বাসন্তী রূপে...
বাসন্তী রূপে...


সারা গায়ে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙল মৃদুলার। চোখ দুটোও জ্বালা করছে, ঠান্ডাটা ধরেছে ভালোই। কালকের বৃষ্টিটাই করেছে সর্বনাশটা। মৃদুলারা যখন ছোটো ছিল তখন বসন্ত কালে বৃষ্টির কথা ভাবাও যেত না আর এখন শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সৌজন্যে মনে হয় অচিরেই বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য হারাবে। কালকের বৃষ্টিটা ক্লান্ত হয়নি আজও, অঝোর ধারায় ঝরেই চলেছে। সাত সকালে উঠে আকাশের মুখভার দেখলে মৃদুলারও মনটা কেমন যেন ভার হয়ে যায়, অন্য সবারও হয় কিনা কে জানে! ইলেক্ট্রিকের তারে কোকিলটা কাকভেজা হয়ে বসে আছে, গলায় তার গান নেই আজ। এখনও টাপুর গভীর ঘুমে অচেতন। ওর মাথায় আলতো করে হাত রাখলো মৃদুলা, ঘুম থেকে তুলতে হবে মেয়েটাকে। রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো কিছুই ওদের মা মেয়ের রোজগার রুটিনের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনা। যাদের জীবনটা বাকি সবার চেয়ে অন্যরকম তাদের রোজগার জীবনে বোধহয় অন্যরকম কিছু ঘটা বারণ।
টাপুরকে ওর স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অটোয় বসল মৃদুলা। শরীরটা খারাপ লাগছে ভীষন, একটা দিন হয়তো বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যেত কিন্তু সে উপায় নেই। আজকে একটা ইম্পরট্যান্ট ফাইল জমা দিতে হবে অফিসে, গতকাল আচমকাই লাস্ট আওয়ারে বস বললেন ফাইলটা কালই কমপ্লিট করে দিতে হবে। এদিকে বাড়ি পৌঁছে ল্যাপটপ নিয়ে বসতে গিয়ে সে দেখে ল্যাপটপটা স্টার্টই নিচ্ছে না, অগত্যা তাই সাইবার ক্যাফে ছোটা, আর ফেরার পথে ধুম বৃষ্টিতে ভেজা। কাল ওই সময়টা বড্ড কান্না পাচ্ছিল মৃদুলার, বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করছিল। কথায় বলে “Time is the best Oblivion”, কথাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়, নয়তো আজ আটবছরেও মৃদুলা কেন পারলোনা সব ভুলতে! আজকাল তো নিজেকে যন্ত্রের মত মনে হয় কিন্তু পুরোপুরি যন্ত্র হতে পারে কই, যন্ত্রের তো কোনো আবেগ থাকেনা, কষ্ট দুঃখের কোনো অনুভূতি থাকেনা, কিন্তু মৃদুলা ওগুলোকে ত্যাগ করতে পেরেছে কই!
একটা লোক অনেকক্ষণ থেকে অটোর ভিড়ের সুযোগ নিয়ে মৃদুলার ব্লাউজের নীচের খালি জায়গাটায় হাত বুলিয়ে চলেছে। দু একবার বারণ করেও কোনো লাভ হলোনা, লোকটা ভিড়ের দোহাই দিয়ে একই কাজ করে যাচ্ছে। আর নিতে পারছেনা মৃদুলা, অটোটাকে থামতে বলে নেমে পড়ল মাঝ রাস্তায়। পরের যত অটো আসছে সব কটাই এমন ভিড় যে ওঠা যাচ্ছে না। অফিসে আজ পৌঁছাতে নির্ঘাত লেট হবে, বস আবার কি বলবেন কে জানে! মন খারাপের সেই অনুভূতিটা আবার ঘনীভূত হচ্ছে; সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে, মৃদুলারই আরেকটা সত্তা যেন ওকে প্রশ্ন করছে অটো থেকে নেমে পড়ার কারণ কি! ও তো কোনো অপরাধ করেনি তাহলে এখন ও কেন ভুগছে? যে লোকটা অন্যায় করলো সে নিজে তো বহাল তবিয়তে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে, আর মৃদুলা… কেন ও প্রতিবাদ করলো না অন্যায়ের! চুপচাপ মেনে নিলো অন্যায়টা! কিন্তু মৃদুলার মা যে ফোনে সবসময় বলেন মেয়ে নিয়ে ও একলা থাকে, কারুর সাথে যেন ঝামেলায় না জড়ায়। তাহলে কার কথা শোনা উচিৎ মৃদুলার? মায়ের কথাটা নাকি ওর নিজের প্রতিবাদী মনের?
************************************************************************
শরীরটাকে কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে চলছে মৃদুলা, ভীষণ বিদ্ধস্ত লাগছে ওর, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। প্রথমত আজ দেরিতে অফিস পৌঁছানোর জন্য বসের ধমক, তারপর কালকের ফাইলটায় তাড়াহুড়োতে কিছু ভুল রয়ে গিয়েছিল সেই জন্য চরম অপমান আর এসবের ওপর দিগন্ত বসু… লোকটা সুযোগ পেলেই মৃদুলাকে কুইঙ্গিত করতেন এতদিন কিন্তু আজ তো সব সীমা পের করে ফেলেছিল লোকটা। কোনোমতে পালিয়ে এসেছে মৃদুলা। বসের ঘনিষ্ট বলে এতদিন লোকটার সব নোংরামো সহ্য করে যাচ্ছিল মৃদুলা কেননা চাকরিটা চলে গেলে টাপুরকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ও! কিন্তু কোনোদিনও ভাবেনি লোকটা এতোটাও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই রজতের চলে যাওয়ার পর থেকে অনেক লোক সহানুভূতি দেখানোর অছিলায় অকারণেই ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছিল, এখনও করে। আজকাল এই সব মিথ্যে সহানুভূতিগুলো যেন কাঁটার মত শরীরে বিঁধে যায় ওর। মাঝে মাঝে মৃদুলার প্রচন্ড রাগ হয় সেই লোকটার প্রতি যার জন্য আজ ওর এই অবস্থা। কাপুরুষ লোক একটা, অটিস্টিক মেয়ের দায়ভার নেওয়ার ভয়ে পালিয়ে গেল ওদের ছেড়ে; এরকম অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে গেল মৃদুলাকে। মৃদুলার সবসময় মনে হয় রজত থাকলে ওদের জীবনে কোন সমস্যাই থাকতো না, যে কোনো বিপদ আপদ হলেই রজতকে মনে পড়ে মৃদুলার। অনেকসময় তো এমন একেকটা ক্ষেত্রে মনে পড়ে যায় যেখানে হয়তো আদপে রজতের কোনো ভূমিকাই থাকার কথা নয়, এই যেমন কালকের অফিসের কাজটা সেরে ভিজতে ভিজতে ফেরার সময় মনে হয়েছিল যে রজত থাকলে বোধহয় এমনটা হতো না।
স্পেশ্যাল চাইল্ডদের জন্য তৈরি এই বিশেষ স্কুলে টাপুরকে নিতে যখন পৌঁছালো মৃদুলা তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। ওর মিস নিশ্চয় বিরক্ত হচ্ছেন অপেক্ষা করে করে। কিন্তু গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অপ্রত্যাশিতভাবে টাপুরের মিস মিষ্টি হেসে অভ্যর্থনা জানালো মৃদুলাকে, বড্ড খুশি দেখাচ্ছে তাকে।
“আসুন মিসেস পাল, আপনার জন্য আজ একটা সারপ্রাইজ আছে।” মিসের কথা শুনে অবাক হয়ে ক্লাসরুমে ঢুকলো মৃদুলা, ফাঁকা ক্লাসরুমের একটা ডেস্কে বসে আনমনে ছবি এঁকে চলেছে টাপুর। পায়ে পায়ে ওর কাছে এগিয়ে গেল মৃদুলা, দেখলো সামনের খাতায় আঁকা মা দুর্গার ছবি; দুহাতে অসুর নিধন করছেন তিনি, বাকি আটটা হাতে আরও অনেক কাজ… কিন্তু মা দুর্গার পরনের পোশাকটা কেমন অন্যরকম লাগছে না! মৃদুলা তাকিয়ে দেখলো ওর আজকের পরা শাড়ীটাই রয়েছে মা দুর্গার বেশে; ছবিটার মা দুর্গার থুতনিতে টাপুর এঁকেছে একটা বাদামি আঁচিল। অজান্তেই মৃদুলার হাত উঠে গেল নিজের থুতনিতে, আঙুলের স্পর্শে অনুভব করলো বাদামি মাংসপিন্ডটাকে।
“আমার সত্যি বিশ্বাস হচ্ছেনা এমন ইনোভেটিভ আইডিয়া এসেছে ওর মাথায়… আয়াম রিয়েলি সারপ্রাইজড, ওকে কিন্তু আমাদের গ্রূম করে যেতে হবে মিসেস পাল…”
আরও হয়তো অনেক কিছু বলে যাচ্ছিলেন টুপুরের মিস কিন্তু সেসব কিছুই আর কানে ঢুকছে না মৃদুলার, এখন শুধু তার কানে বাজছে বাসন্তী পুজোর ঢাক...
***শেষ***