STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy

ভাঙা - চোরা মনের স্বগতোক্তি

ভাঙা - চোরা মনের স্বগতোক্তি

5 mins
314

খুব ভোরের সকালবেলাটা কিন্তু একটি সুন্দর ভালো লাগার অনুভূতির পরিবেশ থাকে, চারিদিক নিস্তব্ধ এক শান্ত বাতাবরণে মনটা একদম অন্যরকম হয়ে যায়। পূর্বদিকের আকাশ রক্তের মত লাল করে যখন সূর্যোদয় হয়, তখন যেন মনে এক নূতন দিনে নূতন জীবনের প্রেরণা জাগিয়ে তোলে। আচ্ছা বলুনতো, জীবনের গল্প কী শুধুই সাফল্যের, অসফলতার কী কোন গল্প হয় না। পাখির কিচিরমিচির শব্দে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল। ছটফটিয়ে উঠে বসল সে বিছানায় । সবকিছু কেমন অন্য রকম মনে হয় তার । চারপাশ জুড়ে বিরাজমান অসীম শূন্যতা যেন তাকে গিলে খাবে ! নিঃসঙ্গতা বুঝি তার গলাটা চেপে ধরেছে ! দমটা বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার । একটু তাজা হাওয়ার জন্য একছুটে বারান্দার কোনায় গিয়ে বসে থাকার আকুল ইচ্ছেটা মাথা থেকে তাড়াতে চাইল সে । যেন ভয়ানক এক অনুভুতি । হঠাৎ প্রচণ্ড পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে মরুভুমি হয়ে আছে তার । চেষ্টা করলেও ঘুম আর আসবেনা বলে মনেহয় তার । হাঁটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতেই, রাগে হতাশায় ইচ্ছে হল নিজের গলাটা যেন নিজেই চেপে ধরে । আচমকা ফরফর আওয়াজ শুনে দেখল মাথার ওপর ঘুরতে থাকা পাখাটার বাতাসে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ডায়েরিটার পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে । তখন তার ইচ্ছে হল ডায়েরিটার পাতা গুলো পড়ে দেখবে । এই চার দেয়ালের বন্ধ পরিবেশের মধ্যে বন্দি থেকে নিজের মনের না বলা কথাগুলো যেন মনের মধ্যেই জং ধরে আছে । তাই সময় পেলেই ডায়েরির সাদা পাতাগুলোতে নিজের মনের কথাগুলো বন্দী করে সে । ইচ্ছেগুলো ,অভিমান গুলি উজাড় করে দিয়ে খুব কাঁদে সে, চিৎকার করে কাঁদে । কিন্তু তার মন হাল্কা করা সেই কান্নার শব্দ বন্ধ চার দেয়ালের কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনিত হয়ে বিলীন হয়ে যায় কোথায় ! এই কান্নার সৃষ্টিও এই ঘরে আর সমাপ্তিও এই ঘরেই হয়ে যায়। আসলে আমরা জীবনকে কতটা বুঝি - ভাবি হয়ত বুঝি, কিন্তু মনে হয় এই বোঝাটা সঠিক তো? জীবন নিয়ে ভাবলে কি মনে হয় জানেন - জীবন মনোরম ;মৃত্যু শান্তিদায়ক। সংকটময় তো শুধু জীবন সন্ধিক্ষণের সময়টুকু।


তার চোখ পড়ে যায় তার ডায়েরির একটি পাতায় । কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে অতীতের কথা মনে করে সে । ডায়েরির পাতায় লেখা …


১০ই সেপ্টেম্বর ,২০০৯

সে চোখ বুলাতে লাগল তার লেখাগুলোর ওপর – “আকাশটা যে এতটা সুন্দর কখনো দেখিনি সেভাবে । খোলা আকাশের দিকে দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে মনে হচ্ছে আজ তুমি আমায় নতুন করে আকাশটা চেনালে । আচ্ছা তুমি কি করছ ?

-ছবি আঁকছি ।

-কার ছবি আঁকছ ? কিসের ছবি আঁকছ? দেখি কি আঁকছ ? আরে ,এতক্ষন বসে একটা বিন্দু এঁকে বসে আছ !

-উঁহু এটাতো তুমি ।

-আমি !

-হুম কেন্দ্রটা তুমি । আর চারপাশে আমি ঘিরে রাখব বৃত্তের মত করে ।

-হাহাহা।

তাই বুঝি ? কিন্তু আমিতো এত ক্ষুদ্র হতে চাই না । আমার আকাশের বুকজুড়ে যে অসীমের ছড়াছড়ি । আমার আকাশ, সব চরাচরে শুধু তুমি আর আমি জেগে আছি । সেই অস্তিত্ব তো ক্ষুদ্র নয়, তাই নয় কি?

- ঠিক আছে, তবে দেখতো এটা কি ?

-এটা তো একটা হৃদয়,হৃদয় আঁকলে তো ! কার হৃদয় শুনি ?

-যেখানে তুমি আছো চিরন্তন ভালোবাসায় বন্দী।

-তাহলে আরো শক্ত করে ধরো আমায় প্লিজ । আমি সারাটা জীবন ওখানেই থাকতে চাই ।

প্রিয়,তুমি এই মুহূর্তগুলো মনে রাখবে তো ? কখনো ছেড়ে যাবে নাতো আমায় ?

তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো সব আমি ডায়েরির পাতায় বন্দী করে রাখছি । স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে সবকিছু । তোমার হাতে হাত রেখে যে পুরো পৃথিবীটা পাড়ি দিতে চাই আমি । আচ্ছা এত সুখ আমার সইবে তো ?”


আর পারল না সে । দু’চোখ ভরে গেল তার জলে । ডায়েরির মাঝখানের অনেকগুলো পাতা শূন্য, বিভীষিকাময় দিনগুলোতে যে আর কিছু লেখা হয়নি তার ! গতকাল রাতে অনেকদিন পর লিখতে বসেছিল সে । খুব কেঁদেছে সে রাতে । মনকে সঙ্গী করে ইচ্ছেমত সব কথা লিখেছে এ বছরের ডায়েরিতে। পাতার ওপরে বড় করে লেখা…


২৪ জানুয়ারী ,২০১০

“দু’হাতে ঠেলছি স্রোত । অনির্দিষ্টের পথ। জানিনা কোথায় পাবে কূল এই ছিন্নভিন্ন দেহ, এই ভাঙাচোরা মন । আচ্ছা প্রিয় ,মনে পড়ে সেদিনের কথা যেদিন প্রথম দেখেছিলে আমায় ? ক্যান্টিনের এক কোনাতে বসে গান শুনছিলাম আমি আর তুমি জানালার পাশে বসে আমার ছবি আঁকছিলে । ছবিটা যখন দেখাতে এলে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম আমি তাই না ? সেদিনের ছবিটা কিন্তু দারুন হয়েছিল জানো ? জানবেই বা কিভাবে কখনো তো বলা হয়নি তোমায় । তোমার মনে পড়ে আমার বড় হওয়ার ১৮ তম জন্মদিনের কথা ? আমায় নিয়ে লেখা তোমার কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলে তুমি আর বলেছিলে চিরদিন ভালবাসবে আমায় ,কখনো যাবেনা চলে ।

আর ঐ যে ওদিন আমি পড়েছিলাম লাল শাড়ি আর তুমি লাল পাঞ্জাবি । জানো,স্মরণাতীত কাল থেকে লাল রং হচ্ছে অগ্নির,প্যাসন বা আবেগ।

দুজনে বসেছিলাম খোলা আকাশের নিচে । আমার হাতটা চেপে ধরে রেখেছিলে তুমি যেন কোথাও হারিয়ে যাব আমি ! কই,সেদিন তো হারিয়ে যাইনি আমি তবে তুমি কেন হারিয়ে গেলে ? ঐ যে সেদিন তোমার সাথে দেখা করব বলে দাঁড়িয়েছিলাম রাস্তায় । হঠাৎ একটা গাড়ির হেডলাইট দেখলাম শুধু , তারপর চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু, অনুভব করলাম অসহ্য একটা যন্ত্রনা । শুনেছিলাম হসপিটালে এসেছিলে তুমি । তবে আমার সাথে দেখা না করেই কেন পালিয়ে গেলে তুমি? তুমি জানো কি কতবার ফোন করেছি তোমায় ? তোমার নাম্বারটা বারবার অফ পেয়েছি আমি । তোমার ঠিকানা- কলেজ কোথাও খোঁজ করে পেলনা বন্ধুরা । ওরা বলল তুমি নাকি কলেজ থেকে টিসি নিয়ে চলে গেছ! জানো কতদিন কাজের মেয়েটাকে বলে কতবার হুইল চেয়ারে করে ঐ পার্কটায় গেছি যেখানে তুমি আর আমি নীল আকাশটা দেখতাম আর স্বপ্নের জাল বুনতাম । কিনতু তোমাকে ওখানেও খুঁজে পাইনি আমি । আচ্ছা তুমি কি সেদিন আমার চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা শুনে পালিয়ে গেছিলে ? জানো, মানুষ তো যেকোনো দুর্ঘটনায় দৈহিক ভাবে পঙ্গু হতে পারে, কিন্তু মন তো কখনও পঙ্গু হয় না। আচ্ছা, তবে কি কোনদিনই ভালবাসনি আমায় ? সবই কি ছিল মিথ্যে অভিনয় ! তুমি কি জানো আজও আমি স্বপ্ন দেখি বেনারসি পড়ে ঘোমটা টেনে তোমার হাত ধরে তোমার সাথে যাব নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে ।”


হঠাৎ দুইটি চড়ুই পাখির কিচকিচ শব্দ শুনতে পায় সে । ডায়েরিটা বন্ধ করে জানালা দিয়ে বারান্দার দিকে তাকায় সে। প্রায় চার তলা পর্যন্ত বেয়ে ওঠা দেবদারু গাছটা হালকা বাতাসে দুলছে এপাশ ওপাশ । জানালার গ্রিলটাকে শক্ত করে ধরে সে । উদাস মনে চেয়ে থাকে ঐ আকাশটার দিকে । আকাশটাকে আজ বড় অচেনা লাগে তার । শুধু অশ্রুগুলো তার দু চোখ বেয়ে, ভিজিয়ে দেয় তার শুকনো ঠোঁট দুটি…..। আকাশ বড় রহস্যময়ী, তার এই বিশালতা - সব সময়েই তাতে কোন না কোন পরিবর্তন হচ্ছে। ঠিক করে লক্ষ্য করলে এটাই মনে হয় - “জীবনে যা কিছু পান নি, তা নিয়ে আফসোস করার চেয়ে, যেটুকু পেয়েছেন তা নিয়ে হিসেব করে দেখুন। আপনার এক হাতে শূন্যতা থাকলেও অপর হাতে ঠিক ই পূর্ণতা খুঁজে পাবেন।”

একথা মনে পড়তেই তার ক্লান্ত ম্লান মুখটায় একটা সুন্দর হাসি ফুটে উঠল, দেখল চোখের জল শুকিয়ে গেছে আর ঠোঁট দুটো আর শুকনো নেই, আর্দ্র হয়ে গেছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy