর কাজ শুরু করলেন। এই চিন্তায় তো নিজের কাজ বন্ধ রাখা যায় না। তবে মাথায় ঘুরেফিরে আসে সেই চিন্তা। তার শিক্ষার্থীদের তিনি নীতিবোধের শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু গ্রামের যে প্রধান তাকে নীতিবোধের শিক্ষা কে দেবে?
গ্রামের সকলের উপর তো সবদিক দিয়ে অত্যাচার নেমে এসেছিল এখন নেমে এলো পণ্ডিতমশাইয়ের ওপর। নতুন জমিদার তার দুই লাঠিয়ালকে নিয়ে পাঠশালায় হাজির হল। পন্ডিত মশাই তখন পড়াচ্ছিলেন শিক্ষার্থীদের। বাইরে থেকে লাঠিয়াল হাঁক দিল। পন্ডিতমশাই সাড়া দিতেই লাঠিয়াল সহ জমিদার ভেতরে ঢুকলো।
'পন্ডিতমশাই কাল থেকে পাঠশালা বন্ধ করে দিতে হবে,' জমিদার তার আদেশ চাপিয়ে দিল পন্ডিত মশাইয়ের উপর।
পন্ডিত মশাই কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন মাথা নিচু করে।
'এদেরকে মানুষ করে কি হবে? সবাই তো জমিদারের দাস। আমার অধীনে শ্রম দেবে। তার জন্য পড়াশোনা করার দরকার কি। চুপচাপ যা বলবো তাই করবে। তাহলে পন্ডিত মশাই কাল থেকে আপনার ছুটি।' জমিদার বলল পন্ডিত মশাইকে।
তারপর শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে বলল,' ছেলে পেলের দল কাল থেকে আর এখানে আসবে না। পাঠশালা বন্ধ।'
তারপর পন্ডিত মশাইকে করজোড়ে প্রণাম করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল জমিদার। তার পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেল দুই লাঠিয়াল। জমিদারের হাসি যেন কটাক্ষের সুরে বাঁজছিল পন্ডিতমশাইয়ের কানে। তিনি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সম্বিৎ ফিরে পেলেন এক শিক্ষার্থীর ডাকে।
'পন্ডিত মশাই পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাবে? কিন্তু এটা তো অন্যায়। তার মানে তো মন্দ কাজ, খারাপ কাজ। আমরা পড়াশোনা করব কোথায়? আপনিই তো বলেছেন মন্দ কিছু শুনবে না, মন্দ কথা বলবে না, মন্দ কিছু দেখবে না।' ছোট এক শিক্ষার্থী বলে উঠলো।
নিজের শেখানো কথাগুলো কেমন অযৌক্তিক ঠেকলো পন্ডিতমশাইয়ের কাছে। তার মনে হতে লাগলো তিনি যেন তার শিক্ষার্থীদের বলেন কথাগুলো শেখানো তার ভুল হয়েছিল। আসলে তার শেখানো উচিত ছিল-' ভালো কিছু শুনবে না, ন্যায়ের কথা বলবে না, সুন্দর কিছু দেখবে না।' কিন্তু তিনি তা পারলেন না। কোন কিছু একটা তাকে বাধা দিল।