নন্দা মুখার্জী

Drama Tragedy

3  

নন্দা মুখার্জী

Drama Tragedy

অনন্যা

অনন্যা

1 min
295


 


  --- বিয়েটাই কি জীবনের শেষ কথা মা ? কত মেয়ের তো বিয়ে হয়না শুধু মেয়ে বলছি কেন কত ছেলে ভালো ভালো চাকরি করে তারাও বিয়ে করেনা --- কেন উঠেপড়ে লেগেছো বাড়ি থেকে আমায় তাড়ানোর জন্য ? কতবার বলেছি আমি চাকরি না পেয়ে বিয়ে করবোনা | বাবারও তাতে মত আছে | সেই আদ্যিকালের মনোভাব নিয়ে বসে আছো | পুরনো ধ্যানধারণাগুলো এখন ত্যাগ করো মা |


--- মেয়ে হয়ে জন্মেছিস পরের ঘরে তো যেতেই হবে মা |

--- জন্মের সময় কি মেয়েরা কোর্ট পেপার পরে সাইন করে আসে বিয়ে করতে তারা বাধ্য ? বিয়ে মানেই তো পরের বাড়ি গিয়ে উদয়স্ত পরিশ্রম করা , অথচ কারো মন না পাওয়া | তারপর একটা কি দুটি ছেলেমেয়ে - ব্যস জীবনের সব স্বাদ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তাদের মানুষ করতে লেগে পরো | আর সারাজীবন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকো | ওই জীবন আমি চাইনা | আমাকে আমার মত নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময় দাও | ভাগ্য বলেও তো একটা কথা আছে | কপালে কি লেখা আছে তাতো জানিনা | তখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো ?


--- কিসব অলক্ষুণে কথাবার্তা | মুখে কিছুই আটকায়না |

--- সত্যি কথা শুনলে তো অলুক্ষণে কথা মনেই হবে মা ---|

    দুদিন ছাড়া ছাড়া মা মেয়ের এই ঝগড়া শুনতে শুনতে অবিনাশবাবুও হাঁফিয়ে উঠেছেন | তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে একদিন বলে দিলেন ,

--- অনুর সাথে আমি এক মত | আগে ওর লেখাপড়া শেষ হোক | তারপর কিছু একটা চাকরিবাকরি জোগাড় করুক | তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে | যুগ পাল্টেছে | এভাবে যদি তুমি ওর পিছনে বিয়ের জন্য দিনরাত লেগে থাকো তাতে ওর মন খারাপ থাকবে , পড়াশুনায় মন বসাতে পারবেনা |

রাস্তাঘাটে অন্যমনস্ক থেকে যাতায়াত করবে , ভগবান না করুন কোন অঘটনও তো ঘটতে পারে ?


--- তোমারও দেখছি মেয়ের মত কিছুই মুখে আটকায়না | আজ প্রতিজ্ঞা করলাম তোমার মেয়ের ব্যাপারে আমি আর কোনদিন কিছু বলবোনা | থাক সারাজীবন আইবুড়ো বাপসোহাগী হয়ে | 


 অবিনাশ মিত্রর  একমাত্র মেয়ে অনন্যা | রূপ তার আহামরি না হলেও গুনে সে সত্যিই অনন্যা , পড়াশুনায় তুখোড় না হলেও ভীষণ অধ্যবসায়ী | স্বপ্ন দেখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর | বাবা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করলেও মাইনে তার খুব একটা কম নয় | কতদিন আর চাকরি করবেন বড়জোর ষাট বছর | পেনশন তো কিছু নেই | মা বাবা দুজনেরই বয়স হচ্ছে | ওষুধপত্র ডাক্তার এসব লেগেই আছে | এখন কোন অসুবিধা হয়না ঠিকই কিন্তু বাবা রিটায়ার করার পর ? তখন কি হবে ? তাই এই মুহূর্তে বিয়েতে সে কিছুতেই রাজি হবেনা | নিজের সুখের জন্য বাবা মাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে সে কিছুতেই যাবেনা | 

     ভূগোলে মাস্টার্স করে অনন্যাকে ছমাসও বসে থাকতে হয়নি |


শুধু তাই নয় ফাইনাল পরীক্ষার অনেক আগে থেকেই সে বাড়িতে কচিনসেন্টার খুলে বেশ কয়েক হাজার টাকা রোজগার করতে শুরু করেছিল | মা পুণরায় ক্ষেপে উঠলেন মেয়ের বিয়ের জন্য | গড়িমসি করেও অনন্যা এবার বিয়েতে মত দিলো | পাত্রপক্ষের সামনে গিয়েও বসলো | ছেলে স্কুল টিচার আর অনন্যা প্রফেসর | এ কথা সে কথার পর প্লেট ভর্তি মিষ্টি খেয়ে ছেলের মা জানতে চাইলেন ,

--- তা মা টিউশনি প্রফেসারি এসব মিলে মাস গেলে তোমার হাতে কত আসে ?

 অনন্যা চোখ বড় বড় করে বললো ,

--- আমি কত টাকা রোজগার করি সেটা জেনেই কি বিয়ের জন্য এগোবেন ?


--- ওমা একি কথা ? কত রোজগার করো সেটা জানবোনা ? আমার ছেলে মাস মাইনের পুরো টাকাটাই তো আমার হাতে তুলে দেয় --- তোমাকেও--

 অনন্যা দাঁড়িয়ে পরে বুকের কাছে হাতদুটি জড়ো করে বলে ,


 --- ক্ষমা করবেন | লেখাপড়া আমার বাবা মা শিখিয়েছেন | তারাই কোনদিন জানতে চাননি আমি কত মাইনে পাই বা টিউশনি মিলে মাস গেলে কত হাতে আসে | আর নিজে পরিশ্রম করে রোজগার করবো তা যদি কারো হাতে দিতেই হয় সেটা আমার বাবা মায়ের হাতে দেবো ---

আপনারা এখন আসতে পারেন আর হ্যা যাবার আগে প্লেটের বাকি মিষ্টগুলিও শেষ করে যাবেন | তানাহলে তো ওগুলো ফেলে দিতে হবে |

বাবার যে অনেক পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করতে হয় | বয়স হয়েছে মানুষটার --| 


 গটগট করে অনন্যা ভিতরের ঘরে চলে এলো | অবিনাশবাবু তখন গোঁফের আড়ালে মিটিমিটি হাসছেন | আর তার স্ত্রী মেয়ের উপর রাগে টগবগ করে ফুঁটছেন | 

--- এই খোকা , এখনো কি বসে রয়েছিস ? ওঠ এ দজ্জাল মেয়ে  আমার ঘরের লক্ষ্মী হতে পারেনা  |


 অবিনাশবাবু এতক্ষণে মুখ খোলেন ,

-- আপনি চাইলেও আপনার ঘরে আমি মেয়েকে পাঠাবোনা | 


 এরপরে অনন্যার মা তার স্বামীর কাছে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ঘ্যানঘ্যান করলেও তার অনুকে আর বিয়ের কথা বলতে সাহস পাননি | বছর দুয়েকের মধ্যে কলিগ রিপন রায়ের সাথে অনন্যার একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে | সে নিজেই মা বাবাকে সে কথা জানায় | তারা খুশি হন এবং কিছুদিনের মধ্যেই চার হাত এক করে দেন | রিপন মধ্যবিত্ত পরিবারের বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান | বাবা সরকারি কেরানি ছিলেন | রিপনের মাইনের টাকা সংসার চালাতে তার দরকার হয়না | রিপন তার ইচ্ছামত খরচ করে | তবে সেগুলো অবশ্যই প্রয়োজনে | যথারীতি অনন্যার চাকরি বা মাইনে নিয়েও তার শ্বাশুড়ীর কোন মাথা ব্যথা নেই | অনন্যা তার মাইনের অর্ধেক টাকা মায়ের একাউন্টে ফেলে দেয় প্রতিমাসে | খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া তিনি সে টাকা তোলেননা | অবিনাশবাবু এখন রিটায়ার করেছেন | জমানো টাকার উপরে সুদ তুলেই এখন তাদের চলে | কলেজে বেরোনোর আগে যেটুকু সময় অনন্যা পায় রান্নাটা করে রেখে বেরোনোর চেষ্টা করে | রিপনের মা খুবই ভালো মানুষ | তিনি কোন ব্যাপারেই তার মতামত অনন্যার উপরে চাপিয়ে দেননা | খুবই ভালো সম্পর্ক শ্বাশুড়ি বৌয়ের |

কলেজ থেকে ফেরার পথে টুকটাক বাজার স্বামী স্ত্রী মিলে করে নিয়ে আসে | প্রায় বছর দেড়েক পরে অনন্যা নূতন অতিথি আগমনের খবর দেয় | ব্যস তার শ্বাশুড়ি তাকে রান্নাঘরে ঢোকা বন্ধ করে দেন | কোন কাজই তাকে আর করতে দেননা | আর সর্বক্ষণ ছেলেকে বলে যান ," সারাদিনই তো ওর সাথে সাথে থাকিস ওর যেন কোন অসুবিধা না হয় খেয়াল রাখিস |" বাসে ট্রামে উঠা ডাক্তারের পরামর্শ মত আপাতত বন্ধ | ট্যাক্সি বা উবের করে নিত্য যাতায়াত | নমাসের পড়ার পর অনন্যা ছুটি নেয় | যথাসময়ে সে হাসপাতাল ভর্তি হয় |

কিন্তু বিধাতা যে তার কপালে এতো সুখ লেখেননি তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি | ছেলে হওয়ার আনন্দে হাসপাতাল থেকে রাতে বাইক করে ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে রিপন সারাজীবনের মত অনন্যাকে ছেড়ে চলে যায় | খবর শুনেই রিপনের মা বিছানা নেন | পরদিন এক আত্মীয় মারফত এ খবর অনন্যার কাছে পৌঁছায় | 

 একদিকে অসুস্থ্য শ্বাশুড়ি অন্যদিকে সদ্যজাত শিশুপুত্র আর রিপনকে হারানোর বুকফাঁটা আর্তনাদ -- কিন্তু অনন্যা ভেঙ্গে পড়েনি | শ্বাশুড়ীকে সুস্থ্য করতে হবে আর ছেলেকে মানুষ করতে হবে , নিজের চাকরিটাকে বাঁচাতে হবে -- এই চিন্তা থেকেই তার ভিতর এক অদম্য মানসিক বল কাজ করতে থাকে | সর্বকাজে সাহায্যের জন্য ভদ্রপরিবারের  একটি মেয়েকেও সে রেখেছে | মা কিছুদিন এসে তার কাছে ছিলেন কিন্তু বাবা একা থাকার কারণে তাকেও ফিরে যেতে হয়েছে | তিনি মেয়েকে বাড়ি যাওয়ার কথা বলেননি | কারণ তিনি জানতেন কোন অবস্থাতেই তার মেয়ে এতে রাজি হবেনা | একরোখা , জেদি মেয়েটি তার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে একচুলও সরবে না | আস্তে আস্তে রিপনের মা স্বাভাবিক হতে শুরু করেন | এমনিতেই তিনি একটু কম কথা বলেন আর এখন যেন আরও কম | তিনি তার নাতিটিকেই নিয়ে থাকেন | 

 অনেকগুলো বছর কেটে গেছে | অনন্যার ছেলে ঋতম এখন ডাক্তার | বিয়ে করেছে | বাবা , মা , শ্বাশুড়ি মা এক এক করে সবাই তাকে ছেড়ে গেছে | সে নিজেও রিটায়ার করেছে | যুক্ত হয়েছে একটি এনজিও সংস্থার সাথে শুধুমাত্র একাকিত্ব কাটানোর জন্য | মনেমনে ভাবে সেদিন মায়ের বিপক্ষে গিয়ে 'চাকরি করে বিয়ে করবো' --- জিদটা না ধরলে তার জীবনের কিযে পরিণতি হত তা ভাবলে নিজেই আজ আঁতকে ওঠে  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama