Sayandipa সায়নদীপা

Drama

4  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

ভোরের আলো

ভোরের আলো

5 mins
2.8K


তখন বয়েস আমার সাড়ে চার, একটি নামী বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের গন্ডি পের করে প্রাথমিক বিভাগে সবে পদার্পণ করতে চলেছি। শিশু বিভাগের শেষ দিন বাবার সঙ্গে গিয়েছি পরীক্ষার ফলাফল জানতে। “অঙ্কুর” এবং “কিশলয়” এর সমস্ত ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের নিয়ে ভরা শ্রেণী কক্ষ। আর দরজার সামনে উৎকন্ঠিত অভিভাবকদের ভীড়। আমি ভেতরে বসে রয়েছি চুপচাপ। আসলে পরীক্ষা নামক দানবটা রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সক্ষম হয়নি তখনও, কাজেই ফলাফলের দিনও মনটা বিশেষ বিচলিত নয়। শুধু দরজা ঘিরে অভিভাবকদের ওই উপচে পড়া ভিড়ের দিকে তাকালেই মনটা এক দুর্দমনীয় অভিমানে ভরে যাচ্ছিল। আমি জানতাম ওই ভিড়ের মধ্যে আমার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা, বাবা নিশ্চয় স্কুলের সুবিশাল মাঠটার মধ্যে থাকা অসংখ্য বৃক্ষের মধ্যে কোনো একটার বাঁধানো বেদিতে বসে অপেক্ষা করছেন। আমার বাবা ওরকমই।

ফলাফল ঘোষণা হলো। প্রগতী পত্র হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা যখন কেউ কেউ বাঁধন ভাঙা উচ্ছাস কিংবা হয়তো কেউ কেউ একবুক হতাশা নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছেন শ্রেণী কক্ষের ভেতরে তাদের বাচ্চাকে নিতে তখন আমি আমার ছোট্ট শরীরটাকে নিয়ে কোনো মতে ফাঁক গলে বেরিয়ে এলাম মাঠে, আমাকে দেখতে পেয়ে বাবাও এগিয়ে এলেন একটু একটু করে। বাবা কাছে আসতেই আনন্দে বলে উঠলাম, “বাবা দিদিমণি বললেন আমি ফার্স্ট হয়েছি।”

“তাই?” ব্যাস এইটুকু বলেই আমার হাত থেকে প্রগতী পত্রটা নিয়ে এক ঝলক তাকালেন ওটার দিকে, হয়তো বাবার ঠোঁটের কোণে একঝলক হাসিও খেলে গেল কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। আমার বাবা ওরকমই।

“এবার?” শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন বাবা। চরম উচ্ছাসে আমি উত্তর দিলাম, “বাড়ি যাবো তাড়াতাড়ি। সবাইকে বলতে হবে না? মা, দিদিভাই, মামা, মৌমা, মাসো, দাদু…” এমন করে একটা লম্বা তালিকা দিয়ে দিলাম। বাবা আগের মতোই শান্তভাবে বললেন, “তার আগে যে স্কুলে একটা কাজ আছে এখনও।”

“আর কি কাজ?”

বাবা আঙ্গুল তুলে ইশারা করলেন শ্রেণীকক্ষের দিকে, দেখলাম বাইরে দরজার পাশে বসে আছে আমাদের “বড় মাসি”। উচ্চতায় চারফুটের একটু বেশি, গায়ের রং গাঢ় বাদামী, মাথার শনের মতো চুল গুলো ছোটো করে কাটা কিন্তু তাতেই একটা গাডার জড়ানো, গাল গুলো অসম্ভব কুঁচকে গেছে, দাঁতগুলোও আর অক্ষত নেই। সব মিলিয়ে এই ছোটখাট্টো বৃদ্ধাটি কিন্তু তার বয়েসের কারণে আমাদের আদরের “বড় মাসি”। শিশু বিভাগে পড়ার সময় যে আমাদের পটি থেকে বমি অবধি পরিষ্কার করেছে, প্রয়োজনে ধমকেছে, কখনো বা আদর করেছে। বাবা বললেন, “মাসিকে প্রণাম করে তারপর ভেতরে গিয়ে সব দিদিমনিদের প্রণাম করবে।” বরাবরই আমি একটু অন্তর্মুখী, কোনো কাজে সহজে এগিয়ে যেতে পারিনা। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলোনা। বাবা বলার পরও মিনিট খানেক ওখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখতে লাগলাম ফল হাতে পাওয়ার পর খোলামনে আলাপ আলোচনার জন্য শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসা আমার সহপাঠী এবং তাদের অভিভাবকরা আবার ফিরে যেতে শুরু করেছেন কক্ষে। আজ দু বছর ধরে আমাদেরকে প্রতিদিন আগলে রাখা মাসিকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন সবাই, ছোটরা প্রণাম করছে দিদিমনিদের আর বড়রা হ্যান্ডশেক। দেখাদেখি আমিও পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম, প্রণাম করলাম দিদিমনিদের। অনেক আদর পেলাম তাদের থেকে। বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফিরে এলাম বাবার কাছে। আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন বাবা, তারপর বললেন, “যে কাজটা বলেছিলাম সেটা সম্পূর্ণ করে এসো।”

“আমি তো…”

“সবাইকে প্রণাম করেছো?”

“হ্যাঁ।” ঘাড়টা ডানদিকে অনেকটা হেলিয়ে জবাব দিলাম।

“আর মাসিকে?”

“নাহ।” চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।

“যাও করে এসো।” কোনো বকা নেই ঝকা নেই, খুব ধীর গলায় বললেন বাবা কিন্তু সেই বলার মধ্যেও এমন কিছু ছিলো যাকে উপেক্ষা করার সাধ্যি আমার ছিল না। এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম মাসিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ওই ছোট্টখাট্টো শরীরটা কাঁপতে শুরু করেছে, ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখদুটো থেকে নামতে শুরু করেছে শ্রাবনের ধারা। বুকে টেনে নিলেন আমায়, চুমুতে ভরিয়ে দিলেন আমার মুখটা। তারপর পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “অনেক বড় হবি মা, অনেক বড় হবি।”

মাসির ওই কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হলো আমার বুকে গিয়ে, আমার অন্তরে যেন মুহূর্তে খেলে গেল একটা ভোরের আলো। কিছুটা দূরে তাকিয়ে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছেন আমার জীবন সূর্য, আমার বাবা। তখন জানতাম না পরে গ্রাজুয়েশন করতে এসে জেনেছি এই অনুভূতিটাকেই হয়তো বলে “এপিফ্যানি” (epiphany), অকস্মাৎ আত্মোপলব্ধি।

বাবার কাছে ফিরে আসতেই দেখলাম বাবার মুখে এক অনাবিল হাসি, মুখে কিছু না বললেও কোলে তুলে নিলেন আমায়। আমার বাবা এরকমই। মাসির সাথে আর কোনোদিনও দেখা হয়নি কিন্তু আজও যখন কোনো সাফল্য পাই তখন একবারের জন্য হলেও মাসির ওই চোখ দুটো মনে পড়ে, মনে পড়ে মাসির বলা ওই কথাগুলো, “অনেক বড় হবি মা।” সেই সাড়ে চার বছর বয়সের একটা দিনে বাবা যে শিক্ষাটা আমায় দিয়েছিলেন তার সৌজন্যে বারেবারে পেয়েছি অনেক কিছু, অনেক ভালোবাসা, অনেক আশীর্বাদ… যা নিঃসন্দেহে যে কোনো পার্থিব প্রাপ্তির থেকে অনেক বেশি কিছু। আর সেদিন থেকেই মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে আরও একটা কথা, সমাজের লাগানো উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের তকমা দিয়ে বিচার হয়না ভালোবাসার, বিচার হয়না শ্রদ্ধার। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এসব কিছুই অনুভূতির ব্যাপার, মানুষের অতল হৃদয় থেকে যা উঠে আসে, যা এইসব তথাকথিত পার্থিব সামাজিকতার অনেক ঊর্ধ্বে।

একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অফিসার হওয়ার কারণে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্রাঞ্চের দায়িত্বে থাকার ফলে বাবা সময় দিতে পারতেননা কখনোই, যেটুকু সময় হয়তো বাড়িতে থাকতেন সেটুকু সময়ও বন্ধুর মতো কখনো মিশতে দেখিনি বাবাকে। গোনাগুনটি কটা কথা হয়তো বলতাম সারা সপ্তাহে; মনের মধ্যে এরজন্য অভিমান জমতো ভীষণ। তখন ছোটো ছিলাম, বুঝতেই পারিনি এরকম দূরত্ব বজায় রেখেই মানুষটা কেমন করে আমার জীবনটা সাজিয়ে তুলেছেন। আমার বায়না শুনে মেঘলা আকাশের চোখ রাঙানি তুচ্ছ করে জ্বর গায়ে আমাকে রথের মেলা দেখতে নিয়ে গেছেন, বৃষ্টি আসতে আগে আমার গায়ে রেনকোট চাপিয়ে তারপর নিজেকে ঢেকেছেন। পুরীর জনসমুদ্রে দুই বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আমায় কোলে আঁকড়ে ধরে রক্ষা করেছেন। এরকম কতো শত কথা আজ হয়তো বলতে চাইলে শেষ করতে পারবোনা। তখন বুঝিনি এসবের গুরুত্ব, বোকার মত অভিমান করে গেছি শুধু।

এমনিতেই আমি আমার দিদিভাইয়ের থেকে প্রায় নয় বছরের ছোটো, কাজেই বাবার এখন বয়েস হয়েছে অনেকটা, কিছুদিন আগেই বাবার এক জটিল হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভীষন মনে পড়ে ওই সব পুরোনো দিনগুলো। দু দুটো কন্যা সন্তান বলে অনেক কথা শুনতে হয়েছে ওদের, সহ্য করতে হয়েছে অনেক কিছু। তাও কোনোদিনও আমার মা বাবাকে কোনো কার্পণ্য করতে দেখিনি আমাদের জন্য, পড়াশুনো থেকে শুরু করে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কোনটারই অভাব রাখেননি, মুখ ফুটে প্রয়োজনের কথা বলার আগেই সামনে এসে হাজির করে দেন সব। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মে ওই বাবার গলা জড়িয়ে “থ্যাংক ইউ ড্যাড” বলাটা আসেনা, ইচ্ছে হলেও কখনো বলতে পারিনা বাবাকে যে কতটা ভালোবাসি তাঁকে, কতটা শ্রদ্ধা করি তাঁকে। তাই চেষ্টা করে চলেছি এমন কিছু করতে যাতে নিজের কাজের দ্বারা ওনাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু এনে দিতে পারি; ওনাদের এতো স্বার্থ ত্যাগ, এতো পরিশ্রম, ওনাদের শিক্ষার যথাযোগ্য সম্মান যেন দিতে পারি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama