শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy

3.4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy

ভালোবাসা কারে কয়

ভালোবাসা কারে কয়

5 mins
209



আজ সোমবার সপ্তাহের প্রথম দিন চারিদিকে যেন শুধু ব‍্যস্ততার ছাপ!!!! তবে এই ব‍‍্যাঙ্গালোর শহর যেন সবসময় ব‍্যস্ত। সারাদিন রাত ধরেই চলে ব‍্যস্ততা। এই শহর ঘুমায়না সবসময় যেন জেগেই থাকে। এই একমাস হল পূজারা এই শহরে এসেছে। কারন দেবাশীষের ট্রান্সফারেবল জব। আজ এই শহর তো.... বছর তিনেক পর অন‍্য এক নতুন শহর। তবে একদিক থেকে ভালো, কত নতুন নতুন শহরের সাথে পরিচয় হয় ওদের। সবাই যে.... যার নিজ নিজ কাজে ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে সকাল থেকেই। কোন ভোরে উঠে স্নান সেরে ঠাকুর পূজো করে পূজা রান্নাঘরে ঢুকেছে। আজ রুহির স্কুলের প্রথম দিন, সকাল থেকেই মেঘলা আকাশের মোটা চাদরের তলায় সূর্য লুকিয়েছে, কিন্তু কিছু করার নেই আজ প্রথম দিন যেতেই হবে। সমস্ত কিছু কাজ গুছিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে পূজা ঢুকল বেডরুমে। তখনও বাবা আর মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পড়ে রয়েছে। তাদের কোন চিন্তা, ভাবনা কিছুই নেই। এই বাবা আর মেয়ে দুজনেই সমান একেবারে কুম্ভকর্ণ। সকাল সকাল এদের উঠানোর জন‍্য পূজাকে একরকম যুদ্ধ করতে হয় প্রতিদিন। তবে এতে পূজার বিরক্ত লাগেনা বরং একটা অন‍্য রকম আনন্দ অনুভূত হয়।

অবশেষে অধ ঘন্টার দীর্ঘ ডাকাডাকির পর ওনারা ঘুম থেকে উঠলেন দয়া করে। বাবা বাথরুম ঢুকলেন ফ্রেস হতে আর মেয়ে একবার এঘর থেকে ওঘর ছোটা ছুটি করতে লাগল। পূজা মেয়েকে ধরে আদর করে ফ্রেস করিয়ে স্কুল ড্রেসে রেডি করে খাওয়াতে লাগল। তারপর দেবাশীষ আর ও একসাথে খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। দেবাশীষ যাবে অফিস আর পূজা যাবে রুহিকে স্কুলে দিতে। এই হলো পূজার জীবনে প্রত‍্যেকদিনের ডেইলি রুটিন। পূজা স্কুটি টা.... রেখে রুহির হাত ধরে স্কুলের ভীতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, দারোয়ানের সাথে কথা বলে ঘুরতে যাবে সেই সময় কারোর সাথে জোড়ে ধাক্কা খেয়ে উহু... বলে চিৎকার করে উঠল পূজা।

----------স‍্যরি....স‍্যরি... শব্দ শুনে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে সামনের মানুষটাকে দেখে পূজা আর স্থির থাকতে পারলনা। পিছন থেকে একটা বাচ্ছার গলার আওয়াজ ভেসে আসল বাই... বাই... পাপা আই... লাভ... ইউ....তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু নিতে। 

পূজা আর এক মুহুর্ত না.... দাঁড়িয়ে স্কুটি নিয়ে ওখান থেকে বেড়িয়ে পড়ল। তবে পূজা নিজের বুকের কষ্ট কে... চেপে রাখতে পারলনা বেশিক্ষন, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। পূজা মনে মনে বলতে লাগল বেশ তো সবকিছু ভুলে ভালো থাকার চেষ্টা করছিলাম কেন আবার আমাকে অতীতের সামনে এনে দাঁড় করালে ভগবান!!!! পূজা সুখি দেবাশীষ আর রুহিকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসারে। তবুও মনের কোথাও এক কোনে একটা চাপা কষ্ট রয়ে গেছে পূজার। দেবাশীষ হয়তো সবসময় ভালোবাসাকে... জাহির করে দেখতে পারে না....!!! কিন্তু তার পূজার প্রতি কেয়ার এবং পূজার ছোটো ছোটো খুশির যেভাবে খেয়াল রাখে তাতেই দেবাশীষের ভালোবাসা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। কোন রকমে বাড়ি ফিরে চোখে মুখে জল দিয়ে পূজা আলমারী থেকে একটা কাঠের পুরনো বাক্স বার করল। যত্ন সহকারে বাক্সের ওপর জমে থাকা ধূলো টাকে মুছে বাক্সটা খুললো।

টপ টপ করে দুফোটা জল পড়ল বাক্সের মধ‍্যে থাকা অসংখ্য চিঠির ওপর। এই চিঠি গুলো এক সময় পূজার কাছে সবকিছু ছিল। সারা দিনে বাড়ির সবাই কে... লুকিয়ে কতবার এই চিঠি গুলো পড়েছে পূজা। চিঠিতে লেখা প্রত‍্যেকটা লাইন পূজার মুখস্ত তবুও পড়তে ভালো লাগত। কিন্তু সেই চিঠিই এক সময় পূজার সমস্ত আনন্দ কে দুঃখে পরিনত করে দিয়েছিল। পূজার চোখের সামনে সেই টুকরো টুকরো ভালো লাগার স্মৃতি গুলো ফুটে উঠতে লাগল।

*****************************************

পূজা তখন ক্লাস ইলেভেন। স্কুলে সরস্বতী পূজোয় সব বান্ধবীরা মিলে একসাথে আনন্দ আর হই হুল্লোড় করছিল ঠিক তখন প্রিয়াংশু, একটা রঙিন খাম দিয়েছিল পূজার হাতে,এবং বলেছিল উত্তরের অপেক্ষায় থাকব তাড়াতাড়ি উত্তর দিস কিন্তু । লজ্জায় পূজার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারন করেছিল। পূজা অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল ব‍্যাপারটা প্রিয়াংশুর হাবভাব দেখে। প্রিয়াংশু পূজার বাবার বন্ধুর ছেলে। ছোট্ট থেকেই ওরা খুব ভালো বন্ধু। স্কুলের সবাই পূজা আর প্রিয়াংশুকে সেরা জুটি বলত মানে মেইড ফর ইচ আদার। এইভাবে শুরু হয়ে ছিল পূজা আর প্রিয়াংশুর পত্রমিতালী। মনের সমস্ত কথা লেখার মাধ‍্যমে জানত একে অপরকে। কখনও কখনও রবিঠাকুরের গানও জায়গা করে নিত প্রশ্ন-উত্তরের। 

প্রিয়াংশু মেডিকেলে চান্স পেয়ে ডাক্তারি পড়তে চলে গেল। আর পূজা ভর্তি হল কলেজে বাংলা অর্নাস নিয়ে। তখনও ডাকপিয়ন এসে প্রত‍্যেক সপ্তাহে একটা করে চিঠি দিয়ে যেত পূজার হাতে। এক সপ্তাহের দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন পূজা চিঠিটা পেত তখন যেন আনন্দের বন‍্যায় নিজেকে ভাসিয়ে ফেলত। তারপর যতদিন যেতে লাগল আস্তে আস্তে চিঠির সংখ্যাও কমতে লাগল, প্রথমে মাসে একটা, তারপর দুমাসে একটা আর তারপর চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পূজা চিঠি লেখা বন্ধ করেনি, তবে সেগুলো পাঠাতেও পাড়েনি কারন প্রিয়াংশু চিঠি পাঠাতে বারন করেছিল তাই লিখে যত্ন করে রেখে দিত পূজা এইভেবে যে.... যখন প্রিয়াংশু আসবে তখন ওকে সব একসাথে দেবে। কিন্তু পূজার সেই ভাবনাও সফল হলোনা কারন, প্রিয়াংশু আর ফিরেই এলনা। তারপর বেশ কিছু বছর পর একটা বিয়ের কার্ড এর সাথে একটা শেষ চিঠি এসেছিল প্রিয়াংশুর পূজার কাছে। পূজার বুঝতে অসুবিধা হয়নি কার্ডটা কার বিয়ের তবুও নামটা দেখতে চেয়েছিল। কার্ডের ওপরে বড় বড় করে লেখা ছিল প্রিয়াংশু ওয়েডস দেবলীনা। পূজার চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়েছিল কার্ডের ওপর। কারন পূজা মনে মনে এইরকম কার্ডের কল্পনা করে রেখেছিল যেখানে প্রিয়াংশুর সাথে ছিল ওর নাম। আর চিঠিটাতে লেখা ছিল......

ডিয়ার, পূজা....

এতদিন তোকে জানাতে পারিনি আমার আর দেবলীনার সম্পর্কের ব‍্যাপারে। তুই কি রকম রিয়াক্ট করবি সেই ভেবে। কিন্তু এখন তো আর লুকিয়ে লাভ নেই, আসলে কি বলত আমাদের সম্পর্কটা একটা অল্প বয়সের মোহ ছিল। সত‍্যি কারের ভালোবাসা ছিলনা। তবে সে যাই হোকনা কেন আমি আজও তোকে আমার খুব ভালো বন্ধু মনে করি। তাই আশা রাখি তুই সমস্ত কিছু ভুলে আমাদের বিয়েতে নিশ্চয়ই আসবি বন্ধু হিসাবে। আর আমি মন থেকে চাই তুইও পুরনোকে আঁকড়ে ধরে না থেকে নতুন করে সবকিছু শুরু কর। 


ইতি, প্রিয়াংশু।


পূজা সেইদিন খুব ভেঙ্গে পড়েছিল এবং নিজের জীবন শেষ করে দেবে মনে মনে ভেবেওছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূজা নিজের মনের কষ্টকে জয় করে ওঠে দাঁড়িয়ে ছিল, এবং নতুন করে জীবন শুরু করেছিল শুধু মাত্র দেবাশীষের বন্ধুত্বের জোড়ে। সত‍্যি আমাদের জীবনে এইরকম একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন যে.... নিঃস্বার্থ ভাবে শুধু ভালোবেসে যাবে তার বিনিময়ে কোনকিছু দাবী করবেনা। দেবাশীষই প্রথম পূজাকে বুঝিয়েছিল ভালোবাসা আসলে কি? দেবাশীষ পূজাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল, তাই পূজাও দেবাশীষের হাত ধরে নতুন জীবন শুরু করেছিল।

তবুও কোথাও যেন প্রিয়াংশু রয়েগেছিল পূজার জীবনের সাথে জড়িয়ে, তাই এত বছর পর প্রিয়াংশুর মুখোমুখি হয়ে পূজা নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। তবে আজ পূজা সবকিছুকে একে বারেই শেষ করে দিতে চায়, কোন কিছুকেই রাখতে চায় না জীবনের সাথে জড়িয়ে। পূজা চোখের জলটা মুছে সমস্ত কিছু ভালো করে কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে বাক্সটাকে আগুন ধরিয়ে দিল। পূজার চোখের সামনে তার প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন গুলো একটু একটু করে পুড়ে ছাই হতে লাগল।

সত‍্যি জীবনে সব স্মৃতিচিহ্ন কে যত্ন করে আগলে রাখা উচিত নয়। কিছু কিছু চিহ্ন কে সময়ের সাথে নিঃশেষ করে দিতে হয় নাহলে সেই অতীতের চিহ্ন এক নিমেষেই বর্তমানের সমস্ত আনন্দকে দুঃখে পরিনত করে দিতে পারে।

আজ পূজা পুরোপুরি অতীত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল। পূজার মনের মেঘলা আকাশে ঝলমলে সূর্যের আলোর দেখা মিলেছে। পূজা নিজের মনকে ঠিক করে দেবাশীষ কে ফোন করে রুহির স্কুলের সামনে চলে আসতে বলল। তারপর হাসতে হাসতে বেড়িয়ে পড়ল মেয়েকে আনতে। স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে দেবাশীষের হাত ধরে এগিয়ে চলল নতুন করে আবার এই চেনা মানুষটাকে আরও ভালো করে চিনতে। এবং সম্পর্কের ভীতটাকে আরও মজবুত করতে। আবার নতুন করে নতুন অনুভূতিকে সাথে নিয়ে জীবনের বাকি পথটা এগিয়ে চলতে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance