আমার বাংলা ভাষা
আমার বাংলা ভাষা
আমি যখন প্রথম 'মা' কথাটা উচ্চারণ করেছিলাম তখন কিন্ত জানতাম না,কথাটা বাংলা না হিন্দী না ইংরাজী। কথাটা শুনে আমার মায়ের কি অনুভূতি হয়েছিল বুঝিনি। বুঝলাম যখন আমার ছেলে দুমাস বয়সে প্রথম বলে উঠল 'মা'। ওও কিন্তু জানত না তখন সেটা কি ভাষা। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল কথাটা।আর আমি বুঝলাম যে কোন্ অমৃতের স্বাদ পেলাম! এত সুন্দর, সহজ,সাবলীল শব্দ বোধহয় বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় পাওয়া যায় না।
বাংলা তো মিশে আছে আমাদের রক্তে। আমার সুখ, দুঃখ ,আনন্দ, বেদনা, জয় ,পরাজয় সব অভিব্যক্তিতেই তো শুধু বাংলাই মনে পড়ে। কারোর উপর যদি আমি খুব রেগে যাই, তবে আমার তো মনে হয় না বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় তাকে বকে গায়ের ঝাল মেটাতে পারব বলে।
সেই আমিই কি পেরেছি ছেলেকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করতে? পারিনি....। কেন? চারিদিকে দেখছি প্রায় সব বাচ্চাই ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। আমারও মনে তখন সংশয় হয় ,আমার ছেলেটাকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ালে ও কি পারবে প্রতিযোগীতায় টিঁকে থাকতে? পারবে বড় হয়ে সেরকম স্মার্ট হতে? ভাল রোজগার করতে? এই দেখেছেন, ঘুরে ফিরে সেই রোজগারের কথাটাই এসে পড়ল। কারণ আমরা যে যাই মুখে বলি না কেন, সবাই জানি এখনকার সামাজিক প্রেক্ষিতে ভাল রোজগার করাটা কি পরিমাণ দরকার। আমরা সবাই , আমাদের সন্তান বড় হয়ে ভাল মানুষ হোক যেমন চাই, তার সাথে ভাল রোজগার করুক সেটাও চাই। কারণ নিজেই দেখেছি চাকরীর ইন্টারভিউ দেবার পরীক্ষায় ইংরাজী মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েরা এক ধাপ উপরের সারিতে থাকে। টিউশনি করতে গিয়ে দেখেছি ইংরাজী মাধ্যমে পড়া হলে তার কদর ও মাইনে বেশী। কারণ বেশীরভাগই তো ইংরাজী মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রী , তাই। অন্তত আমার এলাকায়। ছেলের স্কুলে দেখেছি ,ওদের স্পোকেন ইংলিশটা যাতে ভাল হয় সেদিকে জোর দেয়। তাই আমাকেও শেখাতে হয় বৈ কী। ওর স্কুলে বাংলাটা এখন সেকেন্ড
ল্যাঙ্গুয়েজ।তা হলেও দেখেছি বাংলাটাও বেশ যত্ন সহকারেই পড়ায়।
আর আমিও কিন্তু ওকে শুধু ইংরাজী পড়তেই উৎসাহ দিই না, বাংলাটাও সুন্দরভাবেই পড়াই। কারণ বুঝি বাংলা না জানলে,বুঝলে ও আমাদের মাতৃভাষার আত্মাটা কিছুতেই অনুভব করবে না।তাই বইমেলা থেকে যেমন ইংরাজী বই কিনে দিই তেমন বাংলাও কিনে দিই। নিজে পড়ে বোঝাই।
আচ্ছা বলুন তো , 'ফেলুদা সমগ্ৰ' তো এখন ইংরাজী অনুবাদও বেরিয়েছে। ফেলুদা সমগ্ৰে যে 'মগজাস্ত্র' কথাটা আছে, তার কি কোন ইংরাজী অনুবাদ করা সম্ভব ? না কি করলে , সেই অনুভূতিটা আসে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চাইলে ইংরাজীতে সাহিত্য রচনা করতে পারতেন না ,তা নয়। কিন্তু তিনি লেখেননি। তিনি তার মূল বাংলা লেখার অনুবাদের জন্যই নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে স্থান করে দিয়ে গেছেন।
আমিও বাংলাতেই লিখি আমার প্রাণের কবিতা। ছেলেকে উৎসাহ দিই বাংলায় কবিতা লিখতে। কারণ আমরা এটুকু উদ্যোগ না নিলে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবে না বাংলা ভাষার মর্ম। অনেককে তো দেখেছি বাংলা ভাষার বই পড়তে পর্যন্ত পারে না!
আমার ব্যথা লাগলে 'আঃ' বলেই চিৎকার করে উঠি। কারও কষ্ট হলে 'আহা রে' বলেই সান্ত্বনা দিই, পছন্দের ক্রিকেটার ছয় মারতে না পারলে 'ইসস্' বলেই আফসোস করি।
এই দেখেছেন তো বাংলায় এই প্রবন্ধটা লেখার জন্যও মনটা কেমন আনচান করছিল......