Debdutta Banerjee

Drama

2  

Debdutta Banerjee

Drama

অন‍্য রাখী বন্ধন

অন‍্য রাখী বন্ধন

5 mins
1.7K


গাড়ির আওয়াজে বারান্দায় বেরিয়ে আসে সাদাত। আব্বুর সাথে ঐ মহিলা আর মেয়েটাকে দেখেই মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। যবে থেকে আব্বু ওদের এই গ্ৰামের বাড়িতে এনেছে সাদাতের কিচ্ছু ভালো লাগে না। আব্বুও কেমন বদলে গেছে ওদের কত ভালবাসে। আর ঐ মহিলা আব্বুর সামনে এমন করে কথা বলে যেন সাদাতকে কত ভালোবাসে! সব নাটক। আম্মিকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো কি করে আব্বু?!


মেয়েটা সাদাতের থেকে অনেকটাই ছোট। খুব দাদা দাদা ডেকে ভাব জমাতে এসেছিল প্রথম প্রথম। সাদাত দু'বার ওর পুতুল ভেঙ্গে দিয়েছে। একবার ওর বই পিছনের পুকুরে ফেলে দিয়েছে। এখন আর আসে না মেয়েটা। তবে দূর থেকে সাদাতকে দেখে। 


পরীক্ষা কাল শেষ। হাতে অঢেল সময় । সাদাত ভেবে পায় না কি করে কাটাবে। আম্মি থাকতে ওরা এ সময় পাশের গ্ৰামে যেত। নানার কাছে। খুব মজা হত। আম্মি না থাকায় কতদিন সাদাত নানার কাছে যায়নি! মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। একটু পরেই সাইকেল নিয়ে সাদাত বাগানে খেলতে বেরিয়ে যায়। সাইকেল চালাতে চালাতেই ও দেখেছিল মেয়েটা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। অবাক হয়ে দেখছে ওকে। হঠাৎ বলে,''আমায় শিখিয়ে দিবি, দাদাভাই।''


মাথা নেড়ে না বলে চোদ্দ বছরের সাদাত। মেয়েটাও বায়না করতেই থাকে। হঠাৎ সাদাতের মাথায় একটা চিন্তা আসে। বলে,''আয়, শেখাবো। ''


হাততালি দিয়ে ওঠে সাহানা, ওর বহুদিনের শখ এমন একটা সাইকেলের। সাদাত ওকে সিটে বসিয়ে প‍্যাডেলে চাপ দিতে শেখায় ধীরে ধীরে। কয়েকবার চালিয়ে সাহানা বেশ মজা পেয়েছে। তখনো ব‍্যালেন্স আসেনি ওর। হঠাৎ সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে সাদাত পড়ে যায় ইচ্ছা করে । আর কিছুদূর গিয়ে ছিটকে পড়ে ছয় বছরের সাহানা। কাঁঁদতে থাকে, মালি কাকা, ড্রাইভার, দারোয়ান সবাই ছুটে আসে। সাহানাকে কোলে তুলে নেয়। সাদাতের গা-টা রাগে জ্বলতে থাকে। 


তবে আব্বুর হাত থেকে ঐ মেয়েটাই ওকে বাঁচিয়ে ছিল। সবাই যখন বলছিল সাদাত ওকে ফেলে দিয়েছে পুঁচকে মেয়েটা বলে ওঠে, ''দাদাভাই ইচ্ছে করে ফেলেনি। ও তো নিজেই পড়ে গেছিল।''


আজকাল সাদাত ওদের সাথে খায় না। ওদের হা হা, হি হি খুনসুটি, গল্প কিছুই ওর ভালো লাগে না। তবুও ঐ মহিলা রোজ ওকে ডাকতে আসে। কখনো মেয়েটা আসে। আব্বু বলেছিল ঐ মহিলাকে মামনী ডাকতে। বয়ে গেছে সাদাতের। ওটা ডাইনি। ওর আম্মির জায়গা নিতে চায় । ও কি বোঝে না!! ওদের সঙ্গে সাদাতদের কিছুই মেলে না। 


পরদিন আবার আব্বু গাড়ি বের করে সাদাতকে ডাকাডাকি করছিল। ওরা নাকি পাশের গ্ৰামে নানাকে দেখতে যাবে। ইচ্ছা না থাকলেও নানার নাম শুনে লাফিয়ে ওঠে ও। কতদিন নানার কাছে যায়নি ও!


সারা রাস্তা সাহানা একাই বকবক করে, সাদাত কথাই বলে না ওর সাথে। গ্ৰামে গিয়ে মেয়েটা একটা রঙীন প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে। নানাও ওদের পেয়ে সাদাতকে ভুলে গেছে যেন! ঐ মহিলাকে কি সাধে ডাইনি বলে সাদাত! ও জাদু জানে। নানাও ওকেই 'বেটি' 'বেটি' করে চলেছে। নিজের মেয়েকে কত সহজে ভুলে গেলো বুড়োটা!


সাদাত বাঁধের উপর উঠে এসেছিল। নিচে বরষায় ফুলে ওঠা গঙ্গা। ইচ্ছা করছিল এক লাফে ওখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আর বাড়ি ফিরবে না ও। ওকে খুঁজতে খুঁজতে ওখানে এসেছিল নানা। গোমড়া মুখে ওকে বসে থাকতে দেখে কোলে টেনে নিয়েছিল। তারপর ওকে বলেছিল এক রূপকথায় গল্প। 


ওর মা আর এই 'আলো' বলে মহিলা ছিল ছোট বেলার বান্ধবী। আর ওর আব্বু অলকেশ ছিল ওদের স্যার। দু জনেই ইংরেজি পড়ত ওঁর কাছে। নানা বলছিল,


''তুমি বড় হয়েছো নানুভাই। আজ তাই তোমায় খুলে বলতে সাহস পেলাম এসব। তোমার মা একদিন পড়ে ফেরার পথে এই বাঁধের ধারে কিছু লম্পট বদমাশের হাতে পড়েছিল। অত‍্যাচার করে তোমার মাকে এখানেই ফেলে রেখে গেছিল ওরা। অনেক থানা পুলিশ ডাক্তার হাসপাতাল করে মেয়েকে যখন ফিরে পেলাম সে এক অন‍্য মানুষ। আমার হাসিখুশি মেয়েটা হারিয়ে গেছিল, জিন্দা লাশের মত মেয়েটা তাকিয়ে থাকত। আলো আর অলকেশ অনেক চেষ্টা করে ওকে স্বাভাবিক করার। কিন্তু সমাজ আমাদের এক ঘরে করেছিল। আমাদের বাড়ির ঐতিহ‍্য সম্মান সব মাটিতে মিশে গেছিল। আর তখনই আলো অলকেশের সাথে জোড় করে আমিনার বিয়ে দেয়। ওদের অন‍্য গ্ৰামে পাঠিয়ে দেয়। অলকেশ সেই গ্ৰামেই সরকারী চাকরী করত। সে সময় সবাই জানত ওর সাথে আলোর বিয়ে হবে। আলো নিজের বন্ধুর কথা ভেবে সেদিন জোর করে অলকেশকে রাজি করায় আর ওদের বিয়ে দেয়‌। বিয়ের পর অলকেশ আমিনাকে কখনো ধর্ম বদলাতে বলেনি। ওর সংস্কারে আঘাত করেনি। এসব সমাজ মেনে নেয়নি। এই জন‍্য সমাজ ওদের এক ঘরে করেছিল। অলকেশের সরকারী উচ্চপদস্থ চাকরীর জন‍্য ও কাউকে পরোয়া করত না। আমিনার কোনো অযত্ন ও করেনি। আলো এরপর মামা বাড়ি চলে গেছিল কলেজে পড়তে। ওদের যোগাযোগ ছিল না তেমন। 


আমিনা ভালো হয়ে গিয়েছিল ধীরে ধীরে। এরপর তুমি আসায় ওরা সব দুঃখ ভুলেছিল। এই গ্ৰামে এলেই আমিনা আলোর খোঁজ করত। কিন্তু আলো কখনো আর ফেরেনি। তারপর শুনেছিলাম ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ওদিকেই। 


আমিনার ছিল পোড়া কপাল। রাজরোগ যখন ধরা পড়ল সব আশা শেষ। ও তখন অল্প দিনের মেহমান। অলকেশকে ও বলেছিল আলোকে একবার খুঁজে আনতে। ও একবার দেখতে চায় বন্ধুকে। 


এবার আলোর বাবা সব শুনে ওর ঠিকানা দিয়েছিল। পোড়া কপাল ছিল ঐ বেটিরও। বিয়ের বছর ঘুরতেই বিধবা হয়েছিল। কোলে মেয়ে নিয়ে মামা বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে দিন কাটছিল ওর। আমিনা নিজে অলকেশ আর ওর বিয়ে দিতে বলেছিল আমায়। কথা আদায় করেছিল ওদের থেকে। তুমি ছোট, হাসপাতালে কি হয়েছে তুমি জানো না। তবে আমিনার ইচ্ছায় সব হয়েছিল।''


চোখ মোছে বৃদ্ধ। বলে,

''ঐ মেয়েটার জন‍্য আমার মেয়ে এত বছর সুখে ছিল। এখন তুমি অবুঝ হলে তোমার আম্মি কত দুঃখ পাবে বলো তো!!''


নানার সাথে বাড়ি ফিরে আসে সাদাত। সাহানা ভেজা চোখে ছুটে আসে। দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে,

''কোথায় চলে গিয়েছিলিস তুই? আমার বুঝি ভয় করে না?''

এই প্রথম ছোট বোনটাকে বুকে টেনে নেয় সাদাত। বলে, ''আর কোথাও যাব না। সব সময় তোর সাথে থাকবো বুনু।''


আলো একটা থালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে কি সব সাজিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। হাত ধরে টেনে সাদাতকে বারান্দার একটা চেয়ারে বসায় সাহানা। মায়ের হাত থেকে থালাটা টেনে ওর কপালে তিলক এঁকে দেয়। হাতে বেঁধে দেয় একটুকরো ভালোবাসা, রাখী। আরতী করতে করতে বলে,

''পূর্ণিমা লেগে গেছে, রাখী পড়ালাম তো। এবার আমায় কি দিবি দে ?'' 


আকাশের এক কোনে পূর্ণিমার গোল থালার মত চাঁদ উঠেছিল তখনি। 


সাদাত বলে,

''কথা দিচ্ছি, সারা জীবন এভাবেই ভালোবাসবো তোকে। সব বিপদ থেকে রক্ষা করবো। ''


অলকেশ আর আলো বহুদিন পর ভাই বোনের মিষ্টি খুনসুটি দেখে হেসে ওঠে‌। চোখ মোছে মেয়ে-হারা হতভাগ‍্য বৃদ্ধ। চাঁদের বাধ ভাঙা রুপালী আলোয় সেজে উঠেছে তখন চারদিক। 

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama