ভাঙা গড়ার খেলা
ভাঙা গড়ার খেলা
পেপারের প্রথম পাতায় খবরটা দেখেই পেপারটা লুকিয়ে ফেলে বুলু। বাবার আজকাল এক দোষ হয়েছে। এমনিতেই বাবার জন্য সারা পাড়া বিরক্ত, সবাই বাবাকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দরজা খুলতে চায় না। তাতে এই খবরটা বাবার চোখে পড়লে আর রক্ষা থাকবে না, হয়তো আজকেই নবান্নর সামনে ধর্ণায় বসবে গিয়ে। নয়তো ডিআই অফিসের সামনে অনশন করবে।
বারান্দায় বসে ধ্যান করছেন অমল বাবু, সকালে এক ঘন্টা হেঁঁটে এসে ধ্যানে বসেন রোজ। বুলু কাগজটা লুকিয়ে রাখতে রাখতে ভাবে একসময় এই বাবাকে লোকে কত সম্মান করত।ভালোবাসত।
অমল কান্তি রোদ্দুর হতে পেরেছিলেন। শিশুদের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালানোই ওঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আদর্শ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমলবাবুর হাত ধরে বছর বছর শত শত বিদ্যার্থী পাশ করে এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে একসময়। পাঁচ বছর হল উনি অবসর গ্ৰহন করেছেন। অবসর গ্ৰহনের আগে থেকেই ওঁর মধ্যে এক অদ্ভুত রোগ জন্মেছিল। আজকাল বাংলা মাধ্যম স্কুলে কেউ বাচ্চাদের পড়াতে চায় না। স্কুলের ভর্তির হার চোখে পড়ার মত কমেছিল। উনি ঘরে ঘরে গিয়ে অনুরোধ করতেন শিশুদের ওঁর স্কুল পড়ানোর জন্য। উনি নিজে দায়িত্ববান শিক্ষক ছিলেন একথা ঠিক, তবুও যুগের স্রোতে গা ভাসিয়ে সবাই ইঁদুর দ্রোড়ে সামিল হত। সবাইকে উনি বোঝাতেন মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের গুরুত্ব। কিন্তু তবুও কমছিল শিশু ভর্তির হার।সবাই বিরক্ত হত। নিজের দুই নাতিকে জোর করেই নিজের স্কুলে দিতে গেছিলেন। এই নিয়ে বাড়িতেও নিত্য অশান্তি। বৌদি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছিল দুই ছেলে নিয়ে। পরে সব ঠিক হয়েছে।
অবসর গ্ৰহনের পর অমল বাবু বাড়িতেই অবৈতনিক স্কুল খুলেছিলেন। সেভাবে ছাত্র না আসায় বন্ধ করতে হয়েছিল। আপাতত ইংরেজী স্কুলে পড়া দুই নাতিকে রোজ বিকেলে মাতৃভাষা শেখান উনি। এতেই শান্তি এসেছে সাময়িক। পাড়ায় ছোট শিশুদের বাবা মা কে দেখলেই উনি বোঝাতে ছোটেন যে বাংলায় পড়েও বড় হওয়া যায়। নিজের হাতে গড়া কৃতি ছাত্রদের উদাহরণ দেন সবাইকে।
আজ পেপারে দিয়েছে বেশ কিছু বাংলা মাধ্যমের সরকারী স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছাত্র নেই বলে। এই খবর দেখলে যে কি হবে...., বুলু ভাবে। বাংলা মাধ্যমে যে আজকাল কেউ আর পড়ে না বাবা বুঝবে না। বাংলায় এমএ বুলু বাবাকে দেখে
রেগে যায় মাঝে মাঝে। আজ বাংলা নিয়ে পড়ে ঘরে বসে রয়েছে সে। চাকরী কোথায়?
দুপুরে পেপার না পেয়ে মেয়েকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন অমল বাবু। বুলু এড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিকেলে শহর কলকাতার বুকে যে লজ্জা জনক ঘটনা ঘটল তা টিভির দৌলতে অমল বাবুর চোখ এড়ালো না।
কিন্তু এই প্রথম বুলু দেখল ওর বাবা টিভি অফ করে বারান্দায় এসে বসলেন। কারো সাথে কথা নয়, কোনো রকম ভাবে উত্তেজিত নয় মানুষটা। একভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন উনি। বুলু দুবার খেতে ডেকেছে। আসেননি। দুই নাতি বই নিয়ে ঘুরঘুর করে ফিরে গেছে। ছেলে, বৌ ভয় পেয়েছে ঐ মৌন বৃদ্ধ কে ডাকতে।
বুলু দেখেছে বাবার চোখ থেকে ফোঁঁটা ফোঁঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মাঝরাতে জোর করে ঘরে এনেছে ও বৃদ্ধ বাবাকে। এই অবুঝ বৃদ্ধকে কে বোঝাবে এই যুগে বাংলার আর দাম নেই। দাম নেই বাংলা ভাষার রক্ষক দের। তাই তো আজ বিবেকানন্দ থেকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভঙতে হাত কাঁপে না কারো। এ যে বাঙালির লজ্জা। বাংলার লজ্জা। আজ বহুদিন পর বাবার ঘরেই শোয় বুলু। ভয় লাগে লোকটার জন্য।
ঝকঝকে একটা সকাল, বুলু উঠে দেখে বাবা বিছানায় নেই। দৌড়ে বাইরে যায় ও। না, হেঁটে বোধহয় ফেরেননি উনি। বাড়ির ভেতরে কুয়োতলার দিকে যেতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় বুলু। সে ঠিক দেখছে তো !! কুয়োর পারে কাদা মাটি নিয়ে বসেছেন বাবা, সঙ্গে দুই নাতি। কচি কচি হাতে মাটির তাল ডলছে ওরা। পাশে একটা বিদ্যাসাগরের ক্যালেণ্ডার। বাবা বলছেন -''এভাবেই গড়বো, আবার ভাঙবে, আবার গড়বো, যতবার ভাঙবে ততবার গড়বো। ঈশ্বর রয়েছে আমাদের মনে, প্রাণে। ভেঙে গুড়িয়ে দিলেও ঈশ্বরকে মুছতে পারবে না ওরা। ''
কাদা মাখা দু জোড়া কচি হাতের সাথে একজোড়া বুড়ো হাত গড়ে চলেছে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। বুলুর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওর দাদা, বৌদি। সবার চোখে জল। একে একে সবাই হাত লাগায় মূর্তি গড়তে। কটা মূর্তি ভেঙ্গে কি আর বাঙালির ইতিহাস বদলানো যাবে !! শয়ে শয়ে মূর্তি গড়বে আগামী প্রজন্ম।
মাটি মাখা হাতগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন বৃদ্ধ অমলকান্তি। বলেন - '' এই তো হাতের সংখ্যা বাড়ছে। আরো বাড়বে, বাড়তেই হবে। এভাবেই নতুন করে গড়বো আমরা আমাদের ইতিহাস। ''