অশ্বত্থামা
অশ্বত্থামা
তিনি পিতার নামে দ্রোনি আর মাতার নামে কৃপ্যা এই দুইনামেও পরিচিত হন।
মহাভারতের এক জনপ্রিয় চরিত্র। আর সম্ভবত সবচেয়ে চর্চিত চরিত্র। সবচেয়ে আলোচিত সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রও তিনিই।
এখনো আধুনিক যুগেও ওনার আলোচনা সবচেয়ে বেশি হয়ে চলেছে। কারন একটাই উনি চিরজীবী। আজও দেখা দেন উনি।
কোথায় গেলে তার দেখা মিলবে ?
আজও রয়েছেন অশ্বত্থামা:
শোনা যায় অশ্বত্থামা তারপর থেকে আজও রয়ে গেছেন। চিরজীবী তিনি সাথে চিরযুবা। ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি আজও। মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরে রয়েছে অসীরগর - কেল্লা। বহু প্রাচীন এই কেল্লা, মহাভারতের যুগের থেকে রয়েছে।
এখানে এক মন্দিরে রয়েছে গুপ্তেশ্বর মহাদেব। সেই মন্দিরে প্রতিদিন ব্রহ্ম মুহুর্তে হয় পুজো। মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকলেও পড়ে থাকে তাজা ফুল আর জল।
জনশ্রুতি রয়েছে এই গুপ্তেশ্বর মহাদেবের স্থাপনা করেছিলেন অশ্বত্থামা। তাই তিনি প্রতিদিন নিজের হাতে করেন পুজো।
মাঝে মাঝেই তিনি তেল হলুদের খোঁজ করেন তার ক্ষত নিরাময়ের জন্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকজনের কাছে, তাই সেই মন্দিরে পুজো সামগ্রীর পাশাপাশি তেল হলুদ নিবেদন আজ প্রথা হয়ে গেছে।
বিভিন্ন tv চ্যানেল এই ব্যাপারে অনেক অনুসন্ধান করেছেন বানিয়েছেন বিভিন্ন documentary।
শুধু মধ্যপ্রদেশে নয় তিনি ঘুরে বেড়ান হিমালয়ের বিভিন্ন অংশে। হিমালয়ে ভ্রমণকালে অনেকে তার দেখা পেয়েছে, সেখানের বিশেষ এক জনগোষ্ঠীর সাথে তিনি রয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
শুধু তিনি নন রয়েছে তার বংশ। দক্ষিণের আর মারাঠা বংশ পল্লব বংশ তারই বংশ বলে পারিবারিক দস্তাবেজে উল্লেখ রয়েছে। দক্ষিণের নাগা রানীর সাথে অশ্বত্থামার মিলনে সেই বংশধারা চালু হয় যা আজও চলছে।
এছাড়া অশ্বত্থামার দাদু "ঋষি ভরদ্বাজ" থেকে উৎপন্ন গোত্র ভরদ্বাজ আজও সেই বংশধারার রক্ত বহন করে চলেছে।
জন্ম:
গুরু দ্রোনাচার্য্য তখনও হননি গুরু, সবে বিবাহ হয়েছে আশ্রম জীবন শেষে। পত্নীর নাম কৃপি। শ্যালক কৃপাচার্য্য। তারাও বেশ দরিদ্র। তিনি নিজেও হত দরিদ্র।
এত দারিদ্র ভালো লাগেনা দ্রোনাচার্য্য'র।
এদিকে বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও সন্তান লাভ হয়না।
দ্রোনাচার্য্য তখন রত হলেন দেবাদিদেব মহাদেবের রূপ একাদশ রুদ্রদেবের তপস্যায়। প্রীত হলেন একাদশ রুদ্রদেব। আশীর্বাদ দিলেন সন্তানের।
দারিদ্র্যক্লিষ্ট দ্রোনাচার্য্য জানেন দরিদ্রের খিদে কি, খিদের তীব্রতায় কতটা কষ্ট হয় শরীরের, সেইসব মাথায় রেখে তিনি বলেন এমন সন্তান দিন যার খিদে তেষ্টা থাকবেনা। দ্রোনাচার্য্য চান নি তার আগত সন্তান যেন খিদে তেষ্টায় তার মত কষ্ট পাক।
না খেলেও তার কোনরকম ক্লান্তি আসবে না। সেই সন্তান যেন চির যৌবন প্রাপ্ত হন। মৃত্যু যেন তাকে না নেয়।
মঞ্জুর করেন রুদ্রদেব সেই আবেদন...।
যথাসময়ে জন্ম নিল সেই দিব্য শিশু। মাথায় সহজাত মনি নিয়ে। সেই মনি ছিল তার যাবতীয় শক্তির উৎস। জন্মানোর সাথে সাথে আশেপাশের ঘোড়ার দল হেসে উঠল আনন্দের সাথে, তাই নাম দেওয়া হল অশ্বত্থামা।
শৈশব:
বলাবাহুল্য অশ্বত্থামার বাল্যকাল ভালো কাটেনি, দারিদ্রতার জন্য তার শিক্ষা গ্রহনও হয়নি। গরীবের সন্তান যেরমভাবে বড় হয় অনেকটা সেরকম অবহেলার মধ্যেই বড় হতে থাকে সে।
একদিন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে অশ্বত্থামা শুনে আসেন দুধের গুনাগুন, যেমন স্বাদ তেমনি পুষ্টি।
ফিরে এসে বায়না করতে থাকেন মা বাবার কাছে দুধের জন্য। দ্রোনাচার্য্য এত গরিব ছিলেন যে একটি গরু পোষার ক্ষমতাও ছিল না। দুধ কি জিনিস চোখে দেখেন নি।
শেষে শিশুর মন ভোলাবার জন্য মাতা কৃপি কিছুটা মিছরী আর চাল গুঁড়ো জলে গুলে দুধ বানিয়ে অশ্বত্থামাকে দেন। সেই নকল দুধ খেয়ে খুব খুশি হয় শিশু অশ্বত্থামা।
সমস্ত ঘটনা বসে বসে দেখেন দ্রোনাচার্য্য। পুত্রের এই অবস্থা দেখে বুক ফেটে যায় তার।
দিব্য শিশুর এইভাবে বড় হওয়া পুত্রঅন্ত প্রাণ দ্রোনাচার্য্য মেনে নিতে পারেননা। তিনি মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান কোন একটা কাজের জন্য।
এদিকে কৃপাচার্য্য ডাক দিয়েছেন হস্তিনাপুরে আসার জন্য। হস্তিনাপুরের প্রধান ভীষ্ম চাইছেন এক সুযোগ্য অস্ত্রগুরু, হস্তিনাপুরের বংশের অস্ত্রশিক্ষার জন্য।
দ্রোনাচার্য্যকে যেতে হবে ভীষ্মর সামনে, পরীক্ষা দিতে হবে কঠোর, তারপর যদি কিশোর কৌরব আর পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু হওয়া যায়।
অস্ত্রগুরু হতে পারলে বদলে যাবে ভাগ্য। দারিদ্র ঘুচে যাবে চিরতরে। সংসারে ফিরবে স্বাচ্ছন্দ্য। নিঃসন্দেহে দারুন কাজের খবর দিয়েছেন কৃপাচার্য্য।
কিন্তু এই হত দরিদ্র বেশে কি যাওয়া যায় রাজ পরিবারের সামনে। কিছু ভালো জামা কাপড় দরকার এখন, দরকার কিছু অর্থও।
হয়ত কৃপাচার্য্য ব্যবস্থা করে দেবেন কিন্তু বারবার পরমুখাপেক্ষি হওয়া উচিৎও নয়। কি করা যায় এখন....
তখন ওনার মনে পড়ল রাজা দ্রূপদের কথা। রাজা দ্রূপদ আর তিনি ছিলেন সতীর্থ গুরুর আশ্রমে। দুজনে ছিলেন খুব ভালো বন্ধু। দ্রূপদ কথা দিয়েছিলেন তিনি রাজা হলে দ্রোনকে দেবেন অর্ধেক রাজত্ব।
রাজত্ব নিয়ে আর কি হবে... তিনি আশ্রমিক মানুষ। যদি কিছু অর্থ আর নিস্কর জমি পাওয়া যায় তবে দারিদ্রতা ঘোচে। এই আশা নিয়ে গেলেন তিনি দ্রূপদের কাছে। দ্রূপদ তখন রাজা।
কিন্তু রাজা হয়ে বদলে গেছেন দ্রূপদ। হতদরিদ্র বন্ধুকে এতটুকু পছন্দ হলনা ওনার। তার উপর পুরোন কথা যেই তুললেন দ্রোনাচার্য্য, ভরা রাজসভা থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন।
হতাশা আর একবুক অপমানের বোঝা নিয়ে ফিরে এলেন তিনি তার কুটিরে।
অবশেষে কৃপাচার্য্যর সহায়তায় তিনি পৌঁছলেন হস্তিনাপুর। ভীষ্মর সামনে দিলেন অস্ত্র পরীক্ষা। সফল হয়ে গ্রহণ করলেন হস্তিনাপুরের ভাবী বংশধরদের অস্ত্র শিক্ষার গুরু দায়িত্ব ।
নিয়ে এলেন সন্তান অশ্বত্থামাকেও। রাজকুমারদের সাথে অস্ত্র শিখতে লাগলেন অশ্বত্থামাও।
গুরু দ্রোনাচার্য্য গ্রাম:
ভীষ্ম মতান্তরে ধৃতরাষ্ট্র দান করলেন একটি বিশাল গ্রাম, সেই গ্রামের নাম লোকমুখে প্রচলিত হল "গুরুগ্রাম" কালে কালে সেই নাম "গুরগাঁও" নাম নিয়ে আজও রয়েছে। হ্যাঁ বর্তমান দিল্লি অর্থাৎ ইন্দ্রপ্রস্থ সংলগ্ন গুরগাঁও এলাকায় এখনো রয়েছে দ্রোনের পুকুর।
বর্তমানে গুরুগ্রাম নামটি আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
কৈশোর ও শিক্ষা:
ধীরে ধীরে কৌরবদের সাথে বাড়ে বন্ধুত্ব। বিভিন্ন ব্যাপারে অশ্বত্থামা ধীরে ধীরে অর্জুনের সাথে নিজেকে সমকক্ষ মনে করতে থাকলেন। দুর্যোধন এই ব্যাপারে অশ্বত্থামাকে গরম করতে থাকেন- তোমার বাবা দ্রোনাচার্য্য কি করে অর্জুনকে সেরা ধনুর্ধর বলেন তোমার মত উপযুক্ত সন্তান থাকতে...
এরপরে অশ্বত্থামা তার শেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দেন আরো বেশি করে সময় দেন অনুশীলনে আর প্রতিটি ব্যাপারেই অর্জুনকে দ্রোনাচার্য্য প্রাধান্য দিলেই অশ্বত্থামার বায়নায় তাকেও সমান প্রাধান্য দিতে বাধ্য হতেন দ্রোনাচার্য্য।
পিতার পুত্রের উপরে স্নেহ পরবশেই কিছুটা দ্রোনাচার্য্য মেনেও নিতেন আর বাকি সবাই অর্থাৎ ভীষ্ম সমেত বাকি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পিতাপুত্রের একান্ত ব্যাপার জ্ঞান করে গুরুত্ব দিতেন না।
এই সময়ে পিতার তৈরি বেশ কিছু অস্ত্র অশ্বত্থামা নিজের কব্জায় করে নেন।
এইসবের মধ্যে অযথা কিছুটা প্রাধান্য পেয়ে অশ্বত্থামার মধ্যে একটু অহংকার জন্মে গিয়েছিল ফলে অস্ত্রশিক্ষার অনুশীলনে তিনি ঢিলে দিতে থাকেন। বেশ কিছু অস্ত্র জ্ঞান তার অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল। পুত্রের উপর স্নেহ করে দ্রোনাচার্য্য বিশেষ চেষ্টাও করেননি।
ছোটর থেকেই অশ্বত্থামার রাগ আর জেদ খুব ভয়ঙ্কর তার সাথে হঠকারিতা তার চরিত্রকে দিন দিন বেপরোয়া করে তুলেছিল। যখন কিছু মাথায় উঠে আসে সেটা তৎক্ষণাৎ করে ফেলেন এইসব লক্ষ্য করে দ্রোনাচার্য্য তাকে চার বেদ এর জ্ঞান পূর্ন মাত্রায় দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন বিভিন্ন শাস্ত্র এরফলে তার ক্রোধ আর হঠকারিতা দিন দিন চলে আসে নিয়ন্ত্রণে।
কুরুক্ষেত্রে:
যৌবনে তিনি যখন তখন মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে। যখন শোনেন যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অংশ নেবেন না, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে তার সুদর্শন চক্র চেয়ে বসেন। শ্রীকৃষ্ণ অনুমতি দিলে অশ্বত্থামা চক্রটি নিতে যান। কিন্তু অস্ত্রটি তুলতেই বিফল হন। খুব লজ্জ্বা নিয়ে কোনক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচেন।
এরপরে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি এবং তার পিতা দুজনেই কৌরব পক্ষের হয়ে লড়াই করেন।
হস্তিনাপুরের নুন যতই হোক খেয়েছেন তারা, শুধতে তো হতই।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম ছিলেন কৌরবদের সেনাপতি কিন্তু শিখন্ডীর হাতে ভীষ্ম পতনের পরে সেনাপতি হন গুরু দ্রোনাচার্য্য।
ভীষ্মর শরশয্যা গ্রহনের সেই দশম দিনের রাত্রে দ্রোনাচার্য্য কথা দেন দুর্যোধনকে তিনি জীবন্ত বন্দী করবেন যুধিষ্ঠিরকে। এগারতম দিনে দ্রোনাচার্য্য আসেন যুদ্ধক্ষেত্রে। পিতা পুত্রের সম্মিলিত বহু চেষ্টাতেও কোনভাবেই বন্দী করতে পারেন না যুধিষ্ঠিরকে।
এইভাবে কয়েকদিন পেরোলে পরে এক রাতে দুর্যোধন বেশ কিছু কথা শোনান দ্রোনাচার্য্যকে।
বিরক্ত হয়ে দ্রোনাচার্য্য নামেন পরেরদিন স্বয়ং রুদ্ররূপে।
সেইদিনটি ছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পনেরতম দিন।
শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে অস্ত্র হাতে দ্রোনাচার্য্য বধ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার আর যদি আজ না আটকানো যায় তবে দ্রোনাচার্য্য বন্দী করেই ছাড়বেন যুধিষ্ঠিরকে।
যুধিষ্ঠির বন্দী মানে শেষ যুদ্ধ। পান্ডবপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে হবে বাধ্য।
সেই অনুযায়ী তিনি এক পরিকল্পনা করেন যুধিষ্ঠির আর ভীমকে নিয়ে সাথে...
পরিকল্পনা অনুযায়ী
পরেরদিন বাকী পান্ডবপক্ষ তার সৈন্যদল সমেত একপাশে নিয়ে যান অশ্বত্থামাকে। দূরত্ব তৈরি করা হয় দ্রোনাচার্য্য আর তার পুত্রের মধ্যে।
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পরে একবার সুযোগ বুঝে ভীম বধ করেন অশ্বত্থামা নামে একটি হাতিকে তার গদা দিয়ে। আর খুব জোরে জোরে চিৎকার করে ঘোষণা করেন- অশ্বত্থামা হতঃ অশ্বত্থামা হতঃ ...
দ্রোনাচার্য্য শুনতে পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। পুত্রশোকে কাতর হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কি করবেন ভেবে না পেয়ে তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে জানবেন বলে স্থির করেন। তিনি জানতেন যুধিষ্ঠির কোন অবস্থাতেই মিথ্যে বলেন না। সত্যবাদী হিসেবে যুধিষ্ঠিরের নাম ছিল তাই রথ চালিয়ে যান তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে, জিজ্ঞেস করেন- সত্যিই অশ্বত্থামার মৃত্যু হয়েছে কিনা...
যুধিষ্ঠির উত্তর দেন- অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজঃ।
কিন্তু
ইতি গজঃ কথাটি একটু পরে আর একটু আস্তে বলেন তিনি। ততক্ষনে অশ্বত্থামা হতঃ কথাটি শুনেই দ্রোনাচার্য্য হতোদ্যম হয়ে পড়েন তার হাতের অস্ত্র খসে পড়ে।
পুত্রশোকে কাতর পিতা তখন বসেন ধ্যানযোগে।
রুদ্র আশীর্বাদে প্রাপ্ত সন্তান তার এইভাবে মারা যেতে পারেন না, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কিন্তু যুধিষ্ঠির যখন বলেছে তখন সত্যিই কি মারা গেল তার প্রানপ্রিয় সন্তান... তাই কি হয়েছে সঠিক তাকে জানতে হবে।
এই সময়ে ধৃষ্টদুমন্য তার খড়্গ নিয়ে কেটে ফেলেন দ্রোনাচার্য্যর মাথা।
নিরস্ত্র অবস্থায় এই হত্যা ছিল অন্যায়। পুরো ঘটনা শুনে অশ্বত্থামার মন প্রাণ দুঃখে জ্বলে উঠে।
অশ্বত্থামা ছিলেন পিতা অন্ত প্রাণ। পিতার এরকম অন্যায় হত্যা দেখে দুঃখে শোকে কাতর হয়ে তিনি সংযোজন করে দেন নারায়ণী অস্ত্র। কিছুক্ষনের মধ্যে পঞ্চপান্ডব সমেত প্রতিটি সৈন্যের মাথায় একটি করে মারন বাণ উপস্থিত হয়।
শ্রীকৃষ্ণ নিজে নারায়ন, তিনি জানতেন এই অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ। তিনি সবাইকে বলেন যে যেখানে থাকুক অস্ত্র ফেলে দিক আর নেমে আসুক জমিতে। অর্থাৎ অস্ত্র ফেলে দিয়ে ঘোড়া হাতি রথ সবের থেকে নেমে মাটিতে বসে হাঁটু গেঁড়ে প্রার্থনা করুক নারায়নের কাছে, রক্ষা করার আবেদন করুক। সবাই তাই করতে শুরু করলেও ভীম অস্ত্র ফেলে দিতে রাজি হন না। শেষে শ্রীকৃষ্ণ আদেশে তিনিও অস্ত্র ফেলে প্রার্থনা করেন।
নারায়ণী অস্ত্র নিরস্ত্র থাকলে আর স্মরনাগত হলে কোন ক্ষতি করে না। জানতেন শ্রীকৃষ্ণ।
নিস্ফল হয় অশ্বত্থামার এই প্রচেষ্টা। দুর্যোধন বলেন দ্বিতীয়বার এই নারায়ণী অস্ত্র সংযোজনের জন্য। কিন্তু অশ্বত্থামা করতে পারেন না কারন দ্বিতীয়বার নিস্ফল হলে নারায়ণী অস্ত্র যে নিক্ষেপ করেছে তাকেই ঘুরে বধ করবে।
এরপরে অবশ্য তিনি সংযোজন করেন অগ্নি অস্ত্র। সাথে সাথে যুদ্ধক্ষেত্র গরম হয়ে যায়, শরীর জ্বালা ধরানো গরম বাতাস বইতে থাকে। সবার অসহ্য লাগতে থাকে।
সেই অস্ত্র ছুটে যায় অর্জুনের দিকে। শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র সংযোজন করতে বলেন। ফলে অর্জুন প্রাণে বেঁচে গেলেও পাণ্ডব বাহিনীর বহু সৈন্য ধ্বংস হয়ে যায়।
আবার পাণ্ডব বধে নিস্ফল হয়ে অশ্বত্থামা এবারে আক্রমন করেন পিতৃহন্তা ধৃষ্ট্যাদুমন্যকে। কিন্তু প্রবল বাধা দেন মহষ্মতির রাজা নল, সাত্যকি আর ভীম।সেইযাত্রা বেঁচে যান ধৃষ্ট্যাদুমন্য। কিন্তু মারা যান রাজা নল।
এরপরে ভীমের হাতে মারা যান দুঃশাসন। দুঃশাসনের সেই ভয়ানক মৃত্যুর পরে হতচকিত দুঃখিত অশ্বত্থামা তার বন্ধু দুর্যোধনকে উপদেশ দেন পাণ্ডবদের সাথে সমস্যা মিটিয়ে নিয়ে যুদ্ধ শেষ করতে।
কিন্তু তারপর সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
আঠেরতম দিনের দিনে যুদ্ধশেষে জঙ্ঘা ভাঙা অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকা দুর্যোধনকে দেখতে যান অশ্বত্থামা কৃপবর্মা কৃপাচার্য্য। বন্ধু দুর্যোধনের এই অবস্থা দেখে শোকে দুঃখে কাতর হয়ে যান অশ্বত্থামা।
বেশিক্ষণ তিনি সহ্য করতে পারেন না সেই দৃশ্য। ফিরে আসেন তিনি তার তাঁবুতে। তাঁবুটি ছিল একটি বড় গাছের তলায়। রাতে ঘুম আসেনা। শুয়ে শুয়ে ভেবে যাচ্ছেন কিভাবে বধ করা যায় পাণ্ডবদের।
তার পরম পূজনীয় পিতৃহত্যার সাথে তার বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ কিভাবে নেওয়া যায়।
ভাবতে ভাবতে আসেন তিনি তাঁবুর বাইরে। হঠাৎ দেখেন সেই গাছে একটি পেঁচা এসে একদল ঘুমন্ত কাকের উপর আক্রমণ করল। অন্ধকারে ছিন্ন ভিন্ন কাকের পালক আর মাংস রক্ত এদিক ওদিক উড়ে উড়ে পড়তে লাগলো।
সেই দৃশ্যটি দেখে তিনি বুঝে গেলেন তার করণীয় কি। তিনি ঘুমন্ত কৃপবর্মা আর কৃপাচার্য্য কে জাগিয়ে তুলে সব খুলে বলেন। এরপরে যান দুর্যোধনের কাছে। দুর্যোধনকে বলেন পঞ্চপান্ডবের হত্যা তিনি করবেন সেই রাতেই, যদি দুর্যোধন আদেশ দেন। দুর্যোধন তাকে সেই রাতের সেনাপতি বানান।
তিনজন মিলে সশস্ত্র হয়ে গেলেন ঘুমন্ত পাণ্ডব শিবিরে। একে একে বধ করেন পিতৃহন্তা ধৃষ্ট্যাদুমন্যকে তারপরে শিখন্ডী সমেত অন্যান্য পাণ্ডব সেনাদের।
এরপরে তিনি প্রবেশ করেন পাণ্ডবদের তাঁবুতে। কিন্তু পান্ডবপক্ষ সেদিন ছিল না তাঁবুতে। বদলে ছিল দ্রৌপদীর পাঁচ সন্তান। অন্ধকারে অত বুঝতে না পেরে অশ্বত্থামা কেটে নেন তাদের মাথা এক এক তরোয়ালের কোপে।
এরপরে সেই মাথা নিয়ে গিয়ে দেখান দুর্যোধনকে। এদিকে ফুটে উঠেছে তখন ভোরের আলো। সেই আলোয় দুর্যোধন দেখে চমকে উঠলেন, বললেন- এ তুমি কি করলে, আমাদের পারলৌকিক কাজ করার মত কাউকেই তুমি বাঁচিয়ে রাখলে না। কথা ছিল আনবে পাণ্ডবদের মাথা আর আনলে তাদের পুত্রদের।
অশ্বত্থামা নিজের ভুল বুঝতে পারেন কিন্তু সাথে আনন্দিত হন এরপরে পান্ডবপক্ষ আর যুদ্ধ জয়ের আনন্দ করার মত কিছু পাবে না।
এরপরে দুর্যোধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তারা তিনজন মিলে দুর্যোধনের পারলৌকিক ক্রিয়া করেন।
শেষ পরিনতি:
পরেরদিন সকালে সন্তানদের মৃত্যু সংবাদ শুনে যুধিষ্ঠির মূর্ছা যান। ভীম পাগলের মত হয়ে যান। বাকিদের অবস্থা হয় শোচনীয়। শ্রীকৃষ্ণের সান্ত্বনা পেয়ে তারা একটু ঠান্ডা হলে এবারে বেরোন অশ্বত্থামার খোঁজে।
এদিকে ব্যাসদেবের আশ্রমে লুকিয়ে থাকেন অশ্বত্থামা। তখন ছিলেন না ব্যাসদেব তার আশ্রমে।
পাণ্ডবভাইরা আর শ্রীকৃষ্ণ সেখানে পৌঁছলে অশ্বত্থামা সংযোজন করেন ব্রহ্মাশিরোস্ত্র। তিনি চাইছিলেন সৃষ্টি সমেত পাণ্ডবভাইরা ধ্বংস হয়ে যাক কারন যে সৃষ্টিতে তার পিতা নেই সেই সৃষ্টির কোন দাম নেই তার কাছে।
শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে বলেন ব্রহ্মাশিরোস্ত্র সংযোজন করতে। দুই ব্রহ্মাশিরোস্ত্র তখন একে অন্যের সম্মুখীন হয় সারা সৃষ্টিকে প্রচন্ড বিপদের সম্মুখীন করে তোলে। ঠিক সেই মুহুর্তে নারদ ও ব্যাসদেব হাজির হন ওখানে। দুইজনের প্রচেষ্টায় দুই অস্ত্র একে অন্যের সাথে সঙ্ঘর্ষ না হয়ে আটকে থাকে।
এরপরে দুইজনকেই আদেশ দেন ব্যাসদেব অস্ত্র সম্বরন করতে কিন্তু অর্জুন জানলেও অশ্বত্থামা জানতেন না এই ব্রহ্মাশিরোস্ত্র সম্বরন করতে। অর্জুনের ব্রহ্মাশিরোস্ত্র ফিরে এলে অশ্বত্থামার অস্ত্র তখনও উদ্যত।
পান্ডবপক্ষর একমাত্র বংশধর অভিমন্যুর সন্তান পরীক্ষিত তখন অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভে। যেহেতু সমূলে নষ্ট করতে চেয়েছিলেন পাণ্ডববংশকে অশ্বত্থামা সেই উদ্দেশ্যে তিনি সংযোজন করেছিলেন ব্রহ্মাশিরোস্ত্র।
তাই সেই অস্ত্রকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল উত্তরার গর্ভে।
মারা যান গর্ভস্থ সন্তান পরীক্ষিত। অস্ত্র এরপরে নিষ্ক্রিয় হয়।
শ্রীকৃষ্ণ তখন প্রবেশ করেন উত্তরার গর্ভে পুনর্জীবিত করেন সেই সন্তানকে।
অশ্বত্থামার সমস্ত শক্তির উৎস সেই মনি কেড়ে নেওয়া হয় কপাল থেকে তুলে। এরপরে শ্রীকৃষ্ণ অভিশাপ দেন- যেহেতু তুমি ব্রাহ্মণ হয়েও সৃষ্টির গুরুত্ব বোঝনি, এমনকি তোমার নজর থেকে গর্ভস্থ সন্তানও সুরক্ষিত নয়। তাই তোমায় আমি অভিশাপ দিচ্ছি তোমার মাথার এই ঘা শুকবে না কোনদিন, সাথে তুমি হবে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত।
ঘা পুঁজ তোমায় ঘিরে থাকবে। যে মৃত্যুর ভয় তোমার নেই সেই মৃত্যুও তোমার থেকে থাকবে দূরেই। তুমি চাইবে মৃত্যু কিন্তু আসবে না সে। এরকমভাবে তুমি থাকবে পৃথিবীতে যতদিন না শেষ হচ্ছে এই কলিযুগ।
কলিযুগের শেষে কল্কি_অবতারের সাথে দেখা হবে অশ্বত্থামার, ওনার আশীর্বাদে এই সৃষ্টি চক্র শেষ হলে তখন পাবেন অশ্বত্থামা মুক্তি।
পিতৃঅন্ত প্রাণ অশ্বত্থামার এই পরিণতিকে ঠিক বলব না ভুল সেই ক্ষমতা আমার নেই কারন শ্রীকৃষ্ণ যা করেছেন সঠিক বুঝেই করেছেন তবে এটাও ঠিক অশ্বত্থামার পিতৃভক্তি আর বন্ধুভক্তির তুলনা হয় না।
তবে এরকম এক ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে বোধয় সবাই চাইবে। আমার অন্তরের শ্রদ্ধা রইল ওনার জন্য। ওনার ব্যথার উপশম হোক মুক্তিও মিলুক তাড়াতাড়ি এই রইল আমাদের প্রার্থনা।