Tania Mondal

Horror Crime Thriller

3  

Tania Mondal

Horror Crime Thriller

বছর পাঁচেক পর

বছর পাঁচেক পর

6 mins
309


১.


ঘড়িতে ঢং ঢং করে এগারো’টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই দুশ্চিন্তার কালো ছায়া সুব্রত’কে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। 

সমস্যা সমাধানের জন্য ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হাজার’বার প্রদক্ষিণ করলেও, নতুন কোনো উপায় বের হলো না। আর ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরের টেলিফোন’টা বেজে উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে মনের হাজারো দুশ্চিন্তার মধ্যে কেউ এসে যেন হাজারটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।

সুব্রত মনে মনে একবার ভাবলো, “হয়তো বিজয় তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে, তাই হয়তো সে ফোন করছে...” এইভেবে সে ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসলো, আর সঙ্গে সঙ্গে এক অজানা আতঙ্কে সুব্রতর শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। 


২. 


সুব্রত একটু বিরক্তির সুরেই বললো, “হ্যালো কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে একটা ঘেঁষঘেঁষে গলায় উত্তর এলো, “আরে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? এই তো বছর পাঁচেক আগেও আমি ছাড়া কিছুই চিনতে না। আর এরই মধ্যে বলছো, আমি কে?” এই বলে কেমন ব্যঙ্গাত্মক সুরে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। 

হাসিটা কেন জানিনা সুব্রতর ভালো লাগলো না। এবার সে বেশ ভারী অথচ ভীতস্থ কণ্ঠে বললো, “দেখুন মশাই রাত-দুপুরে আপনার সাথে মশকরা করার সময় আমার নেই। আপনার যদি সত্যিই কোনো কাজ থাকে তো বলুন, নাহলে আমি ফোন রাখছি।”

সুব্রতর কথায় ভদ্রলোক কি ভাবলেন জানিনা। তবে বেশ গম্ভীর হয়েই বললেন, “বেশ, তাহলে এবার কাজের কথায়ই আসি। তোমার হয়তো মনে আছে, আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে তুমি তোমার করা অপবাদ একজন নিরপরাধ মানুষের ওপর চাপিয়ে অতি সহজেই বেঁচে গিয়েছিলে। তাই সেবার তুমি বেঁচে গেলেও এবার তুমি আর পালাতে পারবে না। এবার সময় এসেছে তোমার শাস্তি পাওয়ার...”

কথাগুলো শোনা মাত্রই সুব্রত থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু বলার মত শক্তিও যেন আজ তার নেই। তবুও সে অতিকষ্টে তুতলে তুতলে বললো, “কে আপনি? আপনি এসব জানলেন কি করে!” 

আর সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ভেসে এলো, এক অপার্থিব হাসি। যেন কারোর অতিপুরোনো বাসনা আজ পূরণ হতে চলেছে। 


৩. 


টেলিফোনটা বাজতেই মনের মধ্যে যে হাজারটা প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল, দপ করেই সেসব যেন একমুহূর্তে নিভে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকটা নিবিড় কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল। 

সুব্রত অতীতের কথা ভাবতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল, যে সে ভুলেই গিয়েছিল তার কানে এখনও ফোনটা ধরা। কারণ ঠিক সেইসময় ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই ঘেঁষঘেঁষে কণ্ঠস্বর, যার সাথে সুব্রত এতক্ষন কথা বলছিল।

ভদ্রলোক বললেন, “তোমার কাছে শুধুমাত্র আজকের রাতটা রয়েছে। এরই মধ্যে তুমি সিদ্ধান্ত নাও তুমি কি করবে। নয়, পুলিশের কাছে সবটা স্বীকার করবে নয়...” কথাটা শেষ হলো না। তার আগেই হুট করে ফোনটা কেটে গেল। 


সুব্রত ভয়ে ভয়ে টেলিফোনটা টেবিলে রেখে বিছানায় বসে ভাবতে শুরু করে। ভয় পেলেও, মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে শুরু করে এবার সে কি করবে। প্রথমেই মাথায় এলো, এত বছর পর কেন কেউ তাকে তার অতীতের কথা নিয়ে ভয় দেখাবে। তারপরেই ভাবে এই কথাটাই বা কেউ কি করে জানবে! কারণ কাজটা সে অত্যন্ত গোপনে করেছিল, তাই ঘটনাটা কারোর জানার কথা নয়। 


এসব ভাবতে ভাবতে কেমন অস্থির হয়ে পড়ে সুব্রত। যেন ওর সমগ্র চিন্তাভাবনা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সে পাগলের মত পথ খুঁজতে থাকে, আর তখনই চোখ পরে দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে। আজ ২২ শে ফেব্রুয়ারী, আজই তো ওর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা... আর ঠিক সেই সঙ্গেই মনে পরে যায় বছর ‘পাঁচেক আগের সেই ঘটনা’, যখন নিলয় কোর্টে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমি এর বদলা নেবই। আমি নেবই এর বদলা...” কথাটা মনে পড়তেই সুব্রতর সারা শরীর বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেল। আর মনে মনে বললো, “তাহলে কি নিলয় আজ প্রতিশোধ নিতে এসেছে...” 


৪. 


আজ একমাস হলো সুব্রত মারা গিয়েছে। একে সুব্রত বিপত্নীক ছিল, আর এখন ও মারা যাওয়ার পর পুরো বাড়িটাই খালি হয়ে গেছে। নিঃসন্তান হওয়ায় এই বাড়ি উত্তরাধিকার সূত্রে কারোর পাওনা নেই, তাই বাড়িটা এখন সরকারের অধীনে।

আজ মিস্টার চ্যাটার্জী বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছেন। বাড়ি তার বেশ পছন্দ হয়েছে। একে শহরের কেন্দ্রস্থল, আর দু’য়ে অতি সস্তায় বাড়িটা ভাড়া পাওয়ায় চ্যাটার্জী মশাই বাড়িটা নিয়ে নিলেন। দেনা-পাওনা সব মিটিয়ে যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, তখন চ্যাটার্জী মশাই দালালকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা এই বাড়িটা কার ছিল?”

দালাল মিস্টার কুট্টি বলেন, “বাড়িটা সুব্রত নামের এক ভদ্রলোকের ছিল। বেশ সজ্জন মানুষ ছিলেন। শুনেছি ভদ্রলোক একসময় ব্যাঙ্কের বেশ উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। বছর পাঁচেক আগে, উনাদের ব্যাঙ্কে কর্মরত কোনো ব্যক্তি টাকা চুরি করেন, পরে যদিও তিনি ধরা পড়েন এবং জেলেও যায়; কিন্তু তারপর থেকে সুব্রত বাবুর মাথার ব্যামো হয়। কিসব ভুলভাল বলতেন, কেউ কিছুই বুঝতো না। কেউ-কেউ তো উনাকে পাগলও বলতো। এইসব কারণে চাকরি হারালেন। তারপর একেবারে ঘরে বন্দী ছিলেন, কোথাও বেরোতেন না। তারপর এই একমাস আগে উনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।”

চ্যাটার্জী মশাই বিষ্ময়ের সঙ্গে বললেন, “তা কোনো পুলিশ কেস হলো না?”

“হয়েছিল তো। কিন্তু বেশিদিন কেসটা চলেনি। একে পাগল ছিলেন, তারওপর উনার একটা চিঠি পাওয়া যায়, যাতে উনি লিখে গেছেন, উনাদের ব্যাঙ্কের টাকা চুরি নাকি উনি করেছিলেন। আর তাই তার অনুশোচনায়, উনি আত্মহত্যা করেছেন...” 


৫. 


(একমাস আগের ঘটনা) 


শুনেছি পাপ পাপ’কেও ছাড়ে না। তাই কি আজ সুব্রতর জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে এলো? 

হ্যাঁ আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে সুব্রত তেমন’ই একটা অন্যায় করেছিল, আর তাই হয়তো আজ তাকে এভাবে শাস্তি পেতে হচ্ছে! 

সুব্রত বরাবরই একটু শৌখিন প্রিয় মানুষ ছিলেন। তাই অর্থ-প্রতিপত্তি যতই থাকুক না কেন, কোনোদিন অর্থ সঞ্চয় করতে পারেনি। তাই মাসের শেষে বরাবরই অন্যের কাছে হাত পাততে হতো। আর তারপর জুয়ার নেশায় মত্ত হয়ে আরও বেশকিছু অর্থ ধ্বংস করলো, পাশাপাশি দেনার পরিমাণও বাড়তে থাকলো। আর প্রতিদিনই পাওনাদাররা সুব্রতর বাড়িয়ে সামনে এসে জটলা করতে শুরু করে। আর এই নিত্যদিনের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য, সুব্রতর এককালীন বেশকিছু টাকার প্রয়োজন পরে। তাই কোনরকম পথ খোলা না পেয়ে, সে বরাবরের মত নিলয়ের কাছে সাহায্য চায়। নিলয় ও সুব্রত একই ব্যাঙ্কে কাজ করতো, সেই সূত্রেই বন্ধুত্ব। নিলয় বেশ প্রতিপত্তি ঘরের ছেলে ছিল, তাই সুব্রত ভেবেছিল, হয়তো নিলয় তাকে হতাশ করবে না। কিন্তু নিলয় সাহায্য করলো না। বরং বললো, “আমার তোকে সাহায্য করতে কোনো সমস্যা নেই। আমি আগেও তোকে সাহায্য করেছি। কিন্তু তুই কোনোদিন এসব থেকে বেরোনোর চেষ্টা করিসনি, বরং আরও দেনা করেছিস। তাই আমি তোকে আর সাহায্য করবো না।তোকে সাহায্য করার থেকে, ভিখারী’কে সাহায্য করা অনেক পুণ্যের।”

এই কথাটা সুব্রত মেনে নিতে পারেনি। তাই সে ঠিক করে নিলয়’কে ভিখারীর দশায় পরিণত করবে এবং তাই করে। ব্যাঙ্ক থেকে দশ’লাখ টাকা চুরি করে নিলয়কে ফাঁসিয়ে দেয়, আর এর শাস্তিস্বরূপ নিলয়কে পাঁচ’বছরের জন্য তার জেল হয়। 

আইনের চোখ থেকে বেঁচে গেলেও মানসিক দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পরে। ওর সবসময় মনে হত, এই বুঝি নিলয় তাকে মেরে ফেললো। তাই নিলয়ের জেলে যাওয়ার চার’বছর পর তার চাকরি চলে যায়। এবং তারপর থেকে সারাক্ষণ নিজের ঘরেই বন্দি থাকতেন। সমাজের সকলের কাছে সে তখন এক পাগল। 


এসবই ভেবে চলেছে, ঠিক সেই সময় আবার টেলিফোনটা বেজে উঠলো। 


৬. 


ফোনটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সুব্রত দৌঁড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললো, “হ্যালো কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। হ্যাঁ বিজয় ফোন করেছে। 

“হ্যাঁ আমি বিজয় বলছি।”

প্রবল উৎকণ্ঠার সঙ্গে সুব্রত বলে উঠলো, “হ্যাঁ, বলো বিজয়। তুমি কি কোনো ব্যাবস্থা করতে পারলে?”

“না সুব্রত। আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, তুমি সবটা স্বীকার করে নাও। সেটাই তোমার কাছে সহজ উপায়।”

সুব্রত কথাটা শোনা মাত্রই ভয়ে শিউরে ওঠে। এবার তাহলে কি হবে? কি করবে সুব্রত? 

আবার বিজয় বলে ওঠে, “হ্যাঁ ভালো কথা, আরও একটা খবর দেওয়ার ছিল। নিলয় আজ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। আর...” কথাটা শেষ হলো না, তার আগেই সুব্রত বললো, “হ্যাঁ জানি।”

বিজয় বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, “তুমি জানো? কিন্তু আমি তো এই দশ মিনিট হলো খবর পেলাম, যে নিলয় কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আর ও সম্ভবত তোমার কাছেই আসছিল, কারণ ওর হাতে একটা কাগজ পাওয়া যায় যাতে তোমার বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল।” 

সুব্রত কথাটা শোনা মাত্রই থরথর করে কাঁপতে থাকে। যেন ওর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। সুব্রত ফোন কেটে দেয়। আর ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। 


আর মনে মনে ভাবতে থাকে, এই তার পরিণতি। নয়তো টাকা চুরির চার’বছর পর কেন প্রমাণ হবে যে, সে চুরি করেছে? আর প্রমাণ পেলো তো পেলো বিজয় পেল...যে সেই প্রথম থেকেই সুব্রত’কে সন্দেহ করতো। আর নিলয়? 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror