Santana Saha

Tragedy Fantasy

2  

Santana Saha

Tragedy Fantasy

বিবর্ণ বিকেলের বিদ‍্যুৎ

বিবর্ণ বিকেলের বিদ‍্যুৎ

11 mins
448


রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশটা যেন আজ তার গোটা হৃদয়টা খুলে দিয়েছে। আজ বুঝি সবার জন‍্য তার অবারিত দ্বার। প্রকৃতির এমন উজাড় করা ভালোবাসার দিনেই তো মন চায় এক ছুটে কোথাও বেরিয়ে পড়তে।আজ অনেকদিন পর সুমিত্রার সাথে বেড়াতে বেরিয়ে প্রদীপ্তরও মনে হয় , ভাল দিনেই বেরিয়েছে। তবে ঐ নির্মল আলোকমালার পিছনেই যে বিদ‍্যুতের মত অপেক্ষা করে আছে তার জীবনের না কষা অঙ্ক তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

                 সব টুরিস্ট এসে ওঠার পর ছাড়ল ট্র‍্যাভেলিং কোম্পানীর বাসটা । শুরু করল তার যাত্রা কার্শিয়াং-এর উদ্দেশ‍্যে।প্রদীপ্ত আর সুমিত্রার বয়স হয়েছে।তাই হুড়োহুড়ি থেকে বাঁচতে আগেই এসে উঠেছে বাসে।কিন্তু এ কি! একে একে সব টুরিস্ট ওঠার সময় প্রদীপ্তর চোখ পড়ে একটি মেয়ের উপ‍র।বয়স কুড়ি কি বাইশ হবে। ফেডেড জিন্স, উপরে ক্রশস্টিচের কাজ করা নেভি ব্লু রঙের টপ। লাইট ব্লু সানগ্লাসটা চোখ থেকে তুলে মাথায় গোঁজা। দেখতে বেশ সপ্রতিভ।

                কিন্তু ওকে দেখেই প্রদীপ্তর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ওর পায়ের তলার মাটি সরে যেতে লাগল। প্রদীপ্তর মনে হল এই বড় পৃথিবীতে আর একটুও মাটি অবশিষ্ট নেই তার ছোট দুটি পাকে আশ্রয় দেবার জন‍্য। আরে ও যে নন্দিতা!! বাইশ বছর আগের সেই হারিয়ে যাওয়া নন্দিতা! শুধু বেশভূষাটাই যা অন‍্য।আর সব তো একইরকম।কিন্তু এ কি করে সম্ভব? প্রদীপ্ত ঝটিতি হিসাব কষতে থাকে নন্দিতার বয়স এখন কত হতে পারে...।না কম করে পয়তাল্লিশ তো হবেই। তার নিজেরও তো বয়স কম হল না।গেল ডিসেম্বরেই বাহান্ন পার করেছেন।তাহলে ও কে? প্রদীপ্ত আর কিছু ভাবতে পারছে না...তার মাথা থেকে যেন সব দ্রুত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে...।হঠাৎ সুমিত্রার কথায় হুঁস ফিরল। কি গো, শুনছ না না কি? কখন থেকে বলছি জানালার কাঁচটা দিয়ে দিতে।হুট করে ঠান্ডা লেগে যাবে ,বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে সুমিত্রা। হুম দিচ্ছি বলে দ্রুত কাঁচটা টেনে দেয় প্রদীপ্ত। খেয়াল করে, মেয়েটির সাথে একটি ছেলেও উঠেছে। দেখে মনে হয় মেয়েটির থেকে চার পাঁচ বছরের বেশি বড় হবে না।কিন্তু ওদেরকে দেখে তো স্বামী স্ত্রী মনে হচ্ছে না। তবে কি মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড? হতেই পারে। এইসব সাতপাঁচ ভাবনা মনে আসতে থাকে প্রদীপ্তর। হতাশ হয়ে ভাবে,অথচ বাইশ বছর আগে এই বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড শব্দটার কি মারাত্মক প্রভাবই না ছিল সবার উপর! বিশেষ করে তার বাড়ির লোকের উপর তো বটেই।তাই তো যখন তার মা জানতে পারল তার আর নন্দিতার সম্পর্কের কথা,তখন এমন প্রতিক্রিয়া শুরু করল যেন এমন গর্হিত কাজ পৃথিবীর কোন মানুষেরই শোভা পায় না।

                    প্রদীপ্তর চোখের সামনে ভাসতে থাকে নন্দিতার সাথে কাটানো সেইসব স্বর্ণালী দিনের কথা। প্রদীপ্ত তখন এম.এ পাশ করে নেট পরীক্ষা দিয়ে সবে নতুন একটি কলেজে প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছে। আর নন্দিতাও সেখানে ভর্তি হয় বি.এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী হিসেবে।নন্দিতার ক্লাসে পড়াত প্রদীপ্ত। নন্দিতা ছিল খুব সিরিয়াস ছাত্রী। ক্লাসের পরেও প্রদীপ্তর কাছে অনেক কিছুই ডিসকাস করতে আসত।নন্দিতার সাথে কথা বলার সময় নন্দিতার প্রতি একটা অদ্ভূত আকর্ষণ অনুভব করত প্রদীপ্ত। ওর মধ‍্যে একটা বুদ্ধিদীপ্ততা অথচ সারল‍্য ছিল যেটা প্রদীপ্তকে টানত। উল্টোদিকে নন্দিতাও প্রদীপ্তর সাথে কথা বলতে বলতে ফর্সা,সুদর্শণ,গুণী প্রদীপ্তর প্রতি অনুভব করতে থাকে এক চোরা টান। এইভাবেই কবে যে তাদের ভালোলাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হল তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারেনি।একদিন প্রকাশও পেয়ে গেল পরস্পরের কথায় সেই ভালোবাসা। তারপর থেকে টানা পাঁচবছর চলেছিল তাদের প্রেমপর্ব। কি করে ভুলবে প্রদীপ্ত সেইসব দিনের কথা। মনে হত যেন সোনালী রোদ্দুর মেখে তার মনের পক্ষীরাজ ঘোড়া লাগামছাড়া হয়ে ছুটে চলেছে।এক অদ্ভূত ভালোলাগার আবেশে কিভাবে যে দিন থেকে রাত,রাত থেকে দিনগুলো কেটে যেত ,বুঝতেই পারত না প্রদীপ্ত। প্রতিদিন থাকত কলেজে যাবার , নন্দিতার মুখোমুখি হবার অমোঘ আকর্ষণ। তারপর এদিক সেদিক বেড়ানোও শুরু হল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনের আঙিনা বা গড়ের মাঠে গল্প করে ,বা নন্দনে অথবা শিশিরমঞ্চে সিনেমা বা নাটক দেখে ,কখনও বা শরৎ বোস রোডের নিবিড় সবুজ ঘেরা নিভৃত পার্কে বসে কেটে গেছে কত বিকেল। গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে সম্পর্ক। এর মধ‍্যে প্রদীপ্ত কখনও চেয়েছিল নন্দিতার বাবার কাছে বিয়ের কথা বলতে। কিন্তু নন্দিতা তখন বিয়ে করতে চায়নি। বলেছিল,আমিও এম.এ পড়ব। তারপর স্কুল সার্ভিস কমিশন বা নেট পরীক্ষা দেব।তবে তো তোমার যোগ‍্য হয়ে উঠব। না হলে যদি তোমার বাড়ির লোক আমায় না মেনে নেয়। প্রদীপ্ত সম্মান করত নন্দিতার এই একাগ্ৰতা আর আত্মবিশ্বাসকে। তাই সে আর কিছু বলেনি। তার বাড়িতেও কাউকে কিছু জানায়নি।দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নন্দিতা বি.এ পাশ করে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে।তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়ে ভর্তি হয় এম.এ করার জন‍্য।এম.এ পার্ট ওয়ানও খুব ভাল রেজাল্ট করে উত্তীর্ণ হয়। তারপর এম.এ পার্ট টুর জন‍্য শেষ প্রস্তুতি শুরু হয়। তাকে ক্লাসে বিভিন্ন বিখ‍্যাত লেখকদের জীবনী নিয়ে একটি প্রজেক্ট তৈরী করতে দেওয়া হয়। সে জানত যে, তার প্রিয় প্রদীপ্তর বাড়িতে একটি ছোটখাটো লাইব্রেরী আছে।আর সেখানে আছে অনেক খ‍্যাতনামা লেখকের লেখা বই,তাদের জীবনী।তার প্রজেক্ট জমা দেবার দিন খুব কাছে চলে আসায় সে আর কোন উপায় না দেখে প্রদীপ্তর বাড়ি গিয়ে কিছু বই দেখার ও নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।সেদিন প্রদীপ্তর মা,বাবাও বোন তার মাসির বাড়ি গিয়েছিল এক পুজোর নিমন্ত্রণ উপলক্ষ‍্যে। তাই প্রদীপ্ত নিশ্চিন্ত মনে নন্দিতাকে আসতে বলে।প্রদীপ্তর শরীরটা একটু খারাপ থাকায় সে যায়নি। নন্দিতা এসে প্রদীপ্তর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওদের লাইব্রেরীতে যায়। সেখানে অত বই দেখে সে অবাক হয়ে যায়,আবার খুব খুশিও হয়।তার প্রজেক্টের জন‍্য যে যে বই দরকার সবই সে এখান থেকে পেয়ে যাবে। বই ঘেঁটে দেখতে দেখতে ও বেছে রাখতে অনেকটা সময় চলে যায়। হঠাৎ শুরু হয় প্রবল বেগে বৃষ্টি। আর খুব জোরে জোরে বাজ পড়তে থাকে। নন্দিতা ভয় পেয়ে প্রদীপ্তর কাছে যায়। ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখে অনেক জ্বর গায়ে। গা খুব গরম।সে তাড়াতাড়ি ওর রুমাল ভিজিয়ে প্রদীপ্তকে জলপট্টি দিতে শুরু করে। আস্তে আস্তে গায়ের তাপটা একটু কমে।হঠাৎ প্রদীপ্ত জড়িয়ে ধরে নন্দিতাকে। পাগলের মত চুমু খেতে থাকে।নন্দিতা প্রথমে বাধা দিলেও পরে যেন হারিয়ে যায়।প্রদীপ্ত তার সারা শরীরে এঁকে চলে ভালোবাসার চিহ্ন।বাধভাঙা নদীর মত দুজনেই যেন এক উদ্দামতায় মেতে ওঠে।যখন সম্বিৎ ফিরল দুজনের,তখন বুঝতে পারল বড় ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। নন্দিতাপরনের শাড়ি ঠিকঠাক করে উঠে দাঁড়াল। জানালায় উঁকি মেরে দেখল বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সে যাবার জন‍্য উঠে দাঁড়াতেই দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ।প্রদীপ্তর মা, বাবা ও বোন এসে পড়েছে। নন্দিতা তাড়াতাড়ি প্রদীপ্তর মা , বাবাকে প্রণাম জানিয়ে চলে গেল। প্রদীপ্ত তখন কি বলবে বুঝতে পারছে না।শেষে তার মায়ের উত্তরে বলেছিল, মা ও আমার গার্লফ্রেন্ড নন্দিতা।ওকে আমি ভালোবাসি।

                          ব‍্যস, এই কথা শুনে তার মায়ের মাথায়বজ্রাঘাত হল।তিনি অন্নজল ত‍্যাগ করে বসলেন। কারোর কোন কথাতেই বরফ গলল না। তার এক কথা, ও আমার ছেলে,আমি নিজে দেখে ওর বিয়ে দেব।কোন গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড আমি মানি না। প্রদীপ্ত অনেক চেষ্টা করেছিল তার মাকে বোঝানোর। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। শেষে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। একদিন প্রদীপ্তর হাত ধরে বলল, তোর উপর যদি মা হিসেবে আমার একটুও অধিকার থেকে থাকে, তবে কথা দে আমাকে ফেরাবি না। তুই আমার বান্ধবী কৃষ্ণার মেয়ে সুমিত্রাকে বিয়ে করবি।প্রদীপ্ত হাল্কা স্বরে প্রতিবাদের চেষ্টা করেছিল কিন্তু তার বাবা বলে উঠল, দেখ বাবা, তুই তো জানিসই তোর মা বরাবরই জেদী।এখন তুই যদি না করিস, একটা অনর্থ ঘটে যেতে পারে।তাই আমি তোকে অনুরোধ করছি, তোর মায়ের কথা মেনে নে। যা হয়েছে ভুলে যা। শেষে প্রদীপ্ত ওদের জেদের কাছে নতিস্বীকার করে। পরাজিত সৈনিকের মত নন্দিতাকে সব কথা জানায়। আর কোনও দিনও নন্দিতার সাথে দেখা হয়নি তার। 

                      নন্দিতা তখন লজ্জা,ঘেন্না,রাগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তীব্র আত্মগ্লানির পঙ্কিল স্রোতে সে ডুবে যেতে থাকে। কয়েকমাস পরে সে নিজের শরীরে অনুভব করে নতুন প্রাণের স্পন্দন।তার মা,বাবা একথা জানতে পেরে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। নিঃসহায়,নিঃসম্বল নন্দিতা তখন তার এক দূরসম্পর্কের মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। নিজের প্রতি চরম ধিক্কারে সে বুঝি তখন কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছে। সারাদিন মুখ গুমড়ে পড়ে থাকত। কোনও কথা বলত না। ধীরে ধীরে তার ডেলিভারির দিন চলে এল। সে হাসপাতালে যাবার আগে তার মাসির কাছে একটি ডাইরী রেখে যায়। বলে, মাসি ,বলা তো যায় না, আমি যদি আর না থাকি ,আমার সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে ওকে এই ডাইরীটা দিও। কিন্তু মাসিও বুঝতে পারেনি অভিমানী মেয়েটির গুঢ় অভিপ্রায়। মেয়ের জন্ম দেবার পরই নন্দিতা আত্মঘাতী হয়। শুধু অতটুকু অবলা প্রাণকে মেরে না ফেলে পৃথিবীর আলো দেখাতে চেয়েছিল বলেই মরতে মরতে বেঁচেছিল এতদিন।সন্তানহীন মাসি মেসো নন্দিতাকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করত। তাই তার মৃত‍্যুতে তাঁরা শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। ভারাক্রান্ত মনে নাতনির সব দায়িত্ব গ্ৰহণ করে। 

                        এদিকে নিয়তির কি লিখন! সুমিত্রার সাথে এত বছরের দাম্পত‍্যজীবনেও কোনও সন্তান হয়নি প্রদীপ্তর। তাই সেও ছিল সন্তানসুখবঞ্চিত। তার মাও বংশ রক্ষা হল না বলে আক্ষেপ নিয়েই মারা যান। 

        দেখতে দেখতে জানালার বাইরে পাহাড় আর পাইনের সারির অপরূপ দৃশ‍্য জেগে উঠতে থাকে। ওরা এসে ওদের গেস্ট হাউসে ওঠে। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় প্রদীপ্ত চা খেয়ে রেডি হয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। সুমিত্রা ঘুমোচ্ছে।সে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে যদি মেয়েটির দেখা পাওয়া যায়। মেয়েটিকে দেখার পর থেকে সে এক অচেনা টান অনুভব করছে ওর প্রতি। এক অজানা অস্থিরতায় ভুগছে।তার খালি মনে হচ্ছে কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে ঐ মেয়ের মধ‍্যে। কিছুদূর যাবার পর একটি পাইন গাছের নীচে সে ঐ মেয়ৈটি ও আগের দেখা সেই ছেলেটিকে একসাথে দেখতে পায়। কিন্তু দুজনে একসাথে থাকায় খুব কাছে যেতে আড়ষ্ট বোধ করে। একটু এদিক সেদিক ঘোরার পর ওদের কাছে গিয়ে বলে, আমি আমাদের গেস্টহাউসে যাবার রাস্তাটা হারিয়ে ফেলেছি। একটু দেখাতে পারবে? মেয়েটি বলে, আমরাও তো এখন ফিরব। চলুন একসাথে যাই। একটু পরেই তো আবার বাসে করে কাছাকাছি টুরিস্টস্পটগুলো ঘোরাবে। প্রদীপ্ত বলে, হ‍্যাঁ তাই তো! দেখতে দেখতে কত বেজে গেছে। মেয়েটি প্রদীপ্তর সাথে আস্তে হাঁটছিল বলে ছেলেটি একটু এগিয়ে যায়। প্রদীপ্ত মেয়েটির নাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তার নাম তিয়াশা। মেয়েটিও প্রদীপ্তর নাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, প্রদীপ্ত নাগ। প্রদীপ্ত বলে আজ সন্ধ‍্যেবেলা যদি পারো,সময় করে এসো না একটু আমাদের ঘরে। আমি আর আমার স্ত্রী সুমিত্রা আছে শুধু। বেশ একটু গল্প আড্ডা হবে।তিয়াশা বলল,ঠিক আছে চেষ্টা করব।প্রদীপ্তর রুম নম্বর জেনে গেস্ট হাউসে এসে সে চলে যায়। 

   সারাদিন কার্শিয়াং-এর পাহাড়ি নদী, ঝর্না, বনানী ও আরও অনেক পাহাড়ি শোভার মধ‍্যে থেকে মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। শুধু প্রদীপ্তর মধ‍্যে থেকে থেকে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে লাগল দুটি কথা,মেয়েটি কে? কাঁটার মত খচখচ করতে লাগল প্রশ্নটি। সারাদিনের জার্নিতে সবাই বেশ ক্লান্ত।দুপুরে লাঞ্চ সেরে সবাই একটু রেস্ট নিল। সন্ধ‍্যা হতে তিয়াশা ছেলেটিকে নিয়ে প্রদীপ্তর ঘরে আসে। একথা সেকথায় গল্প বেশ ভালোই জমে উঠল। প্রদীপ্ত আগে থেকেই ওদের জন‍্য চিকেন পকোড়া তৈরী করিয়ে এনেছিল।তার সাথে চা দিয়ে শুরু হল গল্প। প্রদীপ্ত জানতে পারে তিয়াশা ইকনমিক্সে এম.এসসি করছে। আর ছেলেটির নাম অর্ক। ও একই ইউনিভার্সিটিতে জিওগ্ৰাফিতে পি.এইচ.ডি করছে। তাই ভাল বন্ধু। তিয়াশা প্রদীপ্তকে জিজ্ঞাসা করে, আঙ্কেল আপনি কি করেন জানতে পারি কি? প্রদীপ্ত বলে,আঙ্কেল বলছ কেন মা। আমি তো তোমার বাবার মতনই...সঠিক সময়ে সন্তান হলে তো,সে আজ তোমার মতই...। তিয়াশা হঠাৎ কেমন যেন রুড হয়ে যায়। বলে ওঠে, মেয়েরা এখন আর আগের অবস্থায় নেই। মেয়েদের বড় হতে গেলে আর বাবার দরকার হয় না। আমিও বাবা ছাড়াই সুখী। প্রদীপ্ত মনে ব‍্যথা পেলেও কিছু বলল না। তিয়াশাকে নানা কথার ছলে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল,সে তার দিদার কাছে থাকে।কিন্তু

ওর মা বাবার পরিচয় কিছুতেই জানতে পারল না। প্রদীপ্ত তিয়াশার ফোন নম্বরটা চাইল। তিয়াশার নম্বরটা প্রদীপ্ত যখন লিখছিল তখন তিয়াশার চোখ যায় প্রদীপ্তর হাতের আংটিটার দিকে।খুব সুন্দর ডিজাইনে ইংরাজীতে লেখা দুটি লেটার পি ও এন।তিয়াশা প্রদীপ্তকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে ,আংটিটি প্রদীপ্ত ও সুমিত্রার বিয়ের সময় প্রদীপ্তর প্রফেসর কলিগরা সবাই মিলে দিয়েছিল। ওটা প্রদীপ্ত নাগের শর্টফর্ম।তারপর প্রদীপ্ত তিয়াশাকে বলে, তুমি গান জানো মা?তিয়াশা বলে, একটু..। প্রদীপ্তর আবদারে তিয়াশা একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনায়। তার গলায় "সেই ভালো,সেই ভালো, আমারে না হয় না জানো" গানটি শুনতে শুনতে চমকে ওঠে প্রদীপ্ত। একেবারে নন্দিতার গলা যেন বসানো!তার মনে পড়ে যেতে থাকে নন্দিতার গলায় শোনা কত কত গানের কথা। শুনতে শনতে হারিয়ে যেত সে...। তার মন হয়ে উঠত শান্ত,স্নিগ্ধ।আজ এত বছর পর কেন কেন নন্দিতার কথা বারবার মনে পড়ছে..ভাবতে ভাবতে চোখে জল আসে প্রদীপ্তর। তিয়াশা আর অর্ক চলে যায়। 

               রাতে প্রদীপ্তর ঘুম আসে না। মেয়েটা যেন চুম্বকের মত টানছে তাকে। কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। সুমিত্রা বলে, কি হয়েছে?শরীর কি খারাপ লাগছে? প্রদীপ্ত বলে, না এমনি। বলে পাশ ফিরে চুপ করে শুয়ে থাকে। কিন্তু দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। আজ এত বছর পর যেন তার অজানা অতীত হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।প্রদীপ্তর মনে পড়ে যায় নন্দিতার সাথে কাটানো সেই বৃষ্টিভেজা দিনের কথা যা পরে তার কাছে হয়ে উঠেছিল অভিশপ্ত দিন কারণ ঐ দিনের পরই নন্দিতাকে হারায় সে চিরদিনের মত।তার উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত জীবন হয়ে ওঠেঊষর মরুভূমি। হঠাৎ প্রদীপ্তর মনে বিদ‍্যুৎঝলকের মত একটা কথা খেলে যায়। তবে কি তিয়াশা...। উঃ এই রাতটা তার মনে হচ্ছে অনন্ত রাত। সে আর থাকতে পারছে না। মনে মনে ভাবল ভোর হতেই বেরিয়ে যাবে তিয়াশার সাথে দেখা করতে। সারারাত জেগে ভোরের দিকে কখন চোখটা লেগে এসেছিল প্রদীপ্ত বুঝতে পারেনি। যখন চোখ খুলল,দেখল সাড়ে নটা বাজে। সে তড়িঘড়ি পাঞ্জাবীটা গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেল। সুমিত্রার কোন কথার উত্তরে কথা বাড়াল না। 

                             তিয়াশা আর অর্কর ঘরের সামনে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ বাইরে থেকে।সে ত্রস্ত গতিতে ম‍্যানেজারের কাছে যায় কথা বলতে। ম‍্যানেজার তাকে দেখে বলে,আপনিই তো প্রদীপ্ত নাগ। প্রদীপ্ত বলে,হ‍্যাঁ, কেন বলুন তো? তখধ ম‍্যানেজার বলে,ওনাদের খুব জরুরী একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় ওনারা আজ ভোরেই বাড়ি ফিরে গেছে। তবে তিয়াশা ম‍্যাডাম এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলে গেছে। বলে একটি চিঠি প্রদীপ্তকে দেয়। প্রদীপ্ত চিঠিটি খুলে পড়তে থাকে। 

    মিস্টার প্রদীপ্ত নাগ,

                 জানি না আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন না পারেননি।হ‍্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। আমি নন্দিতা সেনের মেয়ে তিয়াশা সেন। কিন্তু কি জানেন তো, আপনার মত ভীরু, কাপুরুষ,স্বার্থপর মানুষকে বাবা বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হয়। তাই আমি শুধু নন্দিতা সেনেরই মেয়ে,আপনার নই। 

                  সেই নন্দিতা সেন যে শুধুমাত্র আমাকে পৃথিবীতে আনার জন‍্য দশমাস বিভীষিকাময় নরকযন্ত্রণা সয়েছে। পরিবার পরিত‍্যাজ‍্য হয়েছে তবু আপনার মত কাপুরুষের কাছে যায়নি। আমায় পৃথিবীর আলো দেখিয়ে নিজে আত্মহত‍্যা করেছে। নিজেকে শেষ করে দেবার আগে মাসি ওরফে আমার দিদার কাছে যে বাক্স রেখে গেছে,তার মধ‍্যে থাকা চিঠি থেকে আমি সব জেনেছি। এও জেনেছি, আপনার হাতের ঐ আংটিটি আমার মায়েরই দেওয়া ছিল। আর ওটার ফুল ফর্ম প্রদীপ্ত নাগ নয়, প্রদীপ্ত নন্দিতা।কারণ ঐরকম একই আরেকটি আংটি আমার মায়েরও ছিল,যেটা ঐ বাক্সে রাখা ছিল। আমি আপনার হাতের ঐ আংটিটা দেখেই চিনতে পারি আপনাকে। কিন্তু বলিনি। কেন জানেন? ঐ যে বললাম আপনি কাপুরুষ।এতটাই যে সত‍্যি কথাটা বলার সৎসাহসও আপনার হল না। আর আপনি জিজ্ঞাসা করছিলেন না, অর্ক কে? অর্ক আমার বয়ফ্রেন্ড এবং আমি ওর সাথে লিভ ইন করি। কারণ আমি কোন পুরুষকেই আর বিশ্বাস করি না। তাই বিয়ে নামক শব্দটারও আমার কাছে কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। আমার দাদুও বছর দুয়েক আগে একটা আ্যক্সিডেন্টে মারা যান।এখন দিদিমা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তবে আপনি কি ভাবছেন আপনি চাইলেই আমি আপনার কাছে ধরা দেব?তাহলে বলি, না মিস্টার প্রদীপ্ত নাগ, আপনি ভুল ভাবছেন। আপনার জন‍্য আমার মা স্বামীসুখ, সন্তানসুখ কোনটাই পায়নি। আপনি তো স্ত্রীসুখ পেয়েছেন কিন্তু সন্তানসুখ আমি আপনাকে কোনভাবেই পেতে দেব না। 


                             ইতি-

           নন্দিতা সেনের মেয়ে তিয়াশা সেন


প্রদীপ্তর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়তে লাগল।তিনি নিজের মনেই বলতে লাগলেন, আমি এসব কিছুই জানতাম না মা। তুই আমায় ছেড়ে যাস না মা। তোর এই কাপুরুষ বাবাকে ক্ষমা করে দে। ফিরে আয় মা। যাস না। বলে পাগলের মত তিয়াশার দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করতে থাকে। কিন্তু প্রত‍্যেক বারই উত্তর আসে," দা নাম্বার ইউ ডায়ালড,ডাজ নট এক্সিসটস"......


           





             


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy