বৃষ্টি ভরা জীবন
বৃষ্টি ভরা জীবন
সকাল থেকে নিম্নচাপের বৃষ্টি একটানা টিপটিপ করে হয়েই চলেছে। এই বৃষ্টি মনকে আনন্দ দেয় না,কেমন যেন একঘেয়ে করে তোলে,একটু আলসেমিরও প্রশ্রয় থাকে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে নটা পর্যন্ত সোহিনীর একটার পর একটা রুটিনমাফিক কাজের চাপ এতটাই থাকে যে তখন এসব অনুভূতি প্রশ্রয় পায় না। সকাল সকাল ছেলে তিতিরকে রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে , মৈনাকের অফিসের টিফিন শেষ করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় তাকে। তারপর তো আবার রান্নায় একটু ত্রুটি হলেই একরাশ বিরক্তি ভরা কথায় জানান দেয় মৈনাক।
মাঝে মাঝে সত্যিই বিতৃষ্ণা জাগে সোহিনীর এই একঘেয়ে জীবনের প্রতি। আজ ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হয়ে গেছে।মৈনাকও একটু আগেই অফিসে বেরিয়ে গেল। আর এই বৃষ্টির টানা টিপটিপ শব্দ যেন তার সেই একঘেয়েমিতে ইন্ধন দিতে লাগল। হঠাৎ নিজের মনেই সে গেয়ে উঠল, "মেরা জীবন কোরা কাগজ,কোরা হি রহে গ্যায়া,জো লিখা থা,জো লিখা থা আসু সঙ্গ বহে গ্যায়া,মেরা জীবন কোরা কাগজ,কোরা হি রহে গ্যায়া।"...
তার মনে পড়ে যেতে থাকে সোহমের সাথে কাটানো সেই বৃষ্টিভেজা দিনের কথা। কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে দুজনে বেরিয়েছিল একটু একান্তে কথা বলবে বলে। সবুজ ঘেরা পার্কে একটু বসতে না বসতেই শুরু হল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সোহিনী দৌড়ে একটা শেডের নীচে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সোহম যেতে দেয়নি। বলেছিল, আজকের দিনটা হোক না একটু অন্যরকম! তারপর দুজনে ভিজেছিল সেই বৃষ্টিতে। "রিমঝিম রিমঝিম, রুমঝুম রুমঝুম,ভিগি ভিগি রুতমে,তুম হাম হাম তুম" গাইতে গাইতে দুজনে প্রেমের ফল্গুধারায় প্লাবিত হয়েছিল। সত্যি কি সুধামাখা ছিল সেসব দিন। সোহমের সাথে কাটানো এমন প্রতিটা মুহুর্ত এখনও শিহরণ জাগায় সোহিনীর প্রাণে। কি রোমান্টিকই না ছিল সেসব দিন! একদিন সোহম বলল,চল আজ টিফিন আনিনি। দুজনে এক জায়গায় খাব। বলে সোহিনীকে টানতে টানতে নিয়ে হাজির সেই শ্যামবাজার। সেখানে খিদে পেটে দুজনে মিলে বেশ খানকতক রুটি আর বিখ্যাত গোলবাড়ির কষা মাংস গোগ্ৰাসে সাবড়ে দিয়েছিল। আরেকবার, সেদিন ছিল সোহিনীর জন্মদিন। সোহিনী তো আশায় আশায় রয়েছে যে আজ বুঝি সোহম তাকে খুব ভাল করে উইশ করবে।ওমা! সোহম ফোন করে নির্বিকারভাবে বলল যে তার শরীর খারাপ। সে কলেজে যাবে না। সোহিনীর জন্মদিনটা বেমালুম ভুলে গেছে দেখে একরাশ অভিমান নিয়ে সোহিনী কলেজে যায় । সেখানে সোহমের এক বন্ধু তাকে বলে প্লেরুমে যেতে। একটু দরকার আছে। প্লেরুমে গিয়ে সোহিনী দেখে সোহম হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। আর সারা প্লেরুম সাজানো অজস্র বেলুনে। টেবিল টেনিস কোর্টের উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজিয়ে লেখা হ্যাপি বার্থডে সোহিনী! বিস্মিত,অভিভূত সোহিনী বলে, তবে যে তুমি বললে,তোমার শরীর খারাপ,আসবে না...। সোহম সোহিনীকে আলতো জড়িয়ে বলে,না বললে কি সারপ্রাইজ হতো? ঐদিন সোহমের কাছ থেকে পাওয়া কুর্তিটা আজও আছে সোহিনীর ওয়ার্ড্রোবে। তবে শুধু বের করে দেখাই হয়,পরা আর হয় না। স্মৃতি বড়ো বেদনার! সোহিনী ভাবে ,আচ্ছা আমার দেওয়া সেই আকাশী নীল টিশার্টটাও কি আছে এখনও সোহমের ওয়ার্ড্রোবে?দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহিনী। কে জানে...।
না আজ আর কিছু ভাল লাগছে না সোহিনীর। কিচ্ছু না। ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিগুলো যেন জোটবদ্ধ হয়ে তার দরজায় কড়া নাড়ছে। সে মুছে ফেলতে চায় সব,কিন্তু পারে কই?সব আরও বেশি করে মনে পড়তে থাকে তার।
এম.কম পড়ার সময় হঠাৎ সোহমের বাবা মারা যান। তিনি যেহেতু স্কুল শিক্ষকের সরকারী চাকরী করতেন,সেই চাকরীটা সোহম পায়। কিন্তু পোস্টিং হয় অনেক দূরে। অন্য জেলা, তাও আবার বেশ গ্ৰাম। সোহিনীর বাবা নিজের একমাত্র মেয়েকে ওখানে বিয়ে দিতে রাজী হননি। তবে সোহম কিন্তু সোহিনীকে বারবার বলেছিল ,সে বদলি হয়ে এদিকে আসার চেষ্টা করবে। সোহিনীর কাছে একটু সময় চেয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। তখনই সোহমের বাবার এক ক্লোজফ্রেন্ড তার ছেলে মৈনাকের সঙ্গে সোহিনীর বিয়ের প্রস্তাব করল। মৈনাক তখন টি.সি.এসে উচ্চপদে চাকুরীরত। সোহমের চেয়ে অনেক বেশি বেতন পায়। তখন সোহিনীর বাবা তার সাথেই মেয়ের বিয়ে দিতে যারপরনাই উদ্যোগী হয়ে উঠলেন।সোহিনীর কোনও কথা কানেই নিলেন না।
যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল। সোহিনী আর সোহমের চলার পথ দুদিকে বেঁকে গেল। তার সাথে ঘটল সোহিনীর সব আশা,আকাঙ্ক্ষা
, স্বপ্নের পরিসমাপ্তি।
মাঝে মাঝে ভাবে সোহিনী,
মৈনাককে বিয়ে করে সে কি পেয়েছে? ভালোবাসা তো নয়ই, সামান্য সম্মানটুকুও পায়নি। সোহিনী চাকরি করুক সেটা তার শাশুড়ি চাইত না। তাই সোহিনী চাকরি করেনি। তাতেও শাশুড়ির মন পায়নি। অথচ সে চাকরি করে না বলে মৈনাকের কাছে অপমানকর কথা শুনতে হয়েছে। মাঝে মাঝে সোহিনী ভাবত, মৈনাক কি কিছুই বোঝে না,না বুঝতে চায় না..। আর এখন তো তিতির এত ছোট। ওর দেখভাল করে কি করে সোহিনী চাকরি করবে তাই ভাবে..। নিজের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা হয় সোহিনীর যখন দেখে,তার সামান্য দোষত্রুটি ধরার লোক এ বাড়িতে কম নেই কিন্তু তার অসুখ হলে ডাক্তার দেখাতে বলার বা বিশ্রাম নিতে বলার কেউ নেই। এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই চোখে জল আসে সোহিনীর। বাইরের বৃষ্টিধারার মত তার দুগাল বেয়ে পড়তে থাকে।
এরপর একমাস কেটে গেছে। আজ তিতিরের স্কুলে ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট আউট। তাই সোহিনী গেছে পেরেন্ট টিচার মিটিং অ্যটেন্ড করে প্রোগ্ৰেস রিপোর্ট আনতে। স্কুলের মেন গেট দিয়ে সোজা ঢুকে ডানদিকের বিল্ডিংয়ে ঢুকতেই সোহিনী দেখে সোহমকে। সোহিনী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ও কে? সোহমই তো? নিজের অজান্তেই অদ্ভূত এক চৌম্বকীয় টানে সোহিনী সোহমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে এতটাই বিহ্বল ছিল যে খেয়ালই করেনি,সোহমও তার দিকে এগিয়ে আসছে। সোহিনীর মুখে কোনও কথা নেই। সেই শুধু জানে,সোহমের প্রতি অবিচারের কি লজ্জা সে এতদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে। সোহম বলে,ভালো আছো? সোহিনীর গলা কেঁপে যায়। সহসা কোনও উত্তর দিতে পারে না। অস্ফুটে বলে,তুমি এখানে? সোহম বলে, দুমাস হল এই স্কুলে বদলি নিয়ে এসেছি। সোহিনী বলে,বড় দেরী করে এলে। সোহম বলে, যত আগে এলে তোমাকে পেতাম,তত আগে যে আসা সম্ভব ছিল না সোহিনী।সোহিনী কিছু বলতে পারে না। কিছুক্ষণ পর বলে, তুমি যে এভাবে বলছ,তোমার স্ত্রী শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে। সোহম হঠাৎ হেসে বলে, স্ত্রী!.. সবার কপালে কি সব হয়? তবে তুমি যে আমাকে ভোলোনি এটাই আমার বাকী জীবনের পাথেয়। সোহিনীর হঠাৎ মনে হল, তার হাত পাগুলো সব শিকলে বাঁধা। সংসারের শিকল। তার ইচ্ছে হচ্ছে এখনই সব সাংসারিক বন্ধনের শিকল দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে সোহমের বুকে গিয়ে আছড়ে পড়ে বলে, আমি আজও শুধু তোমাকেই ভালোবাসি,তোমাকেই পেতে চাই। কিন্তু ঐ শিকলে তার গলা আটকে গেল। সে শুধু বলল, "পুরানো সেই দিনের কথা,সে কি ভোলা যায়?"...