অসময়ের গোলাপ
অসময়ের গোলাপ


জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েই রইল রিক্তা। এইখানটায় বসে বাইরের দিকে তাকাতে এতো ভাললাগে তার.. মনটা জানি কেমন হারিয়ে যায় তার। হারানোর অবশ্য কিছু কারণও যে নেই তা নয়! তাদের অফিসটা রাজারহাট ছাড়িয়ে আরো বেশ কিছুটা এসে একটা ফাঁকা জায়গায়। এখানে বেশী গাছ গাছালি দেখলেই তার পুরোনো সেই দিনগুলোয় ফিরে যায় রিক্তা। কাজের জগতে ঢুকবার সময়ে এক বন্ধু হয় তার.. ঋদ্ধি.. মনের খুব কাছের বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব কবে প্রেমে হল পরিণত তা বোধহয় কেউ টের পেল না। পেল যখন নিজেদের একে অপরের হাত ধরে সল্টলেকের অফিস পাড়ায় ঘুরতে দেখল। দুজনেরি অফিস তখন একই জায়গায়। এরপর কিছুদিন কেটে যায় যেন স্বপ্নের মতোন.. কোথা দিয়ে যেন চোখের পলকে কেটে যায়, কেউ টের পায়না। কিন্তু সময় তো থেমে থাকেনা, তাই সময়ের ঝড়ে একদিন দুজনকে দু জায়গায় নিয়ে ফেলে। ঋদ্ধি ভালো অফার পেয়ে চলে যায় গুরগাওন। প্রথম প্রথম যোগাযোগ ছিল ভালই। কিছু পর থেকেই সেটা ঢিলা পড়তে শুরু করে, একসময় প্রায় বন্ধ। হঠাৎ তার পাশের ফোনটা বেজে ওঠায় সম্বিত ফিরে পায় সে। স্বপ্নের জগৎ ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে এসে পড়ে রিক্তা।
বসের গলা....
"একবার আমার ঘরে এসো, কিছু কথা ছিল....
মনটা আবার বেশ উদ্বিগ্নই হয় রিক্তার। এই কোম্পানিটায় নতুন জয়েন করেছে সে। বসের হাবভাব বিশেষ ভাল নয়। পে স্কেল বেশ ভালই তাই এই মুহুর্তে ছাড়তেও চাইছেনা,, তাই বসের থেকে বেশ একটু নিরাপদ দূরত্বেই থাকে সে। সেটা বুঝতে পেরে আরো যেন তার দিকে এগিয়ে আসে লোকটা অজগর সাপের মতোন তাকে গিলে খাবে বলে। অন্তত: রিক্তার তো তাই মনে হয়!!!! বাইরে একটা ভাল অফার পেয়েছিল সে, কিন্তু মার শরীরটা তেমন ভাল না, তাই আর যাওয়া হয় না। রিক্তা একমাত্র সন্তান, বাবাও চলে গেছেন বছরখানেক হল। মাও এই জায়গা ছেড়ে আর কোথাও যেতে চান না।
তার দক্ষিণ ভারতীয় বস আর. মাধবনের ঘরে প্রবেশ করতেই যেন শরীর মন কুঁকড়ে যায় রিক্তার। শ্যামবর্ণ হলেও চেহারাটা খুবই সুন্দর। শুধু চোখদুটো দেখলেই মাথাটা জানি কেন গরম হয়ে ওঠে রিক্তার। কেমন যেন হাঁ করে গিলে খাওয়া দৃষ্টি.. তাকালেই অস্বস্তি হয় তার। দাঁড়িয়েই ছিল সে,, মাধবনের সুতীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর....
"হোয়াই আর ইউ স্ট্যান্ডিং মাই ডিয়ার, বোসো, হ্যাভ আ সিট....
কথাটা বলতে বলতেই যেন একবার মাপা হয়ে গেল রিক্তাকে। বিরক্তিতে রিক্তা অন্যদিকে তাকিয়েই উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। মাধবন দক্ষিণ ভারতীয় হলেও প্রায় দুই পুরুষ এখানে। তাই মোটামুটি অসাধারণ বাংলা বলে, যদিও কাজের কথা বেশী ইংরাজিতেই চলে। লোকটার সম্বন্ধে অনেক রকম কথা চলে অফিসে। সবই শুনেছে রিক্তা। কেউ বলে খুব ভাল, অসম্ভব দয়ালু মন.... আবার কেউ কেউ বলে লোকটা পয়সা ছাড়া আর কিছু বোঝে না, মহিলাদের সম্পর্কে দুর্বলতার কথাও জানা যায়। কোনটা যে সত্যি তা বোধহয় বলাটা খুবই কঠিন। রিক্তা এ সব নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। এখানে বিশেষ বন্ধুও নেই তার। কাজের বাইরে গান শুনতে আর সময়ে অসময়ে তার স্বপ্নের জগতের মধ্যেই আটকে থাকে সে। আর বিশেষ কিছু ভাললাগেনা তার!!!!
হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে বসের গলা গমগম করে ওঠে....
"ওয়ান থিংগ আই হ্যাভ নোটিসড রিক্তা.. হোয়াই আর ইউ সো লস্ট অলওয়েজ?? ঘরে কোনো অসুবিধা? আই মিন.. কাজটা তুমি এনজয় করছো তো????
প্রচন্ড অস্বস্তিতে হাত কচলাতে থাকে রিক্তা। তবে খুব একটা অবাক হয় না। এই প্রশ্ন তাকে এখানে এই কদিনেই আরো কজন করেছে। তাই কিছু নতুন না। সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারেনা.. সে এমন থাকে কেন?? তার মন বোধহয় সেই দিনগুলো ছেড়ে এখনো বেরিয়ে আসতেই পারেনি।।
মাধবনের গমগমে গলা আবার তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে....
"ওকে ওকে নাউ ডোন্ট বি সো এমব্যারেসড,, আসলে আজ একটা জায়গায় একটু যাওয়ার ইচ্ছা আছে.... ভাবছিলাম তুমি যদি একটু একমপ্যানি করতে প্লিজ....
রিক্তা কি বলবে ভেবে পায় না। লোকটার হাবভাব একটুও ভাললাগেনা তার, তার মধ্যে এতোরকম কথা তাকে নিয়ে। একা তার সাথে, তাও আবার রাতে!! মাধবন কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ....
"ওয়েট এট ডি মেইন গেট ফর মি,, শার্প এট সেভেন, ওকে....
বেচারী আর কি করে, শুধু একটু ঘাড় হেলিয়ে কোনোমতে বলে....
"ওকে স্যার।
সারাটা দিন প্রবল অস্বস্তির মধ্যেই কাটল তার। লোকটার মতিগতি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারা যাচ্ছেনা। যা বাজে দৃষ্টি, নির্ঘাত কোনো বদ মতলব আছে, ভাবে রিক্তা। লাঞ্চের পর থেকে কাজের চাপটা যেন একটু বাড়ে হঠাৎ, একটু যখন হাল্কা হতে পারে তখন বাজে পৌনে সাতটা। এরপর ওয়াশরুমে একটু ফ্রেশ হতে যায় সে। এই কাজটায় তার বেশ সময়ই লাগে। বেরিয়ে আসতে না আসতেই মাধবনের ফোন....
"হোয়্যার আর ইউ মাই ডিয়ারি,, আই এম ওয়েটিং হিয়ার....
গলাটা শুনেই মন যেন দু পা পিছিয়ে আসে তার। কি যে করে.. একবার ভাবলো ব্যাক সাউড গেট দিয়ে কেটে পড়বে কিনা। বেশ কিছু এলোপাথাড়ি ভাবনার পর মেইন গেটের দিকেই পা বাড়ায় রিক্তা। গেটে পৌঁছেই মাধবনের গাড়িটা দেখতে পায় সে। তাকে দেখামাত্রই মিষ্টি হেসে গাড়ির দরজা খুলে দেয় তার বস। কেন জানি এই হাসিটা একটু অন্যরকম লাগে রিক্তার।
গাড়িতে বেশ কিছুটা পথ চলার পর আর থাকতে না পেরে রিক্তা জিজ্ঞেস করে....
"আমরা কোথায় যাচ্ছি স্যার??
"সেটা দেখতেই পাবে যথাসময়ে.. ততক্ষণ অব্ধি সারপ্রাইজ থাক মাই ডিয়ার....
হঠাৎ প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখে রিক্তা কখন যেন ভুল করে গাড়িটা যেন তার বাড়ির রাস্তায় পা বাড়িয়েছে। খুব অবাক হয়ে রিক্তার প্রশ্ন....
"আপনার বাড়িও কি এইদিকে নাকি স্যার????
কোনো উত্তর দিয়ে অল্প হেসে তার মাথায় একটু হাত রাখেন মাধবন। কই, এবার তো আর ছোঁয়া বা দৃষ্টি কোনোটাই আর তেমন খারাপ মনে হয়না তার। কেমন যেন স্নেহের পরশ!! আশ্চর্য! কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গাড়ি। রিক্তা কেমন জানি মূর্তির মতোন বসে থাকে,, কি হতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারে না। বাকিটা বুঝিয়ে দেন রোহিনীদেবী, রিক্তার মা। রিক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন....
"আসলে তুই তো কিছুই জানিস না, তাই তোর অবাক লাগারই কথা। কিছুদিন আগেই ও একবার এখানে এসে দেখা করে যায়, বলে একবার খুব লেট হওয়ায় তোকে ড্রপ করতে এসেছিল। সেই থেকেই বাড়ি চেনে। প্রথম দিন থেকেই তোকে খুব মনে ধরে ওর। কিছু বলতে পারেনি কারণ তুই কারুর সাথেই বেশী কথা বলতিসনা, নিজের মনেই থাকতিস তাই। আর সকলে ওকে নিয়ে নানান কথাও বলে, তাই অন্য কোনো কথায় তুই ভুল ভাবার আগেই এসে আমার সাথে কথা বলতে চায়। একদম পাকাপাকি বিয়ের কথা....
এতো অব্দি শুনেই প্রচন্ড অবাক হয় রিক্তা। না জানি কিরকম সব কথা সে ভাবছিল আর উনি এমন! ছি: নিজের প্রতি একটু রাগই হয় তার। নিজের জগতে আটকে থেকে না জেনেই কতো কিছু ভেবে ফেলেছে সে....
মা আবার একটু নাড়া দেন তাকে....
"কিরে তোর সম্মতি আছে তো নাকি?? আমার কিন্তু বেশ পছন্দ,, ওরাও অনেকদিন ধরেই এখানে তাই ওদের বাড়িতেও নাকি কোনো সমস্যা হবে না। বলছে নাকি ভেবেছিল কখনো বিয়েই করবে না, এইসব নিয়ে ভাবতোই না। তোকে দেখেই নাকি মত বদলেছে.. কিরে এবার তুই কিছু বল....
আর বিশেষ কিছু শুনতে পায় না রিক্তা। চোখ ছলছল করার সাথে সাথে মনটাও আবার যেন রঙিন স্বপ্নে হারাতে চায়। এই সব কিছুর কালপ্রিট তখন তার দিকে মিটিমিটি চেয়ে হাসছে। তার চোখের দিকে তাকিয়েই আবার হারালো রিক্তা।।
#love