বধূ যখন বেশ্যা পর্ব এক
বধূ যখন বেশ্যা পর্ব এক
" চলো ভাই , বালতি সরাও .... লাইন এগোচ্ছে ... "
উর্যার ভাবনার সুতো গুলো ছিঁড়ে এক লমহায় জট পাকিয়ে গেলো । বালতিটা কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে দিতে দিতে অন্যমনেই একটু ম্লান হাসলো । এই তো কয়েক বছর আগের কথা , কি ছেলেমানুষিই না ছিলো তার কল্পনায় । জানতো না বাস্তব কাকে বলে , ধারণা ছিল না কতটা নিষ্ঠুর উপহাস হয়ে যেতে পারে জীবনটা ! লাইনের পিছন দিকে একটা খুচরো ঝামেলা শুরু হয়েছে । ওটা স্বাভাবিক রোজকার ব্যাপার ওদের এখানে । এবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়বে দ্রুত লয়ে , মা মাসি নিয়ে কথা উঠবে । খিস্তির বন্যা বইবে বর্ষার ভরা কালো নোংরা জলে ভরা পয়প্রণালীর মতো । একবার উর্যা ভাবলো থামাতে যাই তার পর নিজেকে আটকে নিলো । আজ মনটা বড্ড ভারি হয়ে আছে । এই জলের লাইনে দাঁড়ানো , ঝগড়া বিবাদ সব ছাপিয়ে ওর মনে উকি দিয়ে যাচ্ছে এক মেঘলা সকালের মনখারাপের গন্ধ । স্মৃতির পাতা গুলো অন্য একটা অশনি সংকেত কে বার বার অবাঞ্ছিত প্রবেশ করতে অনুমতি দিচ্ছে । উর্যা থাকে কাদারোড এর বিখ্যাত যৌনপল্লীতে । বস্তি এলাকা , তার ধার ঘেঁষে চলে গেছে বড় রাস্তা । সারাদিন এক বুক খিদে নিয়ে আসা খদ্দেরদের দরকষাকষি । রাস্তার ধারে লাগানো টাইম কলের জলের জন্য ভোর থেকে হাঁড়ি কলসির লম্বা লাইন । নিত্য দিনের সঙ্গী ঝগড়া বিবাদ , কথা কাটাকাটি ও খিস্তির বন্যা । খদ্দের নিয়ে টানাটানি থেকে শুরু হয় চর থাপ্পড় আর চুলোচুলি । লোকজন কিছুক্ষণ মজা লুটে তার পর মিটমাট করবার জন্য এগিয়ে যায় । এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে উর্যার । অথচ উর্যার জন্য কি এই জীবনটা ছিলো ! বস্তির আর পাঁচটা মেয়ের মতো মুখ খারাপ করেনা সে । পড়শীরা তাকে একটু আধটু সমীহ করেই চলে । একসময় সেও কত আকাশকুসুম কল্পনা করতে থাকতো নিজের আগামীদিন নিয়ে । সেইসব দিনের কথা মনে পরে যখন ছেলেরা ওকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন দেখতো , ভালোবাসতে চাইতো । আর আজ উর্যা যেন একটা অচল পয়সা মাত্র । তার একটা পুরুষের ভোগ করার জন্য শরীর তো আছে কিন্তু তাতে আত্মা নেই । যেন ক্লান্ত , দলিত মথিত শরীরটা শুধুই বয়ে বেড়ানো এক প্রেত উর্যা । আর জলের জন্য হা পিত্যস করে দাঁড়ানোর সময় নেই মথুরা বাবুর আসার সময় হয়ে গেছে । উর্যার কঙ্কালসার হৃদয়টাকে ঢেকে ফেলতে হবে মেকআপের আস্তরণে । মায়াময় দুটো চোখ , বাঁকা ভুরু , লাল চিকচিকে ঠোঁট আর উন্নত তনুর তরোয়াল যার ফাঁকে ফাঁকে উকি দেবে শরীরী লাস্য । মথুরা বাবুর পর আরো কয়েকজন আসবে আজ রাত পর্যন্ত হয়ত কাউকে কাউকে ফিরিয়ে দিতেও হবে তবুও উর্যার শরীরটাকে নয় নয় করে চার পাঁচটি চিল শকুনে তো ছিঁড়ে খাবেই ! মথুরা বাবুর জুয়েলারির আউটলেট আছে দুর্গাপুর , কলকাতা , শিলিগুড়ির মতো বিভিন্ন শহরে । উনি বড়লোক , চাইলে অনেক খরচ করে দামি হোটেলে যেতে পারেন চাহিদা পূরণ করতে , দামী আভিজাত্যময় বেশ্যাদের নিয়ে । তবুও উর্যার জানা নেই কেনই বা প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে উনি আসেন । ব্যবসায়ী মানুষ তাই সময়ের হিসাব ভীষণ পাক্কা । উনি বিকেল সাড়ে চারটে বাজলেই ওনার দামি গাড়ি থেকে নেমে ঘুপচি গলির এক রাতপরির ঘরে টোকা দেন । আবার পাক্কা এক ঘন্টা পর উনি চলে যান । মথুরা বাবু খুব কম কথা বলেন তবে মানুষ হিসেবে ওনাকে একশোতে উর্যা কত দেবে ? একশো তো দেওয়া যায় না কারণ বাড়িতে স্ত্রী থাকতেও মধ্যবয়স্ক মথুরা মোহন সান্যাল এক বেশ্যার সাথে শরীরের খেলা করতে আসেন । তার পরেও অন্যদের থেকে উনি আলাদা । উর্যার কাছে বেশ কয়েকটি উচ্চবিত্ত খদ্দের আসেন । তাদের মধ্যে কেউ খুব কিপটে ... মাগীবাজি করার ইচ্ছা আছে তবে দামি এসকর্ট সার্ভিসকে মোটা টাকা দিতে মন কাঁদে তাই কম টাকায় পুষ্টিকর খাদ্যের মতো উর্যার দুয়োরে আসা । কেউ আবার এসকর্ট সার্ভিস নিয়ে নিয়ে থকে গিয়ে নতুনত্ব খুঁজতে এখানে আসে । ওদের যেমন বউ ঘরকা মুরগির মতো তেমন এক ঘেয়ে এসকর্টদের ন্যাকামি ভরা বেশ্যাবৃত্তি ও ডালের মতো এক ঘেয়ে । অনেক আসেন যারা স্ট্যাটাস অনুযায়ী দামি এসকর্ট ভাড়া করতে গেলে ধরা পড়ে যাবেন সন্দেহবাতিক স্ত্রীর কাছে । কিন্তু মথুরা বাবুর এখানে আসার জন্য এসবের কোন কারণেই কার্যকর নয় । উনি যখনই আসেন সঙ্গে করে নিয়ে আসেন উর্যার বাচ্চা মেয়েটার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার , হাইজিন মেন্টেন করার জিনিসপত্র , নানান রকমের ফল , সবজি ইত্যাদি । উনি বড়লোক চাইলে উর্যাকে টাকা দিয়ে মানবতা দেখতে পারতেন কিন্তু উনি সেটা না করে ওদের মা মেয়ের যে গুলি প্রয়োজন ভেবে ভেবে এক গৃহকর্তার মতো নিয়ে আসেন । কতজনই বা করে এত কিছু তাও এক গণিকার জন্য ? উর্যার সাথে যে কাজের জন্য উনি আসেন সেটা সেরে হাতে সময় সেরকম থাকে না ।তবুও উনি স্পষ্ট আশ্বাস দিয়েছেন যদি উর্যা চায় উনি ওদের মা মেয়ের থাকার জন্য একটা ভালো ব্যবস্থা করে দেবেন । উর্যা কোন জবাব দেয়নি । ওর সাথে যা যা ঘটে গেছে অতীতে ও খুব সন্তর্পণে সিদ্ধান্তে আসে । কারণ একটু বেসামাল হলেই খাদের মধ্য গিয়ে পড়তে হবে মা মেয়েকে । নিজের জন্য না মেয়েটার জন্য আতঙ্কে থাকে উর্যা । কারোর ভরসায় এই যৌনপল্লীর নোংরা হোক তবু নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে যদি বিপদে পড়ে ? তা হলে তো এই তথাকথিত অসামাজিক আশ্রয়টা ও হাতছাড়া হয়ে যাবে ! গুনগুনকে এখানে রেখে বড়ো করতে ভয় হয় তবুও ওকে হোস্টেলে দিতে হতভাগী মায়ের বুক টাটাতে শুরু করে । মথুরা বাবুকে বললেই হয়ত উনি গুনগুনকে হোস্টেলে রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করেই দেবেন তবে এসব সম্পর্কে কোন স্থায়িত্ব নেই ! আজ আছে কাল নেই । তখন কি করবে উর্যা ? পারবে লাখ টাকা খরচ করে মেয়েকে পড়াতে ? গুনগুন অঙ্গনওয়ারী স্কুলে যায় , ওখানে সহায়িকা দিদিমণি ওকে পড়ায় । মাত্র তিন বছর বয়স গুনগুনের ও একা হাতে গরম খিচুড়ি খেতে পারেনা । দিদিমণি অভিলাসা ওকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয় । উর্যা একটা লাল সবুজের শিফন শাড়ি পড়েছে সঙ্গে ম্যাচিং সবুজ ব্লাউজ আর অক্সিডাইজ হার কানের । প্রায় সব খদ্দের বলে উর্যা ইউ আর হট ... তুমি একদম আলাদা অন্য রেন্ডিদের থেকে । উর্যা মনে মনে হাসে .. নিজের মনেই বলে , যতই আলাদা হইনা কেন তোমরা তো আমাকে রেন্ডি বলেই অভিহিত করবে । আমাকে একবারও তোমাদের ঈশ্বরী মনে হবে না ? আমি যতদিন যৌবনবতী ততদিন বর্ষার বারী ধারা মনে হবে আমাকে আর বয়সের ছাপ পড়লেই আমি তোমাদের কাছে শীতের রুক্ষতাতে পরিনিত হবো । একটা দরমার ঝুপড়িতে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বাস করা উর্যার অতীত কিন্তু অন্য । সে একদিন ছিলো আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সাধারণ , সাদামাটা ।
মথুরাবাবু এলেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটের সময় । আজ মথুরা বাবুর তাড়া আছে , একমাত্র ছেলে মার্কণ্ডেয়র কালই রোকা সেরিমনি । একটা ছেলে তাও একটা পাঞ্জাবি মেয়েকে বিয়ে করছে । মথুরা বাবুর কোন কথাই সে শুনলো না । উল্টে গিন্নি সতী নিজে দায়িত্ব নিয়ে ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করছে । গিন্নির হুকুম সাতটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসতে হবে , তার নাকি কাজ আছে । সারা সপ্তাহে এই একটা দিন তাও একঘন্টা মাত্র , উর্যার কাছে এসে একটু শান্তি পায় । তো সেই দিনটাও তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হচ্ছে তাকে । গাড়ির দরজা বন্ধ করে এসি চালিয়ে সে মাথাটা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল। সমস্ত শরীর এখনো দরদরিয়ে ঘামছে, কানে বাজছে উর্যার শীৎকার, সমগ্র শরীরে অনুরণন হচ্ছে। উর্যা, নামের মতই এনার্জি তে ভরপুর । মেয়েটি তন্বী শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যেন আগুন। ওকে দেখার পর থেকেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়েছে স্বর্নব্যবসায়ী মথুরা বাবু। পৈতৃক সোনার দোকানকে এক এক করে আউটলেট বাড়িয়ে দ্বিগুন থেকে চারগুন করতে করতে জীবনে তেমন কিছুই ভোগ করা হয়নি । ব্যবসার বর্তমান কর্নধার হিসেবে মথুরা বাবুর জন্ম সোনার চামচ মুখে নিয়ে হলেও খুব সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করছেন তিনি । জীবনে অভাব অনটন তো দূরের কথা, কষ্ট কাকে বলে কখনো বোঝেনি তবুও সাধারণ মানুষের কষ্টে তাদের যথাসম্ভব সাহায্য করতে সদা এগিয়ে আসেন । প্রাচুর্য, মান সম্মান, খ্যাতি সব আছে আর তার সাথে আছে ইশ্বরপ্রদত্ত রূপসী স্ত্রী সতী । যার মোহে যৌবনে বয়সে আকৃষ্ট হয় তার দিকে পতঙ্গের মতো ধেয়ে যান মথুরা বাবু আর নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই মথুরাবাবুর গণিকালয় যাওয়া শুরু । তার পর সতীর সাথে বিয়ের পর সেটা কমে এলেও একেবারে মুছে দিতে পারেননি । তবে এখন উর্যার সাথে আলাপের পর থেকে অন্য মেয়ের দিকে ঘুরে দেখতেও মন চায়না । সতীর সাথে দাম্পত্যর সম্পর্ক অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে । এখন শুধুই দেওয়া নেওয়ার , কেজো সম্পর্ক ।
উর্যার আর শরীরটা টানছে না । রাত সাড়ে এগারোটা এখনো একজন খদ্দের আসতে চাইছে কিন্তু উর্যা না করে দেয় । ওদের গলিটা যত রাত বাড়ে তত জীবন্ত হয়ে ওঠে । এখানকার অনেক বেশ্যার মেয়েরা বড়ো হয়ে বেশ্যা হয় আর ছেলেরা মেয়ের দালাল । এখন পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে কারণ স্বেচ্ছাসেবক দলেরা এসে সকলকে বোঝায় যে তারা যেন সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলে । তাদের এই জীবনে আর নিজেদের মতো না টেনে আনে । এখানে সারারাত ব্যবসা হয় । বেল ফুল , জুঁই ফুল বা গোলাপের পসরা নিয়ে সান্টু বসে থাকে খদ্দেরদের জন্য । পান গুমটি গুলো পান সাজার সাথে সাথে চোলাই ও বিক্রি করে লুকিয়ে । মাঝে মাঝে পুলিশ আসে , রেড এর নাম করে লুটে চলে যায় । তাদের নারীদেহ ও লাগে আবার কাঁচা টাকাও । বুলটির বুড়ি মা আগে এই এলাকার নাম করা বেশ্যা ছিলো তার পর রূপ ঢলে পড়ে যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে । এখন বুলটির মা মানে মনদা মাসি এক ডেকচি মাংসের চোসতার ঘুগনি নিয়ে বসে । ওই থেকে আয় মন্দ হয়না তার । সাধারণত দেখা যায় সন্তান জন্ম হবার পর পুত্র সন্তান হলে সবাই বেশি খুশি হয় তার কারণ দেখানো হয় সে ভবিষ্যতে বংশে বাতি দেবে বা বংশ রক্ষা করবে । কিন্তু আদতেই কি তাই ? তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত যে পুরুষ রোজগেরে । তাই পুত্র জন্ম মানে মা বাপের বুড়ো বয়সে ভাতের জন্য চিন্তা করতে হবে না । বেশ্যাপট্টিতে কিন্তু নিয়মটা উল্টো । এখানে কন্যা সন্তান জন্ম হলে সকলে খুশি হয় । কারণটা আগের মতো একই । কন্যা সন্তান তার মায়ের পেশা অবলম্বন করে বৃদ্ধ বয়সে মায়ের পেট চালাবে । এখানে পিতা গুরুত্ব রাখে না । কে কার পিতা সেটা কেউ খোঁজ রাখে না । উর্যা ভাবে তার ও তো একটা মেয়ে আছে সে কি ভবিষ্যতে তার মায়ের মতো ? উর্যা কেঁদে ওঠে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় , না না এটা হবে না কোনদিন । অন্যদের থেকে গুনগুন আলাদা । গুনগুনের বাবার পরিচয় আছে , তার মা জানে তার সন্তানের পিতা কে ? গুনগুনকে উর্যা কিছুতেই এই নরকে গুমরে গুমরে মরতে দেবে না । আগামী বুধবার মথুরা বাবু এলেই উর্যা ওনাকে বলবে গুনগুনের একটা কিছু ব্যবস্থা করতে । দরকার নেই নামি দামি স্কুল হোস্টেল , উর্যার সাধ্য কুলবে এমন কোন স্কুলে গুনগুনকে পাঠিয়ে দেবে সে । গুনগুনের বয়স এখন খুব কম , কিছুই বোঝেনা মেয়েটা তবে বুঝতে পারবে একদিন সবকিছুই । আর তার পরে লোভী চোখ গুলো তো আছেই চারদিকে যারা খুবলে খাবে ওকে । যে বাচ্চাটার জন্ম হয়েছিল লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নামি দামি হসপিটালে তাকে আজ ঝুপড়িতে থাকতে হচ্ছে কারণ তার প্রাণ বাঁচাতে তার মাকে এই সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছিল একদিন । গুনগুনের একটাই দোষ ছিল সে ছিল কন্যা সন্তান । উর্যার মতো ধৈয্যশীলা মেয়ে সেদিন বাঘিনী হয়ে উঠেছিল কারণ সন্তানকে রক্ষা করার তাগিদ । ওই রক্তের ডেলাটার জীবন বাঁচাতে এক শান্ত পতিব্রতা স্ত্রীকে রণচন্ডী মহাশক্তিতে পরিবর্তিত করে দিয়েছিল । উর্যা খুনি , সে তার স্বামীকে খুন করে পালিয়ে এসেছিল । যাকে একদিন ভীষণ ভালোবাসত , যার দীর্ঘ আয়ু কামনা করে সে তার সিঁথি সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে রাখতো । যাকে ছাড়া একদিন বছর খানেক মনে হতো সেই ঋষিকে কি করে নিজের হাতে উর্যা শেষ করে দিয়েছে এটা ভাবতে গিয়ে তার নিজের জীবনের আরো অনেক কথা মনে পরে গেলো l
ওর যখন জন্ম হয় ওর মায়ের মৃত্যু হয় । ঠাকুমা ওর বাবা কে বলেছিলো "তোর মেয়ে কুলক্ষনা "। মা মারা মেয়েটাকে বাবা বুকে জড়িয়ে ভেবেছিল কি করে মেয়েকে তার মা ছাড়া মানুষ করবে ? " বাবা যতদিন বেঁচে ছিল মেয়ের ঢাল হয়ে তাকে আগলে রেখেছিল । সংসারে অভাব ছিল না , চাইলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু স্ত্রী বিয়োগে খুবই ভেঙে পড়েছিল তাই বাকি জীবন মেয়েকে ঘিরেই বেঁচে ছিল l মেয়ের দিকে ইচ্ছা থাকলেও মায়ের মতো করে ওতো নজর দিতে পারত না l ঠাকুমা ছেলের অত কম বয়সেই বিপত্নীক হয়ে একা হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি । উর্যাকে কেমন যেন অছেদ্দা করতেন । বলতে গেলে একা একাই বড়ো হয় সে l খুব একটা বন্ধু বান্ধবী ছিল না কোনদিন , ঠাকুমা কারোর সাথেই মিশতে দিত না । মা মরা মেয়ে, বাবাও সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে । ঠাকুমা ভাবতো একটু বড়ো হলে অপদকে শশুরবাড়ী পাঠালে শান্তি । পড়াশোনা তে কোনদিনই ভালো হতে পারেনি উর্যা । ফলস্বরূপ মাত্র আঠেরো বছরের হতেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিল ঠাকুমা । বাবার কোন কথাই ঠাকুমা শোনেনি । কলেজ পর্যন্ত যাবার সুযোগ মেয়েকে তার বাবা করে দিতে চাইলেও পারেনি । উর্যার তাই কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন কিছুই নেই । অবশ্য বিয়ের পরে স্বামী ঋষিকে পেয়ে কোন দুঃখকষ্ট আর ছিলোনা তার । বাপের বাড়িতে ঠাকুমার সাথে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে বাঁচার পর শশুরবাড়ী এসে দক্ষিণের হাওয়ার মতো তার জীবনে আসে ঋষি l
সারাদিনের বেশির ভাগ সময় টাই কাটাতো বাড়ির লোকজনের সাথে l আসতে আসতে উর্যাআর ঋষি একে অপর কে ভালোবেসে ফেলে l ঋষির প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি ! কাজের লোক রান্নার লোক সব আছে । বাড়ির সামনে সবসময় দাঁড়িয়ে বড় বড় নামি ব্র্যান্ডের গাড়ি । উর্যা ভাবত হয়ত তার পড়াশোনা শেষ হলোনা তবুও এই বিয়ের জন্য ঠাকুমার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য । ঋষির মতো ভালো স্বামী পেয়েই তো সে প্রাণ খুলে বাঁচতে শিখেছে ।
ঋষি ইঞ্জিনিয়ার হলেও তার বাবার লেদারের ব্যবসা দেখাশোনা করছিলো l ওরা খুবই ধনী, সম্বলপুরের ওদের বনেদি বাড়ি l উর্যা খুব নিশ্চিন্ত ছিল ঋষি কে পেয়ে l সে তার মন প্রাণ সমস্ত কিছু নির্দ্বিধায় উজাড় করে দিয়েছিল । একসময় উর্যা প্রেগনেন্ট হলো । শশুর শাশুড়ি বা ঋষি সকলে ওকে যেন হাতের তালুতে রেখে দিলো । এত যত্ন নিতে লাগলো উর্যার খুব অশ্বস্তি হতো । কিন্তু একটা কথা তিনজন বার বার মনে করিয়ে দিতে লাগলো হবু মাকে , যেন বংশে বাতি জ্বালানোর লোকই আসে । উর্যার শুনে খুব অবাক লাগতো , এই ছেলে না মেয়ে জন্ম নেবে ? এটা কি তার হাতে ? তবে মনে বিশ্বাস ছিল ওরা যাই বলুক না কেন , বাচ্চা হবার পর ওরা যাই হোক ছেলে বা মেয়ে আদরে ভরিয়ে দেবে । ধুমধাম করে সাধের আয়োজন করা হলো ।আর এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্বলপুর আসতে গিয়েই একটা একসিডেন্ট এ বাবা ঠাকুমা দুজনেই মারা যায় । উর্যার সাধের ভাজা পোড়া এসব দিতে আসছিল দুজনে আর একটা সড়ক দুর্ঘটনায় দুজনই শেষ হয়ে যায় । ওই সময় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো... পায়ের তলার মাটি সরে যেতে লাগলো l এটা কি ঘটে গেলো তার সাথে...কেন হোলো এরকম ? কেন...?
আর তার পর পরই ঋষির পরিবারের আসল চেহারা দেখতে পায় উর্যা । চিন্তার জাল কেটে বর্তমানে ফিরে আসে সে ,গুনগুন ঘুমের মধ্যে ডাকছে মাম্মা হিসি পেয়েছে । ওকে নিয়ে হিসি করিয়ে আবার শুইয়ে দেয় । বর্ষাকাল তাই সারা আকাশ কালো হয়ে আছে রাত থেকে ভোর হয়ে গেলো, এখন ভোর পাঁচ টা, কিছুক্ষণ পরে হয়ত আকাশ ভাঙা বৃষ্টি শুরু হবে....সারা রাত কেটে গেলো....দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি উর্যা । কার কথা ভেবে রাত কাবার করলো সে ? তার আইডিয়াল ফ্যামিলি ম্যানের অভিনয় করা স্বামী ঋষি ? কায়দা করে কথার মায়াজালে আবদ্ধ করে মেয়েদের বিছানায় নিয়ে এসে , তাদের ব্যবহার করতে হয় এবং তারপর তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কৌশলে সিদ্ধহস্ত ঋষি ? যাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রীর হাতে মরতে হলো !
চার বছর আগের কথা .... বাবা আর ঠাকুমার আকস্মিক মৃত্যুর পর উর্যা শোকে নিজেকে সামলে উঠতে পারছে না আর এদিকে শশুর বাড়ীর লোকজনের আমূল পরিবর্তন হলো যেন রাতারাতি ! উর্যা যেন চোখের বিষ হয়ে গেল সবার কাছে । কি বাবা , মা কি ছেলে সবার মুখে এক কথা উর্যার লক্ষণ ভালো না । জন্মে মাকে খেয়েছে এখন ওর সাধ দিতে এসে বাবা আর ঠাকুমাটাও গেল । আপদ নেহাত এ বংশের বাতি পেটে ধরেছে না হলে ওকে ধার ধাক্কা দিয়ে বার করে দিত । উর্যাকে ভালো মন্দ খেতে দেওয়া তো দূর কুকুর বিড়ালের মতো দুচ্চাই করতে লাগলো ঋষি আর ওর বাবা মা । সব সহ্য করে মুখ বুজে পরে থাকতেই হলো উর্যাকে । এই ভরাভরি পোয়াতি মানুষ , কোথায়ই বা যেত ? আর তো কেউ ছিলো না যে সংসারে তার কেউ । তবু পরিবারে মন .... মানসিকতার তফাৎটা সে বেশ কিছুক্ষন ধরেই লক্ষ্য করছিলেন ।
তারপর ওকে ডেলিভারির সময় হলে দামি হসপিটালে ভর্তি করলো ঋষি । তার সন্তান তো যেখানে সেখানে জন্ম নিতে পারে না ? অথচ সন্তান যে ধারণ করে আছে , সেই মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার পর্যন্ত ওরা দিত না । ওই পূর্ন গর্ভবতী অবস্থায় ওকে দিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করাতো । সিজারিয়ান করে ডেলিভারি হলো সেদিন দেবীপক্ষের সূচনা । উর্যা জানত ঋষির পরিবারে পুত্র সন্তানকে বংশের প্রদীপ আর কন্যা সন্তানকে অপয়া মনে করা হয় । উর্যার কন্যা সন্তান হওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ছোট্ট শিশুটির মুখ না দেখেই বাড়ি ফিরে গেছে । নিজেই সে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে কখনও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে....... আবার কখনও চোখের জল মুছেছে । স্নেহের ছায়ায় এক হতভাগ্য মা তার নবজাতককে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় ।
মনে একটাই প্রবোধ , সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু আরো চমক অপেক্ষা করছিল উর্যার জন্য । আজব এই পৃথিবী যেখানে বিত্তবান দের অবস্থান হীন থেকে হীনতর সেখানে উচ্চ মানসিকতা হত দরিদ্র। তবুও সন্তানের জন্মের পর হয়তো বা নারীর অস্তিত্বের অর্ধেকটা তার সন্তানকে জুড়েই বাঁচে । সেই কারণে শত অবহেলা হেলায় ঠিলে উর্যা মেনে নিয়ে ছিলো সব অন্যায় । হসপিটালের বিল মিটিয়ে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার সময় ঋষি থুতু ফেলে বলেছিল , ফালতু ফালতু এত এত টাকা গরচা গেল আমার । উর্যার বুকের ভেতরটা কেউ যেন হাতুড়ির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল তবু জানত এক বাবা তার মেয়েকে ফেলে দিতে পারবে না । একদিন ভালোবাসবে , ঠিক কোলে তুলে নেবে । বাড়ি ফিরে ওই অপারেশনের কাঁচা সেলাই নিয়েই সব কাজ ওকেই করতে হতো । অথচ হেঁসেলে ঢুকে নিজে চারটি বেড়ে যেই নস খেতে যেত , শাশুড়ি তার নিমপাতার থেকেও তেতো বাক্যবানে উর্যাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিত । উনি বলতেন , অভাগীর বেটি ! আতুর তো এখনো শেষই হয়নি ? তা সেটা কি ভুলে মেরে দিয়েছেন মহারানী ? হেঁসেলে ঢুকে সব আতুর ঘাটা করে দিলে চলবে
?
উর্যার অবাক লাগতো ! ওকে দিয়ে সব কাজ করানোর সময় আতুর ছোয়া লাগে না শুধু রান্না ঘরে ঢুকলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় । আসলে এগুলো খেতে না দেওয়া , টর্চার করার বায়না । বুকের দুধ খেয়ে মেয়েটা বেঁচে ছিলো কিন্তু উর্যার কোনদিন দুবেলা ভাত জুটত কোনদিন আবার তাও জুটত না । অত্যাচার সহ্য করতে করতে কখন যেন দেওয়ালে এসে পিট ঠেকে গেছিলো ?
সারাদিন ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন । গুনগুনের জ্বর ধুম জ্বর এসেছিল , মাত্র দু মাসের ওই টুকু বাচ্চাকে কেউ ঘুরেও দেখলো না । উর্যা তাড়াতাড়ি উঠে এলো ঋষির স্টাডি রুমে। কাঁদো কাঁদো হয়ে সে এসে বললো...
প্লিস ঋষি , আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু ওই টুকু দুধের শিশুকে এভাবে তড়পাতে দেখতে পারি না । তুমি তো ওর বাবা ? তুমি নিজের মেয়েকে মরতে দিতে পারো না । - "হ্যাঁ, বলো , যা ইচ্ছা বলো .... বাট আমি পারবো না তোমার কোন হুকুম তামিল করতে ।
- "উফফফ, কাম অন উর্যা , তুমি আর কতদিন মেয়ে মেয়ে করবে বলোতো? তোমাকে বলেছিনা আমাকে শুধু আগামীদিনে আমাদের বংশের প্রদীপের কথাই ভাববে ? "
ঋষিকে উর্যা হাতেপায়ে ধরলো কত , যাতে একবার ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় । কঁকিয়ে কাঁদছে গুনগুন , মা হয়ে মেয়েকে ওই অবস্থায় কি করে দেখে উর্যা ? একাই নিজের কাছে যে কটা গচ্ছিত টাকা পরে ছিল নিয়ে কাছের ওষুধের দোকানে ছুটে যায় সে । দোকানদার জানায় প্রেসক্রিপশন ছাড়া অত ছোট বাচ্চার ওষুধ দেওয়া যায় না । পিডিয়াট্রিস্ট কে দেখতে হবে আর তার জন্য চারশো টাকা লাগবে । ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে তার মানে প্রায় হাজার টাকা লাগবে । উর্যার কাছে তো কুড়িয়ে বাড়িয়ে মাত্র দুশোটাকা ছিল । ওই টাকা দিয়ে কিই বা হতো ? তাই বাড়ি এসে ঋষিকে খুব রিকোয়েষ্ট করলো হাজারটা টাকার জন্য । ঋষি জানালো মেয়ে তার প্রয়োজন নেই তাই ওই আপদের জন্য একটা টাকাও খরচা করবে না । একে একে শাশুরি , শশুর সকলকে ভিক্ষা চাওয়ার মত উর্যা টাকাটা চাইলো । ওরা তো এ কথাও বললো , যাক এবার যদি ঐ অলক্ষুনে টার প্রাণ টা যায় । অনেক কাকুতি মিনতি করে যখন কাজ হলো না সে অসহায় হয়ে ছুটে গেল অসুস্থ মেয়ের কাছে । সেদিন কেই বা জানতো , একটা সাধারণ মেয়ে খুনি হয়ে যাবে রাতারাতি ?

