ভালোবাসারই মরশুম
ভালোবাসারই মরশুম
"ওই, শোন না...",মেসেজটা করে ফেলে সাম্য। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসে,"বলো গো...."
সাম্যর মনে জমা কষ্টের মধ্যেও এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। হোয়াটস্যাপ চ্যাটবক্স এ জ্বলজ্বল করছে একটা নাম। 'ম্যাডাম রাগেশ্বরী'। একমাত্র এই মেয়েটাকে মেসেজ করলেই নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়না ওর! মেয়েটা যেন ওর মেসেজের অপেক্ষাতেই থাকে। ও সাম্য। সাম্য মিত্র। খুব চুপচাপ স্বভাবের ভিড়ে মিশে যাওয়া সাধারণ একটা ছেলে। ও আর ওর প্রাণের গিটার! এই নিয়েই ওর জীবন। ওর পৃথিবীটা একটু বেশিই ছোট। সেই পৃথিবীর মধ্যে যে কাউকে ঢুকতে দেয়না ও। জীবনে প্রথম প্রেম এসেছিলো বেশ কিছুদিন আগে! কিন্তু সেই প্রেমে হয়তো খাদ রয়ে গিয়েছিল। আজকাল সাম্যর মনে হয়...হয়তো শুধু প্রেমই ছিল, ভালোবাসা ছিলোনা। সেই তখন থেকেই একটা অজানা ভয় জন্ম নিয়েছে ওর মধ্যে। হারানোর ভয়! আজও ঠিক যেই ভয়টা অবশ করে দিচ্ছে ওর স্নায়ুকে। আসলেই! ওর জীবনে আরেকবার প্রেম এসেছে। ভালোবাসা এসেছে। কালবৈশাখী ঝড়ে চারপাশ ছাড়খার হয়ে যাওয়ার পরে যেমন ধরণীর বুকে নেমে আসে বারিধারা! ঠিক তেমনি, ওর ভগ্ন হৃদয়জুড়ে আবারও নেমেছে ভালোবাসার প্লাবন। মেয়েটার নাম...শ্রীতমা। শ্রীতমা নন্দী। একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপের মাধ্যমেই শ্রীতমার সাথে আলাপ সাম্যর। পরিচয় হলো.... শুরু হলো কথা! আর কালবৈশাখীর শেষে নামলো প্রেমের বৃষ্টি!
"কী গো? বলো...", আরেকটা নোটিফিকেশনের টুং শব্দে ঘোর কাটে সাম্যর। টাইপ করে,"একটা question ?আমাকে উত্তর দিবি?"
"বলো"
শ্রীতমার রিপ্লাই পেয়ে একটা বড়ো নিঃশ্বাস নেয় সাম্য। লেখে, "কাউকে ভালোবাসিস? নিজের চেয়েও বেশি?"
শ্রীতমার নামের নীচে দেখাচ্ছে 'typing'। সাম্য এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঐদিকেই। রিপ্লাই আসে,"হয়তো। তবে নিজের থেকে বেশি নয়। নিজেকেই যদি ভালোবাসতে না পারি, সম্মান করতে না পারি তাহলে ওই অপরজনকে ভালোবাসবো কি করে? সম্মান করবো কি করে? তবে হয়তো সত্যিই ভালোবাসি, জীবনে প্রথমবার।"
তার প্রায় পরে পরেই আরেকটা রিপ্লাই, "হঠাৎ এই প্রশ্ন?"
সাম্য চুপ করে থাকে। ও নিজেও জানেনা কেন করলো এই প্রশ্ন! শুধু ও জানে... শ্রীতমার হোয়াটস্যাপ status জুড়ে হাজার ক্রাশ এর ভিড়ে কেমন যেন দমবন্ধ লাগছিলো ওর। নিজেকে সামলে নিয়ে সাম্য লেখে, "না মনে হলো তাই করলাম। তা প্রথম বার ??"
" হ্যাঁ প্রথমবার। ক্রাশ বহুবার খেয়েছি। প্রেমেও পড়েছি বহুবার। কিন্তু ভালো হয়তো এই প্রথমবার বাসলাম... ", উত্তরটা দেখে সাম্যর মনে একটা ভালোলাগা কাজ করলেও নিমেষে তা উড়ে যায়! ওই যে.... হারানোর ভয়।
"হঠাৎ?", শ্রীতমা প্রশ্ন করে আবার।সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সাম্য লেখে,"আচ্ছা!তো ছেলেটাকে হঠাৎ পছন্দ হওয়ার কারণ?"
"ওয়ার্ডস..... শব্দ...."
"মানে?"
"মানেটা বড্ডো সহজ। তার কথার প্রেমে পরেছি। কথা বলতে বলতে ভালো লেগেছে। তার কথার মায়ায় জড়িয়ে পরেছি এখন যদি জিজ্ঞেস করো কেন, তার উত্তর আমার কাছে নেই। কারণ ভালোবাসা এমনই একটা অনুভূতি যেটা কখন কার প্রতি জন্মায় সেটা কেউ জানে না।"
"তবে ছেলেটা দেখতে কুৎসিত হয়? দেখতে সেরকম muscular না হয়? বেশ গোলগাল। তারপরেও তাকে তুই ভালোবাসবি?"
"এখন তার থোবড়া দেখে তো আর ভালোবাসিনি রে বাবা! আমি সত্যিই চেয়েছি আমার বয়ফ্রেন্ড হ্যান্ডসাম হাঙ্ক, ড্যাশিং হবে। কিন্তু এখন যদি ভালোবেসে ফেলি তাহলে আমি কি করতে পারি?! আমার দোষ কোথায়?..."
ওপাশ থেকে আসা রিপ্লাইটায় কেমন যেন দমে যায় সাম্য। নিজের মনকে নিজেই প্রশ্নে করে ওঠে, "Handsome dashing হলেই কি ভালোবাসা যায়? নাহলে যায়না ?ছেলেদের প্রেম করতে গেলে কি handsome dashing হতে হয় ?"
"অবশ্যই নয়। এসব ভ্রান্ত ধারণা মাথায় কে ঢোকালো? প্রত্যেকটা মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। এবং তারা পায়ও...", ওপাশ থেকে রিপ্লাই টা আসার পরেই হোয়াটস্যাপ বন্ধ করে নেট অফ করে দেয় সাম্য। মনটা বড্ডো ভারী ভারী লাগছে! চোখেদুটো জ্বালা করছে বড্ডো। বিছানার পাশ থেকে তুলে নেয় নিজের শখের গিটারটা। হাত রাতে গিটারের তারে। ও তো handsome না! Dasing না! তবে কি ওর প্রেমে পরা বারণ? না.... ও সিনেমা-উপন্যাসের নায়কদের মতো না। ও খুব সাধারণ, ছাপোসা একটা ছেলে। অনেক মানুষের কাছে ও বারবার শুনে এসেছে.... ওকে দেখতে খুব একটা সুন্দর না! বুকের মধ্যে জমে থাকা যন্ত্রণাটা তীব্র আক্রমণ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ফলস্বরূপ গিটারের তারে খুব জোরে নিজের আঙ্গুল চালায় ও। ওর সুরেরাও আজ নিখোঁজ হয়েছে! চোখ বন্ধ করে সাম্য!
হোয়াটস্যাপ চ্যাটবক্স এর দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে শ্রীতমা। ওপরে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম....'Mr. রাগেশ্বর'। সেই যে অফলাইন হলো, আর অনলাইন আসছেনা ছেলেটা! ও শ্রীতমা। শ্রীতমা নন্দী। গল্প, উপন্যাস নিয়েই জীবন ওর। ওর স্বপ্ন বড়ো একজন লেখিকা হওয়ার! সেই স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়েই পা রেখেছিলো...."রামধনু" হোয়াটস্যাপ গ্রুপে। সেখানেই পরিচয় সাম্যদার সাথে। যার কথার , গিটারের সুরের প্রেমে পরেছে ও! আবদারি নাম দিয়েছে.... রাগেশ্বর! হ্যাঁ, ভালোবাসে ও ওর সাম্যদা কে। কেজানে কিকরে এতটা ভালোবেসে ফেললো! ও বোঝে..... ছেলেটার মনেও হয়তো ওর জন্য অনুভূতি আছে। শুধু প্রকাশ করতে পারছেনা।
সেই যে কথা হলো এখনও রিপ্লাই দিচ্ছেনা সাম্য। সেই যে অফলাইন হয়েছে, তারপর আর অনলাইনেই আসেনি। শ্রীতমা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। সন্ধ্যের বাতাস দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দের সঙ্গে ওর মনটাও উদাসীন হয়ে পড়ছে। ও জানে.... খুব ভালো করে জানে যে.... ওই 'handsome' আর 'dashing'.... এই দুটো শব্দ আজ খুব কষ্ট দিয়েছে সাম্যকে। ক্ষতবিক্ষত করেছে ওর রাগেশ্বরকে। সাম্য যে বারবার বলে....ওকে নাকি দেখতে খারাপ! কই শ্রীতমার তো সেটা মনে হয়নি কখনো! কী cute দেখতে ওর সাম্যদাকে। ও তো তাকেই থাকে হাঁ করে। স্মরমজিতের 'পুঁটি' কেও যেন হার মানিয়ে দেয় ওর সাম্যদা! আসলেই... সৌন্দর্য আপেক্ষিক! শ্রীতমার কাছে তো ওর সাম্যই সুন্দর!! ওই hansome!! ওই dashing! সাম্য টা কেন বোঝেনা? যে খারাপ বলে এই পৃথিবীতে কিছু হয়না!! পৃথিবীর সব মানুষের কাছে খারাপ হলেও..... সে একটা মানুষের কাছে ঠিক সুন্দর। হতেই হবে সুন্দর!! তুমি কোনো জিনিসকে যেভাবে দেখবে, সেটা সেভাবেই সুন্দর!!! ও যে সাম্যর মায়ায় জড়িয়ে পরেছে। আর
মায়া বড়োই ভয়ঙ্কর!!! একবার ওই মনের মায়ায় জড়িয়ে গেলে বেরানো মুশকিল। শুধু কি মন?তার কণ্ঠস্বরের মায়া! তার হাসির মায়া! কথা বলার ভঙ্গির মায়া..........
"আমি তো কোনোদিন ওকে খারাপ বলিনি! বরং সবসময় বুঝিয়েছি তুমি যেমন তেমনই তুমি সুন্দর! তাহলে এমন করে কেন!?",অভিমানী কণ্ঠে নিজের মনেই প্রশ্ন করে ওঠে শ্রীতমা। আসলে.... সাম্য যে বড্ডো ভালোবাসার কাঙাল। কারণ এতদিন ওকে কেউ বলেনি যে ও সুন্দর। এতদিন ও বাকিদের দেখেছে। তবে.... শ্রীতমাকে দেখেনি... যার কাছে ও সুন্দর।
শ্রীতমা আর বইতে পারছেনা এই চিন্তা! ওর মন-মস্তিস্ক বড্ডো চঞ্চল হয়ে বাঁধনছাড়া হয়ে উঠেছে। পাগল পাগল লাগছে ওর। পরপর sms করতে থাকে...
"ওই
হ্যালো!
শোনো
Online এসো
প্লিজ
একটিবার...."
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনলাইন হয় সাম্য। শ্রীতমা দ্রুত টাইপ করে,"কি হলো তোমার? হঠাৎ অফলাইন হলে কেন?"
"আরে নেট শেষ !মায়ের থেকে wifi নিলাম । বল তুই...."
"কি হয়েছে তোমার?বলো না! এমন করছো কেন!?", ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে শ্রীতমা।
"আরে এতো চাপ লাগছে না!! তাই। বল। আর আমার কিছু হয়নি।"
"না তুমি কিছু লুকোচ্ছো।বলছো না আমায়। আমি বুঝতে পারছি...", শ্রীতমা নাছোড়বান্দা।
"Assignment লেখার আছে প্রচুর। লেখার চাপ..."
"না মোটেও লেখার জন্য নয়। তুমি হঠাৎ এইরকম প্রশ্ন করলে কেন? তারপর আবার এসব বলছো? কি হয়েছে তোমার? বলবে না আমায়?...."
সাম্য একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে হোয়াটস্যাপ চ্যাটবক্স এর দিকে। মেয়েটা চিন্তা করছে। ওর জন্য চিন্তা করছে। বারবার মিথ্যে অজুহাত দিলেও ধরে ফেলছে সেগুলো। নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারেনা সাম্য।
"আসলে এখনকার দিনে তো সবাই dashing handsome বয়ফ্রেন্ড চায় তাই বললাম!"
"কেন মন খারাপ করো তুমি? সবসময় ভাববে এমন কেউ আসবে যে তোমাকে ডিসার্ভ করবে। তুমি কেন নিজেকে ছোটো ভাবো?...."
"সমাজ ভাবায় রে। সমাজ এতো নিষ্ঠুর!!", সাম্যর কথায় ঝড়ে পড়ে কষ্ট।
"ভাববে না! সমাজ তোমায় খাওয়ায় না পড়ায়? আমিও তো ভালো দেখতে নই! আমি মোটা, কালো, দেখতে ভালো নই, কই কারোর কথা তো গায়ে মাখি না! লোকে তো বলবেই! লোকের কাজই বলা! তুমি শুনবে কেন?!"
সাম্যর চোখের কোণে বাষ্পরা ভীড় জমিয়েছে অজান্তেই। শ্রীতমারও তাই! দুজনে আজ দুজনের থেকে অনেক দূরে। তাও পরস্পরকে নিজেদের খুব.... খুব কাছে অনুভব করলো ওরা।
যেন শ্রীতমা ওর সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে অভিমানী সুরে বলছে,"মন খারাপ করবে না একদম! কেন এই বাজে কারণে মন খারাপ করো তুমি!? একদম ভাববে না!... "
আর সাম্য নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরছে ওর শ্রীকে। ওর মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে বলছে, "আচ্ছা! একদম ভাববোনা!..."
"কখনো শুনবে না আর! নাহলে মেরে পুঁতে দেবো যদি কোনোদিন শুনেছি সমাজ লোকের কথা বলতে!...", শ্রীতমা কিল মারছে ওর বুকের ওপর। অভিমানী হয়ে। ও অল্প হেসে বলছে,"আচ্ছা! শুনবোনা এবার থেকে। মন খারাপ করবোনা... আর শুনবো না তো বলবো কিকরে!!...."
শ্রীতমা ওর গাল টিপে দিয়ে মুচকি হেসে বলে ওঠে,এই তো ভালো ছেলে কালো চুল... "
কথাগুলো চলছে হোয়াটস্যাপ এ আর বাকিটা? সেটা নাহয় এখন কল্পনাতেই বন্দি থাক! ক্ষতি কী?
"গান শোনাও একটা...", আবদার করে শ্রীতমা। সাম্য পাঠায় একটা ভয়েস রেকর্ড! সঙ্গে টুকরো মেসেজ।
'Only for ম্যাডাম রাগেশ্বরী..."
সেটা on করতে ভেসে আসে শ্রীতমার 'Mr. রাগেশ্বর' এর গান.......
"মন একে একে দুই
একাকার আমি তুই,
আর না চোখ ফিরিয়ে, একটু হাস।
নেই, মনে কি কিছুই?
তোর ঠোঁটের ডানা ছুঁই,
মিলবে সব জীবনের ক্যালকুলাস।
স্মৃতিরা গেছে পরবাস
কথারা হয়েছে নিঝুম,
এ বুকে তবু বারোমাস
ভালোবাসারই মরশুম,
ভালোবাসারই মরশুম।......"
*সমাপ্ত*