বিভ্রম
বিভ্রম
তানিশা মোবাইল দেখতে দেখতে তাদের লাল ওয়াগনারটা দেখে ফোনের দিকে তাকিয়েই উঠে পড়ে।
হঠাৎ খেয়াল হয় গাড়ি চিংড়িঘাটার দিকে যাচ্ছে লেকটাউনের বদলে। আরে যে গাড়ি চালাচ্ছে সে ফুলকাকা নয় তো, অন্য কেউ।"গাড়ি থামান,গাড়ি থামান"
-তানিশা চিৎকার করতে থাকে। চাপদাড়ি সুবেশ যুবক পেছন ঘুরে বলে-"একি আপনি কে? আপনাকে তো আমার আনার কথা ছিল না, আপনি কখন চড়লেন আমার গাড়িতে। এখানে গাড়ি থামানো যাবে না, সামনে এগিয়ে দাঁড় করাচ্ছি নেমে যান।"-"নেমে তো যাবই, যার তার গাড়িতে বসে থাকব নাকি?"- তানিশা ফুঁসতে থাকে।
"এ তো দেখি উল্টা চোর কোতোয়াল কো ডাঁটে, আপনি যেচে এসে গাড়িতে উঠলেন, এখন আমাকে ধমক লাগাচ্ছেন, আচ্ছা জাঁহাবাজ মেয়ে তো আপনি।"- গম্ভীরভাবে চাপদাড়ি কথা কটা বলেই গাড়ি দাঁড় করায়।
তানিশা গাড়ি থেকে নামতেই ফুলকাকার ফোন আসে-
"কি রে আমি কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্যে, তুই কোথায় চলে গেলি? আমি কি বাড়ি ফিরে যাব?"
"তুমি চিড়িয়া মোড়ে এসো ফুলকা আমি ওখানে দাঁড়াচ্ছি।"- তানিশার উত্তরে ফুলকাকা বলেন-"তুই ওখানে পৌঁছলি কি করে, দাঁড়া আসছি।" এতক্ষণের উল্টোপাল্টা ধকলে তানিশা ঘামছে। ফুল-কার জন্য উদগ্রীবভাবে অপেক্ষা করতে করতে ভাবে এইজন্যই মা সবসময় বলে ঐ ফোনই তোকে খাবে। আজকে প্রায় সেরকমটাই হচ্ছিল, ভাগ্যের জোরে উল্টোপাল্টা কিছু শেষ অব্দি ঘটে নি। ফুল-কা ডাকছে-"তানি আয় তাড়াতাড়ি উঠে আয়"
গাড়িতে ফুল-কা আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি এই রক্ষে।
বাড়ি পৌঁছতেই ঠামি-" তানি তুই আজ কার সঙ্গে গাড়িতে ছিলি, তোর বড়মামা দেখে তোর মাকে ফোন করেছিল।"
দাদুভাইও হাসতে হাসতে ঠিক দোরগোড়ায় হাজির-" কি
দিদিভাই আজ কাকে পাকড়াও করেছিলে, তোমার বায়নার চোটে তোমায় ছেড়ে দিলে বুঝি।"লজ্জা পাওয়ার বদলে তানিশা খেপে যায়-"তোমরা আমার পেছনে স্পাই বসিয়ে রেখেছো বুঝি, মনে রেখো আমি বড় হয়েছি, নিজের ভালমন্দ বোঝার জ্ঞান আমার আছে।" পরিস্থিতি
ঘোরালো হচ্ছে দেখে ফুলকাকা ম্যানেজ করে-" আরে ছাড়ো তো তোমরাও পারো, কে কি দেখল, না দেখল, তানি তো সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই ছিল।" ফুলকার ডাহা মিথ্যেতে তানিশাও একটু অবাক হয়ে খুড়তুতো বোন চিনির ঘরে ঢুকে গেল। এখানে আর চেপে রাখা গেল না,
তানিশার প্রাণের মনের কথা সবই বলে চিনিকে, চিনি বয়সে প্রায় তানিয়ারই বয়সী, সব শুনে চিনি আর মস্করা করতে পারল না। জড়িয়ে ধরে বলল-"তানি আজ তো তোর একটা ঘোর বিপদের ফাঁড়া কাটল।"তানিশার চোখেও জল।
পরদিন তানিশা কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, মা
এসে জানালো-"যাচ্ছ যাও, তবে আজ চিনিকে দেখতে
আসবে, তাড়াতাড়ি ফিরো, হাতে হাতে কাজ সারতে হবে।"
কলেজ যাওয়ার আগে মনটা একটু দমে গেল তানিশার,
এ বাড়িতে চিনির বিদায় ঘন্টা বাজানো হচ্ছে এই ভেবে।
যাহোক, মা জননীর নির্দেশ, অগত্যা তাড়াতাড়িই ফিরল তানিশা। ফিরে দেখে পাত্রপক্ষ হাজির, চিনিকে কি মিষ্টি
লাগছে, আরে উল্টোদিকে বসে থাকা ছেলেটাকে কেমন
চেনা চেনা লাগছে, ওরে বাবা রে, এ তো কালকের চাপদাড়ি, আজ ক্লিন সেভড্ হয়ে এসেছে, তাই প্রথমটা তানিশা বুঝতে পারে নি ঠিকমতো। চাপদাড়ি ওরফে ক্লিন সেভড্ তাকিয়ে আছে তারই দিকে। পরিচয় পর্বে জানা গেল পৃথ্বীরাজের নাম রাতুল, সল্টলেকে আইটি সেক্টরে কাজ করে, যদিও হরণ করেছিল চিনিকে নয় ওকে। যাহোক নতুন জ্যাম্বোর সঙ্গে ওর নিজের একটা মজার স্মৃতি থাকল। রাতুলের মা রাতুলকে স্মরণ করায়-" অ রাতুল, তুই দেখস কারে, ও তো তানিশা, চিনির জ্যাঠার মাইয়া, তুই এই চিনির লগে কথা ক।" মায়ের এ হেন অত্যাচারে বেচারী রাতুল বেকায়দায় পড়ে মুখ নীচু করে।
ও দিক থেকে ঠামি বলতে থাকে-"চিনির আমাদের গুণের সীমা নাই, যেমন লেখাপড়ায় তেমন গানে, গা তো একখানি গান চিনি।" দাদু হঠাৎ বলে ওঠেন-" আমার তানি দিদিভাইও ভাল গায়,ও-ও শোনাবে একখান।"
তানিশা কটমট চোখে দাদুর দিকে তাকায়, রাতুল এই তাকানোটুকু দেখে হেসে ফেলে। পরিবারটা বেশ ভাল মনে হয়, চিনিরও পছন্দ হয় রাতুলকে। শুধু দাদু গুনগুন করে যায়-"যার যেথা মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম।" দীর্ঘ অপেক্ষাতেও যখন রাতুলদের বাড়ির থেকে কোন উত্তর আসে না, তখন ঠামি বলে-" পরিবারটা এত ভালো ছিল, এত আগ্রহ দেখালো তবুও সাড়া দিচ্ছে না কেন?" ফুল-কা বলে-"না দিলে না দেবে, আমাদের চিনি কি ফেলনা।"
এরমধ্যে এক কান্ড হয়, তানিশার সঙ্গে রাতুলের ওদের কলেজ গেটের সামনে দেখা হয়ে যায়। রাতুল বলে-"এই একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।" তানিশা বুঝতে পারে না কার জন্য এখানে রাতুলের অপেক্ষা। এরমধ্যে বন্ধুবান্ধবরা দাঁড়িয়ে যেতে তানিশা আলাপ করিয়ে দেয় রাতুলকে ভাবী জামাইবাবু বলে। যদিও রাতুল তাতে বাধা দিতে চেষ্টা করছিল। তানিশার আপত্তিসত্ত্বেও ওকে কফিশপে নিয়ে যায়, আবার দেখা করার কথা জানায়।
তানির চিনির মুখটা মনে পড়ে যায়, ও রাতুলের মুখের ওপর "না"বলে দেয়। সেদিন তানিশা ঘরে ঢুকতেই ঠামি জানায়-"তানি একটা খারাপ খবর আছে, সল্টলেকের ওরা চিনিকে পাত্রের পছন্দ নয় জানিয়ে দিয়েছে।"
তানিশা একটা অপরাধবোধে ভুগতে থাকে কিন্তু তার যে কি করণীয় সেটাই সে বুঝতে পারে না। কাকে যে তার মনের কথা বলে, চিনিকে এখন বলতে গেলে ও ভুল বুঝবে, নিজের মনে মনেই গুমরে মরে। ফুল-কা কি মনে করে ওর আশেপাশে ঘুরপাক করে। এরপর রাতুলদের বাড়ির থেকে তানিশার জন্য যোগাযোগ করা হয়। চিনির কথা ভেবে তানিশা এককথায় না করে দেয়। তানির না শুনে চিনি ওর ঘরে তানিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে-" আমাকে ঐ দিনই রাতুল জানিয়ে গিয়েছিল যে তোকে ওর পছন্দ, আমাকে নয়, তোর আমাকে নিয়ে ভাববার কিছু নেই, হ্যাঁ করে দে বোকা।" চিনিই সকলকে তানিশার মনের কথা জানিয়ে দেয়। পাত্রী বদলে ভাঙা সম্বন্ধ জোড়া লাগে। হইহই শুরু হয়ে যায় তানিশাদের বাড়িতে।
। শুধু বিয়ের আসরে এসে
তানির বড়মামা বলে-" আরে, এরই নাম রাতুল, এর গাড়িতেই তো আমি তানিকে দেখেছিলাম, আমাকে না বলার কি ছিল।" তানিশা রাতুলের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নীচু করে। তানিশার কলেজের বন্ধুরা বিবাহ বাসরে
এসে রসিয়ে বলে-" কি রে তানিশা সেদিন জামাইবাবু বলে
পরিচয় করালি না, শেষপর্যন্ত তাহলে জামাইবাবুকে বিয়ে
করলি বল।" হাহা হিহি-র মধ্যে মালাবদলটা হয়ে যায়।