ভাই বোন চিরদিন
ভাই বোন চিরদিন
জানলার লোহার গরাদ ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট সাত বছরের বাবলু । তার দৃষ্টি স্থির , দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল।
" এই, তাড়াতাড়ি নীচে আয় খেতে!" সিস্টার মালার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার।
খবরটা শুনে থেকেই বাবলুর মনের মধ্যে জমছে মেঘ, মাঝেমাঝে উঠছে ঝড়।
" এ তো খুব সুখবর বাবলু!" বলেছিলেন সিস্টার রিতা, " ওর ভালো হবে, কত সুখে থাকবে তোর তারা!"
" হ্যাঁ, এটাই নিশ্চয়ই ঠিক।" ভাবলো বাবলু, কিন্তু তার মন যে মানতে চায়না।
তার মনে পড়ে এক বছর আগের সেই দিনটির কথা -- যেদিন সে প্রথম এখানে থাকতে আসে। সে তার কৃষক বাবার পাঁচ সন্তানের একজন- কোনোদিন কলকাতা আসেনি এর আগে। প্রথম প্রথম তার গ্রামের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াত -- সেই সবুজ ধানক্ষেত, ভাইবোনদের সঙ্গে গাছে চড়া, তাদের ছোট্ট নিটোল মাটির বাড়ি, রং করা পাখিগুলো আর মিশকালো তারায় ভরা রাতগুলো।
বাবলুর ছোট বোন তারা জন্মানোর কয়েক মাস পর একদিন তাদের মা বললেন যে সে আর তারা এরপর থেকে কলকাতার এক হোমে থাকবে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ।
" কেন মা?" কেঁদে উঠলো বাবলু, " এখানে কেন থাকতে পারব না আমরা?"
মা চোখের জল মুছে বললেন, " তোদের যে পেট ভরে খেতে দিতে পারিনা বাবু!"
" এভাবে শাস্তি দিওনা মা আমায়!" আরও জোরে কেঁদে উঠেছিল বাবলু, " আমি আর কোনোদিনও বলবো না আমার ক্ষিদে পেয়েছে!"
মা তাকে জড়িয়ে ধরেন, " এটা শাস্তি নয় রে সোনা, এ তোদের ভালোর জন্য। কত বাচ্চাদের সঙ্গে থাকবি, পেট ভরে খাবি, লেখাপড়া শিখবি আর যদি কপাল ভাল হয়, তবে হয়ত কোনোদিন কোন পরিবার তোদের..." কান্নায় গলা বুজে যায় মায়ের।
সেই রাত্রে ঘুমায়নি বাবলু-- আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, ছোট্ট তারা তো অন্ততঃ থাকবে তার সঙ্গে। ওরা "মাদার টেরেসা" র হোমে যাচ্ছে, কানে এসেছিল বাবলুর। অজানা, অচেনা সেই নামটির কিছুই বুঝলো না সে।
বাবলুর বন্ধু রাজু তার জামা ধরে টানলো। " চল ভাই নীচে চল, নয়ত সিস্টার মালা কিন্তু খুব বকবে!" রাজু জড়িয়ে ধরলো বাবলুকে, " কাঁদিস না রে, তারার ভাগ্য খুব ভাল। ও এত ছোট যে ওদেরই নিজের বাবা মা জেনে বড় হবে। আমাকে তো একদিন সিস্টাররা শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে তুলে এনেছিল -- কিন্তু কই, কেউ তো আমায় আজও দত্তক নেয়নি। "
দত্তক শব্দটি বাবলু এখানে এসে শিখেছে। তার কিছু বন্ধু নতুন জামা পরে, নতুন বাবা মায়ের সঙ্গে হাসতে হাসতে এখন থেকে চলে গেছে। কিন্তু তাই বলে তারা...? সে তো তার একমাত্র কাছের মানুষ ! সে সবে হাঁটতে শিখেছে-- আধো আধো গলায় তাকে " দাদা" বলতে শিখেছে।
" ও তো আমায় ভুলেই যাবে!" বলেছিল বাবলু সিস্টার রিতাকে, " ও জানবেই না যে আমি ওর দাদা...আর আমি ওকে কত ভালোবাসতাম।"
দেখতে দেখতে সেই দিনটি এসেই গেল। তারার নতুন বাবা মা ওর জন্য নতুন জামা নিয়ে হাজির। এখন থেকে তারার নামের পর নাকি ওদের পদবী বসবে -- এও শুনল বাবলু। সে দৌড়ে ওপরে চলে গেল -- তারার চলে যাওয়ার মুহুর্তে সে সামনে থাকতে চায়নি। শুধু তারাকে শেষবার দেখার জন্য জানলার ধরে অপেক্ষা করতে লাগল।
হঠাৎ সিস্টার মালা ঘরে ঢুকে বললেন, " বাবলু, এক্ষুনি নীচে এস!"
" তারা কি চলে গেছে?" জিজ্ঞেস করল সে, কিন্তু উত্তর পেলোনা।
নীচে এসেই সে আড়ষ্ট হয়ে গেল -- ওই তো তারা তার নতুন মায়ের কোলে বসে হাসছে।
" এস বাবলু," বললেন সিস্টার রিতা, " এদের সঙ্গে পরিচয় কর, মিস্টার এন্ড মিসেস গুপ্ত -- তোমার নতুন বাবা মা। বাবলু চমকে উঠল!
" হ্যাঁ," বললেন সিস্টার রিতা শান্তভাবে, " ওনারা যখন শুনলেন যে তারা ও তার দাদা সারা জীবনের জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছে, তখন ওনারা তোমাকেও দত্তক নিতে চাইলেন।"
চার বছর পর...
আজও জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাবলু -- কিন্তু এ তার নিজের ঘরের।
" দাদা! তাড়াতাড়ি আয়, রাখী পরানোর সময় হয়েছে যে! " বাবলু ঘুরে দেখল, তার ঘরের দরজায় ঘাগরা পরে দাঁড়িয়ে তার আদরের বোন তারা ।