হ্যালোসিনেশন
হ্যালোসিনেশন
১.
সবাই একে বলে, ‘হ্যালোসিনেশন’, কিন্তু অমিতের বিশ্বাস এটা হ্যালোসিনেশন হতে পারে না। তার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই এর সাথে তার কোনো সূত্র আছে, তাই সে বারংবার একই স্বপ্ন দেখে।
আজ থেকে বছর কুড়ি আগে, অর্থাৎ তখন অমিত বছর চারের শিশু, তখন অমিতের মা এবং বাবা নিখোঁজ হয়ে যান। একটা কথা আছে, “ছোটদের যা শেখানো হয় বা বোঝানো হয়, তারা সেটাই শেখে।” অমিতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই অমিতও বিশ্বাস করেছে যে, তার বাবা তার মায়ের সম্পত্তি পাওয়ার লোভে মা-কে মেরে ফেলে এবং তারপর তিনি পুলিশের হাত থেকে বাঁচবার জন্য পালিয়ে যান।
আসলে অমিতের মা ছিলেন একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী, তার ওপর দাদু অর্থাৎ অমিতের মায়ের বাবা এককালে ব্যাবসা করে প্রচুর টাকা করেছিলেন। আর অন্যদিকে অমিতের বাবা ছিলেন, মধ্যবিত্ত ঘরের একজন চাকুরীজীবী। তাই দাদুর ধারণা অমিতের বাবাই তার মা-কে মেরে ফেলেছেন।
সত্য-মিথ্যা বিচার করার অবসর যদিও এখন আর নেই। কারণ ভবিতব্য-কে কেউ বদলাতে পারে না, অমিতও পারবে না। কিন্তু এই হ্যালোসিনেশনের রহস্য তো উদ্ধার করতে পারবে সে...
অমিত ছোট থেকেই একটা স্বপ্ন দেখে আসছে, যেখানে দুটো কঙ্কাল একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাটির নীচে শুয়ে রয়েছে। অথচ অমিত জীবনেও এরকম ঘটনার সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। ডাক্তার বলেছে, এটা নাকি হ্যালোসিনেশন। কিন্তু তাও কি করে সম্ভব?
শুধু কি এটাই? এর সাথে যেটা দেখে, সেটা দেখা মাত্র অমিত ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। দেখে কোনো একজন ওই দুটো মৃতদেহকে মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে। আর তাদের মৃতদেহই অর্থাৎ কঙ্কাল অমিত স্বপ্নে দেখে।
—আচ্ছা এটার সাথে কি বাস্তবের মিল থাকা সম্ভব? নাকি সত্যিই এটা কল্পনা আমার? কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীতে আমি এর সত্যতা খুঁজবো কি করে?
২.
২২ শে মার্চ, ২০১০
আজ দু’দিন হলো অমিত দার্জিলিং এ এসেছে। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য প্রথমত এই গরমে একটু ঠান্ডা আবহাওয়ায় থাকা, আর দ্বিতীয়ত অমিত যেই কবরস্থানের স্বপ্ন দেখে, সেটার সাথে এখানকার ‘ওল্ড সিমেট্রি’ – এর মিল আছে জানামাত্র, এখানে আসার জন্য মনস্থির করে ফেলে সে।
মালবাজার এর কাছে উদ্যান হোটেলে এসে উঠেছে দুদিন আগে। এখান থেকে ওল্ড সিমেট্রি এর দূরত্ব, হাঁটা পথে তিরিশ মিনিটের রাস্তা। তাই সে ঠিক করে, আগামীকাল সকাল সকাল বেরিয়ে পরবে হ্যালোসিনেশন এর রহস্য সমাধানের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যেতে বসে বসে চা খাচ্ছে, আর ফটো অ্যালবামটা উল্টাতে উল্টাতে কত স্বপ্নই না দেখছে। তার ছেলেবেলার স্বপ্ন। তার মা-বাবার স্বপ্ন।
কলকাতা থেকে আসার সময় এটা নিজের সাথে করে নিয়ে এসেছে অমিত। কারণ, এটাই একমাত্র তার বেঁচে থাকার সম্বল। এখানে তার ছেলেবেলার ছবি রয়েছে, আর রয়েছে তার মা-বাবার কিছু স্মৃতি। যদিও দাদুর ছবিও আছে।
পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নামে, তার পাশাপাশি সেই জোৎস্নালোকিত এক মনমুগ্ধকর পরিবেশ। আহা, মনটা অনায়াসে ভালো হয়ে যায়।
ব্যালকনির সামনে থেকে উঠে এসে, গায়ের চাদরটা ভালো করে গায়ে চাপিয়ে জড়োসড় হয়ে বিছানায় বসে আবার অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে গিয়ে একটা জিনিস দেখে অমিতের চোখটা আটকে গেলো।
অমিতের মনে পড়ে যায়, ছোটবেলার একটা কথা। যখন সে খুব ছোট, তখন সে প্রথম জিনিসটা দেখে। জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা আংটি। সোনার ওপর চকচকে পাথর বসানো হিরের আংটি। সেটা দেখা মাত্রই সে দাদুর কাছে আবদার করেছিল, সেটা দেখার জন্য। কিন্তু দাদু বলেছিল, ওটা নাকি হারিয়ে গেছে। কথাটা মনে পড়তেই অমিতের মনটা খারাপ হয়ে যায়।
৩.
২ রা এপ্রিল, ২০১০
কলকাতায় ফেরার পর, দাদুর হঠাৎ মৃত্যুর কথা শোনামাত্র কান্নায় ভেঙে পরে অমিত। কারণ দাদু ছাড়া তার আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আর ভগবান এতটাই নিষ্ঠুর যে তাকেও কেড়ে নিলেন।
অমিত আসার আগেই তিনি মারা গেছেন, ফলে শেষকৃত্য করার সুযোগও সে পাইনি। একে দাদুর মৃত্যুশোক, তারওপর নিজেও অসুস্থ, তাই আত্মীয়-স্বজন চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসে।
সারা বাড়ি একেবারে নিঃস্তব্ধ-নিঃশ্চুপ। এতটাই নিঃস্তব্ধ যে, সে নিজেই একবার ভয়ে চমকে উঠলো।
ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অমিত। তারপর সামনে প্রতিফলিত হওয়া নিজের প্রতিবিম্বের দিকে এমন করে তাকিয়ে ছিল যেন, আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব না অন্য কারোর ছায়া পড়েছে। আর অমিতও মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রয়েছে, যেন অনেক যুগ পর সে কাউকে দেখছে আজ মনখুলে। কতক্ষন এভাবে তাকিয়ে ছিল সে নিজেও জানে না। হঠাৎ একটা অপার্থিব হাসিতে ঘরটা ভরে ওঠে। আয়নার দিকে তাকাতেই দেখে, অমিতের প্রতিবিম্ব অর্থাৎ অমিত হাসছে। সারাঘর হাসিতে গমগম করে উঠলো। আর সেই হাসির সাথে আরও দু’জনের হাসি মিলিত হয়ে সেটা আরও বিকট রূপ ধারণ করলো যেন। যদিও অমিত ছাড়া আর কারোর প্রতিবিম্ব আয়নায় প্রতিফলিত হলো না, তবুও অমিত তাদের দেখতে পেলো। তাদের মধ্যে একজন মহিলা, আর অপরজন পুরুষ। অমিত তাদেরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বললো, “এতদিন পর আমি তোমাদের নিজের কাছে পেয়েছি, তোমরা আমায় ছেড়ে যেও না।”
অপর দু’জনের কোনো কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল না, তবে অমিত শুনলো, তারা যেন বলছে, “কোনোদিন যাবো না। এবার তো আমরা এক হয়ে গেছি। আর কিসের কষ্ট?”
৪.
22 শে মার্চ, ২০১০ (রাত ২ টো)
রহস্যের সমাধান করতে এসে নিজে এত বড় সত্যের মুখোমুখি হবে তা অমিতের ধারণাতীত ছিল।
প্রতিবারের মত আজও সে একই স্বপ্ন দেখলো। সেই একই কবরস্থান, একই কঙ্কাল, একটা মানুষ দুটো মৃতদেহ কবর দিচ্ছেন, এসবই; যা সে আগেও বহুবার দেখেছে। তবে আজকের সমস্ত ঘটনা এতটাই বাস্তবিক মনে হলো, যে অমিত যেন স্বপ্নেই হারিয়ে গেল। কারণ তারপরে যা যা ঘটলো, তা অমিত করলেও বা দেখলেও তা তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
যেন কোনো মায়ার মত ব্যাপারগুলো অমিতের জীবনে ঘটে গেল। কারণ এসব ঘটনা কাউকে বললে কেউ বিশ্বাসই করবে না। হেসেই উড়িয়ে দেবে।
কোনো অজ্ঞাত আকর্ষণে সে রাত্রিবেলায় পাথরের মত হাঁটতে থাকলো পাহাড়ের গা বেয়ে। সামনে থেকে কেউ দেখলে বলবে, সে যেন একটা রোবোট বা কোনো তান্ত্রিক দ্বারা তার মায়ার জালে আবদ্ধ; তাই সে অমনভাবে হেঁটে চলেছে।
চারিদিকে অমাবস্যার অন্ধকার ছাপিয়ে ঝিঝিপোকা তার রাস্তা নির্দেশ করছে, আর সেও হেঁটে চলেছে তার ভবিতব্যের দিকে।
কিছুক্ষন পর সে এসে পৌঁছাল তার সেই বহু পরিচিত স্থানে অর্থাৎ ওল্ড সিমেট্রি-তে। সম্ভবত এটা পরিত্যক্ত, নাহলে অমিত নিশ্চয়ই কারোর নজরে আসতো। অথবা এমনও হতে পারে, অমিতের আসার জন্যই সমস্ত জগৎ সংসার নিঃস্তব্ধ-নিঃশ্চুপ হয়ে গেছে।
গেট পেরিয়ে সে এগিয়ে চললো। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির তলায় শুয়ে রয়েছে কত মানুষ। যারা হয়তো নীচ থেকে অমিতকে বলছে, “কি রে, তোর এখন আসার সময় হলো? যা এগিয়ে যা, দেখ ওরা কতদিন ধরে তোর অপেক্ষায় রয়েছে। যা এগিয়ে যা।”
আর অমিতও বাধ্য ছেলের মত এগিয়ে চললো, আর তার মধ্যে হঠাৎই একটা আলোর রশ্মি জাগ্রত হলো যে, অমিতের মায়া যেন এক মুহুর্তে কেটে গেলো; আর সে তার আশেপাশের জায়গা দেখে ভয়ে শিউরে উঠলো। আর তখনই শুনলো সেই শব্দ।
৫.
22 শে মার্চ, ২০১০ (রাত ২:৩০ টো)
শব্দটা শোনামাত্র তার উৎসকে লক্ষ্য করে অমিত এগিয়ে গেলো, আর পৌঁছালো কবরস্থানের একদম শেষ প্রান্তের কবরটার সামনে। সামনে আশা মাত্র শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শব্দটা আসছে সামনের কবরের মধ্যে থেকে আর আলোররশ্মিটা-ও নির্গত হচ্ছে সেখান থেকে। অমিত বুঝলো এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, আর এরা যেই হয়ে থাক তারা অমিতের ক্ষতি চায়না। কারণ ক্ষতি চাইলে তারা এতক্ষনে তার ক্ষতি অনায়াসেই করতে পারতো, কিন্তু তারা তা করেনি। তাই অমিতও বুঝলো এরা এমন কিছু দেখাতে চায়, যা অমিতের সাথে জড়িত। তাই সে ওদের সংকেত বোঝা মাত্রই এদিক ওদিক তাকিয়ে কোদাল খুঁজতে লাগলো। আর এদিক ওদিক তাকাতেই কোদাল পেয়ে গেলো। আনন্দ ও উত্তেজনায় সে কোদাল হাতে নিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলো। খুঁড়তে খুঁড়তে ওপরের শক্ত মাটি আলগা হয়ে ভিতরের নরম মাটি বেরিয়ে আসলো। আর তারপর ও বিস্ময়ের সাথে দেখলো, তার স্বপ্নে দেখা দুটো কঙ্কাল একই ভঙ্গিতে মাটিতে শুয়ে রয়েছে। দেখা মাত্রই সে ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেলো। তারপর মনের মধ্যে ভয়কে চেপে রেখে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো আর ফোনের টর্চ জ্বেলে কঙ্কালটা ভালোকরে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তার নজরে এলো সেই হিরের আংটি। অমিত হাত বাড়িয়ে আংটিটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলো, আর তারপর তার সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হলো। হ্যাঁ এটা সেই আংটি, যেটা নাকি হারিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে অমিত এটাও বুঝে গেলো তার মা-বাবার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আসলে কার হাত ছিল। এটা ভাবা মাত্রই অমিত রাগে ফেটে পড়লো। আর সে মনে মনে ভাবলো এর প্রতিশোধ সে নেবেই।
৬.
২ রা এপ্রিল, ২০১০
অমিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো। কারণ তার প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়েছে। হ্যাঁ তার মা-বাবার খুন যিনি করেছিলেন তিনি আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। সবাই জানে উনি হার্ট ফেল করে মারা গেছেন, একমাত্র অমিত আর এই ঘরে উপস্থিত দুই ছায়া মূর্তি জানে, অমিতের দাদু মারা গেছেন ভয়ে। হ্যাঁ, ভয়ে। কারণ, দুজন মৃত মানুষ হঠাৎ যদি কোনো জীবিত মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলে তো মানুষ ভয়ে হার্ট ফেল করবেনই। কি তাই না?
হু হু দুজন ভুল বললাম, তিনজন। অমিতের মা, বাবা এবং অমিত নিজে।
হ্যাঁ, ২২ শে মার্চ সমস্ত ঘটনা জানার পর অমিত ঠিক করে পরের দিন কলকাতার উদ্দেশে রওনা করবে এবং বাড়ি গিয়ে তার প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু ও আর কি করে জানবে যে ওর প্লেন ক্র্যাশ করবে!

