STORYMIRROR

Arpita Pal

Romance Tragedy

3  

Arpita Pal

Romance Tragedy

অতীত

অতীত

6 mins
214

মোবাইলের স্ক্রিনে ফেসবুকের পোস্ট গুলো স্ক্রোল করতে করতে একবার বাইরের দিকে তাকাল গৌতম। সে দেখল অনেক্ষণ ধরে চলা চারিদিকের দৃশ্যপটকে ঝাপসা করে দেওয়া বৃষ্টিটা এখন একটু ক্লান্ত হয়েছে। পুনরায় মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফেসবুকের পেজ থেকে বেড়িয়ে হোম স্ক্রিনের ডিজিটাল ঘড়ি গৌতমকে জানান দিচ্ছে সময় এখন রাত ১০ টা। আজ সারাদিন ধরে কয়েক ঘন্টা অন্তর অন্তর অঝোরে বৃষ্টি পড়ে গেছে। সে মনে মনে ভাবলো আজ আর কাস্টোমার আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এবার বাড়ির দিকে পা বাড়ানো দরকার। সেই সময় একটি মেয়ের আগমন গৌতমের ভাবনাগুলোকে ক্ষণিকের জন্য মুছে দিল। মেয়েটার পরণে আছে ট্রাউজার আর টিশার্ট। এক হাতে একটি খোলা ছাতা এবং অন্য হাতে একটি ছোট পার্স নিয়ে রীতিমতো ব্যাস্তভাবেই মেয়েটি গৌতমের দোকানে প্রবেশ করেছে। গৌতমও মেয়েটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাইরে তখনও ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটি তাই মাথার উপর ছাতাটি খুলে রেখেই গৌতমকে জিজ্ঞেস করল- 

" আপনার কাছে সাদা কাগজের লম্বা খাতা হবে? "

গৌতম সাথে সাথেই উত্তর দিল-

 " হ্যাঁ হবে। তবে মোটা না পাতলা? "

মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল-

 " মোটাই দিন। এই রকম দুটো খাতা দেবেন। "

গৌতম মেয়েটির সামনে বেশ কয়েকটা খাতা রাখল। মেয়েটি সেখান থেকে দুটো খাতা নিয়ে তাদের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। গৌতম বেশ কিছুক্ষন মেয়েটির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। কেন তাকিয়ে রইল সে নিজেই জানে না। এরপর মাঝে দু-তিন মাস কেটে গেছে। কিন্তু মেয়েটি আর দোকানে আসেনি। 

আগামীকাল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই বেশ কয়েকদিন ধরে পরীক্ষার্থীরা বা কখনো তাদের বাবা মায়েরা গৌতমের দোকানে আনাগোনা করছে পরীক্ষার এডমিট কার্ড জেরক্স করার জন্য। সন্ধ্যে বেলায় কাস্টমারের সংখ্যা কমে আসায় গৌতম দোকানটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছিল। এমন সময় একটি মেয়ের গলার আওয়াজে পেছন ফিরে তাকাতেই সে দেখল সেদিনের সেই বৃষ্টি ভেজা রাতের মেয়েটি। তবে আজ অবশ্য বাইরে কোনো বৃষ্টি পড়ছে না। এখন আশেপাশের রাস্তাঘাট ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ। মেয়েটি আজও সেদিনের মতোই ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে আছে। আজ ছাতার বদলে একটা ফাইল আর একটা ছোট পার্স। 

মেয়েটি ফাইল থেকে কিছু একটা বের করে সেটাকে গৌতমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-

 " এই এডমিট কার্ডটা একটু জেরক্স করে দেবেন? "

গৌতম শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে মেয়েটির হাত থেকে এডমিট কার্ডটা নিয়ে জেরক্স মেশিনের দিকে চলে গেল সেটাকে জেরক্স করতে। আর সেই মুহূর্তে গৌতম দেখে নিলো এডমিট কার্ডে মেয়েটির নাম। তিয়াসা রায়।

জেরক্স হয়ে গেলে গৌতম এডমিট কার্ড আর সেটার জেরক্স কপিটা তিয়াসাকে ফিরিয়ে দেয়। তিয়াসা জেরক্সের টাকাটা কাউন্টারে রেখে দোকান থেকে বেড়োতে যাবে এমন সময় দোকানের সামনে ঝুলতে থাকা একটা ছোটো উইন্ড চ্যাং-এর সাথে তার হালকা ধাক্কা লাগে। সে চলে যায় নিজের বাড়ির পথে। আর গৌতম আবারও সেদিনের মতো মেয়েটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

সে আজও বুঝতে পারে না যে মেয়েটি তার সামনে আসলে কেন তার হৃদয়ের স্বাভাবিক ছন্দটা থেমে যায়। কেন তার মন আর শরীর সেই সময় এক অন্য ছন্দে মেতে ওঠে। এই কেন-এর উত্তর একটাই হয়। গৌতমের হয়তো মনে মনে তিয়াসাকে ভালো লেগে গেছে। এই সহজ ব্যাপারটা যে কেউ বলে দিতে পারবে। কিন্তু সবকিছু এতটাও সহজ ছিল না। সেইদিনের পর তিয়াসা আর এক দিনের জন্যও গৌতমের দোকানে আসেনি। সে ঠিক করেছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তিয়াসা যদি কোনো সময় তার দোকানে আসে তাহলে সে তিয়াসার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে আর তিয়াসার দেখা পায়নি।

কয়েকদিন ধরে গরমটা এতটাই বেশি পড়েছে যে নদীর অবিরাম স্রোতের মতো শরীরেও ঘামের অবিরাম স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর কড়া রোদ থাকা সত্ত্বেও ছাতা খোলার কোনো উপায় নেই। কারণ দু হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার করা শাকসবজি, মাছ, মাংস ও আরো অনেক কিছু। পাশে তার সাথেই হাঁটছে ছোট ভাই বুবাই। গিন্নি আজ বাজারের ফর্দটা এতটাই বেশি করেছে যে বুবাইকে সাথে নিতে হলো। আর কেনোই বা হবে না? আজ যে তাদের ছেলে তুতানের জন্মদিন। বাজার থেকে বেরিয়ে মেইন রাস্তায় বুবাইকে রিক্সায় তুলে দিয়ে গৌতম বলল-

 " তুই রিক্সা করে বাড়ি চলে যা। আর এই নে। আমার ব্যাগ গুলোও সাথে নিয়ে যা। আমি তুতানের গিফট্-টা কিনে নিয়ে যাচ্ছি। "

এই বলে গৌতম রিক্সার ভাড়াটা বুবাইয়ের হাতে দিলো। রিক্সাটা বেরিয়ে যাওয়ার পর গৌতম রাস্তা পার হবে এমন সময় রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে দেখতে পায় সেই চেনা পরিচিত মুখ। যেই মুখটাকে আরেকবার দেখার জন্য সে এক বছর অপেক্ষা করেছিল। তারপর বাবার কথা মতো অনিতাকে সে বিয়ে করে। গৌতম অবশ্য অনিতাকে খুবই ভালোবাসে। মেয়েটা স্বামী সেবা আর সংসারের প্রতি দায়িত্ব কোনোটারই আজ পর্যন্ত কোনো ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু হটাৎ যদি অতীত কখনও মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলে তখন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব কিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গৌতমের সামনে এখন সেই অতীতটাই দাঁড়িয়ে আছে - তিয়াসা। হোয়াইট আর রেড কালারের কম্বিনেশনে একটা চুড়িদার পড়ে আছে। সে এখন পরিপূর্ণ নারী। আর আগের মতো নাবালিকা নেই যে রূপে গৌতম তাকে শেষবারের মতন দেখেছিলো। তিয়াসাও কি দেখেছে গৌতমকে? সে কি তাকে চিনতে পেরেছে? 

এমন সময় প্রচন্ড আওয়াজে গৌতম চমকে উঠে পাশ ফিরে দেখে একটা গাড়ি হর্ন দিতে দিতে দুরন্ত গতিতে তারই দিকে ছুটে আসছে। গাড়িটা গৌতমের থেকে প্রায় এক-দু হাতের মধ্যেই চলে এসেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক সজোরে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার এক প্রান্তে এবং সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা কোনো কিছুর সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলো। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশে ঘনিয়ে এলো ঘন কালো অন্ধকার। 


অনিতা দুদিন হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফেরেনি। তাকে অনেকে বহুবার বলেছে যে বাড়ি গিয়ে একটু রেস্ট নিতে। কিন্তু সে কারও কোনো কথাই শুনছে না। দুদিন ধরে এক মহুর্তের জন্যও সে ঘুমায়নি। খাওয়াদাওয়াও বিশেষ করেনি। তাই দূর্বল শরীরে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে গৌতমের বেড়ের পাশে বসে তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে এখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎই অনিতা নিজের হাতের মধ্যে গৌতমের হাতের নড়াচড়া অনুভব করলে তার ঘুম ভেঙে যায়। মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে তার স্বামীর জ্ঞান ফিরছে। তৎক্ষণাৎ সে রুম থেকে বেড়িয়ে সামনের কোরিডোরের সিটে বসে থাকা বুবাইকে খবর দেয় যে তার দাদার জ্ঞান ফিরছে। বুবাইও সাথে সাথে সেখান থেকে বেরিয়ে ডাক্তারকে খবর দিতে গেল। 

কিছুক্ষন বাদে ডাক্তার ও নার্স এসে হাজির হলো গৌতমের কেবিনে। আর সাথে সাথেই অনিতাও ডাক্তারের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল-

 " ডাক্তার আমার হাসব্যান্ড যে চোখে কিছু দেখতে পারছে না। "

এই শুনে ডাক্তার নার্সকে চোখে ইশারা করল। নার্স অনিতাকে side-এ নিয়ে গিয়ে শান্ত হতে বলে। 

ডাক্তার গৌতমের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল-

 " গৌতমবাবু? আপনি এখন কেমন আছেন? "

গৌতমের দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে ধরা গলায় বলল-

 " আমি তো চোখে কিছুই দেখতে পারছি না ডাক্তার! "

ডাক্তার তখন গৌতমের কাঁধে হাত রেখে বলল-

 " আসলে আ্যক্সিডেন্টের সময় আপনার মাথায় এমনভাবে আঘাত লাগে যে আপনার চোখ দুটোও সাথে সাথে ড্যামেজ হয়ে যায়। But don't worry! আমাদের হাসপাতালে অনেক donor আসে, তাদের শরীরের বিভিন্ন পার্ট গুলো donate করার জন্য। আশা করি আপনিও খুব তাড়াতাড়ি আপনার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবেন। "

এরপর তিনি অনিতার কাছে গিয়ে তার হাত দুটো ধরে বললেন-

 " আপনি এখন এইভাবে ভেঙে পড়বেন না। আপনার হাসব্যান্ডের মনে সাহস দিন। নাহলে তো ওনার শরীর আরও খারাপ করবে। Please! Take care of him. " 

এরপর ডাক্তার কিছু ওষুধ prescribe করে দিয়ে চলে যান। নার্স ঘর থেকে বেরোনোর আগে অনিতা আর গৌতমের উদ্দেশ্যে বলল -

 " আপনারা একদম চিন্তা করবেন না। Madam যখন assure করে গেছেন তখন কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই হবে। আর madam আ্যক্সিডেন্টের টাইমে present ছিলেন বলেই গৌতমবাবুকে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে আসা possible হয়েছে। নাহলে অনেক দেড়ি হয়ে যেত। "

নার্সের কাছে এই কথা শোনার পর গৌতম নার্সের উদ্দেশ্যে বলল-

 " তাহলে তো উনি আমার কাছে ভগবান। উনি এতক্ষন ধরে এই ঘরে ছিলেন। আর আমি ওনাকে ধান্যবাদটুকু জানাতে পারলাম না। ওনার নামটাও তো জানি না।ওনার নামটা একটু বলবেন? "

নার্স তখন হাসিমুখে উত্তর দিল-

 " ডা: তিয়াসা রায়। "

                           

                                


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance