Anjishnu Mukhopadhyay

Abstract Fantasy Inspirational

3  

Anjishnu Mukhopadhyay

Abstract Fantasy Inspirational

ভাঙা কাঁচের জানালা

ভাঙা কাঁচের জানালা

4 mins
254


আমি অনেক বছর কাটালাম এই পৃথিবীতে। অনেক অনেক বছর। দেখলাম শুনলাম অনেক কিছু। আজ না হয় সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলি।


আমাকে জীবন দেয় এক বিশাল জমিদার এর ছেলে আর সেই জমিদার এর খাস বাইজির গোপন সম্পর্ক। বাবার রক্ষিতার প্রেমে পড়ে বাবার বখে যাওয়া বড় ছেলে। সমাজের এবং বাবার নিন্দে সহ্য করেও জমিদারের ছেলে তার প্রেমিকাকে তোলে এক বাগান বাড়িতে। আমি তার সেই লুকানো বাগানবাড়িরই বাসিন্দা। আমি তাদের দুজনের রঙিন ভালোবাসার দূত ছিলাম। আমি ছিলাম তাদের ঘরের রঙিন জানালা। আমার অস্তিত্বে ছিল তাদের জীবনের আনন্দ।

তবে জমিদারের ছেলে পরে অবশ্য নিজের বাবার ভালো ছেলে হয়ে ওঠে।সে তার প্রতিজ্ঞা রাখেনি, আমার মালকিন কে সে বিয়ে করেনি। অপমানিত উপেক্ষিত আমার মালকিন কে বন্দি করে রাখা হয় এই ঘরে। মালকিন আমার উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতেন। সেই থেকে চিড় ধরেছিল আমার কাঁচে। কিন্তু একদিন তার সব কান্নাই বন্ধ হয়ে যায় , কান্নার সঙ্গে নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়, গলায় দড়ি দিলে যা হয় আর কি।


তারপর আমি চুপচাপ একা ছিলাম অনেক বছর। এই মৃত্যুর কথা টাকার শক্তি দিয়ে চেপে দেওয়া হয়, আর এই বাগান বাড়ি হয়ে যায় পরিত্যক্ত। আমি ধৈর্য ধরে বসে থাকি আমার জায়গায়।


 সময় আসে দেশের স্বাধীনতার, আমি ভারতের এক অজানা, ক্ষুদ্র সদস্য হয়ে উঠি । তার সঙ্গে হই দেশ ভাগের যন্ত্রণার এক সাক্ষী। আসলে তখনই আমার দেখা নন্দিনীর সঙ্গে। বাচ্চা মেয়ে, নিজের জমি-জমা, দেশ ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে আস্তে হয় উদ্বাস্তু হয়ে। বাবাকে নাকি প্রতিবেশিরাই খুন করেছিলো। অনেক মানুষের সঙ্গে পালিয়ে আসা মা, দাদা আর মেয়ে আশ্রয় নেয় এই বাগান বাড়িতে। তাদের ছোট জীবন সংগ্রামের এক ক্ষুদ্র সঙ্গী হয়ে যাই আমি। বেকার দাদা আর একদম না খেতে পাওয়া মায়ের মধ্যে কষ্ট যন্ত্রনা বেদনা সব ই ছিল, কিন্তু স্বপ্ন ছিল না। নন্দিনী স্বপ্ন দেখতে পারতো। সে সারাদিন কাঁদতো, বলতো," আমাগো দ্যাশের মতো কিসুই দেখি না। এ শহর আমার চাই না।" বড় দম বন্ধ লাগতো তার।


একদিন, আমার নীল রঙের কাঁচে চোখ রেখে নন্দিনী প্রাণপণে নিজের দেশে ফেরার চেষ্টা করেছিল, বাইরের ধূসর পৃথিবীটাকে পদ্মার সুনীল জল কল্পনা করার চেষ্টা করেছিল সে। তার দাদা তাকে বাস্তবে ফেরাতে মাথাটা সজোরে ঠুকে দেয় আমার উপর, আবার চিড় ধরেছিল আমার বুকে, তবে এই দেশের এবং নন্দিনীর মনের ক্ষতর তুলনায় সেটা নিছক সামান্য।


এই পরিবার তারপর কোথায় হারিয়ে যায় কে জানে, হয়তো দাদা একটা চাকরি পেয়ে যায়, হয়তো তো বা নন্দিনীকেই শরীর দিয়ে চাল কিনতে হয়, কে জানে। কিন্তু তার রক্তের দাগ কিছু দিনের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। 



আরো অনেক দিন কাটে, সময় টা সত্তরের দশক, আর পুরো বাংলার বিপ্লবী রক্ত কে নিঃশেষ করতে উঠে পড়ে লাগে পরিকাঠামো। এই ঘরেই আশ্রয় নেয় তেমনি এক নতুন রক্ত। তুখোড় পড়াশোনা, মনের জোর, নতুন সমাজের আলো দেখতে পাওয়ার স্বপ্ন আর একটা ছোট লাঠি ছিল তার সম্বল। নিজের জীবনের কথা না ভেবে সে সব সময় ভেবে চলতো তার ধরা পড়ে যাওয়া বন্ধুদের কি হলো! তবে সে বেশি দিন থাকতে পারেনি এখানে, তার এক প্রাণের বন্ধুই তার ঠিকানা বলে দেয় পুলিশ কে। পুলিশ এসে তাকে বেধড়ক পেটায়, তার লাশ কেও পেটায়। দু চার বার বেকায়দা মার আমাকেও খেতে হয়। আবার নতুন চিড়, আবার নতুন ক্ষত।



সময় পাল্টায়। কেউ জানতে পারে না এই অজস্র মৃত ছেলের লাশের সন্ধান, সমাজ নিজের গতি তে এগিয়ে চলে। হয়তো এদের ভুলেও যায়। আমারও বয়স বাড়ে পাল্লা দিয়ে।



এখন চারদিক অনেক পাল্টে গেছে। ফ্ল্যাট বাড়ির বাসিন্দা রা এখন ফাইবারের। তাদের দেহে নাকি কখনো চিড় ধরে না, আঁচড় পরে না। তারা বাসিন্দাদের সাতেও নেই পাঁচেও নেই।


কিন্তু কারোর কারোর তো চিড় ধরা কাঁচই লাগে তাই না। আজকের এই এই শরিকী বাড়িতে এই ঘরে থাকে উনিশ বছরের কুশল, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাংলা মাধ্যম এর ছাত্র। বাবা মায়ের অসীম চাপে পড়ে ঘষে ঘষে অনেক কষ্টে আই আই টি খড়গপুরে সে ঢুকেছে। সে বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী। কিন্তু সে আর পারছে না। আর পারছে না চাপ নিতে, সে ইঁদুরদৌড় থেকে মুক্তি চায়। সে চায় স্বাধীনতা। অথচ ভালো চাকরি না করলে বাবা মায়ের মুখ উজ্জল করবে কি করে? সবার কাছে জবাবদিহি করবে কি করে? তাই সে আমার কাছে আসে। ক্লান্ত, বিধস্ত, পরাজিত। চিড় ধরা কাঁচ ভাঙতে কষ্ট হয়নি তার, শুধু হাতের শিড়া খুঁজতে একটু সমস্যা হয়। কেন যে সে উচ্চমাধ্যমিকে জীবনবিজ্ঞান নেয়নি।


 আমি বাঁচাতে পারিনি নিজেকে। আমি বাঁচাতে পারিনি তাকে। তার মা বাবার সঙ্গে আমিও খুব কেঁদেছিলাম।

হয়তো চিড়গুলো না ধরলে কুশল এত সহজে ভাঙতে পারতো না আমায় , হয়তো সমাজের ক্ষতগুলো সুযোগ দিয়েছিল তাকে। হয়তো সমাজের এক একটি বাঁক এমন করেই ভবিষ্যত কে তৈরি করে এবং আমাদের এই চিড়ধরা ছন্নছাড়া সমাজ অনেকের জীবনেই এইরকম পরিণতিগুলি ডেকে আনে। হয়তো আমার সবকোটা চিড়ই মানবতার এক একটি পরাজয়ের প্রতীক। আমি কি জানি, আমি তো সামান্য এক পুরোনো ভাঙা কাঁচের জানালা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract