Akash Karmakar

Romance Tragedy Classics

3  

Akash Karmakar

Romance Tragedy Classics

অর্ধগোলার্ধ

অর্ধগোলার্ধ

4 mins
279


হাতের রেখার মতন চেনা শহর, কৈশোর থেকে পরিণত মানুষ করে তোলার শহর তুমি। আনন্দ-উচ্ছ্বাস-হাসি-কান্নার হিসেব জানে আমার শহর। যতবার হোঁচট খেয়েছি ততবার তুমি হাত বাড়িয়ে দিয়েছ। ভালোবাসতে শিখিয়েছ, শিখিয়েছ ভালো রাখতে। অনেকদিন পর তোমার কোলে মাথা রাখতে এলাম আবার, যেমনটা এসেছিলাম কৈশোরের গোড়াপত্তনে – অগোছালো, ছন্নছাড়া। এর মাঝে গঙ্গা দিয়ে বয়ে কত জল যা শুধু ভিজিয়েছে আমার শহরকে, তিলোত্তমা তবুও তুমি কখনো তার আবদার উপেক্ষা করো নি। সেই শহরেই আজ রাতে তুমি আমি কাছাকাছি। হ্যাঁ এই তো ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই শুয়ে আছি দুজনেই, বিছানা দুটো আলাদা, আলাদা দুটো ঘর, সবকিছুই তো আলাদা হয়ে গেছে, আমরা কি পেরেছি আলাদা হতে? 


   জানো রঞ্জনা, গতবছর এই সময় আমি তোমার হাত ধরে পলাশ দেখতে বেরিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে, পলাশ রুক্ষ শুষ্ক ঋতুতেও রক্তিম ভালোবাসার বীজ বপন করে স্নিগ্ধ হৃদয়ের অন্তরে। এনগেজমেন্টের পরে সরস্বতী পুজোর সকালে তোমার হাত ধরে পুজো পরিক্রমা, স্কুল-কলেজের বন্ধু বান্ধবদের সাথে জমজমাট আড্ডার আসর–সেখানেও সকলের চর্চায় ছিল তোমার আমার ভালবাসা, সম্পর্ক। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্রোতের গতিপথ প‍রিবর্তন। কার ভুলে এরকম হল তার হিসেব কষতে আজ আর মন নেই; বিচ্ছেদেই যেখানে পরিসমাপ্তি সেখানে কি ঠিক আর কি ভুল! কোথাও একটা পড়েছিলাম কখনো, “প্রেম শুধু কাছেই টানে না – ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।” কথাটা এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি ক‍রছি। বেঁচে থাকার দায় নিয়ে আজ থেকে এগিয়ে চলা। "আপস করে চলা যায় না" – কথাটা তুমিই বলেছিলে অথচ আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের সাথেই তোমাকে মনে না করার আপস নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। মানুষ নাকি মরে গেলে পচে যায় আর বেঁচে থেকে বদলে যায়; এই যেমনটা তুমি আমি। একবছর আগের কাগুজে স্বামী - স্ত্রী থেকে আজ আগন্তুক‌। 

  

   মনখারাপ লাগছে? যন্ত্রণা হচ্ছে? অসাড় চোখের তারার আঙিনায় ভিড় করছে ল্যামিনেটেড মেমোরি, ভালোলাগার কয়েকটা রেখে বাকিগুলো আজ ডিলিট করে দেব, এমনকি রিসাইকেল বিনেও রাখব না – আমি প্রেমে বিদ্রোহ চাইনি, বিদ্রোহী প্রেম চেয়েছিলাম। তরল পানীয় আমার শরীরকে আসক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আজকের রাতের জন্যে। কিন্তু এ কি মাত্র এক রাতের কাহিনী! 

শেষবার ময়দানে যখন তোমার কোলে মাথা রেখেছিলাম আর তুমি আলতো হাতে বিনি কেটে দিচ্ছিলে আমরা সেখানে ষাটোর্ধ্ব দাদু দিদা হওয়ার শপথবাক্য পাঠ করেছিলাম। সিগারেট ছিল নাকি তোমার সতীন, বলেছিলে এই ঠোঁটে শুধু আমার অধিকার। আজ দেখো সিগারেট, বোতল, গ্লাস সবার সাথে আমার অবৈধ নিশিযাপন; বৈধতা নির্বাসিত! 


       পৃথিবীর শেষ বলে যদি কিছু থাকত তাহলে আজ সেই কিনারায় দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করতাম; কিন্তু দুনিয়াটা তো গোল। আচ্ছা এই গোল দুনিয়ার ঘূর্ণিপাকে যদি আবার কখনো তোমার চোখ পড়ে যায় আমার উপর তুমি কি পারবে ভিড়ের মাঝে আমাকে মিশিয়ে এগিয়ে যেতে? নাকি ভুল করে জিজ্ঞেস করবে 'কেমন আছ?' এরকম সম্পর্কের জটিল সমীকরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আম‍রা পথ খুঁজে চলছি কিভাবে একা একা ভালো থাকা যায়; না না, কিভাবে বেঁচে থাকা যায়। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে আমাদের অর্ধেক জার্নির ছবি; অর্ধেক গল্পে যে মানুষের কৌতূহল বরাবরের। আজ সকালে আসার সময় জানালার পাশের সিটটা জুটেছিল সৌভাগ্যবশত, কানে হেডফোনটা গুঁজে চলে এলাম তিলোত্তমার বুকে নতুন করে আরেকবার নিজেকে খুঁজব বলে। তুমিও তো এলে আজই। একটাই পথ শুধু বাহনদুটো আলাদা–পাশে বসলে তোমার চুলগুলো উড়ে আবার হয়তো আমার মুখে এসে লাগতে পারত! 


      চোখের পাতাগুলো ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুমোতে হবে, উঠতে হবে, আবার একটা তুমিহীনা জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। রাতের চেয়েও দিনগুলোকে এখন কালো অন্ধকার মনে হবে, চারিপাশ হতে ভেসে আসবে গলা পচা দগ্ধ লাশের গন্ধ। ট্রাম-মেট্রো সবই ছুটে চলেছে নিজের গতিতে, লোকে ঠিকই বলে, তিলোত্তমা ঘুমোয় না কখনো কিন্তু এই তিলোত্তমার বুকে প্রতিদিন কতজন ভাঙা টুকরো স্বপ্নের গুড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে রণক্ষেত্রে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তার খবর রাখে না; আসলে সৃষ্টি আর ধ্বংসের শিরোনাম হয় কিন্তু যারা মরে গিয়ে বেঁচে থাকে তারা চিরতরে হারিয়ে যায়। 


   এখনো সইদুটো বাকি আছে আমাদের। ছোটোবেলায় খাতার পেছনে সই প্র্যাক্টিস করতাম যাতে বড়ো হয়ে ভালো করে লিখতে পারি; কেই বা জানত একটা সই এমনও করতে হবে যা আমার আপনজনকে বর্ণহীন একখন্ড সুখ উপহার দেবে। আমরা সবাই আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো ঘুড়ির মতো, লাটাইটা সময় ধরে রেখেছে শক্ত করে। কখন কোথায় কিভাবে জীবনের সুতো ছিঁড়ে যাবে তার কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নেই। স্মৃতির পাহাড় ধীরেধীরে পাথরে পরিণত হবে, বিষাদের রঙে চাপা পড়বে ফেলে আসা সবুজ দিন–নতুন করে লিখব আমি তোমার দেওয়া এই ডাইরিতে আসমুদ্র শোকগাঁথা। যাও, যত দূরে পারবে চলে যাও, যাওয়ার সময় কখনো পিছনে তাকিও না, তুমি এতটাই দূরে চলে যাও যেখান হতে আমাদের দেখা হওয়াটা এক কাল্পনিক গল্প ছাড়া আর কিছু মনে হবে না কখনোই! যেখান থেকে হাত বাড়ালে আমি কুয়াশা ছাড়া আর কিছুরই নাগাল পাব না― ভালোবাসা এমনই এক খরস্রোতা মৃত্যুস্রোত! আমাদের সংসার হল না, তুমি আমার কাগজের বৌ হয়েই রয়ে গেলে প্রিয়তমা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance